রিচার্ড স্টলম্যান
রিচার্ড ম্যাথিউ স্টলম্যান (ইংরেজি: Richard Matthew Stallman; জন্ম ১৯৫৩) ফ্রি সফটওয়্যার আন্দোলনের একজন কর্মী এবং প্রোগ্রামার, যিনি গ্নু প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সযমাধিক পরিচিত। তিনি সফটওয়্যারগুলো এমনভাবে বিতরণের জন্যে প্রচারাভিযান চালান যাতে ব্যবহারকারী এই সফটওয়্যারটি ব্যবহার, গবেষণা, বিতরণ এবং সংশোধন করার স্বাধীনতা পায়। এমন স্বাধীনতা নিশ্চিত করে এমন সফটওয়্যারকে ফ্রি সফটওয়্যার বলা হয়। স্টলম্যান গ্নু প্রকল্প চালু করেন, ফ্রি সফটওয়্যার ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন, গ্নু কম্পাইলার কালেকশন ও গ্নু ইম্যাকস তৈরি করেন, এবং তিনি গ্নু জেনারেল পাবলিক লাইসেন্স লিখেন।
রিচার্ড স্টলম্যান | |
---|---|
জন্ম | রিচার্ড ম্যাথিউ স্টলম্যান ১৬ মার্চ ১৯৫৩ |
অন্যান্য নাম | আরএমএস |
মাতৃশিক্ষায়তন | |
পেশা |
|
পরিচিতির কারণ | |
উপাধি | ফ্রি সফটওয়্যার ফাউন্ডেশনের সভাপতি |
পুরস্কার |
|
ওয়েবসাইট | stallman |
স্টলম্যান সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে সম্পূর্ণ ফ্রি সফটওয়্যারে নির্মিত একটি ইউনিক্স-সদৃশ অপারেটিং সিস্টেম তৈরী করার জন্যে গ্নু প্রকল্প চালু করেন। এটার সাথে সাথে তিনি ফ্রি সফটওয়্যার আন্দোলনেরও সূচনা করেন। তিনি গ্নু প্রকল্পের প্রধান স্থপতি এবং সংগঠক ছিলেন এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত গ্নু সফটওয়্যারের অনেকগুলো তিনি ডেভেলপ করেছিলেন, যার মধ্যে গ্নু কম্পাইলার কালেকশন, গ্নু ডিবাগার, এবং গ্নু ইম্যাকস টেক্সট এডিটর রয়েছে। অক্টোবর ১৯৮৫ সালে তিনি ফ্রি সফটওয়্যার ফাউন্ডেশন গঠন করেন।
স্ট্যালম্যান কপিলেফট ধারণাটি প্রবক্তা, যা কপিরাইট আইনের নীতিগুলো ব্যবহার করে ফ্রি সফটওয়্যার ব্যবহার, পরিবর্তন ও ডিস্ট্রিবিউটের অধিকার প্রদান করে। একই সাথে তিনি জিপিএলের মত, সর্বাধিক ব্যবহৃত লাইসেন্সগুলোর লেখক।
১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত লিগ ফর প্রোগ্রামিং ফ্রিডমের তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই, স্টলম্যান তার অধিকাংশ সময় ফ্রি সফটওয়্যারের সমর্থনে, সফটওয়্যার প্যাটেন্ট, ডিজিটাল রাইট ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য সিস্টেম, যেখানে তার মনে হয়েছে যে এটি ব্যবহারকারীর স্বাধীনতা হরণ করছে, তার বিরূদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে তার অধিকাংশ সময় কেটেছে। এখানের মধ্যে রয়েছে সফটওয়্যার লাইসেন্স চুক্তি, অপ্রকাশিত চুক্তি, এক্টিভেশন কি, কপি রেস্ট্রিকশন, মালিকানাধীন ফরম্যাট এবং সোর্স কোড বিহীন বাইনারি এক্সিকিউটেবল।
প্রাথমিক জীবন
রিচার্ড স্টলম্যান ১৯৫৩ সালের ১৬ মার্চ নিউ ইয়র্ক সিটিতে একটি ইহুদি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা ড্যানিয়েল স্টলম্যান একজন প্রিন্টিং প্রেস ব্রোকার এবং মা এলিস লিপম্যান একজন স্কুল শিক্ষিকা। স্টলম্যানের সাথে তার মা-বাবার সম্পর্ক খুব একটা ভাল ছিলো না, কারণ তার বাবা একজন নেশাগ্রস্থ লোক ছিলেন, যিনি প্রায়ই ছোটখাটো কারণে তার মায়ের গায়ে হাত তুলতেন। খুব অল্প বয়স থেকে তিনি কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি প্রথম প্রোগ্রামটি লিখেন হাই স্কুল উত্তীর্ণ হবার কিছুদিন পরে। তখন তিনি রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাগারে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতেন। তবে ইতিমধ্যে তার কর্মজীবন গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানের পথেই এগিয়ে গেছে, যদিও তার তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষকরা মনে করতেন তিনি হয়তো জীববিজ্ঞানেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবেন।
সত্যিকারের কম্পিউটারের সাথে তার প্রথম অভিজ্ঞতা আইবিএম নিউ ইয়র্ক সায়েন্টিফিক কেন্দ্রে, তখন তিনি একজন হাই-স্কুলের ছাত্র। তাকে ১৯৭০ সালে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখার জন্যে ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হয়, যা তিনি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সমাপ্ত করেন। তিনি তার বাকী সময়, আইবিএম সিস্টেম/৩৬০-তে এপিএল প্রোগ্রামিং ভাষায় পিএল/আই প্রোগ্রামিং ভাষার জন্যে একটি টেক্সট এডিটর লিখে কাটান।
হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও এমআইটি
প্রথম বর্ষের একজন ছাত্র হিসেবে ১৯৭০-এর শেষের দিকে স্টলম্যান ম্যাথ ৫৫ কোর্সে তার ভাল পারফরমেন্সের জন্যে পরিচিত ছিলেন। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি খুশি ছিলেনঃ "আমার মনে হলো, প্রথমবারের মত হারভার্ডে আমি আমার জায়গা করে নিলাম।"
১৯৭১ সালের জুন মাসে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণাগারে একজন প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। সেখানে তিনি হ্যাকার কম্যুনিটির সাথে পরিচিত হন এবং সেখানে তিনি নিয়মিত হয়ে উঠেন। এ কমুনিটিতে তিনি আরএমএস হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন, বর্তমানে তার কম্পিউটার একাউন্টের নাম হিসেবে এখনও তিনি এটি ব্যবহার করেন। তখন কম্পিউটার এবং এর নিরাপত্তা সম্পর্কে যারা খুব দক্ষ ছিলেন তাদেরকে হ্যাকার বলা হতো। হ্যাকিংয়ের যাত্রা শুরু এমএইটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণাগারেই। হ্যাকার হিসেবে তার বেশ কিছু আলোচিত ঘটনাও আছে। ১৯৭৭ সালে এমএইটির এআই গবেষণাগারে প্রত্যেক ছাত্রকে কম্পিউটারে লগইন করার জন্য আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ড দেয়া হয়। স্টলম্যানের এই পাসওয়ার্ডের শৃঙ্খল মোটেও পছন্দ হয় নি। তিনি পাসওয়ার্ড ভেঙ্গে সবার পাসওয়ার্ড তুলে দিয়ে সবাইকে ই-মেইলে জানিয়ে দিলেন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জনের মাধ্যমে তিনি স্নাতক হন। এর পর স্টলম্যান এমআইটি-তে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য ভর্তি হলেও কিছুদিন পর সেটা বাদ দেন। তবে এমআইটির ল্যাবে তিনি কাজ চালিয়ে গেছেন। এমআইটিতে থাকা অবস্থায় তিনি যেসব প্রকল্পে কাজ করেছেন তার মধ্যে টেকো, ইম্যাক্স ও লিস্প মেশিন অপারেটিং সিস্টেম অন্যতম।
গ্নু প্রকল্পের পেছনের ঘটনা
উজ্জীবিত হ্যাকার সংস্কৃতি যার মধ্যে স্টলম্যান বেড়ে উঠেছিলেন, আশির দশকের শুরুতে সে সংস্কৃতি ম্লান হতে থাকে। প্রতিদন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগিতার লক্ষ্যে সফটওয়্যার নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সফটওয়্যারের সোর্স কোড বিতরণ করা বন্ধ করে দিতে থাকে এবং একই সাথে কপিরাইটের মাধ্যমে সফটওয়্যাররের কপি বিতরণ করা থেকে ব্যবহারকারীদের বিরত করা শুরু করে। এ ধরনের মালিকানাধীন সফটওয়্যার আগেও ছিল, কিন্তু আশির দশকের শুরু থেকে এটিই মূল ধারায় পরিণত হওয়া শুরু করে। স্টলম্যানের সহকর্মী ব্রিস্টার কাহলের মতে এই ধারা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমেরিকার কপিরাইট আইন ১৯৭৬-এর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।[1]
যখন ব্রায়ান রেইড স্ক্রাইব মার্কআপ ভাষা ও এর ওয়ার্ড প্রসেসিং সফটওয়্যারে অনিবন্ধিত প্রবেশ রহিত করার জন্যে টাইম বোম্ব স্থাপন করেন, স্টলম্যান একে "মানবতার বিরুদ্ধে অন্যায়" বলে ঘোষণা করেন। ২০০৮ সালের একটি সাক্ষাতকারে তিনি জানান যে, সফটওয়্যারের জন্যে চার্জ করার বিষয়টি নয়, এটি ব্যবহারকারীর স্বাধীনতাকে হরণ করছে, যা একটি অন্যায়।
১৯৮০ সালের একদিন জেরক্স প্রিন্টার জেরক্স ৯৭০০-এর একটি ত্রুটি ঠিক করার জন্য স্টলম্যান এবং তার কয়েকজন সহকর্মী এর সফটওয়্যারের সোর্স কোড চাইলে এআই ল্যাব সোর্স কোড দিতে অস্বীকৃতি জানায়। স্টলম্যান ৫০ পাতার একটি জরুরী ফাইল প্রিন্ট করতে দিয়েছিলেন। লেজার প্রিন্টারটি ছিল অন্য তলায়। স্টলম্যান গিয়ে দেখেন প্রিন্টারের ট্রে-তে মাত্র চারটি পাতা পড়ে আছে, তাও অন্য আরেকজনের। তার ফাইলের একটা পাতাও প্রিন্ট হয়নি। জ়েরক্স ৯৭০০ মডেলের এই প্রিন্টারটি এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে বিনামূল্যে পাওয়া। স্টলম্যান এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রিন্টার সফটওয়্যারের সোর্স কোডে কিছু পরিবর্তন করতে চাইলেন, কিন্তু প্রিন্টার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি অনুসারে এমআইটির এআই ল্যাব সোর্স কোড দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এই ঘটনার ফলে তার উপলব্ধি দৃঢ়তর হয় যে, প্রত্যেক ব্যবহারকারীর সফটওয়্যার পরিবর্তন করার অধিকার থাকা উচিত।[2]
রিচার্ড গ্রিনব্ল্যাট, একজন এআই ল্যাব হ্যাকার, তার ও টম নাইটের ডিজাইনকৃত লিসপ মেশিন বাজারজাতকরণের জন্যে লিসপ মেশনস, ইনকর্পোরেটেড গঠন করেন। গ্রিনব্ল্যাট কোনরকমের বাইরের বিনিয়োগ গ্রহণ করতে চাচ্ছিলেন না, কারণ তার বিশ্বাস ছিলো, বিক্রির অর্থ দিয়ে কোম্পানির সম্প্রসারণ করা যাবে। অন্যদিকে, অন্যান্য হ্যাকারদের মনে হয়েছিলো, ভেঞ্চার-মূলধন অর্থায়ন পদ্ধতিটিই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো। যেহেতু কোন সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছিলো না, পরের দলটি রাফট নসকার, একজন এআই ল্যাব পরিচালকের সাহায্য নিয়ে সিম্বোলিকস গঠন করেন। সিম্বলিকস তারপর অনেক দক্ষ হ্যাকার, বিল গসপারসহ, তাদের কোম্পানিতে নিয়ে নেন। সিম্বোলিকস গ্রিনব্ল্যাটকে চাকরিতে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে। যদিও দুদলই মালিকানাধীন সফটওয়্যার বিতরণ করছিলো, স্টলম্যানের মনে হয়েছে, এলএমআই, সিম্বোলিকসের মত, ল্যাব কম্যুনিটিকে অতটা আঘাত করেনি। দুবছরের জন্যে, ১৯৮২-১৯৮৩, স্টলম্যান চেয়েছেন সিম্বোলিকসের প্রোগ্রামারদের আউটপুট ক্লোন করে, ল্যাব কম্পিউটারে তাদের একচ্ছত্রবাদ বন্ধ করতে।
স্টলম্যান জানান যে, সফটওয়্যার ব্যবহারকারীদের সফটওয়্যারটি তাদের প্রতিবেশীদের সাথে ভাগাভাগি, সোর্স কোড অধ্যয়ন, ও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করার অধিকার থাকা উচিত। মালিকানাধীণ সফটওয়্যারের মালিকদের ব্যবহারকারীদের এধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিষয়টিকে তিনি সমাজবিরুদ্ধ ও অনৈতিক বলে অভিহিত করেন। "সফটওয়্যার ওয়ান্টস টু বি ফ্রি", সফটওয়্যার মুক্ত হতে চায়, কথাটিকে অনেকে তার দর্শনের সাথে উল্লেখ করলেও, তিনি এর বিরোধিতা করেন। তার মতে, শুধু সফটওয়্যারের ক্ষেত্রেই নয়, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা উচিত।
১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে এমআইটি’র প্রোগ্রামারের চাকুরি ছেড়ে দেন এবং পুরো সময় গ্নু প্রকল্পে ব্যয় করতে থাকেন। গ্নু প্রকল্পের ঘোষণা অবশ্য আগের বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই দিয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি এমআইটির একজন অবেতনভুক্ত ভিজিটিং বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত আছেন।
গ্নু প্রকল্প
স্টলম্যান সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে আরপানেট মেইলিং লিস্ট ও ইউজনেটে গ্নু অপারেটিং সিস্টেমের পরিকল্পনার কথা জানান। প্রকল্পটি উনি নিজে নিজেই শুরু করেন, এবং জানান, একজন অপারেটিং সিস্টেম ডেভেলপার হিসেবে আমার কাজটির জন্যে সঠিক দক্ষতা রয়েছে। যদিও নিশ্চিতভাবে আমি এ কাজে সফল হবো না, আমার মনে হয়েছে, এ কাজটির জন্যে আমি নির্বাচিত হয়েছি। পোর্টেবল ও ইউনিক্স-ব্যবহারকারীদের জন্যে সহজ করার জন্যে আমি এটাকে ইউনিক্স-কম্পিট্যাবল করেছি।
১৯৮৫ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় গ্নু প্রকল্পের ইশতেহার । এই ইশতেহারে গ্নু প্রকল্পের বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরার পাশপাশি জানানো হয় ইউনিক্স-সদৃশ একটি মুক্ত অপারেটিং সিস্টেম তৈরির কথা। ইউনিক্সের মতো হলেও এই অপারেটিং সিস্টেমের সোর্স কোড বিতরণ ও পরিবর্তন করা যাবে। এছাড়াও মুক্ত সফটওয়্যার আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে সে বছরের ৪ অক্টোবর গঠন করেন ফ্রি সফটওয়্যার ফাউন্ডেশন নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। মুক্ত সফটওয়্যারের বিতরণ এবং রূপান্তর যেন কপিরাইটের হুমকির মুখে না পড়ে সেজন্য স্টলম্যান এক নতুন ধারণার জন্ম দেন, যার নাম ‘কপিলেফট’। কপিলেফটের ফলে একটি সফটওয়্যার স্বাধীনভাবে ব্যবহার করা ছাড়াও ব্যবহারকারী এর পরিবর্তন করতে পারবেন, এমনকি এই সফটওয়্যারকে রূপান্তর করে একটি নতুন সফটওয়্যারও তৈরি করা যাবে। এজন্য কারো অনুমতি নিতে হবে না। স্টলম্যানের মতে কপিরাইটের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়, আর অন্যদিকে কপিলেফট ব্যবহারকারীর স্বাধীনতা বজায় রাখতে সদা সচেষ্ট। তবে এর মূল উন্নয়নকারীর অবদান যেন ক্ষুণ্ণ না হয় সেজন্য কিছু শর্তও থাকে। ১৯৮৯ সালে তার প্রথম প্রোগ্রাম থেকে স্বাধীন গ্নু জেনারেল পাবলিক লাইসেন্স মুক্তি পায়। তারপরই, গ্নু ব্যবস্থার অধিকাংশ অংশ সম্পন্ন হয়েছে।
নব্বই দশকের শুরু। গ্নু অপারেটিং সিস্টেম উন্মুক্ত হবার অপেক্ষায়। তবে এর একটি বড় অংশ তখনও বাকী, আর সেই অংশটি হলো অপারেটিং সিস্টেম কার্নেল। সেই কাজটিকে সহজ করে দেন ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিনুস তোরভাল্দস। ইউনিক্সভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম "মিনিক্স" নিয়ে শখের বশে কাজ করতে করতে ১৯৯১ সালের মার্চ মাসে লিনুস তৈরি করে ফেলেন একটি অপারেটিং সিস্টেম কার্নেল। ফলে গ্নু অপারেটিং সিস্টেমের কার্নেল হিসেবে একেই বেছে নেয়া হয়, জন্ম নেয় মুক্ত সফটওয়্যার যুদ্ধের সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র- "লিনাক্স"। লিনুসের নামানুসারেই এর নামকরণ করা হয়। ফলে অনেকেই ধারণা করে বসেন লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের পুরোটাই বোধহয় লিনুসের তৈরি করা। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে লিনাক্স হচ্ছে অপারেটিং সিস্টেমের কার্নেল। লিনাক্স আসার পরপরই মুক্ত সফটওয়্যার আন্দোলন একটি নতুন মাত্রা পায়। উন্মুক্ত সোর্সকোড ভিত্তিক এই অপারেটিং সিস্টেম কম্পিউটার ব্যবহারকারী এবং প্রোগ্রামারদের সামনে নতুন দ্বার উন্মোচন করে।
কর্মতৎপরতা
স্টলম্যান ফ্রি সফটওয়্যার নিয়ে অনেকগুলো নিবন্ধ লিখেছেন। এবং ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিক থেকে ফ্রি সফটওয়্যার আন্দোলনের জন্যে রাজনৈতিক ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছেন। তার দেয়া বক্তব্যগুলোর শিরোনাম থাকে, "গ্নু প্রকল্প ও ফ্রি সফটওয়্যার আন্দোলন", "সফটওয়্যার প্যাটেন্টের ভয়াবহতা", "কম্পিউটার নেটওয়ার্কের যুগে কপিরাইট ও কম্যুনিটি"। ২০০৬ ও ২০০৭ সালে পাবলিক কন্সাল্টিং এর ১৮তম মাসের সময় গ্নু জেনারেল পাবলিক লাইসেন্সের তৃতীয় সংস্করণের খসড়া তৈরীর সময় তিনি চতুর্থ বিষয়টি যোগ করেন।
লিনুস তোরভালদস স্টলম্যানের এমন চিন্তাধারাকে শাদা-কালো চিন্তা অভিহিত করে সমালোচনা করেন।
স্টলম্যানের ফ্রি সফটওয়্যারের প্রতি সমর্থন ভার্চুয়াল রিচার্ড স্টলম্যান সফটওয়্যার তৈরীতে উৎসাহ যোগায়, যেটি ডেবিয়ান গ্নু/লিনাক্স ব্যবস্থায় ইন্সটলকৃত সফটওয়্যারগুলো এনালাইজ করে এবং যেগুলো নন-ফ্রি ট্রি থেকে এসেছে সেগুলো সম্পর্কে রিপোর্ট করে। ডেবিয়ানের ফ্রি সফটওয়্যারে যে সংজ্ঞা করে রয়েছে, তার কিছু অংশ সম্পর্কে স্টলম্যানের দ্বিমত রয়েছে।
১৯৯৯ সালে স্টলম্যান ফ্রি অনলাইন এনসাইক্লোপিডিয়ার কথা জানান, যেখানে সবাই তার নিজের নিবন্ধ দিয়ে অবদান রাখবে। যার ফলাফলস্বরূপ জন্ম হয় গ্নুপিডিয়ার। যদিও তৎকালীন উইকিপিডিয়ার একইরকম উদ্দেশ্য ও অধিকতর সফলতাকে লক্ষ্য করে এ প্রকল্প পরবর্তীতে বন্ধ করে দেয়া হয়।
স্টলম্যান একজন বিশ্ব ভ্রমণকারী, উনি এ পর্যন্ত ৬৫টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। অধিকাংশ দেশই তিনি ভ্রমণ করেছেন, ফ্রি সফটওয়্যার ও গ্নু প্রকল্প নিয়ে কথা বলতে। স্টলম্যান মহাত্মা গান্ধীর মতবাদের সাথে ফ্রি সফটওয়্যার আন্দোলনের সাদৃশ্য খুঁজে পান।
ভ্যানিজুয়েলায় স্টলম্যান লোকসম্মুখে বক্তব্য দিয়েছেন এবং রাষ্ট্রের তেল কোম্পানি, মিউনিসিপ্যাল সরকার এবং মিলিটারিতে ফ্রি সফটওয়্যার পরিগ্রহণের প্রচারণা চালান। হুগো চাভেজের সাথে সাক্ষাতে এবং বক্তৃতায়, স্টলম্যান টেলিভিশন প্রচার, মুক্ত বক্তব্য অধিকার, এবং গোপনীয়তার উপর কিছু নীতির সমালোচনা করেন। ল্যাটিন আমেরিকান টেলিভিশন কাউন্সিলের এডভাইজরি কাউন্সিলে তিনি এর প্রথম দিন থেকেই ছিলেন। কিন্তু ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় গাদ্দাফী পরপরবর্তী মিথ্যা সংবাদের সমালোচনা করে তিনি ইস্তফা দেন।
২০০৬ সালে ভারতের কেরালা প্রদেশের সরকারের সাথে তার সাক্ষাতের সময়, তিনি কর্মকর্তাদের মালিকানাধীন সফটওয়্যার ব্যবহার না করতে প্ররোচিত করেন। যার ফলে, ১২,৫০০ হাইস্কুলের কম্পিউটারগুলোয় মাইক্রোসফট উইন্ডোজের বদলে ফ্রি ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম ইন্সটল করার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এরপর স্টলম্যান ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম, ফ্রান্সের ২০০৭ সালের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সেগোলেন রয়্যাল, এবং ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরিয়র ফ্রি সফটওয়্যার আন্দোলনে ইতিবাচক ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন।
১৯৮৮ সালে অ্যাপল যখন মাইক্রোসফট এবং এইচপির বিরুদ্ধে লুক এন্ড ফিল নকলের মামলা করেন, স্টলম্যান অ্যাপলের পণ্য বর্জনের ডাক দেন। এ বর্জন ১৯৯৫ সালে তুলে নেয়া হয়। [3]
অ্যাপলের ক্লোজড সোর্স সফটওয়্যার উন্নয়নে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে, স্টলম্যান মনে করেন কম্পিউটিঙে স্টিভ জবসের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে।
কিছুদিনের জন্যে স্টলম্যান লিব্রেবুট (মুক্ত বায়োস বিকল্প) ও ট্রিস্কল গ্নু/লিনাক্স সংবলিত একটি রিফারবিশড থিংকপ্যাড টি৪০০এস ব্যবহার করেছেন। [4] তার আগে তিনি থিংকপ্যাড এক্স৬০ ব্যবহার করতেন। তারও আগে তিনি লিমোট ইয়েলুং নেটবুক ব্যবহার করতেন।
কপিরাইট হ্রাস
স্টলম্যান বিভিন্ন বক্তব্যে ও তার ওয়েব সাইটে কপিরাইট ও কম্যুনিটি নিয়ে কথা বলেন। ডিজিটাল কপিরাইট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেন। এছাড়াও তিনি তার বর্জন করা পণ্য নিয়েও কথা বলেন।
নজরদারি প্রতিরোধ
স্টলম্যান হুইশেল ব্লোয়ার জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ [5] এবং এডওয়ার্ড স্নোডেনের প্রশংসা করেন। ২০১৩ সালে স্নোডেন যখন গোপন তথ্য ফাস করে, তখন তিনি তার পক্ষ নেন।
সমালোচনা
জেফরি এপস্টেইনের আক্রমণের শিকার নারীদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় সমালোচিত ও ফ্রি সফটওয়্যার ফাউন্ডেশন পর্ষদ থেকে বহিষ্কৃত হন। কিন্তু ১৮ মাস পরে পুনর্বহাল হলে অনেক দাতা অনুদান দেওয়া বন্ধ করে।[6][7][8]
নির্বাচিত প্রকাশনা
- সারগ্রন্থ
- স্টলম্যান, রিচার্ড এম (১৯৮০)। EMACS: The Extensible, Customizable, Self-Documenting Display Editor। ক্যামব্রিজ ম্যাসাচুসেটস: এমআইটি: এমআইটি আর্টিফিশিয়াল ল্যাবেরেটরি পাবলিকেশন। এআইএম-৫১৯এ।
- স্টলম্যান, রিচার্ড এম (২০০২)। GNU Emacs Manual। বোস্টন, ম্যাসাচুসেটস: গ্নু প্রেস। আইএসবিএন 1-882114-85-X।
- স্টলম্যান, রিচার্ড এম; ম্যাকগ্রেথ, রোল্যান্ড; এবং স্মিথ, পল ডি (২০০৪)। GNU Make: A Program for Directed Compilation। বোস্টন, ম্যাসাচুসেটস: গ্নু প্রেস। আইএসবিএন 1-882114-83-3।
- নির্বাচিত প্রবন্ধ
- স্টলম্যান, রিচার্ড এম (২০১৫)। Free Software, Free Society: Selected Essays of Richard M. Stallman (পিডিএফ) (তৃতীয় সংস্করণ)। বোস্টন, ম্যাসাচুসেটস: গ্নু প্রেস। আইএসবিএন 978-0-9831592-5-4।
তথ্যসূত্র
- রবার্ট এক্স ব্রুস্টার কাহেলের সাথে ক্রিশ্চিয়ালি সাক্ষাৎকার, ৪৫ মিনিটের সময়
- উইলিয়ামস, স্যাম (২০০২)। ফ্রি এজ ইন ফ্রিডমঃ রিচার্ড স্টল্ম্যান্স ক্রুসেড ফর ফ্রি সফটওয়্যার। ও'রেইলি মিডিয়া। আইএসবিএন ০-৫৯৬-০০২৮৭-৪। অধ্যায় ১. ও'রেইলি সংস্করণ এবং হালনাগাদকৃত এফএয়আইএফজিলা সংস্করণ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে উভয় প্রাথমিক জিএফডিএল এর অধীনে উপলব্ধ
- "গ্নু এর বুলেটিন, ভলিউম ১ নাম্বার ১৮ - গ্নু প্রকল্প - ফ্রি সফটওয়্যার ফাউন্ডেশন"। Gnu.org। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ২৭, ২০১৫।
- "আমি যেভাবে আমার কম্পিউটিং করি"। stallman.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৯-১৬।
- "'এখন গোপনীয়তা জন্য যুদ্ধ যোগ দিন!' স্নোডেনের স্টলম্যান এবং কীভাবে নজরদারি থেকে পালাতে হয়"। আরটি নিউজ। জুলাই ১৭, ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ১৭, ২০১৪।
- "Free Software Foundation leaders and supporters desert sinking ship"। ZDNet (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৮-১২।
- Brodkin, Jon (২০২১-০৩-২২)। "Richard Stallman returns to FSF 18 months after controversial rape comments"। Ars Technica (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৮-১২।
- Salter, Jim (২০২১-০৩-২৯)। "Red Hat withdraws from the Free Software Foundation after Stallman's return"। Ars Technica (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৮-১২।
বহিঃসংযোগ
- প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট
- কার্লিতে রিচার্ড স্টলম্যান (ইংরেজি)
- গ্নু প্রকল্পের দর্শনের উপর নিবন্ধ , প্রায় সবগুলোই স্টলম্যানের লিখা
- গুটেনবের্গ প্রকল্পে রিচার্ড স্টলম্যান-এর সাহিত্যকর্ম ও রচনাবলী (ইংরেজি)
- ইন্টারনেট আর্কাইভে রিচার্ড স্টলম্যান কর্তৃক কাজ বা সম্পর্কে তথ্য
- ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে রিচার্ড স্টলম্যান (ইংরেজি)