চব্বিশ পরগনা জেলা

চব্বিশ পরগনা জেলা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাবেক একটি জেলা। ১৯৮৬ সালের ১ মার্চ, ২৪ পরগনা জেলাকে ভেঙে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা নামে দুটি নতুন জেলার সৃষ্টি করা হয়।[1]

পশ্চিমবঙ্গে চব্বিশ পরগনা জেলার অবস্থান।

ইতিহাস

পরগনা শব্দটি এসেছে ফারসি থেকে। দিল্লি সালতানাতের রাজস্ব-সংক্রান্ত বিভাগ হিসাবে প্রথম এই শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে মুঘল এবং ব্রিটিশদের সময়েও এই শব্দটির ব্যবহার হয় একই অর্থে।

১৭২২ সালে মুর্শিদকুলি খাঁর সময়ে মোগল আমলের শেষ জরিপে ওই পরগনাগুলিকে হুগলি চাকলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পলাশীর যুদ্ধের ছয় মাস পরে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর এক সন্ধির শর্ত অনুযায়ী বাংলার তৎকালীন নবাব মীর জাফর কলকাতার দক্ষিণে কুলপি পর্যন্ত অঞ্চলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ২৪টি জংলীমহল বা পরগনার জমিদারি সত্ত্ব ২,২২,৯৫৮ টাকা খাজনার বিনিময়ে ভোগ করার অধিকার দেন। সমগ্র অঞ্চলের আয়তন ছিল ৮৮২ বর্গমাইল,ref name="Hill2"> Samuel Charles Hill (১৯০৫)। Bengal in 1756-57, a selection of public and private papers dealing with the affairs of the British in Bengal during the reign of Siraj-Uddaula; with notes and an historical introductionII। পৃষ্ঠা 215–217।</ref> যা পরে অন্যান্য অঞ্চলযোগে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৫,৬৩৯ বর্গমাইল। এরপর থেকে এই অঞ্চলকে একত্রে চব্বিশ পরগনা নামে ডাকা হতো।

এই ২৪টি পরগনা হল:[2][3] ১৯৮৬ সালের ১ মার্চ চব্বিশ পরগনা জেলার দক্ষিণাংশ নিয়ে গঠিত জেলাটি পরিচিত হয় "দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা" নামে।

  1. আকবরপুর
  2. আমীরপুর
  3. কলিকাতা
  4. পাইকান বা পৈখান
  5. আজিমবাদ
  6. বালিয়া
  7. বাদিরহাটি
  8. বসনধারী ব বসনধোয়াব
  9. দক্ষিণ সাগর
  10. গড়
  11. হাতিয়াগড়
  12. ইখতিয়ারপুর
  13. খাড়িজুড়ি
  14. খাসপুর
  15. মেদনমল্ল
  16. মাগুরা
  17. মানপুর
  18. ময়দা
  19. মুড়াগাছা
  20. পেচাকুলি বা পাটকুলি
  21. সাতাল
  22. শাহনগর
  23. শাহপুর
  24. উত্তর পরগনা

১৭৫৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লর্ড ক্লাইভকে এই ২৪টি পরগনা ব্যক্তিগত জায়গীর হিসাবে দেয়। এই সময়ে সুন্দরবনের এক বিস্তৃত অংশ ২৪ পরগনার মধ্যে ছিল না। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম জঙ্গল কেটে সুন্দরবন অঞ্চলে বসতি ও চাষ শুরু হয়। ১৭৭৪ সালে লর্ড ক্লাইভের মৃত্যুর পর এই অঞ্চলটি আবার কোম্পানির হাতে চলে আসে। লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলবৎ করার পর পরগনা ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

১৮২২ থেকে ১৮২৩ সালের মধ্যে বসতি ও চাষের জন্য সুন্দরবনকে লট ও প্লটে ভাগ করা হয়। নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ১৮৫৫ সালের মহাকুমার ধারণাকে নিয়ে আসা হয় ও সমগ্র জেলাকে আটটি মহাকুমায় ভাগ করা হয়। নতুন মহাকুমার সৃষ্টি বা অদলবদলও এরপরে ঘটে। ১৮৭১ সালে কলকাতা ২৪ পরগনা জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের রাজধানীতে পরিণত হয়।[2]

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তান হবার পর যশোর জেলার বনগাঁ চব্বিশ পরগনা জেলার মধ্যে চলে আসে এবং সুন্দরবনের বৃহত্তম অংশ খুলনা ও বাখরগঞ্জের মধ্যে চলে আসে। ১৯৮৩ সালে ডঃ অশোক মিত্রের প্রসাসনিক সংস্কার কমিটি এই জেলাকে বিভাজনের সুপারিশ করে। ১৯৮৬ সালে ১লা মার্চ জেলাটিকে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলাদক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা নামে দুটি জেলায় ভাগ করা হয়। দুটি জেলাই প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।[4]

ঔপনিবেশিক শাসন

ব্রিটিশ রাজ

১৭৫৯ সালে কোম্পানি লর্ড ক্লাইভকে এই ২৪টি পরগনা ব্যক্তিগত জায়গীর হিসাবে দেয়। ১৭৭৪ সালে লর্ড ক্লাইভের মৃত্যুর পর এটি আবার কোম্পানির হাতে চলে আসে। ইংরেজ আমলে ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনিক কারণে বহুবার ভাগ হয়েছে।১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তান হবার পর যশোর জেলার বনগাঁ ২৪ পরগনা জেলার মধ্যে চলে আসে এবং সুন্দরবনের বৃহত্তম অংশ খুলনা ও বাখরগঞ্জের মধ্যে চলে আসে। ইংরেজ আমলে কলকাতা ২৪ পরগনা জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের রাজধানীতে পরিণত হয়।

স্বাধীনতার পর

১৯৮৩ সালে ডঃ অশোক মিত্রের প্রসাসনিক সংস্কার কমিটি এই জেলাকে বিভাজনের সুপারিশ করে। ১৯৮৬ সালে ১লা মার্চ জেলাটিকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলাদক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা নামে দুটি জেলায় ভাগ করা হয়। দুটি জেলাই প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন

১৯২৩ সালে বারুইপুরের ২ মাইল (৩.২ কিমি) উত্তর-পশ্চিমে গোবিন্দপুর গ্রামে দ্বাদশ শতাব্দীর সেনবংশীয় রাজা লক্ষ্মণসেনের গ্রামদানের একটি তাম্রশাসন পাওয়া যায় (দ্রষ্টব্য খাড়ি গ্রাম)। এই গ্রামে পুরানো একটি পুকুরপাড়ে (হেদোপুকুর নামে পরিচিত) কারুকাজ করা ইটের একটি স্তুপ দেখা যায়। গোবিন্দপুরের মাইলখানেক দক্ষিণে বেড়াল-বৈকুণ্ঠপুরে প্রাচীন একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় এবং আরও দক্ষিণে কল্যাণপুর গ্রামে প্রাচীন একটি জীর্ণ মন্দিরে একটি শিবলিঙ্গ আছে যাঁকে 'রায়মঙ্গল' কাব্যের 'কল্যাণ-মাধব' বলে চিহ্নিত করা হয়।

বারুইপুরের পাঁচমাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কুলদিয়া গ্রামে বেশ সুন্দর একটি সূর্যমূর্তি ( ফুট ১০ ইঞ্চি (০.৫৬ মি) উঁচু ও ১ ফুট (০.৩০ মি) চওড়া) এবং সঙ্গে বেলেপাথরের নৃসিংহের একটি প্লাক পাওয়া গিয়েছে। জয়নগর থানার মধ্যে দক্ষিণ বারাসাত গ্রামে বিষ্ণু, নৃসিংহের একাধিক পাথরের মূর্তি, বিষ্ণুচক্র, স্তম্ভ ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এখানকার সেনপাড়ায় পুকুর খননের সময় মাথায় নিখুঁত বহুগুণাবিশিষ্ট সর্পছত্রযুক্ত জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের একটি নগ্নমূর্তির সন্ধান মিলেছিল। দক্ষিণ বারাসাতের দুই মাইল দক্ষিণে বড়ুক্ষেত্র বা বহড়ু গ্রামেও ছ'ফুট উঁচু সুন্দর একটি সূর্যমূর্তি পাওয়া গেছে, গ্রামের লোক 'পঞ্চানন' বলে এর পূজা করেন। ময়দাগ্রামে পুকুর খুঁড়তে গিয়ে প্রায় দেড়ফুট উঁচু নৃত্যরত চমৎকার একটি গণেশমূর্তি পাওয়া যায়।

জয়নগরেও সূর্যমূর্তি পাওয়া গেছে; মথুরাপুরে ভূমিস্পর্শমুদ্রাযুক্ত একটি ভাঙা বুদ্ধমূর্তি এবং সূর্যমূর্তি পাওয়া গেছে। মথুরাপুরের দুই মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘটেশ্বর গ্রামে বিংশ শতকের প্রথম দিকে পুকুর খননের সময় তিনটি জৈনমূর্তি পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটি মূর্তি কুসংস্কারবশত জলে ফেলে দেওয়া হয়, একটি বেদখল হয়ে যায়, আর একটি মজিলপুরের কালিদাস দত্ত নিজের সংগ্রহে নিয়ে এসে রাখেন। কাঁটাবেনিয়া গ্রামেও অনুরূপ বিষ্ণুমূর্তি, বাসুদেবমূর্তি, গণেশমূর্তি, মন্দিরের দ্বারফলক, বড় বড় প্রস্তরস্তম্ভ এবং একটি বৃহৎ জৈন পার্শ্বনাথের নিখুঁত মূর্তি পাওয়া গেছে, এটি বর্তমানে বিশালাক্ষি দেবীর সঙ্গে গ্রামদেবতা 'পঞ্চানন'রূপে পূজিত হন।

জয়নগরের ৩ মাইল (৪.৮ কিমি) দক্ষিণে উত্তরপাড়ার জমিদারদের একটি পুরানো কাছারিবাড়ির কাছে পুকুর সংস্কারের সময় তিনটি সুন্দর বিষ্ণুমূর্তি ও একটি দশভূজা দুর্গামূর্তি পাওয়া যায়; মূর্তিগুলো জমিদাররা তাদের উত্তরপাড়া লাইব্রেরিতে নিয়ে যান৷ ছত্রভোগে একটি কুবেরের মূর্তি, বিষ্ণু ও দশভূজা দুর্গামূর্তি, ব্রোঞ্জের গণেশ ও নৃসিংহমূর্তি পাওয়া গেছে। আটঘরা থেকে তাম্রমুদ্রা, মৃৎপাত্রের টুকরো, পোড়ামাটির মেষমূর্তি, যক্ষ্মিণীমূর্তি, শীলমোহর,তৈজসপত্র, পাথরের বিষ্ণুমূর্তি ইত্যাদি মিলেছে।

১৮৬০-এর দশকে মথুরাপুর থানার মধ্যে, লট নং ১১৬, পুরানো আদিগঙ্গার খাত থেকে এখানকার গভীর জঙ্গল পরিষ্কারের সময় 'জটার দেউল' নামে একটি মন্দির আবিষ্কৃত হয়। অনেকের মতে, এখানে জটাধারী নামে এক শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ছিল; আবার কারোর মতে, জটাধারী বড় বড় বাঘ এখানে ঘুরে বেড়াত। অধিকাংশ প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, জটার দেউলের স্থাপত্যশৈলীর সাথে ভুবনেশ্বরের দেউল স্থাপত্যের মিল আছে এবং সেদিক থেকে ও অন্যান্য আবিষ্কৃত নিদর্শন বিচার করে এর নির্মাণকাল আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দী।

১৯১৮ সালে জঙ্গল সাফ করার সময় জটার দেউলের ছ'মাইল দূরে দেউলবাড়ি নামক স্থানে (লট নং ১২২) এই ধরনের আরও একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় (এখন বিলুপ্ত)। এই স্থানের আধমাইল পূর্বে কমবেশি একবিঘা পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ দেখা গিয়েছিল। ১৯২১-২২ সালে জটার দেউলের বারো-তেরো মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে জগদ্দল গাঙের কাছে আরও একটি মন্দিরের অবশেষের হদিশ মিলেছিল। মাটি খোঁড়ার সময় এখানে (বনশ্যামনগর) ইটের ঘর, প্রচুর ইট মৃৎপাত্রের টুকরো এবং মানুষের অস্থি-কঙ্কাল ইত্যাদি পাওয়া যায়।

এর ৮ মাইল (১৩ কিমি) উত্তর-পশ্চিমে (লট নং ১১৪) এসময় জঙ্গলের মধ্যে বেশ একটি বড় ইটের স্তুপ খুঁড়ে নিচে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, গর্ভগৃহ ছাড়া এই মন্দিরের আর কোন অংশের চিহ্ন ছিল না। খননকালে চারটি বিষ্ণুমূর্তি (একটি ৪ ফুট উঁচু, দুটি ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি এবং আরেকটি ৩ ফুট ২ ইঞ্চি উঁচু) ও একটি নটরাজমূর্তি (মূর্তিটি ৩ ফুট ১ ইঞ্চি উঁচু, দশহাতযুক্ত; গলায় আজানুলম্বিত একটি মালা আছে, মালার নিচে দশটি নরমুণ্ড ঝোলানো।)। এছাড়া, পাথরপ্রতিমা, রাক্ষসখালি প্রভৃতি অঞ্চলেও অষ্টধাতুর বুদ্ধমূর্তি, অন্যান্য পাথর ও পোড়ামাটির মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।[5]

তথ্যসূত্র

  1. মণ্ডল, অসিম কুমার (২০০৩)। The Sundarbans of India : a development analysis। নতুন দিল্লি: ইন্দুস পাব. কো। পৃষ্ঠা ১৬৮–১৬৯। আইএসবিএন 81-7387-143-4।
  2. চট্টোপাধ্যায়, সাগর (২০০০)। "দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও প্রত্নতত্ত্ব : একটি রূপরেখা"। ঘোষ, তারাপদ; মন্ডল, অজিত। পশ্চিমবঙ্গ৩৩। কলকাতা: তথ্য অধিকর্তা, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পৃষ্ঠা ২৩–৫৪।
  3. সমরেন্দ্রনাথ চন্দ (সংকলিত), গল্পে গাথায় ছন্দে বাংলা স্থাননাম, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৮ সংস্করণ, ২০১০ মুদ্রণ, পৃ. ৭১
  4. মণ্ডল, অসিম কুমার (২০০৩)। The Sundarbans of India : a development analysis। নতুন দিল্লি: ইন্ডাস পাব. কো। পৃষ্ঠা ১৬৮–১৬৯। আইএসবিএন 81-7387-143-4।
  5. ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ১৫২-১৫৫

আকর গ্রন্থ

  • আদি গঙ্গার তীরে -ডঃ প্রতিসকুমার রায়চৌধুরী-মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা।
  • চব্বিশ পরগনার আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি -গোকুল চন্দ্র দাস-প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স কলকাতা
  • পশ্চিমবঙ্গ -জেলা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা সংখ্যা
  • পশ্চিমবঙ্গ -শিবনাথ শাস্ত্রী সংখ্যা
  • দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অতীত -কালিদাস দত্ত
  • রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ -শিবনাথ শাস্ত্রী

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.