ভারতীয় জনতা পার্টি

বিজেপির উৎস হলো ভারতীয় জনসংঘ নামে একটি রাজনৈতিক দল। এই দলটি ‘জনসংঘ’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯৫১ সালে ভারতের রাজনীতিতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাধান্যের বিরোধিতা করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সহযোগিতায় এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সাধারণভাবে এই দলটি আরএসএস-এর রাজনৈতিক শাখা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।[9] জনসংঘের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ‘হিন্দু’ সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করা। সেই সঙ্গে এই দল অভিযোগ এনেছিল ভারতের তদনীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ভারত ও নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের মুসলমানদের তোষণ করছে। জনসংঘ তাদের এই অভিযোগের প্রেক্ষাপটে নেহেরুর তোষণনীতির বিরোধিতা করত। সদ্য-গঠিত জনসংঘের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করার জন্য আরএসএস তাদের একাধিক প্রধান প্রচারকদের পাঠিয়েছিল এই দলের কাজে। এঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন দীনদয়াল উপাধ্যায়। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জনসংঘ সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় মাত্র তিনটি আসন জয় করেছিল। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত সংসদে এই দলের প্রতিনিধি সংখ্যা ছিল নগন্য।[10][11]

জনসংঘের প্রথম প্রধান প্রচার অভিযান শুরু হয়েছিল ১৯৫৩ সালের গোড়ার দিকে। দলের দাবি ছিল জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সম্পূর্ণ ভারভভুক্তি,এক দেশ~এক আইন।[12] ১৯৫৩ সালের মে মাসে জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কাশ্মীরে প্রবেশ করার জন্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কে আটক করা হয়। পরের মাসে তার রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। অনেকের মতে তাকে নেহরু সরকার ধরা পরিকল্পিত হত্যা করা হয়[12] শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্থলে দলের সাধারণ সম্পাদক হন মৌলীচন্দ্র শর্মা। যদিও আরএসএস-এর চাপে তাকে সরে যেতে হয়। দীনদয়াল উপাধ্যায় দলের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনিই দলের সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন ছিলেন। তিনিই আরএসএস-এর ছত্রছায়ায় দলের তৃণমূল স্তরের সংগঠন গড়ে তোলেন। জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়ে দল প্রচারকাজের দিকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। দীনদয়াল উপাধ্যায় ছিলেন একাত্ম মানবতাবাদ আদর্শের প্রবক্তা। এটিই দলের আনুষ্ঠানিক মতাদর্শ ছিল।[13] এই সময় অটলবিহারী বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আডবাণী দলের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের পর অটলবিহারী বাজপেয়ী দলের সভাপতি হন। এই সময়ের দলের প্রধান দাবিগুলি ছিল ভারতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তন, গোহত্যা নিষিদ্ধকরণ, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বিলোপ।[14]

১৯৬৭ সালের দেশে বিধানসভা নির্বাচনগুলির পর স্বতন্ত্র পার্টি ও বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দলগুলির সঙ্গে জনসংঘ জোট বাঁধে। এই সময় এই জোট মধ্যপ্রদেশ, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি হিন্দিবলয়ের রাজ্যগুলিতে সরকার গঠন করে। সেই প্রথম জনসংঘ সরকারে আসে। যদিও সেই সরকারগুলি ছিল জোট সরকার।

১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেন। জনসংঘ জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামে। এই সময় অন্যান্য দলের প্রতিবাদীদের সঙ্গে জনসংঘেরও কয়েক হাজার কর্মী কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হয় এবং সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সোশ্যালিস্ট পার্টি, কংগ্রেস (ও) ও ভারতীয় লোক দল সহ কয়েকটি দলের সঙ্গে একত্রিত হয়ে জনসংঘ জনতা পার্টি গঠন করে। এই দলের প্রধান এজেন্ডা ছিল ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যুত করা।[11]

১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনতা পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে মোরারজি দেসাইয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে সরকার গঠন করে। জনতা পার্টির সংসদীয় দলে পূর্বতন জনসংঘের সদস্যদের সংখ্যাই বেশি ছিল। উক্ত দল থেকে ৯৩ জন সদস্য লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। যা জনতা পার্টির মোট সদস্যের ৩১% ছিল। পূর্বতন জনসংঘের নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী এই সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন।[15]

পূর্বতন জনসংঘের জাতীয় নেতৃবৃন্দ সচেতনভাবেই জনসংঘের রাজনৈতিক পরিচয় পরিত্যাগ করে জনতা পার্টির রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়েছিলেন। জনতা পার্টির আদর্শ ছিল গান্ধীবাদী ও হিন্দু ঐতিহ্যবাদী আদর্শ। ক্রিস্টোফ জ্যাফরেলটের মতে, এটি একটি অসম্ভব একত্রীকরণ প্রমাণিত হয়।[16] জনসংঘের রাজ্য ও স্থানীয় স্তরের নেতৃবৃন্দ আপেক্ষিকভাবে অপরিবর্তিত থেকে যান। এঁরা আরএসএসের সঙ্গে তাদের দৃঢ় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি। আরএসএসও জনতা পার্টির মধ্য-দক্ষিণপন্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খায়নি।[17] জনতা পার্টির শাসনকালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৮-৭৯ সালে আলিগড় ও জামশেদপুরের দাঙ্গায় পূর্বতন জনসংঘের সদস্যরা জড়িয়ে পড়েছিলেন। জনতা পার্টির অন্য প্রধান শাখাগুলি দাবি করতে থাকে জনসংঘ আরএসএসের সংশ্রব ত্যাগ করুক। কিন্তু জনসংঘ তা করতে অস্বীকার করে। এরপর জনতা পার্টির একাংশ দলত্যাগ করে জনতা পার্টি (সেক্যুলার) গঠন করে। মোরারজি দেসাই সরকার সংসদে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। ফলে মোরারজি দেসাই পদত্যাগ করেন। এরপর কিছুকাল জোট সরকারের শাসনের পর ১৯৮০ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে জনতা পার্টি খুবই খারাপ ফল করে। এই নির্বাচনে জনতা পার্টি ৩১টি আসন জয় করেছিল। ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে নির্বাচনের কিছুদিন পরেই জনতা পার্টির জাতীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ দলের সেই সব সদস্যদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, যাঁরা দল ও আরএসএসের দ্বৈত সদস্যপদ রক্ষা করছিলেন। এরপরই পূর্বতন জনসংঘের সদস্যরা ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ নামে নতুন একটি দল গঠন করেন।[18][15]

নবগঠিত বিজেপি কার্যত জনসংঘের থেকে আলাদা দল হলেও, বিজেপির অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন পূর্বতন জনসংঘের সদস্য। এমনকি জনসংঘের সদস্য অটলবিহারী বাজপেয়ী বিজেপির প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহা লিখেছেন, ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকটিতে ভারতে অনেকগুলি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল। বিজেপি গোড়ার দিকে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য জনসংঘের হিন্দু জাতীয়তাবাদী অবস্থান সম্পর্কে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে এবং জনতা পার্টি ও গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্রের সঙ্গে এই দলের যোগসূত্রটির দিকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করে।[2] এই পদ্ধতিটি সফল হয়নি। ১৯৮৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি লোকসভায় মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল।[2] এই নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সংঘটিত ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বিরাট জনসমর্থন লাভে সক্ষম হয়। ফলে বিজেপির সাংসদ সংখ্যা কমে যায় এবং কংগ্রেস ৪০৩টি আসনে জয়লাভ করে।[19]

প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা

অটলবিহারী বাজপেয়ী, প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী (১৯৯৮-২০০৪)

লালকৃষ্ণ আডবাণী, বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় উপপ্রধানমন্ত্রী ও রাম জন্মভূমি আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি

অটলবিহারী বাজপেয়ীর মধ্যপন্থী নীতি ব্যর্থ হওয়ার পর বিজেপি আবার কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী অবস্থানে ফিরে আসে।[20][21] ১৯৮৪ সালে লালকৃষ্ণ আডবাণী দলের সভাপতি হন। তার নেতৃত্বে বিজেপি রাম জন্মভূমি আন্দোলনের রাজনৈতিক মুখপাত্রে পরিণত হয়। ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ চত্বরে সনাতন ধর্মানুসারে পরমেশ্বর ভগবানের ত্রেতা যুগের অবতার শ্রী রামের মন্দির নির্মাণের জন্য আন্দোলন শুরু করে। ১৫২৭ সালে মুঘল সম্রাট বাবর উক্ত মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। কোনো কোনো মতে, এই মসজিদ গঠনের আগে ওই স্থানে একটি মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল। যদিও এই মতটি বিতর্কিত।[22] আদোলনকারীদের বক্তব্য ছিল, বাবরি মসজিদ চত্বরটি আসলে রামের জন্মস্থান। একটি মন্দির ধ্বংস করেই বাবরি মসজিদ গঠিত হয়েছে।[23] বিজেপি এই আন্দোলনকে সমর্থন করে এবং এই আন্দোলনকে তাদের নির্বাচনের ইস্যু করে। ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৮৯টি আসন লাভ করে। এই নির্বাচনের পর গঠিত বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে গঠিত জাতীয় ফ্রন্ট সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহকারী দল হয় বিজেপি।[24]

১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লালকৃষ্ণ আডবাণী রাম মন্দির আন্দোলনের সমর্থনে অযোধ্যার দিকে ‘রথযাত্রা’ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। রামচন্দ্র গুহর মতে, এই রথযাত্রা কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য ছিল ‘ধর্মীয়, পরোক্ষ, পৌরুষদীপ্ত’। এই কর্মসূচি চলাকালীন একটি বক্তৃতায় লালকৃষ্ণ আডবাণী বলেন, সরকার মুসলিম-তোষণ নীতি গ্রহণ করে ‘ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতা’র আড়ালে হিন্দুদের আইনসম্মত অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করছে।[25] তিনি কর্মসূচির সমর্থনে বলেন, এটি সোমনাথ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত চলা একটি স্বতঃস্ফুর্ত কর্মসূচি এবং এর পরবর্তী হিংসাত্মক ঘটনাগুলির দায় ইংরেজি সংবাদমাধ্যমগুলির।[26] বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব লালকৃষ্ণ আদভানি বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। যদিও বহুসংখ্যক করসেবক অযোধ্যায় জড়ো হন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব দেড় লক্ষ করসেবককে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন। কিন্তু করসেবকদের একটি অংশ অযোধ্যায় ঢুকে পড়ে এবং মসজিদটি আক্রমণ করে। তিন দিন ধরে আধা-সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বেশ কিছু করসেবকের মৃত্যু ঘটে এবং এই মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ভিএচপি উত্তরপ্রদেশ জুড়ে মুসলমানেদের আক্রমণ করে।[27] বিজেপি বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেয়। এর ফলে দেশে পুনরায় নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে বিজেপির সাংসদ সংখ্যা বেড়ে হয় ১২০ এবং উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।[28]

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর আরএসএস ও তার সহযোগী সংগঠনগুলি এক লক্ষেরও বেশি ভিএইচপি ও বিজেপি কর্মীকে বাবরি মসজিদ চত্বরে জড়ো করে।[28] এই সমায়েতে কি পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। কিন্তু সমবেত জনতা উন্মত্তের মতো মসজিদটিকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়।[28] এর পরের সপ্তাহগুলিতে সারা দেশে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা বাধে এবং সেই দাঙ্গায় দু হাজারেরও বেশি লোক নিহত হন,এবং এই মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ উগ্র মুসলিমরা বাংলাদেশ,পাকিস্তানে হাজারো মন্দির,হিন্দু বাড়িঘর এ হামলা করে ও ধ্বংসপ্রাপ্ত করে এবং উপমহাদেশে একটি করুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়,সরকার ভিএইচপি-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। লালকৃষ্ণ আডবাণী সহ বেশ কিছু বিজেপি নেতা গ্রেফতার হন দাঙ্গায় প্ররোচনামূলক বক্তৃতা দেওয়ার জন্য।[29][30]

বিচারপতি মনমোহন সিং লিবারহানের নেতৃত্বাধীন লিবারহান কমিশন রিপোর্টে (২০০৯) বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য ৬৮ জন ব্যক্তিকে দায়ী করে। এঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন বিজেপি নেতা।[30] এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলী মনোহর যোশী। রিপোর্টে উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়েরও সমালোচনা করা হয়।[30] রিপোর্টে বলা হয়, কল্যাণ সিং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় এমন কিছু সরকারি আধিকারিক ও পুলিশ আধিকারিককে নিযুক্ত করেছিলেন, যাঁরা মসজিদ ধ্বংসের সময় কোনো ব্যবস্থাই নেননি।[30] লালকৃষ্ণ আডবাণীর নিরাপত্তায় নিযুক্ত ভারতীয় পুলিশ কৃত্যক আধিকারিক অঞ্জু গুপ্ত কমিশনের প্রধান সাক্ষ্য হয়েছিলেন। তিনি বলেন, লালকৃষ্ণ আডবাণী ও মুরলী মনোহর যোশী প্ররোচনামূলক বক্তৃতা দিয়ে জনতাকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিলেন।[31]

সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে ইস্যু করে বিজেপি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে লোকসভায় ১৬১টি আসন জিতে বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।[32] অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু লোকসভায় আস্থা ভোটে জয় লাভ করতে না পেরে ১৩ দিনের মধ্যে সরকারের পতন হয়।[32]

২০০৭ সালে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। অটলবিহারী বাজপেয়ীর শাসনকালে ভারত-রাশিয়া প্রতিরক্ষা সম্পর্ক পুনরায় শক্তিশালী হয়। এই সময় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল।[33]

১৯৯৬ সালে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের একটি জোট সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু এই জোট ছিল ক্ষণস্থায়ী। তাই ১৯৯৮ সালে অন্তর্বর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিজেপি একটি জোটের নেতৃত্ব দেয়। এই জোটটির নাম জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট বা এনডিএ। এই জোটের অন্যান্য দলগুলি ছিল সমতা পার্টি, শিরোমণি অকালি দল ও শিবসেনা। এই দলগুলি এখনও এনডিএ-র সদস্য। এছাড়া এই জোটের অন্তর্ভুক্ত হয় অল ইন্ডিয়া দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কড়গম (এআইএডিএমকে) ও বিজু জনতা দল। এই সব দলের মধ্যে একমাত্র শিবসেনার রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে বিজেপির আদর্শের মিল আছে। অমর্ত্য সেন তাই এই জোটকে বলেছিলেন ‘তদর্থক’ জোট।[34][35] তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) এই জোটকে বাইরে থেকে সমর্থন করে। এর ফলে এনডিএ জোট সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হন।[36] কিন্তু ১৯৯৯ সালে এআইএডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা জোটের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে সরকারের পতন ঘটে এবং পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।[37]

১৯৯৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর এআইএডিএমকে-র সমর্থন ছাড়াই এনডিএ জোট সংসদে ৩০৩টি আসন লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জোটে বিজেপির একক সাংসদ সংখ্যা ছিল ১৮৩। অটলবিহারী বাজপেয়ী তৃতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন। লালকৃষ্ণ আডবাণী হন উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই এনডিএ সরকারটি ছিল পাঁচ বছরের পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সরকার। এনডিএ জোট সরকার প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নব্য-উদারপন্থা গ্রহণ করে।[38]

২০০১ সালে তৎকালীন বিজেপি সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে ১০০,০০০ টাকা ঘুষ নেওয়ার একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়।[39] ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য হ্যান্ড-হেল্ড থার্মাল ইমেজার কেনার সুপারিশ-সংক্রান্ত একটি বিষয়ে তিনি ঘুষ নিচ্ছিলেন। তেহেলকা সাংবাদিকরা একটি স্টিং অপারেশন চালিয়ে তাকে ধরেন।[40][41] বিজেপি বাধ্য হয়ে তাকে পদত্যাগ করতে বলেন এবং পরবর্তীকালে তার বিচার হয়। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে তার চার বছরের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের ১ মার্চ তিনি মারা যান।[42]

২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গোধরা শহরের বাইরে মুসলমানেরা হিন্দু তীর্থযাত্রীবাহী একটি ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করেছিল। এই অগ্নিকাণ্ডে শিশুসহ ৫৯ জনের মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনাটিকে হিন্দুদের উপর আক্রমণ ধরে নিয়ে গুজরাত রাজ্যের কয়েকটি জেলায় মুসলমান-বিরোধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক সপ্তাহ ধরে এই দাঙ্গা চলে।[43] এই দাঙ্গায় ২০০০ জন মারা যান এবং ১৫০,০০০ জন গৃহচ্যুত হন।[44] ধর্ষণ, অঙ্গচ্ছেদ ও অত্যাচারের ঘটনাও ঘটতে থাকে।[44][45] গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিকদের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ ওঠে। পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে দাঙ্গাকারীদের পরিচালনা করার এবং তাদের হাতে মুসলমান-অধিকৃত সম্পত্তির তালিকা তুলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।[46] ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গুজরাতের দাঙ্গার ঘটনাগুলির দ্রুত তদন্তের জন্য বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করে। ২০১২ সালে সিট দাঙ্গার অভিযোগ থেকে নরেন্দ্র মোদীকে অব্যহতি দেয়। বিজেপি বিধায়ক তথা নরেন্দ্র মোদীর গুজরাত মন্ত্রিসভার ক্যাবিনেট সদস্য মায়া কোডনানিকে একটি দাঙ্গায় প্রত্যক্ষভাবে মদত দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। তার ২৮ বছরের কারাদণ্ড হয়।[47][48] পল ব্রাস, মার্থা নাসবম ও দীপঙ্কর গুপ্ত প্রমুখ গবেষকদের মতে, এই দাঙ্গার পিছনে সরকারের যথেষ্ট হাত ছিল।[49][50][51]

২০০৪ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী নির্ধারিত সময়ের ছয় মাস আগেই সাধারণ নির্বাচনের ডাক দেন। এই নির্বাচনে এনডিএ-র প্রচার অভিযানের ভিত্তি ছিল ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ শ্লোগানটি। এই শ্লোগানটির মাধ্যমে বিজেপি দাবি করে দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক রূপান্তরের কৃতিত্ব বাজপেয়ী সরকারের।[52] কিন্তু এই নির্বাচনে এনডিএ অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজিত হয়। এনডিএ এই নির্বাচনে ১৮৬টি আসন লাভ করে। অন্যদিকে কংগ্রেস ও তার সহযোগী দলগুলি পায় ২২২টি আসন। মনমোহন সিং সংযুক্ত প্রগতিশীল জোটের নেতা হিসেবে অটলবিহারী বাজপেয়ীর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। এনডিএ-র পরাজয়ের কারণ ছিল গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছাতে না পারা। বিজেপির বিবাদ-সৃষ্টিকারী নীতিগুলিও এই পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল বলে মনে করা হয়।[52][53]

২০০৮ সালের মে মাসে বিজেপি কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে। এটিই ছিল দক্ষিণ ভারতের কোনো রাজ্যে বিজেপির প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ। ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির লোকসভার আসন সংখ্যা কমে হয় ১১৬। ২০১৩ সালে কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি পরাজিত হয়।[54]

২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি ২৮২টি আসন লাভ করে এবং লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে এনডিএ ৩৩৬টি আসন পায়।[55] ২০১৪ সালের ২৬ মে বিজেপির সংসদীয় দলের নেতা নরেন্দ্র মোদী ভারতের ১৫শ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।[56][57]

মোট প্রদত্ত ভোটের মধ্যে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৩১%; যা বিজেপির বিজিত আসনের সংখ্যার তুলনায় আপেক্ষিকভাবে কম।[58] ১৯৮৪ সালের পর এই প্রথম কোনো রাজনৈতিক দল একক ক্ষমতায় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে[59] এবং প্রথম বার লোকসভায় একক শক্তিতে সরকার গঠন করে। বিজেপির জনসমর্থনের ভিত্তি ছিল হিন্দি-ভাষী উত্তর-মধ্য ভারত।[58] বিজেপির জয়ের বিশালতা অধিকাংশ মতামত বা বুথ-ফেরত সমীক্ষার মাধ্যমেও অনুমান করা যায়নি।[58]

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিজেপির জয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা এবং আগের মেয়াদে কংগ্রেসের দুর্নীতির ইস্যুগুলিকে ।[60] বিজেপি দলের চিরকালীন উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্ত সমর্থনের ভিত্তিটিকে ধরে রেখে মধ্যবিত্ত, দলিত ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষদের সমর্থন পেতে সমর্থ হয়েছিল।[61][58] মুসলমানেদের মধ্যে বিজেপির সমর্থনের হার কম। মুসলমান ভোটারদের মাত্র ৮% বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন।[61][58] ভোটারদের সংগঠিত করতে এবং তাদের মধ্যে থেকে ভোটার টার্ন-আউট বাড়াতেও বিজেপি সমর্থ হয়েছিল ।[58]

বিজেপির আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দর্শন হলো একাত্ম মানবতাবাদ। ১৯৬৫ সালে দীনদয়াল উপাধ্যায় প্রথম এই মতবাদ প্রচার করেছিলেন। দীনদয়াল উপাধ্যায় এই দর্শনকে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, এটি ‘এমন এক স্বদেশি অর্থনৈতিক মডেলের পক্ষপাতী যা মানুষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে।’[72][73] এই মতবাদ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামোদর সাভারকর প্রচারিত হিন্দুত্ব মতবাদের অনুগামী। দলের মতে হিন্দুত্ব হলো পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এমন এক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ যা ভারতীয় সংস্কৃতির পক্ষপাতী এবং ধর্মনির্বিশেষে সকল ভারতীয়কে এক ছাতার তলায় আনতে সক্ষম।[2] যদিও গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হিন্দুত্ব আদর্শের উদ্দেশ্য ছিল অন্য ধর্মগুলিকে বাদ দিয়ে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং সেই অর্থে বিজেপিও একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল।[28][2][74][75] ১৯৯৮ সালে এনডিএ সরকার গঠনের পর বিজেপি এই বিষয়ে কিছুটা মধ্যপন্থা গ্রহণ করে। কারণ জোটে অন্যান্য যেসব দল ছিল তাদের আদর্শ কিছুটা ভিন্ন ধরনের ছিল।[28][38]

বিজেপির হিন্দুত্ব আদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে বিজেপি সরকারের বিভিন্ন নীতিতে। বিজেপি বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের পক্ষপাতী।[74] ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে এটিই ছিল বিজেপির প্রধান ইস্যু।[74] যদিও ১৯৯২ সালে বিজেপির একটি মিছিল চলাকালীন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর বিজেপির জনপ্রিয়তা কিছুটা হ্রাস পায়। এর পর মন্দির নির্মাণের গুরুত্ব বিজেপির এজেন্ডায় হ্রাস পায়।[74] এনডিএ সরকারে শিক্ষানীতিতে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এডুকেশনাল অ্যান্ড ট্রেনিং-এর (এনসিইআরটি) সংস্কার ওভারতীয় স্কুলগুলির পাঠ্যপুস্তক সংস্কার গুরুত্ব পেয়েছে।[76] বিভিন্ন গবেষক এই সংস্কারকে, বিশেষত ইতিহাস পাঠ্যপুস্তক সংস্কারকে ভারতীয় ইতিহাসের ‘গৈরিকীকরণ’ আখ্যা দিয়েছেন।[76][77][78][79] বিভিন্ন অগ্রণী বিজ্ঞানীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এনফিএ সরকার বৈদিক জ্যোতিষকে কলেজ পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেছিল।[80]

বিজেপি কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে ‘ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতা’ আখ্যা দিয়ে ‘ইতিবাচক ধর্মনিরপেক্ষতা’র কথা প্রচার করে।[74] অটলবিহারী বাজপেয়ী মহাত্মা গান্ধীর ‘সর্বধর্ম-সম্ভব’ আদর্শটিকে ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে স্থাপন করেছেন।[81] অটলবিহারী বাজপেয়ীর মতে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো সকল ধর্মকে সমান মর্যাদা দান। অন্যদিকে ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষতা হলো ধর্মহীনতা। সেই কারণে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি ‘ইতিবাচক’ বলেছেন।[82] বিজেপি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির সমর্থক। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বলতে বোঝায়, বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা আলাদা দেওয়ানি আইনের বদলে ধর্মনির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য একই আইন। ঐতিহাসিক যোগেন্দ্র মালিকের মতে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংখ্যালঘু মুসলমানেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষাকারী ভিন্ন আইনব্যবস্থার পরিপন্থী।[2][74] বিজেপি ভারতীয় সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপের পক্ষপাতী। উক্ত ধারা অনুসারে, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটিকে উক্ত রাজ্যের ভারতভুক্তির সময় অধিকতর স্বশাসন দেওয়া হয়েছিল।[2]

বিজেপি বাংলাদেশ থেকে ভারতে বেআইনি অনুপ্রবেশের বিরোধী।[75] বিজেপির মতে মূলত অসম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে এই ধরনের বেআইনি অনুপ্রবেশ দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও স্থায়িত্বের প্রতি ক্ষতিকারক।[75] গবেষকেরা দেখিয়েছেন, বিজেপি বাংলাদেশ থেকে হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের শরণার্থী এবং মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দেয়।[75] গবেষক মাইকেল গিলানের মতে, এর মাধ্যমে বিজেপি যে সব অঞ্চলে দল ঐতিহাসিকভাবে সফল নয়, সেই সব অঞ্চলে হিন্দু আবেগকে কাজে লাগাতে চায়।[75][83]

২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় দণ্ডবিধির বিতর্কিত ৩৭৭ ধারাটিকে প্রত্যাহারের কথা বলে। এই ধারা মতে, অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে সমকামিতাকে অপরাধী-তালিকাযুক্ত করা হয়েছিল। মুসলমান ধর্মনেতা সহ কিছু ধর্মগুরু এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলেও, ভারতে উক্ত ধারাটি প্রত্যাহারের দাবি জনসাধারণের মধ্যে জোরালো হয়।[84][85] বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং বলেছিলেন, দল ৩৭৭ ধারা বিলোপের বিপক্ষে। কারণ, দল মনে করে সমকামিতা অস্বাভাবিক।[86] যদিও ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর বিজেপি তার অবস্থান নরম করে।[87]

বিজেপির অর্থনৈতিক নীতি দল গঠিত হওয়ার পর থেকে সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। দলের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক আদর্শ রয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে জনসংঘের মত বিজেপিও আরএসএস ও আরএসএস-অনুমোদিত সংগঠনগুলির ধারণা অনুসরণ করত। সেই সময় বিজেপি স্বদেশি (দেশীয় শিল্প উৎপাদনে উৎসাহ দান) ও সংরক্ষণমূলক রফতানি নীতি সমর্থন করত। যদিও বিজেপি সেই সময় অর্থনৈতিক উদারীকরণ সমর্থন করত এবং কংগ্রেসের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পায়নের বিরোধিতা করত।[88]

১৯৯৬ সালের নির্বাচনের সময় বিজেপি সংরক্ষণবাদ থেকে সরে আসে এবং বিশ্বায়নের নীতি গ্রহণ করে। উক্ত নির্বাচনের ইস্তাহারে বিজেপি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষেত্রগুলিতে অধিকতর বিদেশি বিনিয়োগ ও অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিতে সীমাবদ্ধ বিদেশি বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করেছিল। ১৯৯৮ সালে ক্ষমতায় আসার সময় দল বিশ্বায়নের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে পড়ে। এই সরকারের শাসনকালে প্রচুর বিদেশি কোম্পানি ভারতে বিনিয়োগ করে।[88] বামপন্থী দলগুলি এবং বিজেপির অনুমোদিত সংগঠনসমূহ (আরএসএস ও স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ) এর সমালোচনা করেছিল।[88] কমিউনিস্ট দলগুলি বলেছিল যে বিজেপি নব্যউদার মতবাদের দ্বারা বিশ্ব ব্যাংক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে তুষ্ট করার চেষ্টা করছে।[88] একইভাবে আরএসএস বলেছিল, বিজেপি আর স্বদেশি আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ নেই।[88]

১৯৯৮-২০০৪ পর্যায়ে এনডিএ শাসনকালে বিপুল হারে উদারীকরণ ও সরকারি সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ ঘটে। এই সরকার ট্যারিফ-রিডিউসিং মেজার প্রবর্তন করে। এই উদারীকরণ ছিল ১৯৯০-এর দশকে কংগ্রেস সরকারের চালু করা অর্থনৈতিক উদারীকরণের অনুসারী।[89] এনডিএ শাসনকালে ভারতের জিডিপি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। ২০০৪ সালের এনডিএ-র নির্বাচনী শ্লোগান ছিল ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’। মুক্ত বাজার সমাজের সব ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি আনবে – এই বিশ্বাস ছিল উক্ত শ্লোগানের ভিত্তি।[90] কিন্তু ২০০৪ সালের নির্বাচনে দলের আশাতীত পরাজয়ের পর রাজনৈতিক ব্যাখ্যাকারেরা বলেছিলেন, বিজেপির অর্থনৈতিক নীতি দরিদ্র মানুষের চাহিদার দিক থেকে সরকারের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিল কর্পোরেট ক্ষেত্রের দিকে।[52][53][91]

বিজেপির আর্থিক নীতির পরিবর্তন রাজ্য সরকারগুলির ক্ষেত্রেও লক্ষিত হয়েছে। বিশেষত গুজরাত রাজ্যে, যেখানে বিজেপি প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় রয়েছে, সেখানে এই পরিবর্তনের প্রভাব দেখা গিয়েছে।[92] ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গুজরাতে নরেন্দ্র মোদীর সরকার নব্য-উদার নীতিকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে রাজ্যের প্রভূত উন্নতি সাধন করে।[93][94] পরিকাঠামো ও সার্ভিস ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে বেসরকারিকরণ এবং শ্রম ও পরিবেশ নীতির পরিবর্তন এই নীতির অন্যতম অঙ্গ। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এই নীতি প্রশংসিত হলেও, রাজনৈতিক ব্যাখ্যাকারেরা এটিকে উত্তবিত্ত তোষণের নীতি বলে সমালোচনা করেন।[93][95]

কংগ্রেসের তুলনায় প্রতিরক্ষা নীতি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিজেপির অবস্থান অধিকতর আগ্রাসী ও প্রকৃতিগতভাবে জাতীয়তাবাদী।[96][97] এনডিএ সরকার পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করেছিল এবং প্রিভেনশন অফ টেররিজম অ্যাক্ট পাস করেছিল। এই দুটি পদক্ষেপই বহুল সমালোচিত হয়।[96][97] এনডিএ সরকার কারগিলে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে সেনা মোতায়েন করে এবং রাষ্ট্রসংঘের ওয়ার অন টেররিজম নীতি সমর্থন করে।[98]

আগের কংগ্রেস সরকারও পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করার যোগ্যতা অর্জন করলেও, বাজপেয়ী সরকারই প্রথম ভারতের ঐতিহাসিক পারমাণবিক অস্ত্র এড়িয়ে চলার নীতি থেকে সরে এসে ১৯৯৮ সালে পোখরান-২ পারমাণবিক পরীক্ষা কার্যকর করে।[96] পাকিস্তান মধ্যম রেঞ্জের একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করার পরই এই পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষাকে বিশ্বকে ভারতের সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শনের এবং বিজেপির মধ্যে পাকিস্তান-বিরোধী ভাবধারার প্রদর্শন হিসেবে ধরা হয়।[96]

বাজপেয়ী সরকার ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে আদেশ করেছিল কাশ্মীর অঞ্চল থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বিতাড়িত করার জন্য। এই ঘটনা পরে কারগিল যুদ্ধ নামে পরিচিত হয়।[99][100] যদিও পাকিস্তানি অনুপ্রবেশের আগাম খবর না পাওয়ার জন্য এই সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ সমালোচিতও হয়েছিল। তবে কারগিল যুদ্ধে ভারতীয় সামরিক বাহিনী সফলভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করে।[99][100] বাজপেয়ী প্রশাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধকে সমর্থন করে। সরকার আশা করেছিল কাশ্মীরে সন্ত্রাস ও অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে ভারত সমর্থন আদায় করতে পারবে। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক দৃঢ় হয় এবং অস্ত্র কেনাবেচায় সমঝোতা হয়।[98]

২০০১ সালে ভারতীয় সংসদে জঙ্গিহানার পর ওই বছর ডিসেম্বর মাসে এনডিএ সরকার প্রিভেনশন অফ টেররিজম অ্যাক্ট পাস করে।[97] সরকারের লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানকে দৃঢ় করা।[97] প্রথমে রাজ্যসভায় এই বিল পাস করতে না পেরে, এনডিএ একটি নজিরবিহীন পদক্ষেপ নেয়। সরকার সংসদের যুগ্ম অধিবেশন ডাকে। এই অধিবেশনে লোকসভায় সংখ্যাধিক্যের জেরে বিলটি পাস হয়ে যায়।[97] এই আইন বলে অনেককে সন্ত্রাসবাদী অভিযোগে কারারুদ্ধ করা হয়।[97] যদিও বিরোধী দলসমূহ ও গবেষকরা এই আইনটিকে নাগরিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ আখ্যা দিয়েছিল এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলেছিল যে, এই আইনের মূল লক্ষ্য করা হয়েছে মুসলমানেদের।[97] ২০০৪ সালে কংগ্রেস সরকার এই আইন প্রত্যাহার করে নেয়।[101]

জনসংঘের মতো বিজেপিও বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অবস্থান গ্রহণ করে। এই অবস্থানের ভিত্তি ছিল আগ্রাসী হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদ।[102] জনসংঘ ভারত বিভাজন রদ করার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ লক্ষ্য স্থাপন করেছিল। সেই হিসেবে দলের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান ছিল পাকিস্তানের অস্তিত্ব বেআইনি।[102] এই পাকিস্তান-বিরোধিতা বিজেপির আদর্শেও প্রতিফলিত হয়।[102][103] বিজেপি ও বিজেপি-অনুমোদিত সংগঠনগুলি ভারতের জোট-নিরপেক্ষ নীতির কঠোর বিরোধী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা স্থাপনের পক্ষপাতী।[102]

বাজপেয়ী সরকারের বিদেশ নীতি অনেক দিক থেকেই বিজেপির রক্ষণশীলতার থেকে সরে এসেছিল। যদিও বিজেপির কিছু নীতি এই সরকার অনুসরণ করেছিল।[88][103] এই সরকারের নীতি পূর্ববর্তী সরকারগুলির অনুসৃত নেহেরুর আদর্শবাদ থেকে অনেকটাই সরে এসে বাস্তববাদী অবস্থানের পক্ষপাতী ছিল।[104] নেহেরুর সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত নরম মনোভাব গ্রহণের জন্য সমালোচিত হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে বাজপেয়ী পাকিস্তানে গিয়ে দিল্লি-লাহোর বাস পরিষেবা উদ্বোধন করেন।[102] এই সফরে বাজপেয়ী লাহোর ঘোষণাপত্র সই করেন। এটি ছিল ১৯৯৮ সালের পারমাণবিক পরীক্ষার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতির একটি প্রচেষ্টা।[102] যদিও কয়েক মাস পরে পাকিস্তানের বিতর্কিত অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনা ও সন্ত্রাসবাদীদের অবস্থান ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের কারণ হয়। কয়েক মাস পর এই যুদ্ধ শেষ হয়। নিয়ন্ত্রণ রেখা অপরিবর্তিত রেখে অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়িত করা হয়।[102] এই যুদ্ধের পরেও বাজপেয়ী পাকিস্তানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় সম্মত ছিলেন। বিজেপি কর্মীদের মধ্যে বাজপেয়ীর এই মনোভাব গ্রহণীয় হয়নি। তারা এটিকে সরকারের ‘দুর্বলতা’ বলে সমালোচনা করে।[102] কারগিল-পরবর্তী আগ্রা শীর্ষ সম্মেলনে বিজেপির এই মনোভাব কোনো রকম গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সাক্ষর করা থেকে সরকারকে বিরত রাখে।[102]

• রাজ্য সভাপতি - ড সুকান্ত মজুমদার[108]
• সহ-সভাপতি - অর্জুন সিং , সুভাষ সরকার , জয়প্রকাশ মজুমদার
• সাধারণ সম্পাদক - সায়ন্তন বসু, লকেট চট্টোপাধ্যায় , জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো
• সম্পাদক - সব্যসাচী দত্ত
• মহিলা মোর্চার সভানেত্রী - অগ্নিমিত্রা পাল
• যুব মোর্চার সভাপতি - সৌমিত্র খাঁ
• তফশিলি মোর্চার সভাপতি - দুলাল বর
• তফশিলি উপজাতি মোর্চার সভাপতি - খগেন মুর্মু
• কিষাণ মোর্চার সভাপতি - মহাদেব সরকার
• সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি - আলি হোসেন
• ওবিসি মোর্চার সভাপতি - নির্মল কর্মকার।

সূত্র