চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম (ঐতিহাসিক নাম: পোর্টো গ্র্যান্ডে এবং ইসলামাবাদ) বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। বন্দরনগরী নামে পরিচিত এই শহরটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত। বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত পাহাড়, সমুদ্রে এবং উপত্যকায় ঘেরা চট্টগ্রাম শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে প্রাচ্যের রাণী হিসেবে বিখ্যাত। ২০১৭ সালে শহরের জনসংখ্যা ছিল ১৫ লক্ষের বেশি। ২০২২ সালের জনসুমারি অনুযায়ী চট্টগ্রাম শহর ও চট্টগ্রাম শহরের আশেপাশের উপ শহরের মোট জনসংখ্যা ২০ লক্ষ ( প্রায় )

চট্টগ্রাম
সিটাং
মহানগরী
ডাকনাম: জ্বালনধারা, চাটিগাঁও, চাটগাঁ, ইসলামাবাদ, চট্টলা[1] বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী
চট্টগ্রাম বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম বিভাগ-এ অবস্থিত
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম
বাংলাদেশের চট্টগ্রামের অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২২°২০′০৬″ উত্তর ৯১°৪৯′৫৭″ পূর্ব
দেশ বাংলাদেশ
বিভাগচট্টগ্রাম বিভাগ
জেলাচট্টগ্রাম জেলা
প্রতিষ্ঠা১৩৪০[2]
শহরের মর্যাদা প্রাপ্তি১৮৬৩[3]
সরকার
  ধরনমেয়র - কাউন্সিলর
  শাসকচট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন
  মেয়রএম. রেজাউল করিম চৌধুরী
  পুলিশ কমিশনারকৃষ্ণ পদ রায়, বিপিএম, পিপিএম
আয়তন[4]
  মহানগরী১৫৫ বর্গকিমি (৬০ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা (২০২২)[5]
  মহানগরী৮৭,২০,০০০/
  জনঘনত্ব১৭/বর্গকিমি (৪০/বর্গমাইল)
  মহানগর২৩,০৯,৪২৩
  ভাষাবাংলা চাটগাঁইয়া
বিশেষণচাঁটগাঁইয়া, চাটগাঁমী, চাঁডি, চাড়িগ্রাই
সময় অঞ্চলবিএসটি (ইউটিসি+৬)
ডাক কোড৪০০০
জিডিপি (২০২০)$ ১১৬ বিলিয়ন ডলার[6]
কলিং কোড৩১
ওয়েবসাইটচট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন

ঢাকার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ শহর হচ্ছে চট্টগ্রাম। এখানে দেশের সর্ববৃহৎ বন্দর ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে কর্ণফুলী নদীর তীরে এই শহরটি অবস্থিত।[6]

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চট্টগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চট্টগ্রাম বন্দর, বিশ্বের প্রাচীনতম বন্দরগুলির মধ্যে একটি, যার উপকূল টলেমির বিশ্ব মানচিত্রে আবির্ভূত হয়েছে, এটি দেশের প্রধান সামুদ্রিক প্রবেশদ্বার। বন্দরটি বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর এবং দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় ব্যস্ততম বন্দর।

ব্যুৎপত্তি

চট্টগ্রামের ব্যুৎপত্তি অনিশ্চিত।[7] একটি ব্যাখ্যার কৃতিত্ব প্রথম আরব ব্যবসায়ীদের শাত (ব-দ্বীপ) ও গঙ্গা (গঙ্গা) আরবি শব্দসমূহের সমন্বয়ের জন্য।[7][8][9]

ইতিহাস

চট্টগ্রামের স্কাইলাইন

সীতাকুণ্ড এলাকায় পাওয়া প্রস্তরীভূত অস্ত্র এবং বিভিন্ন মানবসৃষ্ট প্রস্তর খণ্ড থেকে ধারণা করা হয় যে, এ অঞ্চলে নব্যপ্রস্তর যুগে অস্ট্রো-এশীয়াটিক জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। তবে, অচিরে মঙ্গোলদের দ্বারা তারা বিতাড়িত হয়।[10] লিখিত ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম উল্লেখ গ্রিক ভৌগোলিক প্লিনির লিখিত পেরিপ্লাস। সেখানে ক্রিস নামে যে স্থানের বর্ণনা রয়েছে ঐতিহাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে সেটি বর্তমানের সন্দ্বীপ। ঐতিহাসিক ল্যাসেনের ধারণা সেখানে উল্লিখিত পেন্টাপোলিশ আসলে চট্টগ্রামেরই আদিনাম। মৌর্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত নয় তবে পূর্ব নোয়াখালির শিলুয়াতে মৌর্য যুগের ব্রাহ্মী লিপিতে একটি মূর্তির পাদলিপি পাওয়া গেছে।

তিব্বতের বৌদ্ধ ঐতিহাসিক লামা তারানাথের একটি গ্রন্থে চন্দ্রবংশের শাসনামলের কথা দেখা যায় যার রাজধানী ছিল চট্টগ্রাম। এর উল্লেখ আরাকানের সিথাং মন্দিরের শিলালিপিতেও আছে। তারানাথের গ্রন্থে দশম শতকে গোপীনাথ চন্দ্র নামের রাজার কথা রয়েছে।[11]। সে সময় আরব বণিকদের চট্টগ্রামে আগমন ঘটে। আরব ভূগোলবিদদের বর্ণনার ‘সমুন্দর’ নামের বন্দরটি যে আসলে চট্টগ্রাম বন্দর তা নিয়ে এখন ঐতিহাসিকরা মোটামুটি নিশ্চিত।[10] সে সময় পালবংশের রাজা ছিলেন ধর্মপাল। পাল বংশের পর এ অঞ্চলে একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সৃষ্টি হয়।

৯৫৩ সালে আরাকানের চন্দ্রবংশীয় রাজা সু-লা‌-তাইং-সন্দয়া চট্টগ্রাম অভিযানে আসলেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি বেশি দূর অগ্রসর না হয়ে একটি স্তম্ভ তৈরি করেন। এটির গায়ে লেখা হয় ‘চেৎ-ত-গৌঙ্গ’ যার অর্থ ‘যুদ্ধ করা অনুচিৎ’। সে থেকে এ এলাকাটি চৈত্তগৌং হয়ে যায় বলে লেখা হয়েছে আরাকানি পুঁথি ‘রাজাওয়াং’-এ। এ চৈত্তগৌং থেকে কালক্রমে চাটিগ্রাম, চাটগাঁ, চট্টগ্রাম, চিটাগাং ইত্যাদি বানানের চল হয়েছে।[10]

চন্দ্রবংশের পর লালবংশ এবং এরপর কয়েকজন রাজার কথা কিছু ঐতিহাসিক উল্লেখ করলেও ঐতিহাসিক শিহাবুদ্দিন তালিশের মতে ১৩৩৮ সালে সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের‌ চট্টগ্রাম বিজয়ের আগ পর্যন্ত ইতিহাস অস্পষ্ট। এ বিজয়ের ফলে চট্টগ্রাম স্বাধীন সোনারগাঁও রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সে সময়ে প্রায় ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম আসেন বিখ্যাত মুর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা। তিনি লিখেছেন - “বাংলাদেশের যে শহরে আমরা প্রবেশ করলাম তা হল সোদকাওয়াঙ (চট্টগ্রাম)। এটি মহাসমুদ্রের তীরে অবস্থিত একটি বিরাট শহর, এরই কাছে গঙ্গা নদী- যেখানে হিন্দুরা তীর্থ করেন এবং যমুনা নদী একসঙ্গে মিলেছে এবং সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে তারা সমুদ্রে পড়েছে। গঙ্গা নদীর তীরে অসংখ্য জাহাজ ছিল, সেইগুলি দিয়ে তারা লখনৌতির লোকেদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ...আমি সোদওয়াঙ ত্যাগ করে কামরু (কামরূপ) পর্বতমালার দিকে রওনা হলাম।”

১৩৫২‌-১৩৫৩ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহকে হত্যা করে বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার মসনদ দখল করলে চট্টগ্রামও তার করতলগত হয়। তার সময়ে চট্টগ্রাম বাংলার প্রধান বন্দর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর হিন্দুরাজা গণেশ ও তার বংশধররা চট্টগ্রাম শাসন করেন। এরপরে বাংলায় হাবশি বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৪৯২ সালে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলার সুলতান হন। চট্টগ্রামের দখল নিয়ে তাকে ১৪১৩-১৪১৭ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরার রাজা ধনমানিকের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত রাজা ধনমানিকের মৃত্যুর পর হোসেন শাহের রাজত্ব উত্তর আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তার সময়ে উত্তর চট্টগ্রামের নায়েব পরবগল খানের পুত্র ছুটি খানের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীকর নন্দী মহাভারতের একটি পর্বের বঙ্গানুবাদ করেন।

পর্তুগিজদের আগমন ও বন্দরের কর্তৃত্ব লাভ

১৫১৭ সাল থেকে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে আসতে শুরু করে। বাণিজ্যের চেয়ে তাদের মধ্যে জলদস্যুতার বিষয়টি প্রবল ছিল। বাংলার সুলতান প্রবলভাবে তাদের দমনের চেষ্টা করেন। কিন্তু এ সময় আফগান শাসক শের শাহ বাংলা আক্রমণ করবেন শুনে ভীত হয়ে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ পর্তুগিজদের সহায়তা কামনা করেন। তখন সামরিক সহায়তার বিনিময়ে ১৫৩৭ সালে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। একই সঙ্গে তাদেরকে বন্দর এলাকার শুল্ক আদায়ের অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ১৫৩৮ সালে শের শাহের সেনাপতি চট্টগ্রাম দখল করেন। তবে ১৫৮০ সাল পর্যন্ত আফগান শাসনামলে সবসময় ত্রিপুরা আর আরাকানিদের সঙ্গে যুদ্ধ চলেছে।

আরাকানি শাসন

১৮২০এর দশকে জাহাজ নোঙ্গর করছে চট্টগ্রাম বন্দরে

১৫৮১ সাল থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে আরাকানের রাজাদের অধীনে শাসিত হয়। তবে পর্তুগিজ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য এ সময় খুবই বৃদ্ধি পায়। বাধ্য হয়ে আরাকান রাজা ১৬০৩ ও ১৬০৭ সালে শক্ত হাতে পর্তুগিজদের দমন করেন। ১৬০৭ সালেই ফরাসি পরিব্রাজক ডি লাভাল চট্টগ্রাম সফর করেন। তবে সে সময় পর্তুগিজ জলদস্যু গঞ্জালেস সন্দ্বীপ দখল করে রেখেছিলেন। পর্তুগিজ মিশনারি পাদ্রি ম্যানরিক ১৬৩০-১৬৩৪ সময়কালে চট্টগ্রামে উপস্থিতকালে চট্টগ্রাম শাসক আলামেনের প্রশংসা করে যান। ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম মুঘলদের হস্তগত হয়।

চট্টগ্রামে আরাকানি শাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম আরাকানিদের কাছ থেকে অনেক কিছুই গ্রহণ করে। জমির পরিমাণে মঘী কানির ব্যবহার এখনো চট্টগ্রামে রয়েছে। মঘী সনের ব্যবহারও দীর্ঘদিন প্রচলিত ছিল। সে সময়ে আরাকানে মুসলিম জনবসতি বাড়ে। আরকান রাজসভায় মহাকবি আলাওল, দৌলত কাজী এবং কোরেশী মাগণ ঠাকুর এর মতো বাংলা কবিদের সাধনা আর পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি হয়। পদ্মাবতী আলাওলের অন্যতম কাব্য।

মুঘল শাসনামল

১৬৬৬ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানকে চট্টগ্রাম দখলের নির্দেশ দেন। সুবেদারের পুত্র উমেদ খানের নেতৃত্বে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় আরাকানিদের পরাজিত করেন এবং আরাকানি দুর্গ দখল করেন। যথারীতি পর্তুগিজরা আরাকানিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মুঘলদের পক্ষ নেয়। মুঘল সেনাপতি উমেদ খান চট্টগ্রামের প্রথম ফৌজদারের দায়িত্ব পান। শুরু হয় চট্টগ্রামে মুঘল শাসন। তবে মুঘলদের শাসনামলের পুরোটা সময় আরাকানিরা চট্টগ্রাম অধিকারের চেষ্টা চালায়। টমাস প্রাট নামে এক ইংরেজ আরাকানিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মুঘলদের পরাজিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কোলকাতার গোড়াপত্তনকারী ইংরেজ জব চার্নকও ১৬৮৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দখলের ব্যর্থ অভিযান চালান। ১৬৮৮ সালে ক্যাপ্টেন হিথেরও অনুরূপ অভিযান সফল হয় নি। ১৬৭০ ও ১৭১০ সালে আরাকানিরা চট্টগ্রামের সীমান্তে ব্যর্থ হয়।

নবাবি শাসনামল

১৭২৫ সালে প্রায় ৩০ হাজার মগ সৈন্য চট্টগ্রামে ঢুকে পড়ে চট্টগ্রামবাসীকে বিপদাপন্ন করে তোলে। তবে শেষ পর্যন্ত বাংলার নবাব তাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। এই সময় বাংলার নবাবদের কারণে ইংরেজরা চট্টগ্রাম বন্দর কোনভাবেই দখল করতে পারেনি। বাংলার নবাবরা পার্বত্য এলাকার অধিবাসীদের সঙ্গে, বিশেষ করে চাকমা সম্প্রদায়ের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে সদ্ভাব বজায় রাখেন।

পলাশীর যুদ্ধ ও ইংরেজদের কাছে চট্টগ্রাম হস্তান্তর

১৯৪৪ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর নাবিক

পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ইংরেজরা চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নবাব মীর জাফরের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তবে, মীর জাফর কোনভাবেই ইংরেজদের চট্টগ্রাম বন্দরের কর্তৃত্ব দিতে রাজি হন নি। ফলে, ইংরেজরা তাকে সরিয়ে মীর কাশিমকে বাংলার নবাব বানানোর ষড়যন্ত্র করে। ১৭৬১ সালে মীর জাফরকে অপসারণ করে মীর কাশিম বাংলার নবাব হয়ে ইংরেজদের বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম হস্তান্তরিত করেন। চট্টগ্রামের শেষ ফৌজদার রেজা খান সরকারিভাবে চট্টগ্রামের শাসন প্রথম ইংরেজ চিফ ভেরেলস্ট-এর হাতে সমর্পণ করেন। শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন।

কোম্পানির শাসনামলে চট্টগ্রামবাসীর ওপর করারোপ দিনে দিনে বাড়তে থাকে। তবে ১৮৫৭ সালের আগে চাকমাদের বিদ্রোহ আর সন্দ্বীপের জমিদার আবু তোরাপের বিদ্রোহ ছাড়া ইংরেজ কোম্পানিকে তেমন একটা কঠিন সময় পার করতে হয়নি। সন্দ্বীপের জমিদার আবু তোরাপ কৃষকদের সংগঠিত করে ইংরেজদের প্রতিরোধ করেন। কিন্তু ১৭৭৬ সালে হরিষপুরের যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হলে সন্দ্বীপের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। অন্যদিকে ১৭৭৬ থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত চাকমারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সম্মুখ সমরে চাকমাদের কাবু করতে না পেরে ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে কঠিন অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে শেষ পর্যন্ত চাকমাদের কাবু করে।

ইংরেজরা আন্দরকিল্লা জামে মসজিদকে গোলাবারুদের গুদামে পরিণত করলে চট্টগ্রামবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মসজিদের জন্য নবাবি আমলে প্রদত্ত লাখেরাজ জমি ১৮৩৮ সালের জরিপের সময় বাজেয়াপ্ত করা হয়। পরে চট্টগ্রামের জমিদার খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খান কলিকাতায় গিয়ে গভর্নরের কাছে আবেদন করে এটি উদ্ধার করার ব্যবস্থা করেন।

সিপাহি বিপ্লবে চট্টগ্রাম

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের সময় পুরো ভারতবর্ষের বিদ্রোহের ঢেউ চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। ৩৪তম বেঙ্গল পদাতিক রেজিমেন্টের ২য়, ৩য় ও ৪র্থ কোম্পানীগুলি তখন চট্টগ্রামে মোতায়েন ছিল। ১৮ নভেম্বর রাতে উল্লিখিত তিনটি কোম্পানী হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।[12] তারা ব্রিটিশ জেলখানায় আক্রমণ করে সকল বন্দীকে মুক্ত করে। সিপাহী জামাল খান ছিলেন রজব আলীর অন্যতম সহযোগী।[13] সিপাহিরা ৩টি সরকারি হাতি, গোলাবারুদ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্ন রসদ নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। তারা পার্বত্য ত্রিপুরার সীমান্ত পথ ধরে এগিয়ে সিলেট ও কাছাড়ে পৌঁছে। স্বাধীনতাকামী হিসেবে ত্রিপুরা রাজের সমর্থন কামনা করেন কিন্তু ত্রিপুরা রাজ ইংরেজদের হয়ে তাদের বাঁধা দেন। একই অবস্থা হয় আরো বিভিন্ন যায়গায়। এভাবে বিভিন্ন স্থানে লড়াই করতে গিয়ে একসময় রসদের অভাবে বিদ্রোহীরা শক্তিহীন হয়ে পড়ে। শেষে ১৮৫৮ সালের ৯ জানুয়ারি সিলেটের মনিপুরে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে এক লড়াই-এই বিদ্রোহের অবসান হয়।

ভূগোল

বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বে ২০°৩৫’ থেকে ২২°৫৯’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°২৭’থেকে ৯২°২২’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ বরাবর এর অবস্থান। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপকূলীয় পাদদেশকে বিস্তৃত করে। কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহর সহ ব্যবসায় জেলা দক্ষিণ তীর ধরে বয়ে চলেছে। নদীটি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে এবং ১২ কিলোমিটার মোহনা পর্যন্ত চট্টগ্রাম মুল শহর বিস্তুৃত। সীতাকুন্ড পাহাড় চট্টগ্রাম জেলার সর্বোচ্চ শিখর, যার উচ্চতা ৩৫১ মিটার (১,১৫২ ফুট)।[14] বাটালি পাহাড় শহরের মধ্যকার সর্বোচ্চ স্থান, যার উচ্চতা ৮৫.৩ মিটার (২৮০ ফুট। চট্টগ্রামে অনেকগুলি হ্রদ রয়েছে যা মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছিল। ১৯২৪ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং দল ফয়েস হ্রদটি খনন করেছিল।[14] চট্টগ্রামের উত্তরে সিলেট বিভাগ এবং ভারতের ত্রিপুরামিজোরাম রাজ্য এবং মেঘনা নদী, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্য, ত্রিপুরামায়ানমার এবং পশ্চিমে মেঘনা নদী, ঢাকাবরিশাল বিভাগ। এছাড়াও চট্টগ্রামের পূর্বে পার্বত্য জেলাসমূহ এবং দক্ষিণে কক্সবাজার জেলা রয়েছে। চট্টগ্রাম শহর উত্তরে ফৌজদারহাট, দক্ষিণে কালুরঘাট এবং পূর্বে হাটহাজারী পর্যন্ত বিস্তৃত।

আবহাওয়া এবং জলবায়ু

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত চট্টগ্রামেও ছয় ঋতু দেখা যায়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এ অঞ্চলে শীতকাল, মার্চ, এপ্রিল, মে-তে গ্রীষ্মকাল দেখা যায়। জুন, জুলাই, আগস্ট পর্যন্ত বর্ষাকাল। তবে ইদানীং আবহাওয়ার কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়।[15]

কোপেন জলবায়ু শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী চট্টগ্রামে ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু (অ্যাম) বিদ্যমান।[16]

১৯৯১ প্রানঘাতী ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের ১৩৮০০০ জন নিহত এবং ১০ মিলিয়নের বেশি গৃহহীন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে।[17]

মাস জানু ফেব্রু মার্চ এপ্রিল মে জুন জুলাই আগস্ট সেপ্টে অক্টো নভে ডিসে বছর
সর্বোচ্চ রেকর্ড °সে (°ফা) ৩১.৭
(৮৯.১)
৩৩.৯
(৯৩.০)
৩৭.২
(৯৯.০)
৩৮.৯
(১০২.০)
৩৬.৭
(৯৮.১)
৩৬.৭
(৯৮.১)
৩৪.৪
(৯৩.৯)
৩৩.৯
(৯৩.০)
৩৫.০
(৯৫.০)
৩৪.৪
(৯৩.৯)
৩৪.৯
(৯৪.৮)
৩১.১
(৮৮.০)
৩৮.৯
(১০২.০)
সর্বোচ্চ গড় °সে (°ফা) ২৬.০
(৭৮.৮)
২৮.৩
(৮২.৯)
৩০.৮
(৮৭.৪)
৩১.৯
(৮৯.৪)
৩২.৪
(৯০.৩)
৩১.৭
(৮৯.১)
৩১.০
(৮৭.৮)
৩১.৪
(৮৮.৫)
৩১.৮
(৮৯.২)
৩১.৭
(৮৯.১)
৩০.০
(৮৬.০)
২৭.২
(৮১.০)
৩০.৪
(৮৬.৭)
দৈনিক গড় °সে (°ফা) ১৯.৮
(৬৭.৬)
২২.৩
(৭২.১)
২৫.৭
(৭৮.৩)
২৭.৯
(৮২.২)
২৮.৬
(৮৩.৫)
২৮.৪
(৮৩.১)
২৭.৯
(৮২.২)
২৮.১
(৮২.৬)
২৮.৩
(৮২.৯)
২৭.৭
(৮১.৯)
২৪.৯
(৭৬.৮)
২১.২
(৭০.২)
২৫.৯
(৭৮.৬)
সর্বনিম্ন গড় °সে (°ফা) ১৪.০
(৫৭.২)
১৬.৩
(৬১.৩)
২০.৫
(৬৮.৯)
২৩.৬
(৭৪.৫)
২৪.৯
(৭৬.৮)
২৫.৪
(৭৭.৭)
২৫.২
(৭৭.৪)
২৫.৩
(৭৭.৫)
২৫.২
(৭৭.৪)
২৪.১
(৭৫.৪)
২০.৩
(৬৮.৫)
১৫.৮
(৬০.৪)
২১.৭
(৭১.১)
সর্বনিম্ন রেকর্ড °সে (°ফা) ৫.২
(৪১.৪)
৬.৬
(৪৩.৯)
১০.২
(৫০.৪)
১৩.৬
(৫৬.৫)
১৪.৩
(৫৭.৭)
১৮.১
(৬৪.৬)
১৯.৪
(৬৬.৯)
১৯.৯
(৬৭.৮)
১৭.২
(৬৩.০)
১২.৭
(৫৪.৯)
১০.০
(৫০.০)
৭.৫
(৪৫.৫)
৫.২
(৪১.৪)
অধঃক্ষেপণের গড় মিমি (ইঞ্চি) ৭.৩
(০.২৯)
২৫.০
(০.৯৮)
৫৫.৫
(২.১৯)
১৩৬.৪
(৫.৩৭)
৩১৪.০
(১২.৩৬)
৫৯১.৩
(২৩.২৮)
৭৩৫.৬
(২৮.৯৬)
৫১৩.৯
(২০.২৩)
২৩৯.৩
(৯.৪২)
১৯৭.৮
(৭.৭৯)
৫৯.৫
(২.৩৪)
১৪.১
(০.৫৬)
২,৮৮৯.৭
(১১৩.৭৭)
অধঃক্ষেপণ দিনগুলির গড় ১৩ ১৬ ১৯ ১৭ ১৩ ১০৪
আপেক্ষিক আদ্রতার গড় (%) ৭৩ ৭০ ৭৪ ৭৭ ৭৯ ৮৩ ৮৫ ৮৫ ৮৩ ৮১ ৭৮ ৭৫ ৭৯
মাসিক সূর্যালোক ঘণ্টার গড় ২৬৪.১ ২৪৪.৩ ২৭৬.৪ ২৪২.৭ ২২৭.২ ১১৬.৭ ১০৫.১ ১২৪.৪ ১৬৬.৭ ২১৮.২ ২৪১.৩ ২৪৫.৫ ২,৪৭২.৬
উৎস ১: বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর[18][19][20]
উৎস ২: বিশ্ব বায়োক্লাইমেটিক শ্রেণীবিভাগ প্রক্রিয়া (চূড়ান্ত),[21]জার্মান আবহাওয়া পরিষেবা (সূর্য, ১৯৬১-১৯৯০)[22][lower-alpha 1]

প্রশাসনিক বিভাগ

চট্টগ্রাম শহর এলাকা ১৬টি থানার অধীনঃ[23]

থানাসমূহ
ক্রম নংমেট্রোপলিটন থানাপ্রতিষ্ঠাকাল
০১কোতোয়ালী মডেল থানা৩০ নভেম্বর, ১৯৭৮
০২চান্দগাঁও থানা৩০ নভেম্বর, ১৯৭৮
০৩ডবলমুরিং থানা৩০ নভেম্বর, ১৯৭৮
০৪পাহাড়তলী থানা৩০ নভেম্বর, ১৯৭৮
০৫পাঁচলাইশ মডেল থানা৩০ নভেম্বর, ১৯৭৮
০৬বন্দর থানা৩০ নভেম্বর, ১৯৭৮
০৭কর্ণফুলী থানা২৭ মে, ২০০০
০৮খুলশী থানা২৭ মে, ২০০০
০৯পতেঙ্গা মডেল থানা২৭ মে, ২০০০
১০বাকলিয়া থানা২৭ মে, ২০০০
১১বায়েজিদ বোস্তামী থানা২৭ মে, ২০০০
১২হালিশহর থানা২৭ মে, ২০০০
১৩আকবর শাহ থানা৩০ মে, ২০১৩
১৪ইপিজেড থানা৩০ মে, ২০১৩
১৫চকবাজার থানা৩০ মে, ২০১৩
১৬সদরঘাট থানা৩০ মে, ২০১৩

চট্টগ্রাম শহরে রয়েছে ৪১টি ওয়ার্ড এবং ২৩৬টি মহল্লা। শহরের মোট এলাকা হলো ১৬৮.০৭ বর্গ কিলোমিটার।[24]

ওয়ার্ডসমূহ
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ডসমূহ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে বর্তমানে ৪১টি ওয়ার্ড রয়েছে।

ক্রম নংওয়ার্ড নংওয়ার্ডের নাম
০১১নং ওয়ার্ডদক্ষিণ পাহাড়তলী
০২২নং ওয়ার্ডজালালাবাদ
০৩৩নং ওয়ার্ডপাঁচলাইশ
০৪৪নং ওয়ার্ডচান্দগাঁও
০৫৫নং ওয়ার্ডমোহরা
০৬৬নং ওয়ার্ডপূর্ব ষোলশহর
০৭৭নং ওয়ার্ডপশ্চিম ষোলশহর
০৮৮নং ওয়ার্ডশুলকবহর
০৯৯নং ওয়ার্ডউত্তর পাহাড়তলী
১০১০নং ওয়ার্ডউত্তর কাট্টলী
১১১১নং ওয়ার্ডদক্ষিণ কাট্টলী
১২১২নং ওয়ার্ডসরাইপাড়া
১৩১৩নং ওয়ার্ডপাহাড়তলী
১৪১৪নং ওয়ার্ডলালখান বাজার
১৫১৫নং ওয়ার্ডবাগমনিরাম
১৬১৬নং ওয়ার্ডচকবাজার
১৭১৭নং ওয়ার্ডপশ্চিম বাকলিয়া
১৮১৮নং ওয়ার্ডপূর্ব বাকলিয়া
১৯১৯নং ওয়ার্ডদক্ষিণ বাকলিয়া
২০২০নং ওয়ার্ডদেওয়ান বাজার
২১২১নং ওয়ার্ডজামালখান
২২২২নং ওয়ার্ডএনায়েত বাজার
২৩২৩নং ওয়ার্ডউত্তর পাঠানটুলী
২৪২৪নং ওয়ার্ডউত্তর আগ্রাবাদ
২৫২৫নং ওয়ার্ডরামপুর
২৬২৬নং ওয়ার্ডউত্তর হালিশহর
২৭২৭নং ওয়ার্ডদক্ষিণ আগ্রাবাদ
২৮২৮নং ওয়ার্ডপাঠানটুলী
২৯২৯নং ওয়ার্ডপশ্চিম মাদারবাড়ী
৩০৩০নং ওয়ার্ডপূর্ব মাদারবাড়ী
৩১৩১নং ওয়ার্ডআলকরণ
৩২৩২নং ওয়ার্ডআন্দরকিল্লা
৩৩৩৩নং ওয়ার্ডফিরিঙ্গি বাজার
৩৪৩৪নং ওয়ার্ডপাথরঘাটা
৩৫৩৫নং ওয়ার্ডবকশীর হাট
৩৬৩৬নং ওয়ার্ডগোসাইলডাঙ্গা
৩৭৩৭নং ওয়ার্ডউত্তর মধ্য হালিশহর
৩৮৩৮নং ওয়ার্ডদক্ষিণ মধ্য হালিশহর
৩৯৩৯নং ওয়ার্ডদক্ষিণ হালিশহর
৪০৪০নং ওয়ার্ডউত্তর পতেঙ্গা
৪১৪১নং ওয়ার্ডদক্ষিণ পতেঙ্গা

নগর প্রশাসন

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত
ফয়'স লেক

১৮৬৩ সালের ২২শে জুন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি'র যাত্রা শুরু। তবে এর প্রশাসন ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৮ জন কমিশনার সমন্বয়ে পরিষদ গঠন করা হয় ১৮৬৪ সালে। ঐসময়ে চট্টগ্রাম শহরের সাড়ে চার বর্গমাইল এলাকা মিউনিসিপ্যালিটির আওতাধীন ছিল। প্রথমে ৪টি ওয়ার্ড থাকলেও ১৯১১ সালে ৫টি ওয়ার্ড সৃষ্টি করা হয়। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি ১৯৮২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সিটি কর্পোরেশনে রুপান্তরিত হয়। বর্তমানে ওয়ার্ড সংখ্যা ৪১টি। চট্টগ্রাম শহর এলাকা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন-এর অধীনস্থ। শহরবাসীদের সরাসরি ভোটে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এবং ওয়ার্ড কমিশনারগণ নির্বাচিত হন। বর্তমানে এই শহরের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। শহরের আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নিযুক্ত রয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। এর সদর দপ্তর দামপাড়ায় অবস্থিত। চট্টগ্রামের প্রধান আদালতের স্থান লালদীঘি ও কোতোয়ালী এলাকায় ঐতিহাসিক কোর্ট বিল্ডিং এ।

জনসংখ্যা

জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর তথ্যমতে, চট্টগ্রাম শহরের জনসংখ্যা ১ কোটি ১১ লক্ষ ৭৫ হাজার ২৬ জন এবং নারী ও পুরুষের সংখ্যা যথাক্রমে ৫৫ লক্ষ ৭৭ হাজার ১৬৮ জন ও ৫৫ লক্ষ ৯৬ হাজার ৮২১ জন।[25] চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাধিন এলাকার জনসংখ্যা ৩২ লক্ষ ২৭ হাজার ২৪৬ জন[26]। যেখানে নারী ও পুরুষের সংখ্যা যথাক্রমে ১৫ লক্ষ ৫৩ হাজার ২৫২ জন ও ১৬ লক্ষ ৭৩ হাজার ৬২৭ জন।[25]

বাংলায় সুলতানি ও মুঘল শাসনামলে চট্টগ্রামের জাতিগোষ্ঠীর একটি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমদিকে মুসলিম অভিবাসন শুরু হয়েছিল এবং মধ্যযুগীয় সময়ে উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনবসতি গড়ে উঠেছিল। পারস্য ও আরব থেকে আগত মুসলিম ব্যবসায়ী, শাসক এবং প্রচারকরা প্রথমদিকে মুসলমান বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং তাদের বংশধররা এই শহরের বর্তমান মুসলিম জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ। শহরে ইসমাইলিস এবং যাযাবর শিয়া সহ অপেক্ষাকৃত ধনী এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবিত শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় রয়েছে। এই শহরে অনেক জাতিগত সংখ্যালঘুও রয়েছে, বিশেষত চাকমা, রাখাইন এবং ত্রিপুরী সহ চট্টগ্রাম বিভাগের সীমান্তবর্তী পাহাড়ের উপজাতি গোষ্ঠীর সদস্য; এবং তার পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীও রয়েছে। বড়ুয়া নামে পরিচিত এ অঞ্চলের বাংলাভাষী থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাচীন সম্প্রদায় এবং বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্মের সর্বশেষ অবশেষ। প্রায়শই ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত, পর্তুগিজ জনগোষ্ঠীর বংশোদ্ভূত চট্টগ্রামের প্রাচীন ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়, যারা পাথরঘাটা পুরনো পর্তুগিজ ছিটমহলে বাস করেন। এখানে একটি ছোট্ট উর্দুভাষী বিহারি সম্প্রদায়ও রয়েছে, যারা বিহারি কলোনি নামে পরিচিত জাতিগত ছিটমহলে বসবাস করে।

দক্ষিণ এশীয়ার অন্যান্য প্রধান নগর কেন্দ্রগুলির মতো, এ মহানগরেরও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলমুখি মানুষের ঢলের ফলস্বরূপ চট্টগ্রামের বস্তিগুলোর অবিচ্ছিন্নভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দারিদ্র্য বিমোচনের প্রকাশনার তথ্য অনুসারে, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১,৮১৪ টি বস্তি রয়েছে, যাতে প্রায় ১৮০,০০০ বস্তিবাসী বসবাস করে, যা রাজধানী ঢাকার পরে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।[27] বস্তিবাসীরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রায়শই উচ্ছেদের মুখোমুখি হন এবং তাদের সরকারি জমিতে অবৈধ আবাসনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়।

খাদ্য

চট্টগ্রামের মানুষ ভোজন রসিক হিসেবে পরিচিত। তারা যেমন নিজেরা খেতে পছন্দ করেন, তেমনি অতিথি আপ্যায়নেও সেরা। চট্টগ্রামের মেজবান হচ্ছে তার বড় উদাহরণ। শুঁটকি, মধুভাত, বেলা বিস্কুট, বাকরখানি, লক্ষিশাক,গরুর গোস্ত ভুনা, পেলন ডাল, কালাভুনা, বিরিয়ানি, মেজবানি মাংস, আফলাতুন হালুয়া, তাল পিঠা, নোনা ইলিশ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাদ্য।[28]

মেজবান

মেজবান চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় ভোজন উৎসব। যেকোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামে মেজবান আয়োজন করা হয়ে থাকে। এইধরণের আয়োজনে ৫ শতাধিক মানুষকে আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে।[29] মূলত গরম ভাত, গরুর মাংস, মুগ বা ছোলার ডালে মেশানো মাংস, গরুর নলা থাকে মেজবানের প্রধান মেন্যু। ১৫০০ শতকে কবি বিজয় গুপ্তের পদ্মপূরাণ কাব্যগ্রন্থে এই উৎসবের তথ্য পাওয়া যায়। ১৬০০ শতকে সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ কাব্যগ্রন্থে ভোজন অর্থে 'মেজোয়ানি' শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ফারসি শব্দ মেজবান অর্থ অতিথি আপ্যায়নকারী, মেজবানি অর্থ আতিথেয়তা।[30]

সাহিত্য এবং সংস্কৃতি

সাহিত্য

চট্টগ্রামে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ শুরু হয় ষোড়শ শতকে। সে সময়কার চট্টগ্রামের শাসক পরাগল খাঁ এবং তার পুত্র ছুটি খাঁর সভা কবি ছিলেন কবীন্দ্র পরমেশ্বরশ্রীকর নন্দী[23] কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের একটি সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ করেন। আর শ্রীকর নন্দী জৈমিনি সংহিতা অবলম্বনে অশ্বমেধ পর্বের বিস্তারিত অনুবাদ করেন।

চট্টগ্রামের মধ্যযুগের কবি

আরাকানের রাজসভায় চট্টগ্রামের কবি

  • দৌলত কাজী
  • মহাকবি আলাওল
  • কোরেশী মাগণ ঠাকুর
  • কবি মরদন এবং
  • আব্দুল করিম খোন্দকার

অষ্টম শতক থেকে পরবর্তীকালের উল্লেখযোগ্য কবি ও সাহিত্যিক

আধুনিক যুগের কবি-সাহিত্যিক

সংস্কৃতি

চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। জানা ইতিহাসের শুরু থেকে চট্টগ্রামে আরাকানী মঘীদের প্রভাব লক্ষনীয়। ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতিতেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সে সময় এখানকার রাজারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হওয়ায় তার প্রভাবও যথেষ্ট। সুলতানি, আফগান এবং মোগল আমলেও আরাকানীদের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত মঘীদের প্রভাব বিলুপ্ত হয়নি। এছাড়া চট্টগ্রামের মানুষ আতিথেয়তার জন্য দেশ বিখ্যাত।

চট্টগ্রামের বর্তমান সংস্কৃতির উন্মেষ হয় ১৭৯৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে সামাজিক ধানোৎপাদন ও বণ্টনে পদ্ধতিগত আমূল পরিবর্তন হয়। অন্যান্য স্থানের মতো চট্টগ্রামেও একটি নতুন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। নতুন এরই ফাঁকে ইংরেজরা প্রচলনা করে ইংরেজি শিক্ষা। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ইতিহাস সমৃদ্ধ। একাধারে নন্দীত গায়ক, সুরকার ও গীতিকার এম এন আখতার এর হাতে গড়া শেফালী ঘোষ এবং শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবকে বলা হয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাট ও সম্রাজ্ঞি। আর অসংখ্য আঞ্চলিক গান ও মাইজভান্ডারী গান এর রচয়িতা আবদুল গফুর হালী বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে গীত দরিয়া বা গানের সাগর নামে পরিচিত। আঞ্চলিক গান, মাইজভান্ডারী গান ও কবিয়াল গান চট্টগ্রামের অন্যতম ঐতিহ্য। কবিয়াল রমেশ শীল একজন বিখ্যাত কিংবদন্তি শিল্পী। জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলস, এল আর বি, রেঁনেসা, নগরবাউল এর জন্ম চট্টগ্রাম থেকেই। আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, রবি চৌধুরী, নকীব খান, পার্থ বডুয়া, সন্দিপন, নাসিম আলি খান, মিলা ইসলাম চট্টগ্রামের সন্তান। নৃত্যে চট্টগ্রামের ইতিহাস মনে রখার মত। রুনু বিশ্বাস জাতীয় পর্যায়ে বিখ্যাত নৃত্যগুরু। চট্টগ্রামের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক সংগঠন হল দৃষ্টি চট্টগ্রাম, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা, "অঙ্গন" চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, আলাউদ্দিন ললিতকলা একাডেমি, প্রাপন একাডেমি, উদিচি, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, ফু্লকি, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা, রক্তকরবী, আর্য সঙ্গীত, সঙ্গীত পরিষদ। মডেল তারকা নোবেল, মৌটুসি, পূর্ণিমা,শ্রাবস্তীর চট্টগ্রামে জন্ম। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় জেলা শিল্পকলা একাডেমি, মুসলিম হল, থিয়েটার ইন্সটিটিউটে।[28]

অর্থনীতি এবং উন্নয়ন

বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো চট্টগ্রামের অর্থনীতিও কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য নির্ভর। চট্টগ্রাম শহরের জিডিপি ৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২০ সালের হিসাবে, এছাড়া চট্টগ্রাম শহরের পিপিপি ১২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চট্টগ্রাম দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ৫ম বৃহৎ অর্থনীতির শহর। । চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল বা ইপিজেড চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়।[24]

কৃষি

চট্টগ্রামের কৃষির প্রধান শস্য ধান। এছাড়া শীতগ্রীষ্ম মৌসুমে ব্যাপক শাকসবজির চাষ হয়। উল্লেখযোগ্য শাকসবজির মধ্যে রয়েছে- বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, সাদা কুমড়া, লাউ, ঢেড়শ, ঝিংগা, চিচিংগা, শশা, বরবটি, সীম, মটরশুঁটি, টমেটো, মুলা, বীট, গাজর, শালগম, ফুলকপি, বাধাকপি, পটল করলা, বিভিন্ন রকমের শাক ইত্যাদি। ফলমূলের ক্ষেত্রে নারিকেলই মুখ্য। তবে, আম, কলাকাঁঠালের উৎপাদনও হয়ে থাকে।

তামাক

১৯৬০ এর দশকে শংখমাতামুহুরী নদীর তীরবর্তী এলাকায় তামাক চাষ শুরু হয়। বাংলাদেশ টোব্যাকো কোম্পানি (এখন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী) রাঙ্গুনিয়াতে তামাক চাষের ব্যবস্থা করে এবং পরে লাভজনক হওয়ায় চাষীরা তা অব্যাহত রাখে।

লবণ

সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় লবণ চাষ লাভজনক। ইতিহাসে দেখা যায় ১৭৯৫ সালে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে গড়ে বার্ষিক ১৫ লাখ টন লবণ উৎপন্ন হতো।

মৎস চাষ ও আহরণ

চট্টগ্রাম জেলায় মাছচাষের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। সমুদ্র এবং নদী-নালার প্রাচূর্য এর মূল কারণ। শহরের অদূরের হালদা নদীর উৎসমুখ থেকে মদুনাঘাট পর্ষন্ত মিঠা পানির প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবে বেশ উর্বর। বৃহত্তর চট্টগ্রামে দিঘি, বিল ও হাওড়ের সংখ্যা ৫৬৮, পুকুর ও ডোবার সংখ্যা ৯৫,৯৪১। মোট আয়তন ৮৫,৭০০ একর (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ১৯৮১), কর্ণফুলী নদীর মোহনায় প্রায় ৬ লাখ ৪০ হাজার একর বিস্তৃত মাছ ধরার জায়গা হিসাবে চিহ্নিত।

রপ্তানির ক্ষেত্রে সামুদ্রিক মাছ হাঙ্গর, স্কেট, রে, হেরিং, শার্কফিন এবং চিংড়ি উল্লেখ্য।

শুঁটকি

চট্টগ্রামের মাছ চাষ ও আহরণের একটি উল্ল্যেখযোগ্য দিক হলে শুঁটকি (মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করা)। সোনাদিয়া, সন্দ্বীপ প্রভৃতি দ্বীপাঞ্চল থেকে শুঁটকি মাছ চট্টগ্রামের বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হয়। ব্রিটিশ আমলে শুঁটকি রেঙ্গুনে রপ্তানি করা হতো।

শিল্প

বন্দর নগরী হিসাবে ব্রিটিশ-পূর্ব, ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান পর্বে চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল। বন্দরভিত্তিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও ব্রিটিশ আমলে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়। পাকিস্তান পর্বে চট্টগ্রামে ভারী শিল্প যেমন - ইস্পাত, মোটরগাড়ি, পাট, বস্ত্র, সুতা, তামাক, ম্যাচ ও ঔষধ শিল্পের কারখানা গড়ে ওঠে। তাছাড়া কিছু বহুজাতিক কোম্পানির সদর দপ্তরও চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে।

শিক্ষা

চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ভারতের অন্যান্য স্থানের মতো ধর্ম ভিত্তিক তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। আরবি নির্ভর মুসলমানদের জন্য মক্তব-মাদ্রাসা, সংস্কৃত ভাষা নির্ভর হিন্দুদের জন্য টোল-পাঠশালা‌-চতুষ্পাঠী এবং বৌদ্ধদের জন্য কেয়াং বা বিহার। সে সময় রাষ্ট্রাচারের ভাষা ছিল ফার্সি। ফলে হিন্দুদের অনেকে ফার্সি ভাষা শিখতেন। আবার রাষ্ট্র পরিচালনা এবং জনসংযোগের জন্য মুসলিম আলেমদের সংস্কৃত জানাটা ছিল দরকারি। এ সকল প্রতিষ্ঠানে হাতে লেখা বই ব্যবহৃত হতো। ইংরেজদের নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার আগ পর্যন্ত এই তিন ধারাই ছিল চট্টগ্রামের শিক্ষার মূল বৈশিষ্ট্য।

১৭৬০ সালে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠত হলেও ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের কোন উদ্যোগ দেখা যায় নি, সমগ্র ভারত বর্ষে। ১৭৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা মাদ্রাসা ছাড়া শিক্ষা বিস্তারে কোম্পানির আর কোন উদ্যোগ ছিল না। ১৮১৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতে শিক্ষা বিস্তারের জন্য আইন পাশ করে। এর পর ভারতের বিভিন্ন স্থানে মিশনারী স্কুলের সংখ্যা বাড়ে তবে ১৮৩৬ এর আগে চট্টগ্রামে সে মাপের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে নি। ১৮৩৬ সালে জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন চট্টগ্রাম জেলা স্কুল নামে প্রথম ইংরেজি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান চালু করে। এলাকার খ্রীস্টান মিশনারীরা ১৮৪১ সালে সেন্ট প্লাসিড্‌স হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

১৮৪৪ সালে ভারতের বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ রাজকার্যে নিয়োগ পাওয়ার জন্য ইংরেজি জানা আবশ্যক ঘোষণা করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ে। ১৮৫৬ ও ১৮৭১ সালে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হলেও সেগুলো ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দে মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল প্রতিষ্ঠত হয়। ১৮৮৫ সালে শেখ‌-ই-চাটগাম কাজেম আলী চিটাগাং ইংলিশ স্কুল নামে একটি মধ্য ইংরেজি স্কুল (অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৮ সালে এটি হাই স্কুলে উন্নীত হয়।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে রয়েছে
বেসরকারি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।

তাছাড়াও মেডিকেল কলেজ ইউএসটিসি, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ, সাউদার্ন মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম ডেন্টাল কলেজ রয়েছে।

চট্টগ্রাম শহরের মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয় গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ

উল্লেখযোগ্য কলেজের মধ্যে রয়েছে-

ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে আছে

  • সানশাইন গ্রামার স্কুল অ্যান্ড কলেজ
  • চিটাগাং গ্রামার স্কুল,
  • বে ভিউ,
  • লিটল জুয়েলস,
  • সামাফিল্ডস স্কুল,
  • রেডিয়্যান্ট স্কুল,
  • সাউথ পয়েন্ট স্কুল,
  • সাইডার ইন্টা্ন্যাশনাল স্কুল,
  • মাস্টারমাইন্ড স্কুল,
  • চাইল্ড হেভেন স্কুল,
  • ডিউ পয়েন্ট স্কুল,
  • প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।

শহরের একমাত্র আমেরিকান কারিকুলাম ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উইলিয়াম কেরি একাডেমি।

মাদ্রাসাসমুহের মধ্যে রয়েছে

উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব

ক্রীড়া

বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো চট্টগ্রামে বিভিন্ন জনপ্রিয় খেলা যেমন ফুটবল, ক্রিকেট, বিলিয়ার্ড, টেবিল টেনিস, অ্যাথলেটিক্স, সকার, দাবা, বাস্কেটবল, হকি, কাবাডি, ভলিবল ইত্যাদি প্রচলিত রয়েছে। ব্যাডমিন্টনও একটি অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিকগণ অবশ্য বেশ কিছু প্রাচীন খেলার কথা উল্লেখ করে থাকেন। এর মধ্যে রয়েছে বলীখেলা, গরুর লড়াই. তুম্বুরু, চুঁয়াখেলা, ঘাডুঘাডু, টুনি ভাইয়র টুনি, তৈইক্যা চুরি, হাতগুত্তি, কইল্যা, কড়ি, নাউট্টা চড়াই, ডাংগুলি, নৌকা বাইচ ইত্যাদি। এর মধ্যে জব্বারের বলীখেলার কারণে বলীখেলা, কুস্তি এবং নৌকা বাইচ এখনও চালু আছে। গ্রামাঞ্চলে বৈচি, ডাংগুলি এখনো দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে, অন্যগুলোর তেমন কোন প্রচলন দেখা যায় না।

জাতীয় পর্যায়ে চট্টগ্রামের খেলোয়াড়দের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। দেশের বাইরে থেকে সুনাম আনার ক্ষেত্রেও চট্টগ্রামের ক্রীড়াবিদদের অবদান উল্লেখযোগ্য। আইসিসি ট্রফি জেতা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দলনেতা ছিলেন আকরাম খানকমনওয়েলথ গেমস থেকে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম স্বর্ণপদক অর্জনকারী চট্টগ্রামের শুটার আতিকুর রহমান।[31]

চট্টগ্রামের স্প্রিন্টার মোশাররফ হোসেন শামীম জাতীয় পর্যায়ে পরপর ৭ বার ১০০ মিটার স্প্রিন্টে চ্যাম্পিয়ন হোন। এ কারণে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ দল যখন প্রথম বিশ্ব অলিম্পিকে অংশ নেয় তখন মোশাররফ হোসেন শামীম বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র ক্রীড়াবিদ ছিলেন।

চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গণের মূল কেন্দ্র চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়াম। চট্টগ্রামের প্রধান ক্রীড়া সংগঠন চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া পরিষদের প্রধান কার্যালয় এই স্টেডিয়ামে। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম দেশের অন্যতম ক্রিকেট স্টেডিয়াম। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করছে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স।

স্থাপত্য

দর্শনীয় স্থান

যোগাযোগ এবং গণমাধ্যম

চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য দৈনিক পত্রিকার মধ্যে রয়েছে দৈনিক আজাদী, দৈনিক পূর্বকোণ, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ এবং দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ। অনলাইন নিউজ পোর্টালের মধ্যে রয়েছে সিটিজি নিউজ ডটকম[32], চট্টগ্রাম নিউজ ডটকম, সিটিজি টাইমস ডটকম, দেশরিভিউ.কম[33],চট্টগ্রাম ডেইলি ডটকম, সিটিজিসান ডটকম। এছাড়া জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর চট্টগ্রাম সংস্করন বের হয়। সাপ্তাহিক পত্রিকা : সাপ্তাহিক চট্টগ্রাম দর্পণ, সাপ্তাহিক চাটগাঁর সংবাদ, সাপ্তাহিক চট্টলা,সাপ্তাহিক শ্লোগান,সাপ্তাহিক ইসতেহাদ,সাপ্তাহিক রায়হান।

বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের মূল স্টুডিও আগ্রাবাদে অবস্থিত। এছাড়া কালুরঘাটে একটি বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনএর চট্টগ্রাম কেন্দ্র পাহাড়তলীতে অবস্থিত। বেসরকারি এফএম রেডিও রেডিও ফুর্তি এবং রেডিও টুডের চট্টগ্রাম সম্প্রচার কেন্দ্র রয়েছে।

ভ্রমণব্যবস্থা

ঐতিহাসিক স্থানসমূহ:

পার্ক, বিনোদন ও প্রাকৃতিক স্থান:

স্মৃতিসৌধ ও স্মারক:

আরও দেখুন

পাদটীকা

  1. চট্টগ্রামের (পতেঙ্গা) স্টেশন আইডি হলো ৪১৯৭৮ সূর্যালোকের সময়কাল সনাক্ত করতে এই স্টেশন আইডি ব্যবহার করুন

তথ্যসূত্র

  1. শরীফ, আহমদ (ফেব্রুয়ারি ২০১১)। চট্টগ্রামের ইতিহাসআগামী প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৯। আইএসবিএন 978 984 401 637 8।
  2. বাংলাদেশের শহরের তালিকা, সংগৃহীত হয়েছে ১৬ জুন ২০১৬
  3. "চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ইতিহাস"চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুন ২০১৬
  4. "Area, Population and Literacy Rate by Paurashava –2001" (পিডিএফ)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। ২০০৮-১২-১৭ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-১৮
  5. "জনসংখ্যা ও হাউজিং জনগণনা-২০১১" (পিডিএফ)বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। পৃষ্ঠা ৩৯। ৮ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুন ২০১৬
  6. "The world's fastest growing cities and urban areas from 2006 to 2020"। citymayors.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০৫-০৮
  7. O'Malley, L.S.S. (১৯০৮)। চট্টগ্রাম। পূর্ববঙ্গের জেলা গেজেটিয়ার। ১১এ। Calcutta: দ্য বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট বুক ডিপো। পৃষ্ঠা । সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুন ২০১৬
  8. শিরীন হাসান ওসমানী (২০১২)। "চট্টগ্রাম নগরী"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743
  9. Bernoulli, Jean; Rennell, James; Anquetil-Duperron, M.; Tieffenthaller, Joseph (১৭৮৬)। Description historique et géographique de l'Inde (ফরাসি ভাষায়)। 2। Berlin: C. S. Spener। পৃষ্ঠা 408। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুন ২০১৬
  10. হাজার বছরের চট্টগ্রামদৈনিক আজাদী। নভেম্বর ১৯৯৫। পৃষ্ঠা ২৩।
  11. বাংলাপিডিয়া, খন্ড ৩, পৃ.২৭৬।
  12. "১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ: আমাদের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ ও একজন"। দৈনিক সমকাল। ২৩ মার্চ ২০২০।
  13. "জেলার ইতিহাস - চট্টগ্রাম জেলা"www.chittagong.gov.bd। ২৭ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ জুন ২০২০
  14. "About Chittagong"muhammadyunus.org। ৪ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ অক্টোবর ২০১৯
  15. হাজার বছরের চট্টগ্রামদৈনিক আজাদী। নভেম্বর ১৯৯৫। পৃষ্ঠা ১৯।
  16. Peel, M. C. and Finlayson, B. L. and McMahon, T. A. (২০০৭)। "Updated world map of the Köppen–Geiger climate classification" (পিডিএফ)Hydrol. Earth Syst. Sci.11 (5): 1633–1644। আইএসএসএন 1027-5606ডিওআই:10.5194/hess-11-1633-2007
  17. Unattributed (২০১২)। "NOAA's Top Global Weather, Water and Climate Events of the 20th Century" (পিডিএফ)NOAA Backgrounder। সংগ্রহের তারিখ ৩০ এপ্রিল ২০১২
  18. "বাংলাদেশের জলবায়ু" (পিডিএফ)। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। পৃষ্ঠা ১৯–২৩। ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮
  19. "সাধারণ মাসিক বৃষ্টির দিন" (পিডিএফ)। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। ৯ জুলাই ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮
  20. "সাধারণ মাসিক আর্দ্রতা" (পিডিএফ)। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮
  21. "বাংলাদেশ-চট্টগ্রাম" (স্পেনীয় ভাষায়)। ফাইটোসোসিওলজিকাল গবেষণা কেন্দ্র। ৭ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
  22. "স্টেশন ৪১৯৭৮ চট্টগ্রাম (পতেঙ্গা)"বৈশ্বিক স্টেশন উপাত্ত ১৯৬১-১৯৯০—সূর্যালোকের সময়কাল। জার্মান আবহাওয়া পরিষেবা। ২০১৭-১০-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০১৬
  23. সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সম্পাদনাঃ অঞ্জলি বসু, ৪র্থ সংস্করণ, ১ম খণ্ড, ২০০২, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। পৃ. ৭৬
  24. Chittagong District ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৮ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে, বাংলাপিডিয়া থেকে।
  25. জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ প্রাথমিক প্রতিবেদন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো। জুলাই ২০২২। পৃষ্ঠা ৯–১০। আইএসবিএন 9789843527882।
  26. "বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে সাড়ে ১৬ কোটি | জাতীয়"Noyashotabdi। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৪
  27. International Monetary Fund. Asia and Pacific Dept (২০১৩)। Bangladesh: Poverty Reduction Strategy PaperIMF। পৃষ্ঠা 213। আইএসবিএন 1-4755-4352-2।
  28. “হাজার বছরের চট্টগ্রাম” (দৈনিক আজাদী কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ)
  29. "মেজবান: ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির বন্ধন"টিবিএস বাংলা। ২০২১-১০-০৩। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০২২
  30. "চট্টগ্রামের ঐতিহ্য মেজবান"banglanews24.com। ২০২২-০৩-১০। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৪
  31. এছাড়া ২০১০ এর উইজডেন বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার তামিম ইকবাল ও চট্টগ্রামের ছেলে।
  32. https://www.ctgnews.com/
  33. http://moi.gov.bd/sites/default/files/files/moi.portal.gov.bd/notices/bbc88285_548b_4761_9e31_dfbfa8eae94c/433.pdf

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.