অম্বিকাচরণ মজুমদার
অম্বিকাচরণ মজুমদার (৬ জানুয়ারি১৮৫১- ২৯ ডিসেম্বর১৯২২) বাঙালি রাজনীতিবিদ, আইনজীবী এবং সমাজসেবী[1] যিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন।[2][3]
অম্বিকাচরণ মজুমদার | |
---|---|
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | ১৮৫১ মাদারীপুর, বাংলাদেশ |
মৃত্যু | ১৯২২ |
অম্বিকাচরণ মজুমদার ১৮৫১ সালে বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানাধীন সেনদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷ তিনি একাধারে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সমাজসেবক ও গ্রন্থকার ছিলেন৷ কৃতিত্বের সাথে বি.এ পাস করার পর ১৮৭৪ সালে তিনি শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেন ৷ ১৮৭৯ সাল থেকে তিনি ফরিদপুর সদরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে রাজনৈতিক জীবনে পদার্পণ করেন। ১৮৮১ সালে পিপলস এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন এবং তা ভারতসভার সঙ্গে যুক্ত হয়।[3] উনিশ শতকের শেষ দিকে তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত উক্ত এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন৷ ১৯১৬ সালে লখনউতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি সভাপতি নিযুক্ত হন৷ ১৯১৮ সালে রাজেন্দ্র কলেজ স্থাপিত হলে তিনি কলেজের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভাপতি নিযুক্ত হন এবং কলেজ পরিচালনায় ও উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখেন৷ তিনি ফরিদপুর জেলা বোর্ডের সদস্য ও পৌরসভার সভাপতি ছিলেন৷[3]
জন্ম ও পরিচয়
বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সমাজ সেবক অম্বিকাচরণ মজুমদার ১৮৫১ সালে বৃহত্তম ফরিদপুর (বর্তমান মাদারীপুর) জেলার রাজৈর থানার সেনদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার বংশ ছিল কুলিন কায়স্থ। অম্বিকাচরণের বাবার নাম ছিল রাধা মাধব এবং মায়ের নাম ছিল সুভদ্রা দেবী। রাধা মাধবের পূর্ব পুরুষ সবাই ছিল নামকরা লোক। অম্বিকাচরণের জন্মের সময় মাদারীপুর ছিল বাকেরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল) জেলার অন্তর্গত। আর রাজৈর ছিল বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার অন্তর্গত। তার বাবা ছিল জমিদার। সে সময় বাকেরগঞ্জের মধ্যে মজুমদার পরিবারের একটি সম্ভ্রান্ত ইতিহাস ছিল।
শিক্ষা জীবন
অম্বিকাচরণ মজুমদারের শুরু হয় ১৮৫৮ সালে স্থানীয় পাঠশালায়। এরপর ভর্তি হন খালিয়া গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে স্কুলের শিক্ষকদের ধরাবাধা নিয়ম অ অতিরিক্ত শাসনের কারনে তিনি স্কুল ত্যাগ করেন। এরপর ১৮৬০ সালে তার মা সুভদ্রা দেবী তাকে ভর্তি করে দেন বরিশালের একটি ইংরেজী স্কুলে। বরিশালে পড়া শেষে ভর্তি হন ফরিদপুর জিলা স্কুলে। আর সেখান থেকেই তিনি ১৮৬৯ সালে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করার পর তিনি ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৮৭১ শালে তিনি এ কলেজ থেকে এফ এ পাশ করেন। এফ এ পাশ করার পর ভর্তি হন এসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন স্কটিশ চার্চ কলেজে। ১৮৭৪ সালে তিনি এ কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ৮ম স্থান বি এ পাশ করেন। এরপর তিনি আবার ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। আর এখান থেকে তিনি এম এ পাশ করেন। এরপর তিনি কিছু সময় চাকরি করেন। এ চাকরি ছেড়ে তিনি আবার ভর্তি হন আইন পড়ায়। ১৮৭৮ সালে তিনি বি এল পাশ করেন।
কর্মজীবন
প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়া শেষে অম্বিকাচরণ মজুমদার ১৮৭৪ সালে যোগদান করেন মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ইংরেজী অধ্যাপক হিসেবে। এ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আর সে সুবাদেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাথে তার গভীর সম্পর্ক হয়। আইন বিষয়ে পড়ার জন্য তিনি এ চাকরি ছেড়ে দেন। আইন পড়া অবস্থায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য আবার অনুরোধ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের অনুরোধে তিনি ১৮৭৫ সালে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে দুই বছর চাকরি করে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসেন জন্মভূমি ফরিদপুরে।
রাজনীতির সূচনা
অম্বিকাচরণে মজুমদারের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয় কলকাতায় পড়ালেখা করার সময় থেকেই। তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতার সময় তার সহকর্মী ছিল সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। এই রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের সংস্পর্শে তিনি রাজনীতির প্রতি আগহী হয়ে উঠেন এবং তাকে রাজনৈতিক গুরু হিসেবে গ্রহণ করেন। তারা দুজন মিলে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন এক ‘তর্ক সভা’। যে সভার মূল কাজ ছিল রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা। আর এ সভা থেকেই তিনি রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রানিত হন। অম্বিকাচরণ তার রাজনৈতিক জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত গুর সুরেন্দ্রনাথের অনুগত্য ছিলেন।
আইন পেশা
অম্বিকাচরণ মজুমদার বি এল পাশ করার পর আইন ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। কলকাতা থেকে ফিরে তিনি ফরিদপুরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এক সময় তার আইন পেশা প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং তার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৮০ সালে তিনি ফরিদপুর বার লাইব্রেরীর সভাপতি নির্বাচিত হন। বার লাইব্রেররীর গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও সংস্কারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯০২-১৯০৩ সালের ৩য় নির্বাচনে তিনি পুনরায় বার লাইব্রেরীর সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯০২ সালে ‘Supreme Legislative Council’ এ আইনজীবী বিরোধী একটি বিলের প্রস্তাব করেন। অম্বিকাচরণ মজুমদার এ বিলের চরম বিরোধীতা করেন এবং আয়োজন করেন প্রতিবাদ সভা। তাদের এই আন্দোলনের কারেন পরবর্তীতে এ বিলটি বাতিল হয়ে যায়।
রাজনৈতিক জীবন
অম্বিকাচরণ মজুমদার ছিলেন একজন নামকরা রাজনীতিবিদ। জনগনের সেবা অ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই ছিল তার রাজনীতির প্রধান আদর্শ। তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। শত বাধাও তাকে সুরেন্দ্রনাথের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। যদিও তিনি ছাত্র অবস্থা থেকেই রাজনীতি চর্চা করতেন, তবে তার মূল রাজনীতি শুরু হয় ফরিদপুর থেকেই। ফরিদপুরে যখন তিনি আইন ব্যবসা করতেন তখন থেকেই তিনি রাজনীতিকেও একটি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। আস্তে আস্তে তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন। ১৮৮৫ সালে ফরিদপুর পৌরসভা সৃষ্টি হলে তিনি পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি পোউরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি একটানা বিশ বছর ফরিদপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৮৮৩ সালে তার গুর সুরেন্দ্রনাথ ‘Indian National Congress’ নামে একটি সম্মেলন ডাকেন। অম্বিকাচরণ সেই সম্মেলনে তার গুরুর সাথে যোগদান করেন। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠাকালে অম্বিকাচরণ মজুমদার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন কংগ্রেস এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৮৬ সালে তিনি কংগ্রেস এর ২য় সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৮৮৯ সালে জাতীয় মুভমেন্টে তিনি বাংলার একজন অন্যতম নেতা ছিলেন। ১৮৮৯ সালে বর্ধমানে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি তার গুরু সুরেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত ‘ফরিদপুর পিপলস এসোসিয়েশন’ কে ভারত সভার অন্তর্গত করেন। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি ভারত সভার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অম্বিকাচরণ মজুমদার ছিলেন বঙ্গভঙ্গের চরম বিরোধী। এর বিরুদ্ধে তিনি জনমত তৈরি করেন ও আন্দোলনের প্রস্তুতি নেন। ১৯০৪ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি ফরিদপুরে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী এক বিশাল জনসভার ডাক দেন। উক্ত সভায় তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০৫ সালে অম্বিকাচরণ মজুমদার অশ্বনিকুমার দত্ত, ভূপেন্দ্রনাথ বসু এবং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির সাথে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, মিছিল ও হরতালের আয়োজন করেন। ১৯০৬ সালে তিনি বরিশাল প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯০৭ সালে অম্বিকাচরণ মজুমদার স্বদেশী আন্দোলনের জন্যে ফরিদপুর কমিটি গঠন করেন এবং তিনি এ কমিটির মনোনীত হন। এরপর তিনি ব্যাপকভাবে শুরু করেন স্বদেশী বিরোধী আন্দোলন। এ আন্দোলনের জন্য তিনি শত শত সভা-সমাবেশ করেন। ১৯০৮ সালে মাদ্রাজে কংগ্রেসের সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় তিনি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী কঠিন বক্তব্য প্রদান করেন। ১৯১০ সালে তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন। ১৯১১ সালে ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রদেশের সম্মেলনে তিনি তিনি অভ্যর্থনা কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৫ সালে তিনি ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশন্যাল ইভোলিউশন’ নামে একটি বই লিখেন। অম্বিকাচরণ মজুমদার ১৯১৬ সালে লক্ষ্মীতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কংগ্রেসের সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সম্মেলনে মুসলিম লীগের সাথে কংগ্রেসের সমঝোতা হয়। এ সমঝোতায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯১৭ ও ১৯১৮ সালে অম্বিকাচরণ বঙ্গীয় আইনসভার ঢাকা বিভাগের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৮ সালে তিনি দিল্লীতে অনুষ্ঠিত যুদ্ধ সম্মেলনে যোগ দেন। এ সম্মেলনে তিনি ১ম বিশ্বযুদ্ধে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা প্রদান করেন। ১৯১৯ সালে তিনি ফরিদপুরে ‘জুরি’ বিচার প্রথা চালু করেন। কংগ্রেস দুভাগে বিভক্ত হয়। ১৯২০ সালে মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও এ কে ফজলুল হক খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন। এ আন্দোলনে তিনি ও তার গুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপধ্যায় চরম বিরোধীতা করেন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধি খেলাফত আন্দোলনের পক্ষ নেন। আর এ কারনে গান্ধির সাথে তার বিরোধীতা দেখা দেয়। ১৯২১ সালে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধীতা করে ‘National Liberal Association’ গঠন করেন। অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধীতার কারেনে তাকে ফরিদপুর বার সমিতি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তিনি রাজনীতি থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ১৯২৩ সালের নির্বাচনে তিনি শরীয়তপুরের তরুন নেতা ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের কাছে পরাজিত হন। পরাজয়ের পর তিনি রাজনীতি থেকে নীরবে অবসর গ্রহণ করেন। বিবাহ বন্ধন ও পারিবারিক জীবনঃ অম্বিকাচরণ মজুমদার বিয়ে করেন খুলনা নিবাসী মাধব সেনের কন্যা বিনোদিনীকে। স্বামী অম্বিকাচরণ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তিনি সংসার পরিচালনা করেন। তবে তিনি বেশি শিক্ষিত ছিলেন না। অম্বিকাচরণ ও বিনোদিনীর ঘরে জন্ম গ্রহণ করে ৬ সন্তান(চারুচন্দ্র, কিরন চন্দ্র, হেমচন্দ্র, সরযু বালা, শৈলবালা, পুতুল চন্দ্র)। ৬ সন্তানের মধ্যে ৪ জন পুত্র ও ২ জন কন্যা সন্তান ছিল। তার সন্তানের মধ্যে হেমচন্দ্র মজুমদার কলকাতা হাই কোর্টের উকিল ছিলেন। তবে হেমচন্দ্র মজুমদারের অকাল মৃত্যু হয়। ১৯০৬ সালে তার স্ত্রী বিনোদিনী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যু বরন করেন।
রাজেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা ও ফরিদপুরের কিছু উন্নয়ন
ফরিদপুরের শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে অম্বিকাচরণ মজুমদারের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন ফরিদপুরের সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজেন্দ্র কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১৫ সালের ২১ নভেম্বর কয়েকজন গণ্যমান্য লোকদের নিয়ে একটি সভা ডাকেন। উক্ত সভায় কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং অম্বিকাচরণ মজুমদার কে সভাপতি মনোনীত করা হয়। এরপর ১৯১৬ সালের ৯ জানুয়ারি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মাষ্টার প্লান করা হয় এবং নির্বাচিত করা হয় কলেজের স্থান। তবে পরিকল্পনা করলেই তো আর কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়ে যায় না, এর জন্য প্রয়োজন কিছু জমি ও প্রচুর টাকা-পয়সা। তাই অর্থের জন্য তিনি দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেন। বিভিন্ন লোকের সাথে যোগাযোগ করেন। এক পর্যায়ে তিনি যান বাইশরশির জমিদার রমেশচন্দ্র রায় চৌধুরীর কাছে। রমেশচন্দ্র জানান তিনি টাকা দিতে রাজি আছেন, যদি ঐ কলেজের নাম তার বাবা রাজেন্দ্র চন্দ্র রায় চৌধুরীর নামে রাখা হয়। ১৯১৬ সালের ১৩ অক্টোবর কলেজ কমিটি রাজেন্দ্র কলেজ নামকরণের প্রস্তাব গ্রহণ করে। রমেশচন্দ্র চৌধুরীর পিতার নামে কলেজের নামকরণের প্রস্তাব গৃহীত হলে তিনি কলেজের জন্য ৫০ হাজার টাকা দান করেন। এছাড়া মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী নামে এক জমিদার কলেজ স্থাপনের জন্য ৩০ হাজার টাকা দান করেন। টাকা জোগাড় হলেও এক সময় কলেজের জমি নিয়ে সমস্যা হলে কলেজ প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। এরপর সরকার কলেজ ভবন নির্মাণের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে শত বাধা সত্যেও অম্বিকাচরণ মজুমদার থেমে থাকেননি। সরকারি বরাদ্দের জন্য ঘুরেছেন সরকারের উচ্চ পর্যায় প্রযন্ত। তবে অবশেষে তিনি সফল হন। ১৯১৮ সালের ২৫ মে ভারত সরকার বার্ষিক একটাকা খজনার বিনিময়ে রাজেন্দ্র কলেজের জন্য ৫.৫৫ একর জমি বরাদ্দ দেন এবং ঐ সালের ১১ জুন কলেজ ভবন নির্মাণের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। অবশেষে ১৯১৮ সালের ৩০ জুলাই রাজেন্দ্র কলেজের উদ্বোধন করা হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ঐ কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। অম্বিকাচরণ মজুমদার একটানা ২০ বছর ফরিদপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি ফরিদপুরের অনেক উন্নয়ন করেন। ফরিদপুরকে গড়ে তুলেন নিজের মত করে। পৌরভবন, রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণ ও পৌরসভায় পানির ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করেন। আর এজন্য তাকে বলা হয় আধুনিক ফরিদপুরের রূপকার। তিনি ছিলেন বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার ঢাকা বিভাগের পৌরসভা প্রতিনিধি। ফরিদপুর পৌরসভার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখতে এসে তৎকালীন বাংলার গভর্নর স্যার জন উডবান তাকে ‘Grand Oldman’ উপাধি দেন। তিনি দীর্ঘ দেন ফরিদপুর জেলা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। এক সময় তিনি ফরিদপুর লোন অফিসের পরিচালক ছিলেন। তিনি ছিলেন ফরিদপুর টাউন থিয়েটারে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তার উদ্যোগে ১৯৮৮ সাল থেকে ফরিদপুরে মেলা শুরু হয়। তিনি ছিলেন ঐ মেলা কমিটির সম্পাদক। ১৯০৬ সালে তিনি ফরিদপুর বঙ্গ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি ১৯০৭ সালে পুনরায় ঐ কলেজের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯০৭ সাল থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঐ স্কুলের সভাপতি ছিলেন। তার প্রচেষ্টায় ফরিদপুর থেকে রাজবাড়ী পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ করা হয়। তিনি ফরিদপুর থেকে মাদারীপুর পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্য চর্চাঃ রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সাহিত্য চর্চাও করেছিলেন। তিনি ‘চিত্রকর’ নামে একটি বাংলা সাময়িকপত্র পরিচালনা করতেন। পত্রিকাটি প্রকাশিত হত মাদারীপুরের উলপুর থেকে এবং মূদ্রিত হত কলকাতা থেকে। এর প্রথম সংখ্যা বের হয় বাংলা ১২৮৩ সালে। লেখালেখিতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। ১৯১৫ সালে তিনি ‘Indian National Evolution’ নামে একটি বই রচনা করেন। বইটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ভারতীয় রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদ। সে সময় তার এ বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ফরিদপুর হিতৈষী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত।
গ্রন্থ
ইন্ডিয়ান ন্যাশন্যাল ইভোলিউশন[3]
সম্মাননা
ফরিদপুর শহরে অম্বিকা মেমোরিয়াল হল ও অম্বিকা ময়দান তার স্মৃতিকে ধারণ করে আছে ৷
মৃত্যু
১৯১৮ সালে তার পুত্র কলকাতা হাই কোর্টের উকিল হেমচন্দ্র মজুমদারের মৃত্যুর পর থেকে শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে ঐ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৭২ বছর বয়সে এই মহান রাজনীতিবিদ দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন। অম্বিকাচরণ মজুমদারের মৃত্যুর পর তার স্মৃতি স্বরূপ ফরিদপুর টাউন হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় অম্বিকা মেমোরিয়াল হল এবং তার বাড়ির সামনের সড়কের নাম রাখা হয় অম্বিকা রোড।
তথ্যসূত্র
- "বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব -ফরিদপুর জেলা তথ্য বাতায়ন"। ২০১২-০৩-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৫-১০।
- "Ambica Charan Mazumdar"। Archived from the original on ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০১৫।
- স্বাধীনতা সংগ্রামী চরিতাভিধান - ডাঃ ননীগোপাল দেবদাস