শেক্সপিয়রীয় ট্র্যাজেডি
শেকসপিয়রীয় ট্র্যাজেডি বলতে উইলিয়াম শেকসপিয়রের লেখা অধিকাংশ বিয়োগান্ত নাটকগুলিকে বোঝায়। শেকসপিয়রের অনেকগুলি ইতিহাসাশ্রয়ী নাটকও শেকসপিয়রীয় ট্র্যাজেডির অনুরূপ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কিন্তু এগুলি ইংল্যান্ডের ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রের জীবনী অবলম্বনে রচিত বলে ফার্স্ট ফোলিও-তে এগুলিকে "হিস্ট্রিজ" অর্থাৎ ইতিহাসাশ্রয়ী নাটক আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। রোমান ট্র্যাজেডিগুলিও (জুলিয়াস সিজার, অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা ও কোরিওলেনাস) ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের জীবনী অবলম্বনে রচিত; কিন্তু এগুলির উৎসসূত্র বিদেশি এবং প্রাচীন হওয়ায় এগুলিকে ইতিহাসাশ্রয়ী নাটকের পরিবর্তে "ট্র্যাজেডি" আখ্যা দেওয়া হয়। রোম্যান্স নাটকগুলি (ট্র্যাজিকমিক নাটক) শেকসপিয়রের কর্মজীবনের শেষভাগে রচিত। এগুলি প্রথমে হয় ট্র্যাজেডি নয় কমেডি হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলির মধ্যে ট্র্যাজেডির কিছু কিছু উপাদান বিদ্যমান। যেমন, এগুলিতে একজন উচ্চ-মর্যাদাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকে, কিন্তু তাঁরাও শেকসপিয়রীয় কমেডিগুলির মতোই মিলনান্তিক সমাপ্তির দিকে যান। শেকসপিয়রের মৃত্যুর প্রায় তিন শতাব্দীকাল পরে গবেষক ফ্রেডেরিক এস. বোয়াজ পঞ্চম একটি বর্গের কথা প্রস্তাব করেন: "সমস্যাশ্রয়ী নাটক"। যে সব নাটকগুলিকে বিষয়বস্তু, প্রেক্ষাপট ও সমাপ্তিভাগের জন্য একক কোনও বর্গের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সেগুলির জন্যই তিনি এই বর্গটির প্রস্তাব রেখেছিলেন।[1][2] শেকসপিয়রের কয়েকটি নাটকের বর্গবিন্যাস নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক আছে।
কালপঞ্জি
নিচে সম্ভাব্য রচনাকালের উল্লেখ সহ ফার্স্ট ফোলিওতে ট্র্যাজেডি হিসেবে চিহ্নিত শেকসপিয়রীয় নাটকগুলির তালিকা দেওয়া হল:[1][3]
নাটক | সময়কাল | |
---|---|---|
যে সালের পরে | যে সালের আগে | |
টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাস | ১৫৯১ | ১৫৯৩ |
রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট | ১৫৯৪ | ১৫৯৫ |
জুলিয়াস সিজার | ১৫৯৯ | ১৬০০ |
হ্যামলেট | ১৬০০ | ১৬০১ |
ট্রলিয়াস অ্যান্ড ক্রেসিডা[lower-alpha 1] | ১৬০১ | ১৬০২ |
ওথেলো | ১৬০৪ | ১৬০৫ |
কিং লিয়ার | ১৬০৫ | ১৬০৬ |
ম্যাকবেথ | ১৬০৫ | ১৬০৬ |
টাইমন অফ এথেন্স | ১৬০৫ | ১৬০৮ |
অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা | ১৬০৬ | ১৬০৭ |
কোরিওলেনাস | ১৬০৭ | ১৬০৮ |
প্রভাব ও উৎসসূত্র
ইংল্যান্ডের নবজাগরণ অর্থাৎ শেকসপিয়র যে যুগে সক্রিয় ছিলেন সেই যুগে রোমান ও গ্রিক ধ্রুপদি সাহিত্য এবং প্রতিবেশী ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেনের রেনেসাঁ সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ নতুন করে জেগে উঠেছিল।[1] শেকসপিয়র তাঁর অধিকাংশ ট্র্যাজেডি রচনা করেছিলেন প্রথম জেমসের রাজত্বকালে। এই ট্র্যাজেডিগুলির অন্ধকারাচ্ছন্ন বিষয়বস্তুগুলির মধ্যে সম্ভবত প্রথম এলিজাবেথের মৃত্যু-পরবর্তীকালে দেশের সাধারণ অবস্থাটির প্রতিফলন রয়েছে।[1] সেযুগের অন্যান্য নাট্যকারেদের রেওয়াজ মাফিক ইতিহাস, অন্য নাটক ও নাট্যসাহিত্যের বাইরে অন্য বর্গের সাহিত্যকে নিজের নাটকের উৎস হিসেবে গ্রহণ করতেন। এলিজাবেথীয় ইংল্যান্ডে মেধাস্বত্ব বা কুম্ভীকলবৃত্তির বিরুদ্ধে কোনও রক্ষাকবচ ছিল না। তাই চরিত্র, আখ্যানবস্তু এমনকি কবিতার সমগ্র পংক্তিকেও সাধারণ সম্পত্তি মনে করা হত।[4] শেকসপিয়রের অধিকাংশ ট্র্যাজেডিই ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের জীবনকথা অবলম্বনে রচিত। ব্যতিক্রম কেবলমাত্র মেজার ফর মেজার ও ওথেলো, যেগুলি গিরাল্ডি সিনশিওর লেখা কথাসাহিত্য অবলম্বনে রচিত হয়।[1] শেকসপিয়রের রোমান নাটকগুলির ঐতিহাসিক ভিত্তি ছিল প্লুতার্কের দ্য লাইভস অফ নোবল গ্রেসিয়ানস অ্যান্ড রোমানস,[5] আবার শেকসপিয়রের ব্রিটেন-ভিত্তিক নাটক ও হ্যামলেট-এর (ডেনীয় রাজপুত্র অ্যামলেথের জীবন অবলম্বনে)[6] উৎস ছিল হলিনশেড'স ক্রনিকল।[1] এছাড়া ফরাসি লেখক বেলফরেস্ট ১৫৮২ সালে The Hystorie of Hamblet, Prince of Denmarke নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই বইটিতেই ছিল কীভাবে রাজকুমার পাগলামির ভান করতেন এবং কীভাবে রানির কক্ষের বাইরে হ্যামলেট ও তাঁর মায়ের কথাবার্তা আড়ি পেতে শোনা রাজার কাউন্সেলরকে তিনি হত্যা করেন।[6] লিয়ারের কাহিনিটি পাওয়া যায় মনমাউথের জিওফ্রের Historia regium Britanniae (আনু. ১১৩৫) এবং তারপর জন হিগিনসের কবিতা দ্য মিরর ফর ম্যাজিস্ট্রেটস (১৫৭৪), এবং সেই সঙ্গে হলিনশেডের ক্রনিকলস-এ (১৫৮৭)[7] শেকসপিয়রের কিং লিয়ার নাটকের কয়েকটি ঘটনা অনুপ্রাণিত হয়েছে ফিলিপ সিডনির আর্কেডিয়া-র (১৫৯০) বিভন্ন পর্ব থেকে; অন্যদিকে এডগারের "পুওর টম"-এর অর্থহীন চিন্তনের মধ্যে স্যামুয়েল হার্সনেটের আ ডিক্লেয়ারেশন অফ এগ্রেজিয়াস পোপিস ইমপোচারস (১৬০৩) গ্রন্থের বহুল উল্লেখ পাওয়া যায়।[7]
সমসাময়িক ট্র্যাজেডি
এই যুগের ট্র্যাজেডিগুলি দার্শনিক সারমর্ম গ্রহণ করেছিল সেনেকীয় ট্র্যাজেডি থেকে।[1] এগুলির ভিত্তি অভিজাত পুরুষদের জীবনকথা, যাঁদের জীবনে বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে অথবা যাঁরা কোনও একটি মারাত্মক ভুলের (হ্যামারশিয়া) ফলে ভাগ্যবিড়ম্বনার (পেরিপেশিয়া) শিকার হন। (যদিও কোনও কোনও সমালোচকের মতে, "ছদ্ম-অ্যারিস্টটেলীয়" বিয়োগান্ত ভুলের ধারণাটি শেকসপিয়রের ট্র্যাজিক চরিত্রগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।[8]) প্রতিহিংসামূলক ট্র্যাজেডিও এই যুগে ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল; শেকসপিয়রের হ্যামলেট তারই একটি উদাহরণ।[2][3] এই যুগের নাটক নিঃসন্দেহেই ধর্মনিরপেক্ষ ছিল।[1] প্রথম এলিজাবেথ কর্তৃক এই যুগে বেআইনি ঘোষিত ধর্মীয় নীতিনাটক ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ইংরেজি নবজাগরণকালীন ট্র্যাজেডি এবং যে ধ্রুপদি নাটক থেকে সেগুলি অনুপ্রাণিত হয়েছিল, তার মধ্যে একটি লক্ষণীয় পার্থক্য হল মঞ্চে সহিংসতা ও হত্যা দৃশ্যের প্রয়োগ ও তার জনপ্রিয়তা।[1]
কয়েকটি বিশিষ্ট এলিজাবেথীয় ও জেকবীয় ট্র্যাজেডি (অ-শেকসপিয়রীয়) হল:[6]
- দ্য স্প্যানিশ ট্র্যাজেডি, টমাস কিড
- দ্য জিউ অফ মালটা, ক্রিস্টোফার মার্লো
- ট্যাম্বারলেইন, ক্রিস্টোফার মার্লো
- ডক্টর ফস্টাস, ক্রিস্টোফার মার্লো
- অ্যান্টোনিও'জ রিভেঞ্জ, জন মার্সটন
- দ্য রিভেঞ্জার'স ট্র্যাজেডি, টমাস মিডলটন
- 'টিজ পিটি শি'জ আ হোর, জন ফোর্ড
তথ্যসূত্র
পাদটীকা
- ট্রলিয়াস অ্যান্ড ক্রেসিডা নাটকটি ফার্স্ট ফোলিওতে কমেডি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু এখন একটি ট্র্যাজেডি শ্রেণিভুক্ত করা হয়।
উল্লেখপঞ্জি
- Dunton-Downer ও Riding 2004।
- Boas 1910, পৃ. 344–408।
- Brockett ও Hildy 2007, পৃ. 109।
- Bryson 2007, পৃ. 99।
- Mowat ও Werstine 2013।
- Hoy 1992।
- Foakes 1997।
- "Shakespeare and the Tragic Virtue"। www.jsu.edu। ২০১৮-০৫-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৫-০৩।
গ্রন্থপঞ্জি
- Boas, Frederick S. (১৯১০)। Shakespere and his Predecessors। University manuals। John Murray। ওসিএলসি 939680633।
- Brockett, Oscar G.; Hildy, Franklin J. (২০০৭)। History of Theatre (9th সংস্করণ)। Boston: Pearson Education। আইএসবিএন 978-0205358786।
- Bryson, Bill (২০০৭)। Shakespeare: The World as Stage। Eminent Lives। New York: HarperCollins। আইএসবিএন 978-0-06-074022-1। ওসিএলসি 136782567।
- Dunton-Downer, Leslie; Riding, Alan (২০০৪)। Essential Shakespeare Handbook। New York: Dorling Kindersley। আইএসবিএন 978-0789493330।
- Foakes, R. A., সম্পাদক (১৯৯৭)। King Lear। Arden Shakespeare, third series। Cengage Learning। আইএসবিএন 1903436591।
- Hoy, Cyrus, সম্পাদক (১৯৯২)। Hamlet। Norton critical editions। New York: W. W. Norton & Company। আইএসবিএন 978-0-393-31642-1।
- Mowat, Barbara A.; Werstine, Paul, সম্পাদকগণ (২০১৩)। The Tragedy of Julius Caesar। New York: Folger Shakespeare Library। আইএসবিএন 978-1-4391-9671-7।
আরও পড়ুন
- Boyce, Charles (১৯৯০)। Shakespeare A to Z। New York: Roundtable Press। আইএসবিএন 0-440-50429-5।
- Greenblatt, Stephen, সম্পাদক (১৯৯৭)। The Norton Shakespeare (2nd সংস্করণ)। New York: W. W. Norton & Company। আইএসবিএন 978-0-393-92991-1।
- McEachern, Claire, সম্পাদক (২০১৩)। The Cambridge Companion to Shakespearean Tragedy। Cambridge Companions to Literature। Cambridge: Cambridge University Press। আইএসবিএন 978-0511999314। ডিওআই:10.1017/CCOL0521790093।