হিন্দু পুরাণে এলজিবিটি বিষয়বস্তু

হিন্দু পুরাণে এলজিবিটি বিষয়বস্তু বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কয়েকজন দেবদেবী ও যোদ্ধার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে বা আচরণে স্ত্রী সমকামীতা, পুরুষ সমকামীতা, উভকামীতা বা রূপান্তরকামীতা অর্থাৎ (এককথায় এলজিবিটি) বৈশিষ্ট্য বা আচরণ পরিদৃষ্ট হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁদের চরিত্রে লিঙ্গ পার্থক্যঅ-বিষমকামী যৌনপ্রবৃত্তিরও আভাস মেলে। ঐতিহ্যগত হিন্দু সাহিত্যে সরাসরি সমকামিতার কথা উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু বেদ, রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরাণিক সাহিত্যে এবং স্থানীয় লোকসাহিত্যে লিঙ্গ পরিবর্তন, সমকামোদ্দীপক (হোমোইরোটিক) ঘটনা এবং আন্তঃলিঙ্গতৃতীয় লিঙ্গ চরিত্রের উপস্থিতি প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়।

লোকদেবতা অরবানের (বাঁ দিকে) রূপান্তরকামী স্ত্রী অরাবীরা (ডান দিকে) তাঁর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করছেন।

হিন্দু পুরাণে প্রায়শই দেখা যায় দেবদেবীরা লিঙ্গ পরিবর্তন করছেন বা বিভিন্ন সময়ে বিপরীত লিঙ্গের রূপ ধারণ করছে অথবা একজন দেবতা ও একজন দেবী মিলিত হয়ে একই শরীরে উভলিঙ্গ রূপ ধারণ করছেন। যৌনমিলনের সুবিধার্থেও দেবতাদের বিপরীত লিঙ্গের অবতার রূপে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়।[1][2][3][4] দেবতা ভিন্ন অন্যান্য চরিত্রদেরও দেবতার বরে বা অভিশাপে অথবা পুনর্জন্মের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় লিঙ্গ পরিবর্তন করতে দেখা যায়।

হিন্দু পুরাণে এমন অসংখ্য ঘটনা দেখা যায়, যেখানে যৌনমিলন একটি অযৌন পবিত্র উদ্দেশ্যে সাধিত হয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এগুলি সমকামী যৌনমিলন। কখনও কখনও দেবতাদের এই জাতীয় মিলনকে নিন্দা করতে দেখা যায়। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে এগুলি তাঁদেরই বরে ঘটেছে।[5][6]

আধুনিক গবেষক ও সমকামী-অধিকার আন্দোলনকারীরা মূলধারার হিন্দু সাহিত্যে উল্লিখিত লিঙ্গ বিভিন্নতা ও অ-বিষমকামী যৌনপ্রবৃত্তি সংক্রান্ত উপাখ্যানগুলি ছাড়াও অপেক্ষাকৃত অল্পপরিচিত গ্রন্থগুলিতে প্রাপ্ত এলজিবিটি বিষয়বস্তুর উপর আলোকপাত করেছেন। এমনকি সাধারণ দৃষ্টিতে যে সকল উপাখ্যানের মধ্যে কোনও প্রকার সমকামিতার আভাস নেই, তাঁরা সেগুলিরও অ-বিষমকামী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অবশ্য এই ধরনের ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে প্রাচীন উপাখ্যানগুলির অর্থ সংক্রান্ত মতবিরোধও দেখা দিয়েছে।[7][8]

দেবদেবীদের লিঙ্গ পার্থক্য

হিন্দুধর্মে ও ভারতীয় পুরাণে একাধিক দেবদেবীকে বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন রূপে পুরুষ ও নারী উভয় সত্ত্বা ধারণ করতে দেখা যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার একজন দেবতা ও একজন দেবী একই সময়ে একই মূর্তিতে একাধারে পুরুষ ও নারী রূপে প্রকাশিত হন। এই রকম একটি মূর্তি হল অর্ধনারীশ্বর। ইনি শিব ও তাঁর পত্নী পার্বতীর সম্মিলিত রূপ।[n 1][1] অর্ধনারীশ্বর নামটির অর্থ "প্রভু, যাঁর অর্ধাংশ নারী"। শিবের এই মূর্তিটি "দ্বৈতসত্ত্বার উর্ধ্বে স্থিত সামগ্রিকতা"র প্রতীক। এই মূর্তি নশ্বর জীব ও অমর দেবদেবীদের এবং পুরুষ ও নারীসত্ত্বার যোগসূত্র।[2] অ্যালাই ড্যানিলোর মতে, "উভলিঙ্গ, সমকামী ও রূপান্তরকামীতার একটি প্রতীকী মূল্য রয়েছে এবং এঁদের সম্মানীয় সত্ত্বা অর্ধনারীশ্বর মূর্তি মনে করা হয়।"[2][9] আরেকটি অনুরূপ মূর্তি হল লক্ষ্মী-নারায়ণ। এই মূর্তিটি সৌন্দর্য ও সম্পদের দেবী লক্ষ্মী ও তাঁর স্বামী বিষ্ণুর যুগল উভলিঙ্গ মূর্তি।[10]

ভাগবত পুরাণ গ্রন্থে পাওয়া যায়, বিষ্ণু অসুরদের অমৃত থেকে বঞ্চিত করার জন্য ছলনাকারী মোহিনী অবতার গ্রহণ করেছিলেন। শিব মোহিনীকে দেখে আকৃষ্ট হন এবং তাঁর বীর্যপাত হয়। সেই বীর্য পাথরের উপর পড়ে সোনায় পরিণত হয়। ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ গ্রন্থে দেখা যায়, শিবের পত্নী পার্বতী তাঁর স্বামীকে মোহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখে "লজ্জায় মাথা নত করেন"। কোনও কোনও উপাখ্যানে দেখা যায়, শিব পুনরায় বিষ্ণুকে মোহিনী মূর্তি ধারণ করতে বলেন, যাতে তিনি প্রকৃত রূপান্তরটি স্বচক্ষে দেখতে পারেন।[3] যে সকল উপাখ্যানে শিব মোহিনীর সত্য প্রকৃতিটি জানতেন, সেই উপাখ্যানগুলিকে "যৌন আকর্ষণে লিঙ্গের অনিশ্চয়তার পরিচায়ক" হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।[11]

পট্টনায়ক লিখেছেন যে, শুধুমাত্র সমকাম উদ্দীপনার দিকে গুরুত্ব আরোপ করলে, লেখকের রচনার গভীর অধিবিদ্যামূলক গুরুত্বটি হারিয়ে যায়: মোহিনীর নারীসত্ত্বা হল সত্যের জাগতিক দিক এবং শিবকে আকর্ষিত করার যে চেষ্টা মোহিনী করেছিলেন, তা শুধুমাত্র শিবকে জাগতিক বিষয়ে আগ্রহী করে তোলার জন্যই তিনি করেন। পট্টনায়ক অপর একটি উপাখ্যানের উদাহরণ দেখিয়ে বলেছেন যে, কেবলমাত্র বিষ্ণুরই শিবকে "মোহিত" করার ক্ষমতা ছিল: এক অসুর নারীমূর্তি ধারণ করে শিবকে হত্যা করতে যায়। সে তার নারীমূর্তির যোনিতে তীক্ষ্ণ দাঁত স্থাপন করেছিল। শিব তার ছলনা ধরে ফেলেন এবং নিজের "পুরুষত্বে" একটি "বজ্র" স্থাপন করে "রতিক্রিয়া"র সময় সেই অসুরকে হত্যা করেন।[12]

হিন্দু দেবতা আয়াপ্পার জন্ম সংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনিটির মধ্যেও অ-বিষমকামী যৌনপ্রবৃত্তির আভাস পাওয়া যায়।[n 2] শিবের ঔরসে মোহিনীরূপী বিষ্ণুর গর্ভে আয়াপ্পার জন্ম হয়। বিষ্ণু লজ্জায় তাঁকে পরিত্যাগ করেন। পট্টনায়ক লিখেছেন, শিবের ঔরসে মোহিনীর গর্ভে আয়াপ্পার জন্ম হয়নি। মোহিনীকে আলিঙ্গন করার সময় শিবের বীর্যপাত হয় এবং সেই বীর্য থেকেই আয়াপ্পার জন্ম হয়েছিল।[13] এই কাহিনির অন্য একটি পাঠান্তর অনুসারে, পন্তলমের পাণ্ড্য রাজা রাজশেখর একটি শিশুকে দত্তক গ্রহণ করেছিলেন। এই কাহিনি অনুসারে, আয়াপ্পা হলেন অযোনিজাত (অর্থাৎযোনি থেকে যাঁর জন্ম হয়নি) এবং হরিহরপুত্র (অর্থাৎ,বিষ্ণু ও শিবের পুত্র)। বড়ো হয়ে আয়াপ্পা একজন মহান যোদ্ধা হয়েছিলেন।[4][14]

মহাভারত মহাকাব্যের তামিল সংস্করণ অনুসারে, বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণ মোহিনী মূর্তি ধারণ করে অরবানকে বিবাহ করেছিলেন। ইরাবান আত্মবলিদানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে প্রেমের স্পর্শ দান করার জন্য কৃষ্ণ তাঁকে বিবাহ করেন। অরবানের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ মোহিনী মূর্তিতেই তাঁর জন্য বিলাপ করতে থাকেন। বার্ষিক তালি অনুষ্ঠানে অরবানের বিবাহ ও মৃত্যুর ঘটনাকে স্মরণ করা হয়। এই অনুষ্টানে হিজরারা (ভারতীয় তৃতীয় লিঙ্গ গোষ্ঠীর মানুষ) কৃষ্ণ-মোহিনীর ভূমিকা গ্রহণ করে এবং একটি গণবিবাহ অনুষ্ঠানে অরবানকে "বিবাহ" করে। এরপর ১৮ দিন ধরে উৎসব চলে। উৎসব শেষ হয় অরবানের আনুষ্ঠানিক সমাধিদানের মধ্য দিয়ে। এই সময় হিজরারা তামিল প্রথানুসারে নৃত্য করতে করতে বুক চাপড়ায়, হাতের চুড়ি ভেঙে ফেলে এবং বৈধব্যের শ্বেত বস্ত্র পরিধান করে।[15]

যোদ্ধাদের লিঙ্গ পার্থক্য

পুরাণকথায় দেবতা নন এমন চরিত্রদেরও লিঙ্গ পরিবর্তন করতে বা বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করতে দেখা যায়। এমনই এক চরিত্র হলেন মহাভারত মহাকাব্যের শিখণ্ডী। শিখণ্ডী বালিকা রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ‘শিখণ্ডিনী’। তাঁর পিতা ছিলেন পাঞ্চাল রাজ্যের রাজা দ্রুপদ। পূর্বজন্মে শিখণ্ডিনী ছিলেন অম্বা নামে এক নারী। ভীষ্ম তাঁকে বিবাহের অযোগ্য বিবেচনা করেছিলেন। অপমানিত হয়ে অম্বা কঠোর তপস্যা করেন এবং দেবতাদের থেকে এই বর প্রাপ্ত হন যে তিনি ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হবেন। পরজন্মে অম্বা শিখণ্ডিনী রূপে জন্মগ্রহণ করেন। একটি দৈববাণী দ্রুপদকে নির্দেশ দিয়েছিল যে, তিনি যেন শিখণ্ডিনীকে পুত্র রূপে পালন করেন। তাই দ্রুপদ তাঁকে পুত্রসন্তান বিবেচনা করতেন। শিখণ্ডিনী যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করেন এবং এক নারীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। বিবাহরাত্রে শিখণ্ডিনীর স্ত্রী জানতে পারেন যে তাঁর "স্বামী" আসলে এক নারী। তিনি শিখণ্ডিনীকে অপমান করেন। শিখণ্ডিনী পালিয়ে আসেন। কিন্তু এক যক্ষের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। যক্ষ ও শিখণ্ডিনী নিজেদের মধ্যে লিঙ্গ আদানপ্রদান করেন। এরপর শিখণ্ডিনী পুরুষ রূপে ফিরে আসেন। তাঁর নাম হয় ‘শিখণ্ডী’। তিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সুখী বিবাহিত জীবন যাপন করতে থাকেন এবং তাঁদের সন্তানাদিও হয়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় ভীষ্ম শিখণ্ডী রূপে পুনর্জন্ম গ্রহণকারী অম্বাকে চিনতে পারেন এবং ‘এক নারী’র সঙ্গে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেন। এরপর অর্জুন প্রায় অপরাজেয় ভীষ্মকে পরাজিত করার জন্য শিখণ্ডীর পিছনে লুকিয়ে ভীষ্মকে পরাজিত করেন। যবদ্বীপীয় উপকথা অনুসারে, শ্রীখণ্ডী (যবদ্বীপীয় উপকথায় শিখণ্ডীর এই নামটিই প্রচলিত) কখনই পুরুষে পরিণত হননি। বরং তিনি ছিলেন পুরুষতুল্য এক নারী এবং অর্জুনের পত্নী।[16] মৃত্যুর পর শিখণ্ডীর পুরুষত্ব সেই যক্ষের কাছে ফিরে যায়।

বালির রাজপথে অর্জুনের মূর্তি

অর্জুন নিজেই লিঙ্গ পার্থক্যের একটি উদাহরণ। উর্বশী নামে এক অপ্সরা অর্জুনকে প্রেম নিবেদন করলে, অর্জুন তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। তখন উর্বশীর অভিশাপে অর্জুন এক "ক্লীব" বা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিতে পরিণত হয়। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে, পাণ্ডবদের বর্ষব্যাপী অজ্ঞাতবাসের ক্ষেত্রে এই অভিশাপ ফলপ্রসূ হবে। অর্জুন বৃহন্নলা নাম গ্রহণ করেন এবং নারীর পোশাক পরিধান করেন। এরপর তিনি রাজা বিরাটের রাজ্যে প্রবেশ করেন এবং রাজকন্যা উত্তরা ও তাঁর সহচরীদের সংগীত ও নৃত্যকলার শিক্ষাদান শুরু করেন।[16][17] ডনিগারের বর্ণনা অনুসারে, অর্জুনের নারীবেশ ধারণ গল্পের মধ্যে হাস্যরসের উৎস। কারণ, তাঁর বাহুদ্বয় ছিল লোমশ।[18] পদ্মপুরাণ অনুসারে, কৃষ্ণের রাসনৃত্যে কেবলমাত্র নারীরই প্রবেশাধিকার ছিল। সেই রাসনৃত্যে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানালে অর্জুন শারীরিকভাবেই নারীতে পরিণত হয়েছিলেন।[17]

আরেকটি উপাখ্যান হল ইলার কাহিনি। এই কাহিনিটি একাধিক হিন্দু ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়। ইলা ছিলেন এক রাজা। তিনি শিব ও পার্বতীর অভিশাপে এক মাস পুরুষ রূপে এবং পরবর্তী এক মাস নারী রূপে দেহধারণ করতেন। লিঙ্গ পরিবর্তনের পর ইলা তাঁর পূর্বতন লিঙ্গের কথা বিস্মৃত হতেন। এই রকম একটি পর্যায়ে ইলা গ্রহদেবতা বুধকে বিবাহ করেন। বুধ ইলার পরিবর্তনশীলতার কথা জানতেন। কিন্তু তিনি ‘পুরুষরূপী’ ইলাকে তা জানালেন না। ইলাও তাঁর নারী রূপের কথা বিস্মৃত হলেন। ইলা যখন স্ত্রী রূপে থাকতেন, তখনই বুধ ও ইলা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্রে বাস করতেন। রামায়ণ অনুসারে, ইলা বুধের এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। যদিও মহাভারত অনুসারে, ইলাকেই সেই পুত্রের মাতা ও পিতা বলা হয়েছে। পুত্রের জন্মের পর ইলার অভিশাপের মেয়াদ শেষ হয়। তখন ইলা পাকাপাকিভাবে পুরুষে পরিণত হন। এরপর ইলা তাঁর স্ত্রীর কাছে ফিরে যান এবং তাঁর একাধিক সন্তানের জন্ম হয়।[19][20][21]

এলজিবিটি ও তৃতীয় লিঙ্গের রক্ষক

একাধিক দেবদেবীকে তৃতীয়-লিঙ্গ বা সমকামীদের রক্ষাকর্তা মনে করা হয়। এই সব দেবদেবীদের পৌরাণিক কাহিনি বা তাঁদের পূজার রীতিনীতিগুলি এই ধারণার উৎস। কনার ও স্পার্কস মনে করেন যে, অগ্নি, প্রেম ও যৌনতার দেবী অরণিকে তাঁর অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে স্ত্রী সমকামিতার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে: উক্ত অনুষ্ঠানে দুটি কাঠের টুকরোকে নারী মূর্তি মনে করা হয়। এগুলির নামকরণ করা হয় অধরারণিউতরারণি। তারপর এই দুটি টুকরোকে পরস্পরের সঙ্গে ঘষা হয়। এটি একটি আধ্যাত্মিক স্ত্রী সমকামী মিলনের পরিচায়ক।[22]

বহুচারা মাতা হলেন হিজরাদের দেবী। তাঁর জনপ্রিয় মূর্তিটিতে দেখা যায়, তিনি একটি মোরগের পিঠে বসে আছেন এবং হাতে ধরে আছেন একটি তরবারি, ত্রিশূল ও একটি বই। বহুচারা সংক্রান্ত কাহিনিগুলিতে পুরুষাঙ্গ কর্তন এবং শারীরিক যৌন বৈশিষ্ট্যের অন্যান্য পরিবর্তনের বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। এই জন্য তাঁকে পুরুষের প্রতি অভিশাপদাত্রী দেবী মনে করা হয়। কথিত আছে, বহুচারা ছিলেন এক নশ্বর নারী। তিনি শহিদ হন। একটি গল্পে দেখা যায়, একদল দস্যু বহুচারাকে ধর্ষণ করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু তিনি তরবারি বার করে নিজের স্তনদুটি কেটে ফেলেন এবং মারা যান।[23][24] অন্য একটি গল্পে দেখা যায়, বহুচারার স্বামী যখন একটি উপবনে সমকামী রতিক্রিয়ায় রত ছিলেন, সেই সময় বহুচারা তাঁকে ধরে ফেলেন। ফলে তাঁর পুরুষাঙ্গ খসে যায় এবং তিনি নারীর বেশ ধারণ করতে বাধ্য হন।[5]

বহুচারার উপাখ্যানগুলিতে তাঁর দৈবসত্ত্বা পাওয়ার পর লিঙ্গ পার্থক্যের বিষয়টি লক্ষিত হয়। একটি কিংবদন্তি অনুসারে, এক রাজা বহুচারার কাছে পুত্রসন্তান কামনা করেছিলেন। বহুচারা তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। কিন্তু বড়ো হয়ে রাজকুমার সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হন। এক রাত্রে বহুচারা স্বপ্নে সেই রাজকুমারকে দেখা দেন এবং আদেশ করেন যাতে তিনি নিজের পুরুষাঙ্গ কর্তন করেন, নারীর বেশ ধারণ করেন এবং তাঁর দাসত্ব করেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, বহুচারা এরপরও পুরুষত্বহীন পুরুষদের চিহ্নিত করে সেই কাজ করতে বলেন। যারা তা করতে অস্বীকার করে, তিনি তাদের শাস্তি দেন। তারা পরবর্তী সাত জন্ম পুরুষত্বহীন হয়ে থাকে। এই গল্পটিই বহুচারা কাল্টের উৎস। বহুচারার ভক্তদের নিজের পুরুষাঙ্গ কর্তন করে আজীবন ব্রহ্মচারী থাকতে হয়।[25]

কৃষ্ণের পুত্র শাম্বও খোজা পুরুষ, রূপান্তরকামী ও সমকামোদ্দীপনার পৃষ্ঠপোষক। শাম্ব নারীর বস্ত্র পরিধান করে মানুষকে উপহাস করতেন এবং বিপথে চালনা করতেন। নারীর বেশ ধারণ করে তিনি সহজেই নারীদের সঙ্গে মিশতে পারতেন এবং তাঁদের সম্ভোগ করতেন।[26] মৌষলপুরাণ গ্রন্থে দেখা যায়, শাম্ব একবার নারীর বেশ ধারণ করে কয়েকজন ঋষিকে নিজের গর্ভধারণ নিয়ে প্রশ্ন করেন। ঋষিরা তাঁকে অভিশাপ দেন যে, পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি লৌহ মুষল প্রসব করবেন।[27]

সমকামী যৌন সম্পর্ক

দেবতাদের মধ্যে সমকামী বা উভকামী ক্রিয়াকলাপ ঘটতে দেখা যায়। যদিও এই ধরনের আদানপ্রদান যৌনসুখ উপভোগের জন্য ঘটে না। এগুলি শুধুমাত্র অনুষ্ঠান-সংক্রান্ত বা অন্যান্য উদ্দেশ্যে ঘটে। আগুন, সম্পদ ও সৃষ্টিশক্তির দেবতা অগ্নির সঙ্গে সমকামিতার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি অন্যান্য দেবতাদের বীর্য গ্রহণ করেন। অগ্নি দেবী স্বাহাকে বিবাহ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তাঁকে ও চন্দ্রদেবতা সোমকে সমকামী যুগল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সম্পর্কে অগ্নি গ্রহিতার ভূমিকা পালন করেন। তিনি নিজের মুখে সোমের বীর্য গ্রহণ করেন। এটি পৃথিবী থেকে স্বর্গে যজ্ঞের আহুতি নিয়ে যাওয়ায় অগ্নির ভূমিকাটির অনুরূপ। রক্ষণশীল হিন্দুধর্মে এটিকে "মিথুন" বা আনুষ্ঠানিক যৌন ক্রিয়া বলা হয় এবং বলা হয় যে অগ্নি ও তাঁর মুখ নারীর ভূমিকা পালন করেন।[28][29]

কার্তিকের জন্মবৃত্তান্ত

অগ্নি যজ্ঞের আহুতি গ্রহণ করেন। এই ধারণাটি তাঁর অন্য দেবতাদের বীর্য গ্রহণ করার অনুরূপ।

পুরুষ-সৌন্দর্য ও যুদ্ধের দেবতা কার্তিকের জন্ম-সংক্রান্ত পুরাণকথাতেও অগ্নিকে বীর্যগ্রহিতা রূপে দেখা যায়।[n 3] কার্তিকের জন্মকাহিনির একাধিক পাঠান্তর পাওয়া যায়। এগুলির অনেকগুলিতেই দেখা যায় যে, শুধুমাত্র পুরুষের দ্বারাই কার্তিকের জন্ম হয়েছে। তবে এগুলিতে বিষমকামী যৌনতা বা ইচ্ছাও একটি ভূমিকা গ্রহণ করেছে। যদিও পার্বতীকেই কার্তিকের মা বলা হয়ে থাকে। কারণ, শিবের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনিই শিবের বীর্যপাতের কারণ হয়েছিলেন। কোনও কোনও কাহিনিতে গঙ্গাকে কার্তিকের মা বলা হয়। তিনি অগ্নির থেকে বীর্য গ্রহণ করে অজাত শিশুটিকে বহন করেছিলেন। এই ক্ষেত্রে জনকের ভূমিকায় কোথাও শিবকে, কোথাও অগ্নিকে অথবা কোথাও শিব ও অগ্নি দুই জনকেই রাখা হয়েছে।[30] শিবপুরাণরামায়ণ গ্রন্থে রয়েছে, দেবতারা শিব ও পার্বতীর ‘মহাসুরতে’র (প্রগাঢ় রতিক্রিয়া) ফল কী হতে পারে, তা চিন্তা করে ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁরা সেই রতিক্রিয়ায় বাধা দিলেন। শিব তখন তাঁদের সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন, “এখন যে বীর্য আমি পাত করব, তা যে গ্রহণ করতে পারবে সে সামনে আসুক।” দেবতাদের অনুরোধে অগ্নি শিবের বীর্য নিজের হস্তে গ্রহণ করলেন এবং তা পান করলেন।[29] এই কাহিনিগুলিতে দেখা যায়, শিব ও পার্বতী অগ্নির কাজকে অনুমোদন করছেন না। তাঁরা এই কাজকে ‘অশুভ’ ও ‘ভুল’ বলে উল্লেখ করছেন। খ্রিস্টীয় ১১শ শতাব্দীতে রচিত কথাসরিৎসাগর গ্রন্থে যদিও দেখা যায়, শিব বলপূর্বক অগ্নিকে নিজের বীর্য গ্রহণে বাধ্য করছেন।[31] সেই বীর্য অগ্নির উদরে প্রচণ্ড জ্বলন সৃষ্টি করল। তখন তিনি শিবের উপদেশে তা একদল ঋষিপত্নীর উপর উগরে দিলেন। ঋষিপত্নীগণ আবার সেই বীর্য গঙ্গা নদীতে ফেলে দিলেন। গঙ্গার তীরে পড়ে কার্তিকেয়ের জন্ম হল। মহাভারত গ্রন্থেও কার্তিককে অগ্নির পুত্র বলা হয়েছে। এই গ্রন্থ অনুসারে, অগ্নি একজন কৃত্তিকার হাতে নিজের বীর্য দান করেছিলেন। উক্ত কৃত্তিকা সেই বীর্য একটি হ্রদে নিক্ষেপ করেন। তা থেকেই কার্তিকের জন্ম হয়। কোনও কোনও পুরাণকথায় দেখা যায়, অগ্নি তাঁর বীর্য এমন এক পর্বতের উপর পাত করেছিলেন, যেটি শিবের দিব্য বীর্যে নির্মিত হয়েছিল। এইভাবে কার্তিক শিব ও অগ্নির সন্তান। বনপর্ব অংশের মার্কণ্ডেয় কৃত একটি ব্যাখ্যায় তা-ই বলা হয়েছে।[30]

আরও দেখুন

  • ধর্ম ও সমকামিতা
  • ধর্ম ও রূপান্তরকামিতা
  • সমকামী ধর্মতত্ত্ব
  • হিন্দুধর্মে এলজিবিটি প্রসঙ্গ
  • পুরাণে এলজিবিটি বিষয়বস্তু
  • এলজিবিটি সাহিত্য
  • এলজিবিটি ইতিহাস

পাদটীকা

  1. পার্বতীকে শক্তি বা উমাও বলা হয়।
  2. আয়াপ্পা হরিহরপুত্র ও মণিকণ্ঠ নামেও পরিচিত। তিনিই হিন্দু দেবতা ধর্ম-শাস্তা
  3. কার্তিককে মুরুগান, স্কন্দ (‘যা উতলে পড়েছে বা বীজ’), সুব্রহ্মণ্য, কুমার (‘অবিবাহিত’ বা ‘মার-বিজয়ী’), গুহ, ললিত (‘সুন্দর’), কান্ত (‘সুপুরুষ’) সেনাপতি ও ব্রহ্মচারীও বলা হয়।

তথ্যসূত্র

  1. Conner & Sparks (1998), p. 305, "Shiva"
  2. Conner & Sparks (1998), p. 67, "Ardhanarishvara "
  3. Vanita & Kidwai (2001), p. 69
  4. Vanita & Kidwai (2001), p. 94
  5. Pattanaik (2001), p. 99
  6. Quote: "The hermaphrodite, the homosexual and the transvestite have a symbolic value and are considered privileged beings, images of the Ardhararishvara.". Alain Danielou
  7. Conner & Sparks (1998), p. 211, "Lakshmi"
  8. Vanita & Kidwai (2001), p. 70
  9. Pattanaik (2001), pp. 73–74
  10. Pattanaik (2001), p. 76
  11. Smith, B.L., p. 5, Legitimation of Power in South Asia
  12. Canner & Sparks, p. 66, "Aravan"
  13. Conner & Sparks (1998), p. 68, "Arjuna"
  14. Pattanaik (2001), p. 80
  15. Doniger, p. 281
  16. Vanita & Kidwai (2001), p. 18.
  17. Pattanaik (2001), pp. 45–47
  18. Conner & Sparks (1998), p. 183, "Ila/Sudyumna"
  19. Conner & Sparks (1998), p. 66, "Arani".
  20. Conner & Sparks (1998), p. 81, "Bahucharamata"
  21. Pattanaik (2001), p. 101
  22. Abott, Elizabeth (২০০১)। A History of Celibacy। Cambridge, MA, USA: Da Capo Press। পৃষ্ঠা 329। আইএসবিএন 0-306-81041-7।
  23. Conner Sparks (1998), p. 303, "Shamba"
  24. Chattopadhyaya, Bankim Chandra। Krishna Charitra। Pustak Mahal। পৃষ্ঠা 165–166। আইএসবিএন 978-81-223-1035-1।
  25. Conner & Sparks (1998), p. 309, "Soma"
  26. Conner & Sparks (1998), p. 44, "Agni"
  27. Vanita & Kidwai (2001), p. 78
  28. Vanita & Kidwai (2001), p. 79

সাধারণ

  • Conner, Randy P.; Sparks, David Hatfield; Sparks, Mariya (১৯৯৮)। Cassell's Encyclopedia of Queer Myth, Symbol and Spirit। UK: Cassell। আইএসবিএন 0-304-70423-7।
  • Courtright, Paul B. (১৯৮৯)। Ganesa: Lord of Obstacles, Lord of Beginnings। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-505742-3।
  • Das Wilhelm, Amara। Tritiya-Prakriti: People of the Third Sex। 2006: Xlibris Corporation। আইএসবিএন 978-1-4134-6420-7।
  • Doniger, Wendy (১৯৯৯)। Splitting the difference: gender and myth in ancient Greece and India (Volumes 1996–1997 of Jordan lectures in comparative religion)। University of Chicago Press। আইএসবিএন 978-0-226-15641-5।
  • Doniger O'Flaherty, Wendy (১৯৮৭)। Tales of sex and violence: folklore, sacrifice, and danger in the Jaiminīya Brāhmaṇa। Motilal Banarsidass। আইএসবিএন 978-81-208-0267-4।
  • Goldman, Robert P. (July–Sept 1993)। "Transsexualism, gender, and anxiety in traditional India"The Journal of the American Oriental Society। The American Oriental Society। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  • Greenberg, Yudit Kornberg (২০০৭)। Encyclopedia of Love in World Religions। ABC-CLIO। আইএসবিএন 978-1-85109-980-1।
  • Murphy, Timothy F. (২০০০)। Reader's guide to lesbian and gay studies। Taylor & Francis। আইএসবিএন 978-1-57958-142-8।
  • Pattanaik, Devdutt (২০০১)। The man who was a woman and other queer tales of Hindu lore। Routledge। আইএসবিএন 978-1-56023-181-3।
  • Penczak, Christopher (২০০৩)। Gay Witchcraft: Empowering the Tribe। Weiser। আইএসবিএন 978-1-57863-281-7।
  • Thadani, Giti (১৯৯৬)। Sakhiyani: lesbian desire in ancient and modern India। Cassell। আইএসবিএন 978-0-304-33452-0।
  • Vanita, Ruth; Kidwai, Saleem (২০০১)। Same-sex love in India: readings from literature and history। Palgrave Macmillan। আইএসবিএন 978-0-312-29324-6।
  • Wilhelm, Amara Das (২০০৪)। Hindu Deities and the Third Sex। ২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জুলাই ২০১৬

টেমপ্লেট:LGBT in India টেমপ্লেট:LGBT fiction

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.