হাথোর

হাথোর (প্রাচীন মিশরীয়: ḥwt-ḥr, "হোরাসের গৃহ", গ্রিক: Ἁθώρ Hathōr) ছিলেন প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের অন্যতম প্রধান দেবী। প্রাচীন মিশরীয়দের ধারণায় তাঁর ভূমিকা ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। আকাশের দেবী হিসেবে হাথোর ছিলেন আকাশ-দেবতা হোরাস ও সূর্যদেবতা রা-এর একাধারে মাতা ও পত্নী। আবার রাজপদের সঙ্গে এই দুই দেবতার সম্পর্কের প্রেক্ষিতে হাথোরকে এঁদের পার্থিব প্রতিনিধি ফ্যারাওদের প্রতীকী মাতা বলে গণ্য করা হত। অন্যদিকে যে সব দেবী "রা-এর চোখ" অর্থাৎ রা-এর নারী প্রতিমূর্তি চক্ষুদেবী হিসেবে বিবেচিত হতেন, হাথোর তাঁদেরও অন্যতম ছিলেন। চক্ষুদেবী রূপে হাথোরের প্রতিহিংসাপরায়ণতা রা-কে তাঁর শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করে বলে মনে করা হত। এর বিপরীতে কল্যাণময়ী রূপে হাথোর ছিলেন সংগীত, নৃত্যকলা, আনন্দ, প্রেম, যৌনতা ও মাতৃস্নেহের প্রতীক। মিশরীয় পুরাণে তাঁকে একাধিক পুরুষ দেবতার দাম্পত্যসঙ্গী এবং সেই সব দেবতার সন্তানের জননী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পত্নী ও মাতা রূপে তাঁর এই দুই দিককে প্রাচীন মিশরে নারীজাতির আদর্শ জ্ঞান করা হত। এছাড়াও মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে, হাথোর ইহলোক ও পরলোকের সীমানা পার হয়ে মৃতের আত্মাকে পরলোকে উপনীত হতে সহায়তা করেন।

হাথোর
Profile of a woman in ancient Egyptian clothing. She has yellow skin and bears on head a pair of cow horns, between which sits a red disk encircled by a cobra. She holds a forked staff in one hand and an ankh sign in the other.
হাথোরের সর্বাধিক পরিচিত রূপ (আংশিকভাবে নেফেরতারির সমাধিতে প্রাপ্ত ছবিগুলির ভিত্তিতে অঙ্কিত)
চিত্রলিপিমিশরীয়: ḥwt-ḥr
O10
[1]
প্রধান অর্চনাকেন্দ্র centerদেনদেরা, মেমফিস
মাতাপিতারা
সঙ্গীরা, হোরাস, আতুম, আমুন, খোনসু
সন্তানসন্ততিহার-পা-খেরেদ (শিশু হোরাস), আইহি, নেফেরহোতেপ

প্রাচীন মিশরে বহু ক্ষেত্রেই হাথোরকে এক গো-রূপিণী দেবী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল। এই রূপটি ছিল তাঁর মাতৃত্ব ও স্বর্গীয় সত্ত্বার প্রতীক। অবশ্য হাথোরের যে রূপটি সর্বাধিক পরিচিত ছিল সেটিতে তাঁকে গোরুর শিং ও সৌর চাকতি-সংবলিত শিরস্ত্রাণ পরিহিত এক নারী হিসেবেই দেখা যায়। এছাড়া সিংহী, গোখরো সাপ ও সাইকামোর গাছকেও তাঁর প্রতীক মনে করা হত।

গবাদি পশুর রক্ষয়িত্রী ও হাথোরের অনুরূপ যে সকল দেবীর পূজা প্রাচীন মিশরীয়রা করত, তাঁদের খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মিশরীয় শিল্পকলাতেই দেখা যায়। কিন্তু হাথোরের আবির্ভাব সম্ভবত পুরনো রাজ্যের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮৬-২১৮১ অব্দ) পূর্বে ঘটেনি। এই রাজ্যের শাসকবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় মিশরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দেবদেবীর তালিকায় স্থান পান হাথোর। শুধু তাই নয়, অন্যান্য দেবদেবীদের তুলনায় অধিকতর সংখ্যায় মন্দির উৎসর্গিত হয় হাথোরের উদ্দেশ্যেই। উচ্চ মিশরের দেনদেরায় অবস্থিত হাথোরের প্রধান মন্দিরটি ছাড়াও এই দেবীকে পূজা করা হত তাঁর পুরুষ দাম্পত্যসঙ্গীদের প্রতি উৎসর্গিত মন্দিরগুলিতেও। এছাড়া মিশরীয়রা নুবিয়া ও কনানের মতো বিদেশি রাজ্য এবং সেই সব রাজ্যের ধূপ ও রত্নপাথরের মতো মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রীর সঙ্গেও হাথোরকে যুক্ত করায় সেই সব রাজ্যের কিছু অংশেও তাঁর পূজার প্রচলন ঘটেছিল। ব্যক্তিগত প্রার্থনা ও মানত পূরণের উদ্দেশ্যে পূজিত মিশরীয় দেবদেবীদেরও অন্যতম ছিলেন হাথোর। বিশেষত সন্তানকামনায় মেয়েরা তাঁর কাছে মানত করত।

নতুন রাজ্যের রাজত্বকালে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০-১০৭০ অব্দে) রাজকীয় ভাবাদর্শে হাথোরের স্থানটি দখল করে নেন মুতআইসিসের মতো দেবীরা। তা সত্ত্বেও মিশরের সর্বাধিক পূজিত দেবদেবীদের তালিকা থেকে তাঁর নামটি মুছে যায়নি। নতুন রাজ্যের সমাপ্তির পর আইসিসের প্রভাবে হাথোর ক্রমশ ঢাকা পড়ে যেতে থাকেন। কিন্তু খ্রিস্টের জন্মের অব্যবহিত পরের কয়েক শতকে প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের অবলুপ্তির পূর্বাবধি তাঁর পূজা প্রচলিত ছিল বলেই জানা যায়।

উৎস

Drawing of a slate carved with reliefs
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব একত্রিংশ শতাব্দীতে খোদিত নারমার প্ল্যালিটের অনুকৃতি; এই ছবির উপরিভাগে এবং রাজার কোমরবন্ধনীর নিচে (বা সজ্জাবরণীতে) চিত্রিত গোরুর শিং ও কান-বিশিষ্ট নারীমুখ দেবী হাথোর বা বাতের প্রতীক।

মিশরের প্রাক্-রাজবংশীয় (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ অব্দের পূর্বে) শিল্পকলায় গবাদি পশু প্রায়শই চিত্রিত হত। এই সব ছবির মধ্যে গোরুর শিঙের মতো উর্ধ্বমুখী ও বাঁকানো বাহুবিশিষ্ট নারীর ছবিও পাওয়া যায়। দুই ধরনের ছবিই সম্ভবত ছিল গবাদি পশুর দেবীদের প্রতীক। [2] বাছুরের প্রতি যত্নগ্রহণ ও মানবজাতিকে দুধ জোগানোর জন্য মাতৃত্ব ও পুষ্টির প্রতীক হিসেবে প্রাচীন মিশর সহ বিভিন্ন প্রাচীন সংস্কৃতিতে গোরু ছিল পূজনীয় এক পশু। প্রাগৈতিহাসিক যুগের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০-৩২০০ অব্দ) দ্বিতীয় নাকাদা পর্যায়ের গেরজেহ্ প্যালিট নামে একটি প্রস্তর প্যালিটে নক্ষত্রবেষ্টিত ও ভিতরের দিকে বাঁকানো শিং-বিশিষ্ট একটি গোরুর মাথার ছায়াচিত্র দেখা যায়। এই প্যালিটটি দৃষ্টে অনুমিত হয় যে, হাথোর, মেহেত-ওয়েরেতনুটের মতো যে দেবীরা পরবর্তীকালে গো-প্রতীকের মাধ্যমে উপস্থাপিত হতেন তাঁদের মতো গোরুকেও প্রাচীন মিশরীয়রা আকাশের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।[3]

এই সকল পূর্বদৃষ্টান্ত সত্ত্বেও পুরনো রাজ্যের চতুর্থ রাজবংশের রাজত্বকালের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৬১৩-২৪৯৪ অব্দ) আগে হাথোরের কোনও নিদর্শন দ্ব্যর্থহীনভাবে চিহ্নিত করা যায় না।[4] যদিও আদি রাজবংশীয় যুগের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০-২৬৮৬ অব্দ) কয়েকটি দ্রব্যসামগ্রীতে সম্ভবত তাঁকেই পরোক্ষ উল্লেখ করা হয়েছিল।[5] সুস্পষ্টভাবে যখন হাথোরের চিত্রাঙ্কন শুরু হয়, তখন প্রাক্-রাজবংশীয় শিল্পের বিপরীত রীতিতে তাঁর শিং দু’টি বাঁক নেয় ভিতরের দিকে। [6]

মিশরীয় ইতিহাসের একেবারে আদিপর্বের নারমার প্যালিটে ভিতরের দিকে বাঁকানো শিং-বিশিষ্ট এক ধরনের গো-দেবতার ছবির পাওয়া যায়। প্যালিটটির উপরিভাগে এবং প্যালিটে চিত্রিত রাজা নারমারের কোমরবন্ধনী (বা সজ্জাবরণীর নিম্নাংশে) এই দেবতার একাধিক ছবি অঙ্কিত হয়েছিল। মিশরতত্ত্ববিদ হেনরি জর্জ ফিশারের মতে এই দেবতা সম্ভবত বাত নাম্নী দেবী; পরবর্তীকালে যাঁকে ভিতরের দিকে কুঞ্চিত শিং-সংবলিত নারীমুখবিশিষ্ট দেবী হিসেবে চিত্রিত করা হত। ফিশারের মতে, উক্ত কুঞ্চিত শিংটি ছিল আপাতদৃষ্টিতে গোরুর শিং-এর অনুকৃতি।[6] অপর মিশরতত্ত্ববিদ লানা ট্রয় অবশ্য পুরনো রাজ্যের শেষভাগের পিরামিড লিপির এমন একটি অংশ চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন, যেখানে হাথোরকে রাজার "সজ্জাবরণী"-র সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তাঁর মতে, লিপির এই অংশটি নারমার প্যালিটে নারমারের বস্ত্রে অঙ্কিত দেবীর স্মৃতিই বহন করছে। এই প্রমাণের ভিত্তিতেই তিনি নারমার প্যালিটে চিত্রিত দেবীকে বাতের পরিবর্তে হাথোর বলে চিহ্নিত করেন।[4][7]

চতুর্থ রাজবংশের আমলে হাথোরের প্রাধান্য দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।[8] উচ্চ মিশরের দেনদেরায় ইতিপূর্বে পূজিত এক আদি কুমির-দেবতার স্থান দখল করে হাথোর সেই অঞ্চলের অভিভাবিকা দেবীতে পরিণত হন। পার্শ্ববর্তী হু অঞ্চলে প্রচলিত বাতের কাল্টটিকেও হাথোরের উপাসকেরা ক্রমশ আত্মীভূত করতে শুরু করে। ফলে মধ্য রাজ্যের আমলেই (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০৫৫-১৬৫০ অব্দ) দুই দেবী একীভূত হয়ে যান।[9] পুরনো রাজ্যের ফ্যারাও-কেন্দ্রিক ধর্মতত্ত্বেও পুরনো রীতি বর্জিত হয়ে দেবতাদের রাজা তথা পার্থিব রাজার পিতা ও অভিভাবক হিসেবে সূর্যদেবতা রা-এর প্রাধান্য গুরুত্বপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় হাথোরের মর্যাদাও। মিশরীয় পুরাণে তিনি রা-এর পত্নীর স্বীকৃতি অর্জন করেন এবং সেই সূত্রে লাভ করেন ফ্যারাওদের দিব্য মাতার মর্যাদাও।[8]

ভূমিকা

প্রাচীন মিশরীয় পুরাণে হাথোরকে বহু রূপে এবং বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় ভূমিকায় চিত্রিত করা হয়েছে।[10] মিশরতত্ত্ববিদ রবিন গিলামের মতে, প্রথম দিকে প্রাচীন মিশরের সাধারণ মানুষ অসংখ্য স্থানীয় দেবীর পূজা করত। পুরনো রাজ্যের শাসকবর্গ সেই সব দেবী-সংক্রান্ত ধারণাগুলিকে এক ছাতার তলায় এনে একক রাজকীয় দেবীর প্রচার শুরু করলে হাথোরের এই বিচিত্র রূপগুলির উদ্ভব ঘটে এবং তারপর থেকে পূর্বোক্ত দেবীরা হাথোরেরই রূপভেদ হিসেবে কল্পিত হতে থাকেন।[11] প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্যে প্রায়শই "সপ্ত হাথোর" বা সাতজন হাথোরের ধারণাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।[10] সংখ্যায় অল্প হলেও ক্ষেত্রবিশেষে আরও বহু সংখ্যক (সর্বাধিক ৩৬২ জন) হাথোরের কথাও উল্লিখিত হয়েছে।[12] এই কারণেই গিলাম হাথোরকে একক দেবতার পরিবর্তে দেবতাদের একটি শ্রেণি আখ্যা দেওয়ার পক্ষপাতী।[11] মিশরীয়রা তাদের নারী দেবতাদের সঙ্গে কী কী বিষয় যুক্ত করত তার একটি প্রতিফলন ঘটেছে হাথোরের বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমিকাগুলির মধ্যে। শুধু তাই নয়, প্রাচীন মিশরে আদর্শ নারীর উদাহরণ হিসেবেও হাথোর যেভাবে চিত্রিত হয়েছেন, তেমনভাবে আর কোনও দেবতা হননি।[13]

আকাশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী

প্রাচীন মিশরে হাথোরকে "আকাশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী" ও "নক্ষত্রলোকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী" নামে অভিহিত করা হত। মিশরীয়রা মনে করত, রা ও অন্যান্য সৌরদেবতাদের সঙ্গে হাথোরও আকাশেই বাস করেন। তাদের ধারণায় আকাশ ছিল এমন এক জলাশয় যেখানে সূর্যদেবতা তাঁর ডিঙি নৌকা চালিয়ে এগিয়ে চলেন। প্রাচীন মিশরীয় সৃষ্টিপুরাণে সৃষ্টির আদিতে যে জল থেকে সূর্যের উদ্ভব ঘটেছিল, সেই জলের সঙ্গেই এই ধারণাটিকে যুক্ত করেছিল মিশরীয়রা। এই আকাশের অধিবাসিনী মাতৃকাদেবী হাথোরকে তারা প্রায়শই প্রকাশ করত গো-প্রতীকের মাধ্যমে। হাথোর ও মেহেত-ওয়েরেত উভয় গো-দেবীকেই সূর্যদেবের জন্মদাত্রী মনে করা হত। তাই হাথোরের শিং দু’টির মধ্যে সূর্যকে অঙ্কন করা হত। কথিত ছিল, নুটের মতো হাথোরও প্রতিদিন ভোরে সূর্যকে জন্মদান করেন।[14]

মিশরীয় ভাষায় হাথোরের নাম ছিল ḥwt-ḥrw[15] বা ḥwt-ḥr[16] সাধারণ অনুবাদে শব্দটির অর্থ ছিল "হোরাসের গৃহ"; যদিও এটিকে "আকাশ আমার গৃহ" অর্থেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।[17] বাজপাখি-রূপী দেবতা হোরাস অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে সূর্য ও আকাশেরও দেবতা বলে পরিগণিত হতেন। যে আকাশে হোরাস বাস করেন অথবা সূর্যরূপী হোরাস দেবীর যে গর্ভ থেকে প্রতিদিন জন্মগ্রহণ করেন, সম্ভবত সেই দু’টিকেই "ভবন" শব্দটির দ্বারা বোঝানো হত।[18]

সৌরদেবী

হাথোর ছিলেন একজন সৌরদেবী, সূর্যদেবতা হোরাস ও রা-এর নারী প্রতিরূপ এবং মিশরীয় বিশ্বাসে রা যখন আকাশে তাঁর ডিঙি নৌকা বেয়ে চলেন, সেই সময় তাঁর সেই দিব্য যাত্রার এক সদস্যা।[18] তাঁকে সাধারণভাবে বলা হত "স্বর্ণালি [দেবী]" নামে, যা ছিল সূর্যের রশ্মিবিকিরণের রূপক এবং দেনদেরায় তাঁর মন্দিরের লিপিগুলিতে বলা হয়েছে যে, তাঁর রশ্মি দ্বারা সমগ্র পৃথিবী আলোকিত হয়।[19] কখনও কখনও তাঁকে পর দেবী নেবেথেতেপেতের (যাঁর নামের অর্থ "পূজা-উৎসর্গের দেবী", "সন্তুষ্টির দেবী"[20] বা "যোনিদ্বারের দেবী"[21]) সঙ্গে একীভূত করা হত। হেলিওপোলিসে রা-এর কাল্ট কেন্দ্রে নেবেথেতেপেতকে রা-এর পত্নী হিসেবে পূজা করা হত।[22] মিশরতত্ত্ববিদ রুডলফ অ্যান্থেসের মতে, হেলিওপোলিসে হাথোরের নামটির সঙ্গে পৌরাণিক "হোরাসের ভবন" হিসেবে হাথোরের নামের যে উল্লেখ পাওয়া যায় তা রাজপদের ভাবাদর্শের সঙ্গে যুক্ত ছিল।[23]

মিশরের অনেক দেবীকেই রা-এর চোখ অর্থাৎ সৌরচাকতির নারী মূর্তিরূপ ও রা-এর নিজস্ব ক্ষমতার এক সম্প্রসারিত রূপের ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যেত। হাথোর ছিলেন এই দেবীদের অন্যতম। কখনও কখনও রা-কে উক্ত সৌরচাকতির ভিতর অঙ্কন করা হত। ট্রয়ের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এর অর্থ চক্ষুদেবীকে একটি জরায়ু হিসেবে দেখা হত এবং মনে করা হত যে সেই জরায়ু থেকেই সূর্যদেবতার জন্ম হয়। রা-এর মা, স্ত্রী ও কন্যা রূপে হাথোরের আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী ভূমিকাগুলি সূর্যের দৈনন্দিন চক্রটিকে প্রতিফলিত করে। সূর্যাস্তের সময় সূর্যদেবতা দেবীর শরীরে প্রবেশ করে তাঁকে গর্ভবতী করেন এবং সূর্যোদয়ের সময় দেবীর জরায়ু থেকে জাত দেবতাদের পিতা রূপে দেখা দেন। এই জাত দেবতারা হলেন তিনি নিজে ও চক্ষু দেবী। চক্ষুদেবী এরপর সূর্যদেবতারই জন্ম দেন। রা তাঁর কন্যা চক্ষুদেবীকে জাগরিত করেন, যিনি অপর দিকে তাঁর পুত্র রা-কেই জন্মদান করেন। পুনরুৎপাদনের এই চক্র ক্রমাগতই চলতে থাকে।[24]

রা-এর চোখ সূর্যদেবতাকে তাঁর শত্রুদের থেকে রক্ষা করেন। এই চোখকে প্রায়শই ইউরায়েয়াস বা উত্থিত গোখরো সাপ অথবা সিংহী প্রতীকের দ্বারা উপস্থাপনা করা হত।[25] রা-এর চোখের একটি রূপ পরিচিত ছিল "চতুর্মুখী হাথোর" নামে। এই রূপের প্রতীক ছিল একত্রে চারটি গোখরো সাপ। কথিত ছিল যে, এই চারটি সাপ চার দিক থেকে সূর্যদেবতার দিকে এগিয়ে শত্রুদের দিকে নজর রাখে।[26] নতুন রাজ্য (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০-১০৭০ অব্দ) ও তার পরবর্তীকালে পরিচিত এক শ্রেণির অতিকথায় বর্ণিত হয়েছে চক্ষুদেবীর ক্রোধ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠলে কী ঘটতে পারে। স্বর্গীয় গোরুর বই নামে পরিচিত অন্ত্যেষ্টিলিপিতে দেখা যায়, যে সব মানুষ রা-এর শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তাদের শাস্তি দিতে রা হাথোরকে পাঠিয়েছিলেন চক্ষুদেবী হিসেবে। হাথোর সিংহী দেবী সেখমেতের রূপ ধরে বিদ্রোহী মানুষদের গণহত্যার আয়োজন করেন। কিন্তু রা স্থির করেন তাঁকে সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করতে দেবেন না। তিনি আদেশ করেন যে, অনুগ্র মদ লাল রঙে রঞ্জিত করে সারা দেশের মাটিতে ঢেলে দেওয়া হোক। চক্ষু দেবী সেই মদকে রক্ত মনে মরে পান করেন এবং মদোন্মত্ত অবস্থায় তিনি রূপান্তরিত হন সদয় ও সুন্দরী হাথোরে।[27] শেষটলেমীয় পর্যায়ের দূরবাসিনী দেবীর অতিকথাটিও এই কাহিনির সঙ্গে জড়িত। চক্ষুদেবী, কখনও হাথোরের রূপে, রা-এর নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মিশরের পশ্চিমে লিবিয়া অথবা দক্ষিণে নুবিয়ার মধ্যে কোনও একটি বিদেশি রাজ্যে ক্রোধোন্মত্ত অবস্থায় ছোটাছুটি শুরু করেন। চক্ষু হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে রা অন্য একজন দেবতাকে (যেমন থোথ) প্রেরণ করেন হাথোরকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে আনার জন্য।[28] শান্ত হওয়ার পর দেবী সূর্যদেবতা অথবা যে দেবতা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিলেন তাঁর পত্নী হতে ফিরে আসেন।[29] মিশরতত্ত্ববিদ ক্যারোলিন গ্রেভস-ব্রাউনের মতে, চক্ষু দেবীর দুই দিক—হিংস্র ও বিপজ্জনক বনাম সুন্দরী ও আনন্দময়ী—নারীজাতি সম্পর্কে মিশরীয়দের যে ধারণা অর্থাৎ নারী রোষ ও প্রেমের চরম অনুভূতি দ্বারা আবৃত, তারই প্রতিফলন ঘটায়।[27]

সংগীত, নৃত্য ও আনন্দ

Painting of elaborately dressed men and women. Some women clap and play flutes while others dance.
নেবামুনের সমাধি মন্দিরের গাত্রে ভোজসভার দৃশ্য, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দী। সংগীত ও নৃত্যের এই চিত্রকল্পটি হাথোরের পরোক্ষ ইঙ্গিতবাহী।[30]

মিশরীয় ধর্মের উদ্যাপন করা হত জীবনের ইন্দ্রিয়সুখগুলি পালনের মাধ্যমে। মিশরীয়রা এই সুখগুলিকে মনে করত মানবজাতিকে দেওয়া দেবতাদের উপহার। ধর্মীয় উৎসবে তাঁর পানভোজন ও নৃত্যগীত করত। ফুল ও ধূপের মাধ্যমে বায়ুকে সুগন্ধিত করা হত। হাথোরের অনেকগুলি বিশেষণের সঙ্গে তাঁর উৎসবের যোগ ছিল; হাথোরকে বলা হত সংগীত, নৃত্য, মালা, মার ও মাতলামির অধিষ্ঠাত্রী। স্তোত্র ও মন্দির খোদাইচিত্রগুলিতে দেখা যায়, হাথোরের সম্মানে বাদ্যকরেরা ট্যামবারিন, হার্প, লিয়ার ও সিস্ট্রাম বাজাচ্ছেন।[31] হাথোরের পূজায় সিস্ট্রাম নামের এই ঝুমঝুমি-সদৃশ বাদ্যযন্ত্রটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কামোদ্দীপনার সঙ্গে সিস্ট্রামের একটি সম্পর্ক ছিল এবং সেটিকে নতুন জীবন সৃষ্টির প্রতীক জ্ঞান করা হত।[32]

হাথোরের এই দিকগুলি রা-এর চোখ-সংক্রান্ত অতিকথার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মানবজাতির ধ্বংস-সংক্রান্ত উপাখ্যানে কথিত হয়েছে, চোখ শান্ত হয়েছিল অনুগ্র মদ দ্বারা। দূরবাসিনী দেবী-সংক্রান্ত উপকথাটির কোনও কোনও পাঠান্তরে পাওয়া যায়, সংগীত, নৃত্য ও মদের মতো সভ্যতার উৎপাদনগুলি দ্বারা সন্তুষ্ট হয়ে ভ্রাম্যমাণ চোখের বন্যতা দূরীভূত হয়। নীল নদের বন্যার সময় পলির কারণে নদীর জলের রং লাল হয়ে যায়। এই লাল জলটিকে মদ এবং মানবজাতির ধ্বংস উপাখ্যানের লাল রঙে রঞ্জিত অনুগ্র মদের সমতুল্য জ্ঞান করা হয়। প্লাবনের সমকালীন উৎসবগুলি তাই প্রত্যাবর্তনকারিণী দেবীকে তুষ্ট করতে মদ্যপান ও নৃত্যগীত দ্বারা পালিত হত।[33] এদফুর মন্দিরের একটি লিপিতে হাথোর সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তাঁর বদ মেজাজকে ভালো করতে দেবতাকে তাঁকে সিস্ট্রাম বাজিয়ে শোনান এবং দেবীরা তাঁকে নৃত্য প্রদর্শন করান।[34] মেদামুদের মন্দিরে হাথোর রূপ হিসেবে দেবী রাএত-তাওই-এর একটি স্তোত্রে মাতলামির উৎসবকে হাথোরের পুরাণকথিত মিশরে প্রত্যাবর্তনের অঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।[35] এই উৎসবে দেবীর মূর্তি মন্দিরের উৎসব কুটিরে প্রবেশ করলে মহিলারা ফুলের তোড়া নিয়ে যেত, মাতাল অংশগ্রহণকারীরা ঢোল বাজাত এবং বিদেশি রাজ্যের মানুষ ও জন্তুজানোয়ার নাচ শুরু করত। মনে করা হত, উৎসবের কোলাহল প্রতিকূল শক্তিগুলিকে দূরীভীত করে এবং দেবীর পৌরাণিক স্বামী মোনতুর সন্তান গর্ভে ধারণের জন্য অপেক্ষা করার সময় তাঁর আনন্দময়ী রূপটি বজায় থাকে।[36]

যৌনতা, সৌন্দর্য ও প্রেম

হাথোরের হর্ষোৎফুল্ল, আনন্দদায়িনী দিকটি তাঁর নারীত্ব ও প্রজননশক্তির ইঙ্গিতবাহী। কয়েকটি সৃষ্টিপুরাণে দেখা যায়, তিনি জগৎ সৃষ্টি করতে সহায়তা করছেন।[37] সৃষ্টিকর্তা দেবতা আতুম সকল বস্তুকে নিজের মধ্যে ধারণ করতেন। কথিত ছিল যে, তিনি হস্তমৈথুন করে তাঁর সন্তান শুতেফনুতকে সৃষ্টি করেন এবং এইভাবেই সৃষ্টি প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই কাজে যে হাত ব্যবহার করেছেন (মিশরীয় পুরাণে যা "আতুমের হস্ত" নামে পরিচিত), সেটি তাঁর নারী সত্ত্বার প্রতীক এবং হাথোর, নেবেথেতেপেত অথবা অপর এক দেবী ইউসাসেত এই হাতেরই মূর্তিরূপ।[38] টলেমীয় যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২-৩০ অব্দ) রচিত পরবর্তীকালীন সৃষ্টিপুরাণে বলা হয়েছে যে খোনসু সৃষ্টিকর্মে কেন্দ্রীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন এবং হাথোরই ছিলেন সেই দেবী যাঁর সঙ্গে সংগমের মাধ্যমে খোনসু সৃষ্টিকর্মে সক্ষম হয়েছিলেন।[39]

হাথোরকে একাধিক পুরুষ দেবতার পত্নী রূপে কল্পনা করা হয়েছিল। রা কেবলমাত্র এই পুরুষ দেবতাদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। নতুন রাজ্যের প্রধানতম দেবতা আমুনের পত্নী হিসেবে সাধারণভাবে মুতকেই কল্পনা করা হত এবং আমুনকে প্রায়শই যুক্ত করা হত রা-এর সঙ্গে। কিন্তু যৌনতা বা প্রজননশক্তির প্রেক্ষাপটে খুব অল্প ক্ষেত্রেই মুতকে আমুনের সঙ্গে চিত্রিত করা হত এবং সেই সব ক্ষেত্রে হাথোর বা আইসিস থাকতেন আমুনের স্ত্রীর স্থানটিতে।[40] মিশরীয় ইতিহাসের পরবর্তী পর্যায়গুলিতে দেনদেরার হাথোর ও এদফুর হোরাসকে স্বামী-স্ত্রী গণ্য করা হত[41] এবং দূরবাসিনী দেবীর অতিকথাটির ভিন্ন ভিন্ন পাঠে হাথোর-রাএৎতাওয়িকে মোনতুর পত্নী[42] ও হাথোর-তেফনুতকে শু-এর পত্নী[43] রূপে কল্পনা করা হয়েছিল।

হাথোরের যৌন দিকটি প্রাচীন মিশরের ছোটোগল্পগুলিতে পাওয়া যায়। "রাখালের উপাখ্যান" নামে পরিচিত মধ্য রাজ্যে রচিত একটি কাহিনির দুর্বোধ্য খণ্ডাংশে দেখা যায়, এক জলাভূমিতে এক রাখালের সঙ্গে এক লোমশ, জন্তুসদৃশ দেবীর সাক্ষাৎ হয় এবং সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অন্য একদিন তিনি এক নগ্ন, প্রলুব্ধকারিণী নারীর রূপে সেই দেবীর দেখা পান। যে সকল মিশরতত্ত্ববিদ এই গল্পটি পর্যালোচনা করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই এই নারীকে হাথোর বা তাঁর অনুরূপ এক দেবী বলেই মনে করেছেন, যিনি বর্বর ও বিপজ্জনক হতে পারেন, আবার সদয় ও কামোদ্দীপকও হতে পারেন। টমাস শ্নেইডার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই গল্পটিতে দেবীর সঙ্গে রাখালের দুই সাক্ষাতের পিছনে দেবীকে তুষ্ট করার কোনও বিষয় থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে।[44] "হোরাস ও সেতের দ্বন্দ্ব" কাহিনিটি ছিল নতুন রাজ্যের আমলে রচিত উক্ত দুই দেবতার সংঘাত নিয়ে লিখিত একটি ছোটোগল্প। এই গল্পে দেখা যায়, বাবি নামক অপর এক দেবতার কাছে অপমানিত হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রা একাকী শুয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পরে হাথোর নিজের যৌনাঙ্গ দেখিয়ে রা-কে হাসান এবং তারপর রা উঠে আবার দেবতাদের রাজা হিসেবে তাঁর কর্তব্য সম্পাদনে রত হন। মিশরীয়রা মনে করত, জীবন ও জগতের শৃঙ্খলা রা-এর ক্রিয়াকলাপের উপর নির্ভরশীল। তাই এই গল্পটি ইঙ্গিত করে যে রা-এর আলস্যতার যে ভয়ংকর পরিণতি হতে পারত তা হাথোরের মাধ্যমে এড়ানো সম্ভব হয়। তাঁর কাজে রা-এর দেহ ও মন যে উজ্জীবিত হয় তার আংশিক কারণ সেই কাজ তাঁকে যৌন উত্তেজনা দান করেছিল। কিন্তু তিনি কেন হেসেছিলেন, তা সম্পূর্ণ বোঝা যায় না।[45]

সুন্দর চুলের জন্যেও হাথোরের প্রশংসা করা হয়। মিশরীয় সাহিত্যে এমন একটি অতিকথার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা প্রাপ্ত কোনও লিপিতে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়নি। এই অতিকথায় দেখা যায়, হাথোর তাঁর কেশের গুচ্ছ হারাচ্ছেন, যা তাঁর যৌন সম্মোহনশক্তির প্রতীক। অপর একটি লিপিতে এই হারানোটিকে তুলনা করা হয়েছে হোরাস ও সেতের সংঘর্ষের সময় হোরাসের দিব্য চক্ষু ও সেতের অণ্ডকোষ হারানোর সঙ্গে। এই বিবরণটি ইঙ্গিত করে যে, হোরাস ও সেত যেমন তাঁদের অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন, তেমনই হাথোরের কেশগুচ্ছ হারানোও দেবীর কাছে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।[46]

হাথোরকে বলা হত "প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী"। এটি ছিল তাঁর যৌন দিকটির একটি সম্প্রসারিত রূপ। বিংশ রাজবংশের আমলে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১১৮৯-১০৭৭ অব্দ) লিখিত প্যাপিরাস চেস্টার বিটি ১-এর ধারাবাহিক প্রেমের কবিতাগুলিতে দেখা যায় যে, পুরুষ ও নারী উভয়েই হাথোরের কাছে তাদের প্রণয়ীদের এনে দেওয়ার প্রার্থনা জানাচ্ছে: "আমি তাঁর [হাথোর] কাছে প্রার্থনা করেছিলাম এবং তিনি আমার প্রার্থনা শুনেছেন। তিনি আমার প্রেমিকাকে নির্ধারিত করেছেন। সে নিজের ইচ্ছায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।"[47]

মাতৃত্ব ও রানিত্ব

Relief of a cow with a disk between her horns. A human wearing a crown drinks from her udders.
গো-রূপী হাথোর নারী ফ্যারাও হাতশেপসুতকে স্তন্যপান করাচ্ছেন, দেইর এল-বাহারিতে হাতশেপসুতের মন্দিরে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দী

হাথোরকে একাধিক শিশু দেবতার মাতা গণ্য করা হত। তাঁর নামের অর্থটির অনুষঙ্গে তাঁকে প্রায়শই হোরাসের মাতা ও পত্নী উভয় রূপেই দেখা হত।[48] রাজার পত্নী ও রাজ-উত্তরাধিকারীর মাতা রূপে হাথোর ছিলেন মানব রানির পৌরাণিক প্রতিরূপ।[15]

অন্তত পুরনো রাজ্যের সময়কাল থেকে ওসাইরিস অতিকথায় আইসিস ও ওসাইরিসকে হোরাসের মাতাপিতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মা হিসেবে হাথোরের সঙ্গে হোরাসের সম্পর্কটি আরও পুরনো। যদি তাই হয়, তাহলে পুরনো রাজ্যের আমলেই ওসাইরিস অতিকথার সৃষ্টির সময় হোরাসের সঙ্গে আইসিস ও ওসাইরিসের যোগসূত্রটি কল্পিত হয়েছিল।[49] হোরাসের মা হিসেবে আইসিসের স্থানটি পাকাপোক্তভাবে জনসাধারণের মনে গেঁথে গেলেও হাথোর এই ভূমিকাটি পালন করতেন, বিশেষত ফ্যারাওকে শুশ্রুষাকারিণী দেবী হিসেবে তাঁর ভূমিকাটির ক্ষেত্রে। একটি প্যাপিরাসগুচ্ছে প্রাপ্ত শিশু সহ গোরু-রূপী হাথোরের ছবিটি বিচ্ছিন্ন জলাভূমিতে ফ্যারাওয়ের পৌরাণিক ছেলেবেলার প্রতীক। দেবীর স্তন্য ছিল দেবত্ব ও রাজকীয় মর্যাদার একটি চিহ্ন। এই কারণে যে ছবিতে হাথোরকে ফ্যারাওয়ের শুশ্রুষা করতে দেখা যায়, সেই ছবিটি ফ্যারাওয়ের শাসন-অধিকারের প্রতীক।[50] হোরাসের সঙ্গে হাথোরের সম্পর্কটি হাথোরের চরিত্রের সঙ্গে চিকিৎসা-সংক্রান্ত একটি দিক যুক্ত করে। কথিত ছিল, সেত হোরাসকে আক্রমণ করলে হোরাস যখন একটি বা দুই চোখই হারান, তখন হাথোর সেই চক্ষু প্রতিস্থাপন করেন।[18] "হোরাস ও সেতের দ্বন্দ্ব" উপাখ্যানের এই পর্বের একটি পাঠে দেখা যায়, চক্ষু উৎপাটিত অবস্থায় হোরাসকে খুঁজে বের করে হাথোর তাঁর ক্ষতস্থান গজলা-হরিণের দুধ দিয়ে নিরাময় করেছিলেন।[51]

শেষ পর্যায়ে (খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৪-৩২৩ অব্দ) মন্দিরগুলিতে এক দেবপরিবার-কেন্দ্রিক উপাসনার সূত্রপাত ঘটে: এই পরিবারের অংশ ছিলেন এক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ দেবতা, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের অপরিণত পুত্র। মাম্মিসিস নামে পরিচিত অতিরিক্ত ভবনগুলি নির্মিত হত স্থানীয় শিশুদেবতার জন্মোৎসব উদ্যাপন করার জন্য। এই শিশু দেবতা ছিলেন ব্রহ্মাণ্ডের চক্রাকার পুনর্নবীকরণের প্রতীক এবং রাজপদের উত্তরাধিকারের মৌল আদর্শ।[52] এই সব স্থানীয় দেবতাত্রয়ীর মধ্যে অনেকগুলিতেই হাথোরকে মা হিসেবে দেখানো হত। দেনদেরায় এদফুর প্রাপ্তবয়স্ক হোরাস ছিলেন পিতা ও হাথোর ছিলেন মাতা; অন্যদিকে শিশুদেবতা ইহির নামের অর্থ ছিল "সিস্ট্রাম-বাদক" এবং তিনি ছিলেন যন্ত্রটির সঙ্গে জড়িত আনন্দোল্লাসের মূর্তিরূপ।[53] কোম ওম্বোতে হাথোরের স্থানীয় রূপ তাসেনেৎনোফ্রেতকে হোরাসের পুত্র পানেবতাওয়ির মা মনে করা হত।[54] হাথোরের অন্যান্য সন্তানাদির মধ্যে রয়েছেন হু শহরের অপ্রধান দেবতা নেফেরহোটেপ[53] এবং হোরাসের বেশ কয়েকটি শিশু রূপ।[55]

সাইকামোর গাছের দুগ্ধতুল্য রসটিকে মিশরীয়রা জীবনের প্রতীক মনে করত। এটিও হাথোরের অন্যতম প্রতীকে পরিণত হয়েছিল।[56] দুধকে নীল নদের বন্যার জলের সমতুল্য এবং সেই সূত্রে উর্বরতার সমতুল্য মনে করা হত।[57] টলেমীয় যুগের শেষ ভাগে এবং রোমান যুগের অনেক মন্দিরে বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে বহুকাল-লালিত ধারণাগুলি থেকে সঞ্জাত সৃষ্টিপুরাণের চিত্র পাওয়া যায়।[58] দেনদেরায় হাথোরের মন্দিরে চিত্রিত এই জাতীয় একটি ছবিতে দেখা যায়, সৌরদেবী-রূপিণী হাথোর প্রথম সত্ত্বা হিসেবে সৃষ্টির পূর্ববর্তী আদ্যকালীন জল থেকে উত্থিত হচ্ছেন এবং তাঁর জীবনদাত্রী আলো ও দুগ্ধ সকল জীবিত সত্ত্বাকে পুষ্টিদান করছে।[59]

মেসখেনেতের মতো অপর এক দেবীও জন্ম বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে। তাঁর মতোই হাথোরকেও যুক্ত করা হয়েছিল শাই বা মিশরীয় নিয়তিবাদের উপর, বিশেষত তিনি যখন সপ্ত হাথোরের রূপে পূজিতা হতেন। নতুন রাজ্যের দু’টি কথাসাহিত্য "দুই ভাইয়ের উপাখ্যান" ও "দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত রাজপুত্রের উপাখ্যান"-এ দেখা যায়, হাথোর প্রত্যেকটি প্রধান চরিত্রের জন্মের সময় উপস্থিত থাকছেন এবং প্রত্যেকের মৃত্যুর কীভাবে হবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করছেন।[60]

হাথোরের মাতৃসুলভ দিকটি আইসিস ও মুতের মাতৃসুলভ দিকগুলির সমতুল্য। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে এঁদের মধ্যে অনেক পার্থক্যও রয়েছে। হাথোরের অসংযত যৌনাকাঙ্ক্ষা[61] এবং মুতের যৌনাকাঙ্ক্ষী চরিত্রের পরিবর্তে অধিকতর দমনমূলক মনোবৃত্তির[62] তুলনায় স্বামীর প্রতি আইসিসের ভক্তি ও তাঁদের সন্তানদের প্রতি তাঁর যত্ন সামাজিকভাবে অধিকতর গ্রহণযোগ্য এক আচরণবিধির প্রতীক ছিল। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে লিখিত ইনসিংগার প্যাপিরাসে বিশ্বস্ত পত্নী ও গৃহকর্ত্রীর ধারণাটিকে মুতের সঙ্গে, অন্যদিকে বিবাহিত পুরুষকে প্রলুব্ধকারিণী অচেনা নারীর ধারণাটিকে হাথোরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।[62]

বিদেশি রাজ্য ও দ্রব্যসামগ্রী

সিরিয়াকনানের উপকূলীয় শহরগুলির, বিশেষভাবে বিবলোসের সঙ্গে মিশর বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলত। এর ফলে মিশরীয় ধর্মের সঙ্গে সেই অঞ্চলের ধর্মের সংস্পর্শে এসেছিল।[63] ইতিহাসের কোনও একটি ক্ষণে, সম্ভবত অন্ততপক্ষে পুরনো রাজ্যের সমসাময়িক কালে, মিশরীয়রা বিবলোসের পৃষ্ঠপোষক দেবী বালাত গেবালকে হাথোরের স্থানীয় রূপ বলে নির্দেশ করতে শুরু করেছিল।[64] বিবলোসে হাথোরের যোগসূত্রটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে দেনদেরার লিপিতে উল্লিখিত হয়েছে যে দেবী বিবলোসেই বাস করেন।[65] ক্ষেত্রবিশেষে মিশরীয়রা আনাত নামে এক উগ্রা কনানীয় দেবীকে হাথোরের সমান বিবেচনা করত। নতুন রাজ্যের আমলে মিশরে আনাতের পূজা শুরু হয়েছিল।[66] কোনও কোনও কনানীয় শিল্পকলায় হাথোরের মূর্তিরূপের অনুরূপে কুঞ্চিত পরচুলা পরিহিতা এক নগ্ন দেবীকে চিত্রিত করা হয়েছিল।[67] এই ছবিগুলিতে চিত্রিত দেবী কে তা সঠিক জানা যায় না। কিন্তু মিশরীয়রা তাঁর মূর্তিকল্পটিকে গ্রহণ করেছিল এবং তাঁকে কেতেশ নামে এক স্বতন্ত্র দেবতা রূপে বিবেচনা করত।[68] কেতেশকে মিশরীয়রা হাথোরের সঙ্গেই সংযুক্ত করেছিল।[69]

হাথোর সৌরদেবীর চরিত্রটি সম্ভবত বাণিজ্যের সঙ্গে তাঁর যোগের ক্ষেত্রে একটি ভূমিকা পালন করেছিল: মিশরীয়রা বিশ্বাস করত তিনি যেমনভাবে আকাশে রা-এর ডিঙি নৌকাটি রক্ষা করেন, তেমনভাবেই নীল নদে এবং মিশরের বাইরের সমুদ্রে রক্ষা করেন মানুষের জাহাজগুলিকে।[70] নুবিয়া বা লিবিয়ায় চক্ষু দেবীর পৌরাণিক ভ্রমণও সেই সব দেশের সঙ্গে হাথোরের একটি যোগসূত্র স্থাপন করে।[71]

সিনাই উপদ্বীপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন হাথোর।[72] এই অঞ্চলটি মিশরের মূল ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে বিবেচিত না হলেও মধ্য ও নতুন রাজ্যের আমলে এই অঞ্চলটি হয়ে উঠেছিল তামা, বৈদূর্য মণি ও ম্যালাকাইট পাথরের মিশরীয় খননক্ষেত্র।[73] হাথোরের "মেফকাতের নারী" উপাধিটির মাধ্যমে সম্ভবত বিশেষভাবে বৈদূর্য বা সকল সবুজাভ-নীল খনিজ পদার্থের ইঙ্গিতবাহী। এছাড়াও তাঁকে "ফেয়ান্সের নারী" নামেও অভিহিত করা হল। এই "ফেয়ান্স" ছিল এক ধরনের নীলাভ-সবুজ চিনামাটি যাকে মিশরীয়রা যুক্ত করেছিল বৈদূর্যের সঙ্গে।[74][75] মিশরের পূর্ব মরুভূমির বিভিন্ন খনি ও খননক্ষেত্রেও হাথোরকে পূজা করা হত। এই ধরনের খনির অন্যতম ছিল ওয়াদি এল-হুদির নীলার খনি। এখানে কখনও কখনও তাঁকে "নীলার নারী" নামেও অভিহিত করা হত।[76]

মনে করা হয় যে, মিশরের দক্ষিণে হাথোরের প্রভাব প্রসারিত হয়েছিল পুন্ত রাজ্য পর্যন্ত। লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত এই অঞ্চলটি ছিল ধূপের (যার সঙ্গে হাথোরকে যুক্ত করা হত) একটি প্রধান উৎস। এছাড়াও পুন্তের উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত নুবিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ এই অঞ্চলের মাধ্যমে রক্ষিত হত।[70] ষষ্ঠ রাজবংশের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৩৪৫-২১৮১ অব্দ) জনৈক আধিকারিক হারখুফের আত্মজীবনীতে নুবিয়ায় অথবা নুবিয়ার কাছে একটি রাজ্যে তাঁর অভিযানের বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। রাজার সেই অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণে আবলুস কাঠ, কালো চিতার চামড়া ও ধূপ নিয়ে এসেছিলেন। গ্রন্থে এই সব বহুমূল্য সামগ্রীকে ফ্যারাওর প্রতি হাথোরের উপহার বলে বর্ণনা করা হয়েছিল।[72] মধ্য ও নতুন রাজেয়র আমলে নুবিয়ায় স্বর্ণখনি অভিযানে গিয়ে মিশরীয়রা সেই অঞ্চলে হাথোরের কাল্টের প্রচলন ঘটায়[77] এবং নতুন রাজ্যের ফ্যারাওরা তাঁদের শাসনাধীনে থাকা নুবিয়ার অংশগুলিতে হাথোরের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।[78]

পরকাল

Painting of a cow whose head protrudes from a hill, in front of which stand papyrus stalks and a pyramidal chapel
গো-রূপিণী হাথোর থিবীয় সমাধিনগরীর প্রতীকস্বরূপ পাহাড় থেকে উত্থিত হচ্ছেন; মৃতের বই-এর একটি কপিতে চিত্রিত, খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দী

প্রাচীন মিশরীয় পরকালতত্ত্বে পরলোকে যে কয়েকজন দেবীকে মৃতের আত্মাকে সহায়তাকারী বলে মনে করা হত, হাথোর ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম।[79] উল্লেখ্য, এই দেবীগণের অন্যতম ছিলেন পশ্চিম দিকের দেবী ইমেনতেত, যাঁকে নীল নদের পশ্চিম তীরের সমাধিনগরী বা সমাধিগুচ্ছের এবং পরলোক রাজ্যের মূর্তিরূপ মনে করা হত। ইমেনতেতকে প্রায়শই হাথোরের একটি বিশেষ রূপভেদ বলেও গণ্য করা হত।[80]

ঠিক যেমন করে হাথোর মিশর ও বিদেশি রাজ্যের সীমানা পার হয়েছিলেন, ঠিক তেমনই করে পার হয়েছিলেন জীবিতদের লোক এবং দুয়াত অর্থাৎ মৃতের রাজ্যের সীমানা।[81] মনে করা হত যে, তিনি মৃত ব্যক্তির আত্মাকে দুয়াতে প্রবেশ করতে সহায়তা করেন এবং যেখানে এই স্থানান্তরকরণের সূচনা হয় সেই সমাধিক্ষেত্রগুলির সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।[82] উদাহরণস্বরূপ, থিবীয় সমাধিনগরীটিকে প্রায়শই একটি শৈলীবদ্ধ পর্বতের আকারে চিত্রিত করা হত, যেখান থেকে হাথোরের গোরুটিকে বেরিয়ে আসতে দেখা যেত।[83] আকাশের দেবী রূপে তাঁর ভূমিকাটির সঙ্গেও পরলোকের যোগ ছিল। কারণ নুট ও হাথোর, আকাশের উভয় দেবীই রা-কে তাঁর দৈনন্দিন পুনর্জন্মলাভে সহায়তা করেন বলে ধারণা ছিল। মিশরীয় ধারণা অনুযায়ী, মৃত মানবও সূর্যদেবতার মতো পুনরায় জন্মগ্রহণ করে বলে প্রাচীন মিশরীয় পরকালতত্ত্বে হাথোরের স্থানটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।[84] শবাধার, সমাধিসৌধ ও সমগ্র পাতালকে দেবীর জরায়ু বলে ব্যাখ্যা করা হত এবং সেই জরায়ু থেকেই আত্মার পুনর্জন্ম ঘটে বলা সবাই বিশ্বাস করত।[85][86]

বিভিন্ন লিপি অনুযায়ী, নুট, হাথোর ও ইমেনতেত তিন জনেই মৃতকে এমন এক স্থানে নিয়ে যেতে পারেন যেখানে মৃত ব্যক্তি চিরকাল ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয় পেতে পারেন। তাই সমাধিসৌধের চিত্রে প্রায়শই দেখা যায় ইমেনতেতের মতো হাথোরও মৃত ব্যক্তিকে তাঁর সন্তানের মতো আনন্দময় পরলোকে স্বাগত জানাচ্ছেন।[87] নতুন রাজ্যের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত লিপি ও শিল্পকর্মগুলিতে প্রায়শই পরলোককে এক মনোরম উর্বর বাগানের আকারে চিত্রিত করা হত, যেখানে ক্ষেত্রবিশেষে হাথোরকেও রাজত্ব করতে দেখা যেত।[88] পরলোকে অভ্যর্থনাকারিণী দেবীকে প্রায়শই মৃত ব্যক্তিকে জলদানকারী একটি গাছের আকারেও চিত্রিত করা হত। নুটকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই রূপে দেখা গিয়েছে। যদিও বৃক্ষদেবীকে কখনও কখনও নুটের পরিবর্তে হাথোরও বলা হয়েছে।[89]

পরলোকের একটি যৌন দিকও ছিল। ওসাইরিস-সংক্রান্ত পুরাণকথায় দেখা যায়, আইসিস যৌনসংগমের মাধ্যমে নিহত দেবতা ওসাইরিসকে পুনর্জীবন দান করেছিলেন এবং হোরাসকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। সৌর মতাদর্শে বলা হত যে, রা-এর সঙ্গে আকাশের দেবীর মিলনের ফলেই রা-এর নিজের পুনর্জন্ম সম্ভব হত। সেই কারণেই মনে করা হত, যৌনসংগমের মাধ্যমে মৃতের পুনর্জন্ম ঘটে এবং আইসিস ও হাথোরের মতো দেবীগণ মৃতকে নতুন জীবনে জাগ্রত করার কাজ করেন। কিন্তু তাঁরা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতেন না, বরং পুরুষ দেবতাদের পুনরুৎপাদন ক্ষমতাকেই উদ্দীপিত করতেন।[90]

প্রাচীন মিশরীয়রা ওসাইরিসের নাম মৃত্য ব্যক্তির নামের সম্মানসূচক পূর্বপদ হিসেবে ব্যবহার করত পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে মৃতকে যুক্ত করার জন্য। উদাহরণস্বরূপ, হেনুতমেহিত নাম্নী নারীকে উল্লেখ করা হত "ওসাইরিস-হেনুতমেহিত" নামে। কালে কালে তারা মৃত ব্যক্তিদের এইভাবে পুরুষ ও নারী উভয় দৈবী শক্তির সঙ্গেই যুক্ত করতে শুরু করে।[91] অন্ততপক্ষে পুরনো রাজ্যের শেষভাগ থেকেই এমন একটি ধারণা প্রচলন ঘটে যে, পুরুষরা যেমন পরলোকে ওসাইরিসের উপাসকদের সঙ্গে যোগ দেয়, তেমনই নারীরা সেখানে যোগ দেয় হাথোরের উপাসকদের সঙ্গে। তৃতীয় মধ্যবর্তী পর্যায়ে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০৭০-৬৬৪ অব্দ) মিশরীয়রা মৃত নারীর নামের আগে ওসাইরিসের নামের বদলে হাথোরের নাম যোগ করতে শুরু করে। ক্ষেত্রবিশেষে নারীদের বলা হত "ওসাইরিস-হাথোর", যা ইঙ্গিত করে যে মিশরীয়রা মনে করত উভয় দেবতার পুনরুজ্জীবনদাত্রী শক্তির দ্বারাই তারা উপকৃত হবে। এই সকল পরবর্তী পর্যায়ে হাথোরকে কখনও কখনও ঠিক ওসাইরিসের মতোই পরলোকের শাসনকর্ত্রী মনে করা হত।[92]

মূর্তিতত্ত্ব

গো-মুণ্ডবিশিষ্ট নারীর রূপে হাথোর, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৪ থেকে ৩৩২ অব্দের মধ্যবর্তী সময়

হাথোরকে প্রায়শই (বিশেষত যখন তাঁকে রাজ-শুশ্রুষাকারিণী রূপে চিত্রিত করা হয়) দেখা যায় শিং-এর মাঝখানে সৌর-চাকতি ধারণ করা এক গোরুর রূপে। কোনও কোনও ছবিতে তাঁর নারীদেহের উপর গোরুর মাথাও চিত্রিত হতে দেখা যায়। তাঁর সর্বাধিক পরিচিত রূপটি যদিও শিং ও সৌর-চাকতি লাঞ্ছিত শিরাবরণী পরিহিতা নারীর রূপ। এই রূপে প্রায়শই তাঁকে লাল বা সবুজাভ-নীল অথবা দুই রঙের মিশ্রণে নির্মিত আঁটসাঁট বস্ত্র পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে শিং দু’টিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় একটি নিচু মোডিয়াস বা গৃধ্র-লাঞ্ছিত শিরাবরণীর উপর। এই জাতীয় শিরাবরণী নতুন রাজ্যের রানিরা প্রায়শই পরতেন। নতুন রাজ্যের আমলে যেহেতু আইসিসের মস্তকেও অনুরূপ শিরাবরণী দেখা যায়, সেই হেতু ছবির নিচে উৎকীর্ণ তথ্য ব্যতিরেকে দুই দেবীকে পৃথক করা সম্ভবপর হয় না। ইমেনতেতের ভূমিকা পালন করার সময় হাথোর শিং-বিশিষ্ট শিরাবরণীর পরিবর্তে মস্তকে পশ্চিমের প্রতীক পরিধান করেন।[93] সপ্ত হাথোরকে কখনও কখনও সাতটি গোরুর এক সারির মাধ্যমে প্রকাশ করা হত; তাঁদের সঙ্গে থাকতেন একজন অপ্রধান আকাশ ও পরলোক দেবতা (যাঁকে বলা হত পশ্চিমের বৃষ)।[94]

গবাদি পশু ছাড়াও অন্য কয়েকটি পশু হাথোরের প্রতীক হতে পারে। মিশরীয় শিল্পকলায় একটি প্রায়শ দৃষ্ট বিষয় হল ইউরিয়াস এবং রা-এর চোখ হিসেবে চিহ্নিত একাধিক দেবী এই প্রতীকটির মাধ্যমে উপস্থাপিত হতেন।[95] ইউরিয়াস রূপে হাথোর তাঁর হিংস্র ও রক্ষাকারিণী দিকটির প্রতীক। এছাড়াও সিংহী রূপেও তাঁকে চিত্রিত করা হয়েছে। এই মূর্তিটির অন্তর্নিহিত অর্থও ইউরিয়াসের অনুরূপ।[96] এর বিপরীতে গৃহপালিত বিড়ালও কখনও কখনও হাথোরের সঙ্গে যুক্ত হত। এই প্রাণীটি প্রায়শই চক্ষু দেবীর শান্ত রূপের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হত।[97] সাইকামোর বৃক্ষরূপী হাথোরের চিত্রগুলিতে দেখা যায় তাঁর মানব-সদৃশ ঊর্ধ্বাঙ্গ উদ্গত হচ্ছে গাছের কাণ্ড থেকে।[98]

অন্যান্য দেবীদের মতো হাথোরকেও ক্ষেত্রবিশেষে দণ্ডের মতো করে প্যাপিরাসের গুচ্ছ ধারণ করতে দেখা যায়। অন্য কয়েকটি চিত্রে তাঁকে ওয়াজ-দণ্ড ধারণ করতেও দেখা যায়। এটি ক্ষমতা এমন একটি প্রতীক যা সচরাচর পুরুষ দেবতাদের ক্ষেত্রেই সীমায়িত থাকত।[75] হাথোরের মতো যে সকল দেবী ওয়াজ ধারণ করতেন, তাঁরা যুক্ত ছিলেন রা-এর চোখের সঙ্গে।[99] প্রায়শই তাঁর হাতে একটি সিস্ট্রাম বাদ্যযন্ত্র বা গলায় একটি মেনাত কণ্ঠহারও দেখা যায়। সিস্ট্রাম দুই ধরনের হত: সরল বাঁকানো গড়ন অথবা অধিকতর জটিল নাওস সিস্ট্রাম, যার আকৃতির সঙ্গে নাওস পূজাস্থানের গড়নের সাদৃশ্য ছিল এবং বাদুড় প্রতীকের শুঙ্গের ন্যায় আকার বিশিষ্ট কুণ্ডলায়িত নকশা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল।[100] তাঁর অপর প্রতীক ছিল আয়না। কারণ মিশরে আয়না প্রস্তুত করা হত সোনা বা ব্রোঞ্জ দিয়ে। সেই কারণে সেগুলি ছিল সৌর চাকতির প্রতীক। অবশ্য আয়না হাথোরের প্রতীক হওয়ার অপর কারণটি ছিল এই জিনিসগুলির সঙ্গে সৌন্দর্য ও নারীত্বের যোগসূত্র। কোনও কোনও আয়নায় হাতলগুলি হাথোরের মুখের আদলে নির্মিত হত।[101] সুতোয় গাঁথা অনেকগুলি গুটিকা দিয়ে নির্মিত মেনাত কণ্ঠহারকে হাথরের সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সিস্ট্রাম যন্ত্রের অনুরূপভাবে ঝাঁকানো হত।[102] এর ছবিগুলিকে ক্ষেত্রেবিশেষে স্বয়ং হাথোরের মূর্তিরূপও মনে করা হত।[103]

কোনও কোনও ছবিতে দেখা যায়, হাথোরের মাথাটি মানুষের হলেও কান গোরুর। এই ছবিগুলি মূলত মিশরীয় চিত্রকলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসূচক পার্শ্বচিত্র। এই রূপটিতে তাঁর মুখের যে কোনও একটি পাশ প্রায়শই কুঞ্চিত হয়ে বেঁকে যায়। পুরনো রাজ্যের শেষভাগের গোড়ার দিকে থেকেই স্তম্ভশীর্ষে মুখোশ-সদৃশ মুখগুলি স্থাপন শুরু হয়। এই শৈলীর স্তম্ভগুলি হাথোর ও অন্যান্য দেবীদের অনেক মন্দিরে ব্যবহৃত হয়েছিল।[104] এই স্তম্ভগুলি দু’টি বা চারটি করে মুখ আছে, যা সম্ভবত দেবীর বিভিন্ন রূপের মধ্যে দ্বৈতভাবের অথবা চতুর্মুখী হাথোরের প্রহরারত বৈশিষ্ট্যটির প্রতীক। হাথোরীয় স্তম্ভগুলির নকশাগুলির সঙ্গে সিস্ট্রাম বাদ্যযন্ত্রের নকশার একটি জটিল সম্পর্ক রয়েছে। সিস্ট্রাম যন্ত্রের উভয় শৈলীতেই হাতলে হাথোরের মুখোশ আঁকা থাকতে পারে এবং হাথরীয় স্তম্ভগুলিতেও প্রায়শই দেবীর মাথার উপর নাওস সিস্ট্রামের আকারটি যুক্ত করা হত।[100]

পূজা

Refer to caption
হাথোরের (মধ্যে) সঙ্গে উচ্চ মিশরের পঞ্চদশ নোমের মূর্তিরূপ এক দেবী (বাঁদিকে) এবং চতুর্থ রাজবংশীয় রাজা মেনকাউরের (ডানদিকে) মূর্তির অনুকৃতি; মূল মূর্তিটির সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ষড়বিংশ শতাব্দী।

রাজপদের সঙ্গে সম্পর্ক

আদি রাজবংশীয় যুগে রাজসভায় সর্বাগ্রগণ্য দেবী ছিলেন নেইথ[105] কিন্তু চতুর্থ রাজবংশের আমলে রাজার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত দেবীর মর্যাদা লাভ করেন হাথোর।[63] পরবর্তী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা স্নেফেরু সম্ভবত হাথোরের একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন এবং দ্জেদেফ্রার এক কন্যা ছিলেন হাথোরের প্রথম পুরোহিত যাঁর সম্পর্কে লেখ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়।[106] পুরনো রাজ্যের শাসকবর্গ শুধুমাত্র সেই সব মন্দিরেই দ্রব্যসামগ্রী দান করতেন, যেগুলি নির্দিষ্ট রাজা বা রাজপদের সঙ্গে যুক্ত দেবদেবীদের প্রতি উৎসর্গিত হত। হাথোর ছিলেন সেই অল্প কয়েকজন দেবদেবীর অন্যতম যাঁর মন্দির এই ধরনে দানসামগ্রী পেয়েছিল।[107] পুরনো রাজ্যের শেষ দিকের শাসকেরা প্রদেশগুলিতে বিশেষভাবে হাথরের কাল্ট প্রচার করেন। এই প্রচারকার্য ছিল সেই সব অঞ্চলগুলি রাজসভার সঙ্গে বাঁধার অন্যতম পদ্ধতি। এই সময় সমসাময়িক প্রাদেশিক দেবীদের বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও সম্ভবত হাথোরের সঙ্গে একাত্মীভূত হয়ে যায়।[108]

রাজপরিবারের অনেক নারী শাসনকর্ত্রী রানি না হয়েও পুরনো রাজ্যের আমলে কাল্টে পদাধিকার অর্জন করেছিলেন।[109] দ্বিতীয় মেনটুহোটেপ ছিলেন মধ্য রাজ্যের প্রথম ফ্যারাও যাঁর সঙ্গে পুরনো রাজ্যের শাসকদের কোনও সম্পর্কই ছিল না। তিনি তাঁর শাসনকে বৈধকরণের জন্য নিজেকে হাথোরের পুত্র বলে ঘোষণা করতেন। প্রথম দিকের ছবিগুলিতে দেখা যায় হাথোর-রূপী গোরু রাজাকে স্তন্যদান করছেন। এই ছবিগুলি তাঁর শাসনকালের প্রথম দিকে অঙ্কিত হয়। হাথোরের একাধিক নারী-পুরোহিতকে তাঁর পত্নীর মতো করে চিত্রিত করা হয়েছিল, যদিও সম্ভবত তিনি প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁদের বিবাহ করেননি।[110][111] মধ্য রাজ্যের আমলে রানিদের ক্রমবর্ধমান হারে সরাসরি দেবীর প্রতিরূপ গণ্য করা শুরু হয়, ঠিক যেমনভাবে রাজাকে স্বয়ং রা হিসেবে গণ্য করা হত।[112] নতুন রাজ্যেও রানিকে হাথোর বলে গুরুত্ব দানের প্রথাটি অব্যাহত থাকে। অষ্টাদশ রাজবংশের শেষভাগের গোড়ার দিকে রানিদের চিত্রে তাঁদের মাথায় হাথোরের শিরাবরণী দেখা যেত। তৃতীয় আমেনহোটেপের শাসনকে উদ্যাপন ও পুনর্নবীকরণের উদ্দেশ্যে আয়োজিত সেদ উৎসবের একটি ছবিতে রাজাকে হাথোর ও তাঁর রানি তিয়ে উভয়ের সঙ্গে দেখা যায়। এর অর্থ রাজা এই উৎসবে প্রতীকীভাবে দেবীকে বিবাহ করতেন।[113]

নতুন রাজ্যের গোড়ার দিকে হাতশেপসুত নামে এক নারী ফ্যারাও হিসেবে শাসনকার্যা চালিয়েছিলেন। তিনি হাথোরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটির উপর জোর দিয়েছিলেন ভিন্ন উপায়ে।[114] স্বাভাবিকভাবে রাজ্যচালনা ছিল পুরুষ শাসকদের কাজ। তাই হাতশেপসুত নিজের শাসন বৈধকরণের উদ্দেশ্যে হাথোর সহ বিভিন্ন দেবীকে তাঁর সঙ্গে যুক্ত করার জন্য একাধিক রাজকীয় নাম ও উপাধি ব্যবহার করতেন।[115] তিনি হাথোরের বেশ কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন এবং দেবীকে তাঁর নিজের শবাগার মন্দিরেও স্থান দিয়েছিলেন। মধ্য রাজ্যের আমল থেকেই দেইর এল-বাহারি ছিল হাথোরের একটি কাল্ট-কেন্দ্র। এইখানেই অবস্থিত হাতশেপসুতের শবাগার মন্দিরে হাথোরের প্রতি একটি উপাসনাস্থল উৎসর্গিত হয়।[114]

নতুন রাজ্যের আমলে আমুনের প্রাধান্যের কারণে আমুনের পত্নী মুতের উপস্থিতি বেশি চোখে পড়ে। এই যুগেই আইসিসের উপর সেই সকল ভূমিকাগুলি আরোপ করা শুরু হয় যেগুলি প্রথাগতভাবে হাথোর একাই পালন করতেন (যেমন সৌর ডিঙির দেবী হিসেবে ভূমিকা)। এই সকল দেবদেবীর ক্রমবর্ধমান প্রাধান্য সত্ত্বেও নতুন রাজ্যের আগাগোড়াই হাথোর একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবীই থেকে গিয়েছিলেন। বিশেষত উর্বতা, যৌনতা ও রানিত্বের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই গুরুত্ব বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়।[116]

নতুন রাজ্যের পরে আইশিশ ক্রমবর্ধমান হারে হাথোর ও অন্যান্য দেবীদের ম্লান করে দিয়ে তাঁদের বৈশিষ্ট্যগুলি গ্রহণ করতে শুরু করেন।[117] টলেমীয় যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৩০৫-৩০ অব্দ) যখন গ্রিকরা মিশর শাসন করত এবং তাদের ধর্মের সঙ্গে মিশরের ধর্মের একটি জটিল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তখন টলেমীয় রাজবংশ রাজপদ সম্পর্কে মিশরীয় ভাবাদর্শটিকে গ্রহণ ও সংশোধন করে। দ্বিতীয় টলেমির স্ত্রী দ্বিতীয় আরসিনোর সময় থেকে টলেমীয়রা তাঁদের রানির সঙ্গে আইসিস ও বেশ কয়েকজন গ্রিক দেবীকে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করতে শুরু করে। এই গ্রিক দেবীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গ্রিকদের নিজস্ব প্রেম ও যৌনতার দেবী আফ্রোদিতি[118] তা সত্ত্বেও গ্রিকরা যখন মিশরীয় দেবতাদের গ্রিকদের নিজস্ব দেবতাদের নামে উল্লেখ করতে শুরু করে (রীতিটিকে বলা হত ইন্টারপ্রিটেটিও গ্রেসিয়া), তখন তারা কখনও কখনও হাথোরকেই আফ্রোদিতি নামে অভিহিত করত।[119] আইসিস, হাথোর ও আফ্রোদিতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে সম্মিলিত করা হয়েছিল টলেমীয় রানিদের দেবী হিসেবে গণ্য করার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করার জন্য। এই কারণেই কবি ক্যালিমাকাস তাঁর এটিয়া কাব্যে আফ্রোদিতির উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় বেরেনিসের কেশ উৎসর্গের প্রশংসা করতে হাথোরের হারানো কেশগুচ্ছের পুরাণকথাটির উল্লেখ করেন[46] এবং আইসিস ও হাথোরের গোরুর শিং ও গৃধ্র শিরাবরণীর মতো মূর্তিবৈশিষ্ট্যগুলি আফ্রোদিতি-রূপী টলেমীয় রানিদের ছবিতে দেখা যেতে থাকে।[120]

মিশরে অবস্থিত মন্দিরসমূহ

Room with tall stone columns topped by faces of women. The columns, walls, and ceiling are covered in painted reliefs.
দেনদেরায় হাথোরের মন্দিরের হাইপোস্টাইল হল, খ্রিটীয় প্রথম শতাব্দী

অন্যান্য মিশরীয় দেবীদের তুলনায় হাথোরের প্রতি অনেক বেশি সংখ্যক মন্দির উৎসর্গিত হয়েছিল।[81] পুরনো রাজ্যের আমলে তাঁর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পূজাকেন্দ্রটি ছিল মেমফিস অঞ্চলে। এখানে সমগ্র মেমফিসীয় সমাধিনগরী জুড়ে অনেক স্থানে "সাইকামোরের হাথোর" পূজিতা হতেন। নতুন রাজ্যের যুগে মেমফিসে দক্ষিণ সাইকামোরের হাথোরের মন্দিরটি ছিল দেবীর প্রধান মন্দির।[121] এই স্থানে তাঁকে শহরের প্রধান দেবতা পিতাহ্-এর কন্যা রূপে পূজা করা হত।[84] মেমফিসের উত্তরপূর্বে হেলিওপোলিসের রা ও আতুমের কাল্টে হাথোর-নেবেথেতেপেতের একটি মন্দিরও ছিল। এটি সম্ভবত নির্মিত হয়েছিল মধ্য রাজ্যের আমলে। প্রধান পূজাস্থানের কাছে একটি উইলো ও একটি সাইকোমার গাছ ছিল। এগুলিকে সম্ভবত দেবীর মূর্তিরূপ হিসেবেই পূজা করা হত।[22] নীল নদের বদ্বীপে আরও উত্তরে ইয়ামুতেরেনুথিসের মতো কয়েকটি শহরেও হাথোরের মন্দির ছিল।[122]

পুরনো রাজ্যের শাসকবর্গ উচ্চ ও মধ্য মিশরে শহর গড়ে তুলতে প্রয়াসী হলে এই সব অঞ্চলের কুসাই, আখমিমনাগা এদ-দের সহ বিভিন্ন স্থানে হাথোরের একাধিক কাল্ট-কেন্দ্র গড়ে ওঠে।[123] প্রথম মধ্যবর্তী পর্যায়ে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২১৮১-২০৫৫ অব্দ) দেনদেরার কাল্ট-মূর্তিটিকে পর্যায়ক্রমিকভাবে থিবীয় সমাধিনগরীতে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। মধ্য রাজ্যের গোড়ার দিকে দ্বিতীয় মেনটুহোটেপ দেইর এল-বাহারির সমাধিনগরীতে হাথোরের একটি স্থায়ী কাল্ট-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।[124] নিকটবর্তী দেইর এল-মেদিনা গ্রামটি ছিল নতুন রাজ্যের আমলে সমাধিক্ষেত্রের মজুরদের আবাসস্থল। সেখানেও হাথোরের কতকগুলি মন্দির ছিল। গ্রামটি পরিত্যক্ত হওয়ার কয়েক শতাব্দী পরেও অন্তত টলেমীয় যুগ পর্যন্ত এর মধ্যে একটি মন্দিরটি সক্রিয় ছিল এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে পুনর্নির্মিত হয়েছিল।[125]

উচ্চ মিশরে হাথোরের সবচেয়ে পুরনো মন্দিরটি দেনদেরায় অবস্থিত। এই মন্দিরটি অন্ততপক্ষে চতুর্থ রাজবংশীয় যুগের।[126] পুরনো রাজ্যের শাসনকাল সমাপ্ত হওয়ার পর এটি গুরুত্বের দিক থেকে হাথোরের মেমফিসীয় মন্দিরগুলিকে ছাপিয়ে যায়।[127] মিশরের সমগ্র ইতিহাসে বহু রাজা এই মন্দির চত্বরে নতুন কিছু সংযোজন করে গিয়েছেন। এখানকার সর্বশেষ মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল টলেমীয় ও রোমান যুগে। বর্তমানে এই মন্দিরটি সেই সময়কার সর্বাধিক সু-সংরক্ষিত মিশরীয় মন্দিরগুলির অন্যতম।[128]

পুরনো রাজ্যে সর্বোচ্চ পুরোহিত সহ হাথোরের অধিকাংশ পুরোহিতই ছিলেন নারী। এই নারীদের অনেকেই ছিলেন রাজপরিবারের সদস্যা।[129] মধ্য রাজ্যের আমলে সর্বোচ্চ পুরোহিতের পদ থেকে নারীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় বাদ দেওয়া হতে থাকে। সেই সময়ই রানিরা অধিকতর ঘনিষ্ঠভাবে হাথোরের কাল্টের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করেন। এইভাবেই হাথোরের উচ্চ পুরোহিত পদগুলি থেকে রাজপরিবারের বাইরের নারীগণ অপসারিত হয়ে যান।[130] যদিও সমগ্র মিশর জুড়েই মন্দির কাল্টগুলিতে সংগীত ও বাদ্য পরিবেশনে নারীদের ভূমিকা অব্যাহত থাকে।[131]

মিশরে কোনও মন্দিরের সর্বাধিক আচরিত অনুষ্ঠানটি ছিল দৈনিক পূজা-উৎসর্গের প্রথাটি। এই অনুষ্ঠানে কাল্ট-মূর্তিটিকে বস্ত্র পরানো হত এবং সেটির সামনে খাদ্য নিবেদন করা হত।[132] সকল মিশরীয় মন্দিরেই দৈনন্দিন আচারগুলি একই প্রকারের ছিল।[132] শুধুমাত্র যে দ্রব্যগুলি দেবতাকে নিবেদন করা হত, তা দেবতাভেদে ভিন্ন ভিন্ন হত।[133] মদ ছিল সকল মন্দিরেই একটি সাধারণ পূজাদ্রব্য। কিন্তু হাথোরের সম্মানে আয়োজিত আচারগুলিতে এই দ্রব্যটির একটি বিশেষ স্থান ছিল।[134] হাথোর ও হাথোরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দেবীদের প্রায়ই সিস্ট্রাম বাদ্যযন্ত্র ও মেনাত কণ্ঠহার উৎসর্গের প্রমাণ পাওয়া যায়।[133] পরবর্তীকালে এবং টলেমীয় যুগে তাঁদের এক জোড়া আয়নাও উৎসর্গ করা হত, যা ছিল সূর্য ও চন্দ্রের প্রতীক।[135]

উৎসব

হাথোরের অনেকগুলি বাৎসরিক উৎসব উদ্যাপিত হত একটি আচারগত উদ্দেশ্যে পালিত মদ্যপান ও নৃত্যানুষ্ঠানের প্রথার মধ্য দিয়ে। উৎসব উপভোগকারীদের উদ্দেশ্য সম্ভবত থাকত আধ্যাত্মিক আনন্দানুভূতি লাভ করা, যে ধারণা অন্য ক্ষেত্রে প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে দুর্লভ অথবা অস্তিত্ববিহীন। গ্রেভস-ব্রাউনের মতে, হাথোরের উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের লক্ষ্য ছিল চৈতন্যের একটি পরিবর্তিত অবস্থায় যাতে, যাতে তারা দিব্য জগতের সঙ্গে নিজেদের যোগসূত্র স্থাপনে সক্ষম হতে পারে।[136] মাতলামির উৎসবের একটি উদাহরণ হল রা-এর চোখের প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিতে আয়োজিত উৎসবটি। হাথোর ও অন্যান্য চক্ষুদেবীর মন্দিরগুলিতে থৌত মাসের বিংশতিতম দিনে এটি পালিত হত। অন্ততপক্ষে মধ্য রাজ্যের আমল থেকে এই উৎসব পালিত হত। অবশ্য এই উৎসবের সর্বাধিক পরিচিতি ঘটে টলেমীয় ও রোমান যুগে।[136] মিশরীয়রা মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত করত দুঃখ, ক্ষুধা ও তৃষ্ণার ধারণাটিকে। তাই মাতলামির উৎসবে আয়োজিত নৃত্য ও পানভোজন ছিল তার বিপরীত ধারণা প্রতীক। যদিও রা-এর চোখের ক্রোধে মানুষের মধ্যে মৃত্যু নেমে আসে বলে মনে করা হত, তবু মাতলামির উৎসব পালিত হত জীবন, প্রাচুর্য ও আনন্দ উদ্যাপনের মাধ্যমে।[137]

মধ্য রাজ্যের আমলে "উপত্যকার সুন্দর উৎসব" নামে একটি স্থানীয় থিবীয় উৎসব উদ্যাপনের সূচনা ঘটে। এই উৎসবে কারনাকের মন্দির থেকে আমুনের কাল্ট-মূর্তিটিকে থিবীয় সমাধিনগরীর অন্যান্য মন্দিরগুলিতে নিয়ে যাওয়া হত। স্থানীয় মানুষজন এই উপলক্ষ্যে তাদের মৃত আত্মীয়বর্গের সমাধিতে গিয়ে পানভোজন ও উৎসব উদ্যাপন করত।[138] নতুন রাজ্যের প্রথম ভাগেই প্রথম এই উৎসবের সঙ্গে হাথোরকে যুক্ত করা হয়।[139] এরপর থেকে দেইর এল-বাহারি মন্দিরে আমুনের রাত্রিবাসকে হাথোরের সঙ্গে তাঁর যৌন মিলন হিসেবে দেখা হত।[140]

দেনদেরার মন্দির সহ টলেমীয় যুগে একাধিক মন্দিরে একাধিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মিশরীয় নববর্ষ উৎসব পালন করা হত। মনে করা হত, এই উৎসবে মন্দিরের দেবতা সূর্যদেবতার সংস্পর্শে এসে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। নববর্ষের পূর্ববর্তী দিনগুলিতে দেনদেরায় হাথোরের মূর্তিটিকে মন্দিরের মধ্যেই ওয়েবেত নামে পরিচিত একটি বিশেষায়িত কক্ষে নিয়ে গিয়ে সেখানকার আকাশ ও সূর্যের চিত্র সংবলিত সিলিং-এর নিচে রাখা হত। নতুন বছরের প্রথম দিনটি অর্থাৎ থোথ মাসের প্রথম দিনে হাথোরের মূর্তিটিকে প্রকৃতি সূর্যালোকে স্নান করানোর জন্য ছাদে নিয়ে যাওয়া হত।[141]

হাথোরকে কেন্দ্র করে সর্বাধিক বিস্তারিতভাবে নথিবদ্ধ উৎসবটি ছিল আরেকটি টলেমীয় উৎসব। এটির নাম ছিল "সুন্দর পুনর্মিলনের উৎসব"। এটি আয়োজিত হত এপিফি মাসে চোদ্দ দিনেরও বেশি সময় ধরে।[142][143] এই উৎসবে হাথোরের কাল্ট-মূর্তিটিকে দেনদেরা থেকে নৌকায় করে বিভিন্ন মন্দির ক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হত যাতে তিনি সেই সব মন্দিরের দেবতাদের সঙ্গে দেখা করতে পারে। এই যাত্রার শেষ গন্তব্যটি ছিল এডফুতে হোরাসের মন্দির। সেখানে দেনদেরার হাথোরের মূর্তিটিকে এডফুর হোরাসের মূর্তির সঙ্গে স্থাপন করা হত।[144] উৎসবের একটি দিনে এই মূর্তি দু’টিকে এমন একটি পূজাস্থানে নিয়ে যাওয়া হত, প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী যেখানে সমাধিস্থ করা হয়েছিল সূর্যদেবতা ও এননিয়াদের মতো আদ্যকালীন দেবতাদের। প্রাচীন মিশরীয় লিপিগুলিতে উল্লিখিত হয়েছে যে, এখানে সেই দেবদম্পতি সেই সব সমাধিস্থ দেবতাদের প্রতি পূজা-উৎসর্গের আচার-অনুষ্ঠানগুলি পালন করতেন।[145] অনেক মিশরতত্ত্ববিদ এই উৎসবটিকে হোরাস ও হাথোরের আচারগত বিবাহের একটি উৎসব হিসেবে গণ্য করেন। যদিও মার্টিন স্ট্যাডলার সেই মতের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, এটি ছিল সমাধিস্থ সৃষ্টিকর্তা দেবতাদের পুনর্যৌবনদানের প্রতীক।[146] সি. জে. ব্লিকার সুন্দর পুনর্মিলনের উৎসবটিকে দূরনিবাসিনী দেবীর প্রত্যাবর্তনের আরেকটি উৎসব বলেই মনে করেছেন। এই ব্যাপারে তিনি মন্দিরের উৎসব-সংক্রান্ত লিপিগুলিতে সৌরচক্ষুর পুরাণকথাটির ইঙ্গিতের উদাহরণ দিয়েছেন।[147] বারবারা রিকটারের মতে, উৎসবটির মধ্যে একাধারে উপরিউক্ত তিনটি বিষয়ই নিহিত ছিল। তিনি দেখিয়েছেন যে, হোরাস ও হাথোরের পুত্র ইহির জন্মোৎসব সুন্দর পুনর্মিলনের উৎসবের নয় মাস পরে দেনদেরায় অনুষ্ঠিত হত। এর থেকে বোঝা যায়, মিশরীয় বিশ্বাসে হোরাসের সঙ্গে দেখা করতে এসে হাথোর ইহিকে গর্ভে ধারণ করতেন।[148]

মিশরীয় পঞ্জিকার তৃতীয় মাস হাথোর বা আথির এই দেবীরই নামাঙ্কিত। প্রাচীনকালে এই সময় সারামাস ধরে তাঁর সম্মানে উৎসবের আয়োজন করা হত। যদিও দেনদেরার লিপিগুলিতে সেই তথ্য নথিবদ্ধ হয়নি।[149]

মিশরের বাইরে পূজা

Foundations of a small stone wall at the base of a desert cliff
তিমনা উপত্যকায় হাথোরের পূজাস্থানের ধ্বংসাবশেষ

অন্ততপক্ষে পুরনো রাজ্যের আমল থেকেই মিশরীয় রাজারা বিবলোসের বালাত গেবালের মন্দিরে দ্রব্যসামগ্রী দান করতেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বালাতের সঙ্গে হাথোরের সমন্বয়-প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিবলোসের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক মসৃণ করা।[150] অষ্টাদশ রাজবংশের ফ্যারাও তৃতীয় থুতমোসের রাজত্বকালে (খ্রিস্টপূর্ব ১৪৭৯-১৪২৫ অব্দ) বিবলোসের নারী রূপে হাথোরের একটি মন্দিরও নির্মিত হয়েছিল। যদিও এটি সম্ভবত ছিল বালাতের মন্দিরের মধ্যে একটি সাধারণ পূজাস্থান।[151] নতুন রাজ্যের পতনের পর বিবলোস শহরের সঙ্গে মিশরের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন হয় এবং তার সঙ্গেই এই অঞ্চলে হাথোরও গুরুত্ব হারান। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের গোড়ার দিকের কয়েকটি পুরাদ্রব্য ইঙ্গিত করে যে, সেই সময়েই মিশরীয়রা বালাতকে আইসিসের সমতুল্য বিবেচনা করতে শুরু করেছিল।[152] খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রিক লেখক প্লুটার্ক তাঁর আইসিস ও ওসাইরিস প্রসঙ্গে গ্রন্থে বিবলোসে আইসিসের উপস্থিতির একটি অতিকথার উল্লেখ করেছিলেন। এই বিবরণ ইঙ্গিত করে যে, প্লুটার্কে সমসাময়িক কালে সেই শহরে আইসিস সম্পূর্ণরূপেই হাথোরের স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন।[153]

পাইলোসের এক মাইসিনীয় সমাধিতে পাওয়া খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতাব্দীর একটি পেনডান্টে হাথোরের মুখ চিত্রিত রয়েছে। সমাধিক্ষেত্রে এই পেনডান্টটির উপস্থিতি থেকে অনুমান করা হয় যে মাইসিনীয়রা সম্ভবত জানত যে, মিশরীয়রা হাথোরকে পরলোকের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।[154]

সিনাই অঞ্চলের মিশরীয়রা সেই অঞ্চলে অল্প কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করেছিল। এগুলির মধ্যে বৃহত্তম মন্দির চত্বরটি উপদ্বীপের পশ্চিম প্রান্তে সেরাবিত এল-খাদিমে অবস্থিত। এটি প্রধানত খনি-খননের পৃষ্ঠপোষক রূপে হাথোরের প্রতি উৎসর্গিত একটি মন্দির চত্বর।[155] মধ্য রাজ্যের মধ্যভাগ থেকে নতুন রাজ্যের প্রায় শেষ ভাগ পর্যন্ত মন্দিরটি সক্রিয় ছিল।[156] উপদ্বীপের পূর্ব প্রান্তে মিশরীয় সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী তিমনা উপত্যকা ছিল নতুন রাজ্যের সমসাময়িক কালে মরসুমি খনি অভিযানের ক্ষেত্র। এখানেও হাথোরের একটি পূজাস্থান ছিল, যেটি সম্ভবত বেমরসুমে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকত। মিশরীয় খনি মজুর হিসেবে যে স্থানীয় মিদিয়ানীয়দের ব্যবহার করত, তারাও সম্ভবত তাদের শ্রমিকসর্দারদের মতো হাথোরের নিকট পূজা উৎসর্গ করত। যদিও বিংশ রাজবংশের সমসাময়িক কালে মিশরীয়রা ক্ষেত্রটি চিরতরে পরিত্যাগ করলে মিদিয়ানীয়রা পূজাস্থানটিকে তাদের নিজস্ব দেবদেবীদের পূজাস্থানে রূপান্তরিত করে নেয়।[157]

উল্টোদিকে দক্ষিণে নুবীয়রা হাথোরকে সম্পূর্ণভাবে তাদের ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। নতুন রাজ্যের আমলে নুবিয়ার অধিকাংশ অংশই মিশরীয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। সেই সময় ফ্যারাওরা নুবিয়ার ফারাসমিরগিসা সহ বিভিন্ন জায়গায় হাথোরের উদ্দেশ্যে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।[78] তৃতীয় আমেনহোটেপ ও দ্বিতীয় রামেসিস দু’জনেই তাঁদের রানিদের হাথোর সহ দেবীগণের রূপভেদ রূপে সম্মান প্রদর্শনার্থে নুবিয়ায় মন্দির নির্মাণ করেছিলেন: আমেনহোটেপের পত্নী তিয়ের মন্দির নির্মিত হয়েছিল সেদেইংগায়[158] এবং রামেসিসের পত্নী নেফেরতারির মন্দিরটি ছিল আবু সিমবেলের ছোটো মন্দিরটি[159] নতুন রাজ্যের পতনের পর নুবিয়ায় উত্থান ঘটে স্বাধীন কুশ রাজ্যের। এই রাজ্যের রাজাদের সম্পর্কে যা বিশ্বাস করা হত, তার ভিত্তি ছিল মিশরের রাজকীয় ভাবাদর্শ। তাই হাথোর, আইসিস, মুত ও নুট সকলকেই কুশীয় রাজাদের পৌরাণিক মাতা এবং রাজার আত্মীয়াদের সমতুল্য জ্ঞান করা হত। এই ধরনের আত্মীয়ার উদাহরণ কানদাকে (কুশীয় রানি বা রাজমাতা), যিনি কুশীয় ধর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।[160] জেবেল বারকাল ছিল আমুনের একটি পুণ্যস্থান। এখানে কুশীয় রাজা তাহারকা এক জোড়া মন্দির নির্মাণ করেছিলেন; একটি হাথোরের এবং অপরটি মুতের। উভয় দেবীর মন্দিরই নির্মিত হয়েছিল আমুনের স্ত্রীর মন্দির হিসেবে এবং মন্দির দু’টি প্রতিস্থাপিত করেছিল নতুন রাজ্যের সেই মন্দিরগুলিকে যেগুলি সম্ভবত একই দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত হয়েছিল।[161] কিন্তু আইসিস ছিলেন নুবিয়ায় পূজিত সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মিশরীয় দেবী এবং সেখানে তাঁর মর্যাদা যুগে যুগে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই কারণে নুবীয় ইতিহাসের মেরোইটীয় পর্যায়ে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০-৪০০ অব্দ) মন্দিরগুলিতে হাথোরের উপস্থিতি লক্ষিত হয় কেবলমান আইসিসের একজন সঙ্গিনী হিসেবে।[162]

জনপ্রিয় পূজা

Plaque showing a woman squatting while cow-headed women stand at either side
হাথোরের দুই মূর্তির সহযোগিতায় প্রসূতির টলেমীয় ফলক, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে প্রথম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনও এক সময়

মন্দিরের প্রাতিষ্ঠানিক ও জনসাধারণ কর্তৃক আয়োজিত আচার-অনুষ্ঠানগুলি ছাড়াও মিশরীয়রা তাদের দেবদেবীদের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে এমনকি ঘরেও পূজা করত। প্রাচীন মিশরে সন্তানের জন্মদান প্রসূতি ও সদ্যোজাত উভয়ের ক্ষেত্রেই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, এদিকে সন্তানও ছিল বহুকাঙ্ক্ষিত। এই জন্যই প্রজননশক্তি ও নিরাপদে শিশুর জন্মের বিষয়টি জনসাধারণের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এই জন্যই বাড়ির পূজাস্থানে হাথোর ও তাওয়েরেতের মতো প্রজননশক্তির দেবতাকে পূজা করা হত। সন্তানের জন্মদানের সময় মিশরীয় প্রসূতিদের ইটের উপর উবু করে বসানো হত। প্রাচীন মিশরের একমাত্র জ্ঞাত জন্মদানকালীন ইটের গায়ের হাথোরের ছবি ঘেরা সন্তানধারী এক নারীর ছবি পাওয়া যায়।[163] রোমান যুগে টেরাকোটা মূর্তিতে হাথোর যেমন করে রা-কে খুশি করেন ঠিক সেই রকমভাবে এক সুনির্মিত শিরাবরণী-পরিহিতা নারীকে নিজের যৌনাঙ্গ উন্মোচিত করতে দেখা যায়। এই ধরনের মূর্তি ক্ষেত্রবিশেষে গার্হস্থ্য পরিমণ্ডলেও পাওয়া গিয়েছে।[164] এই সকল মূর্তির অর্থ জানা না গেলেও[165] প্রায়শ ক্ষেত্রে মনে করা হয় এগুলি আফ্রোদিতির বৈশিষ্ট্য সমন্বয়ে হাথোর বা আইসিসের প্রতীক, যা প্রজননশক্তি অথবা অশুভশক্তির হাত থেকে উদ্ধারের প্রার্থনার প্রতীক।[164]

হাথোর ছিলেন আমুন, প্তাহ্ ও থোথের মতো অল্প কয়েকজন দেবদেবীর অন্যতম যাঁদের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রার্থনার চল ছিল।[166] অনেক মিশরীয়ই যে দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হত তাঁদের মন্দিরে বা ছোটো পূজাস্থানে পূজাদ্রব্য উৎসর্গ করে যেত। হাথোরের প্রতি উৎসর্গিত দ্রব্যের অধিকাংশই ছিল প্রতীকী, সেগুলির স্বকীয় মূল্যের জন্য তা উৎসর্গিত হত না। হাথোরের ছবি আঁকা কাপড় উৎসর্গ করার খুব চল ছিল। সেই সঙ্গে দেবী যে সকল পশুর রূপ ধারণ করতেন বলে বিশ্বাস করা হত সেই সব পশুর ছবি আঁকা ফলক ও মূর্তিও অনেক উৎসর্গিত হত। বিভিন্ন ধরনের উৎসর্গিত দ্রব্য সম্ভবত দাতার পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্যের প্রতীক ছিল। কিন্তু সেগুলির অর্থ সাধারণত অজ্ঞাতই থেকে গিয়েছে। হাথোরের ছবিগুলির মধ্যে তাঁর পৌরাণিক ভূমিকাগুলির চিত্রণ দেখা যেত। যেমন, জলাভূমিতে মাতৃরূপী গোরুর ছবি।[167] সম্ভবত দেবীর ভয়ংকর দিকগুলিকে শান্ত করার এবং তাঁর মঙ্গলময়ী দিকটি বের করে আনার উদ্দেশ্যে সিস্ট্রাম বাদ্যযন্ত্র উৎসর্গ করা হত।[168] অন্যদিকে একটি উদাহরণের গায়ে খোদিত লিপি থেকে জানা যায় যে, পুরুষাঙ্গ-প্রতীক ছিল উর্বরতার প্রার্থনার প্রতীক।[169]

কোনও কোনও মিশরীয় হাথোরের উদ্দেশ্যে লিখিত প্রার্থনা রেখে গিয়েছেন। এগুলি স্টেলাগুলিতে খোদিত অথবা দেওয়ালচিত্রের আকারে লিখিত।[166] আমুনের ন্যায় কোনও কোনও দেবতার প্রার্থনায় দেখা যায়, তাঁরা অপকর্মকারীদের শাস্তি দেন এবং যারা তাদের অপকর্মের জন্য অনুশোচনা করেন তাদের শান্তি দান করেন। কিন্তু হাথোরের প্রতি লিখিত প্রার্থনাগুলিতে তিনি যে সুফলগুলি দান করতে পারেন (যেমন জীবৎকালে প্রচুর খাদ্য এবং মৃত্যুর পর সুবন্দোবস্ত-সম্পন্ন সমাধি) সেগুলিরই উল্লেখ পাওয়া যায়।[170]

অন্ত্যেষ্টি প্রথা

Relief of Hathor holding a man's hand and lifting her menat necklace for him to grasp
পরলোকে প্রথম সেতিকে স্বাগত জানাচ্ছেন হাথোর, খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দী

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত গ্রন্থাবলি ও শিল্পকলায় পরকালের দেবী হিসেবে হাথোরের উল্লেখ প্রায়শই লক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ নতুন রাজ্যের গোড়ার দিকে রাজকীয় সমাধিক্ষেত্রের অলংকরণে যে তিন দেবদেবীর চিত্র সচরাচর সর্বাধিক সংখ্যায় পাওয়া গিয়েছে তাঁরা হলেন ওসাইরিস, আনুবিস ও হাথোর।[171] সেই যুগে বহু ক্ষেত্রে তাঁকে দেখানো হয়েছে পরলোকে মৃতকে অভ্যর্থনাকারিণী দেবী হিসেবে।[172] অন্যান্য চিত্রে অধিকতর পরোক্ষভাবে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরনো রাজ্যের সমাধিগুলির খোদাইচিত্রে পুরুষ ও নারীদের "প্যাপিরাস অনুসন্ধান" নামে একটি আচার পালন করতে দেখা যায়। এই প্রথাটির অর্থ জানা যায় না; তবে কোনও কোনও উৎকীর্ণ লিপিতে বলা হয়েছে যে, এটি পালিত হত "হাথোরের জন্য"। প্যাপিরাসের পত্রবৃন্ত নাড়লে যে মরমর শব্দ হয় তার সঙ্গে সম্ভবত সিসট্রাম বাদ্যের ঝমঝম শব্দের সাদৃশ্য নির্ণীত হয়েছিল।[173] সমাধিক্ষেত্রে হাথোরের অন্যান্য চিত্রের মধ্যে রয়েছে সমাধিনগরীর পর্বত থেকে বেরিয়ে আসা গোরু[83] এবং পরলোকের উদ্যানে পৌরহিত্যকারিণী এক উপবিষ্ট দেবীর ছবি।[88] নুতের চিত্র প্রায়শই শবাধারের ভিতর চিত্রিত বা খোদাইকৃত থাকত। শবাধার নুতের জরায়ু এবং সেখান থেকেই শবাধারে শায়িত ব্যক্তি পরলোকে পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন এই ধারণারই ইঙ্গিত বহন করে এই ছবিগুলি। তৃতীয় মধ্যবর্তী পর্যায়ে শবাধারের মেঝেতে হাথোরের এবং ঢাকনার অভ্যন্তরভাগে নুতের চিত্র অঙ্কনের রীতির সূচনা ঘটে।[86]

অষ্টাদশ রাজবংশের সমাধি শিল্পকলায় প্রায়শই দেখা যায় লোকজন মদ্যপান ও নৃত্যগীত করছে এবং সেই সঙ্গে মেনাত কণ্ঠহার ও সিস্ট্রা বাদ্যযন্ত্র ধারণ করে রয়েছে—এই চিত্রকল্প পরোক্ষে হাথোরকেই ইঙ্গিত করে। ছবিগুলি সম্ভবত সমাধিস্থ ব্যক্তির স্মৃতিরক্ষার্থে সমাধির সম্মুখে আয়োজিত ব্যক্তিগত ভোজসভার অথবা "উপত্যকার সুন্দর উৎসব" প্রভৃতি মন্দির-উৎসবে জনসমাগমের দৃশ্য।[174] মিশরীয়রা বিশ্বাস করত উৎসবের মাধ্যমে মানব দিব্যজগতের সঙ্গে এবং সম্প্রসারিত অর্থে জীবিত মৃতের সঙ্গে যোগাযোগে সক্ষম হয়। এই জন্য সমাধিক্ষেত্রে লিপিগুলিতে প্রায়শই এমন ইচ্ছা প্রকাশ করা হত, যেন মৃত উৎসবে, বিশেষ করে ওসাইরিসের প্রতি উৎসর্গিত উৎসবগুলিতে, অংশগ্রহণ করতে পারেন।[175] সমাধির উৎসব-সংক্রান্ত চিত্রগুলিতে অবশ্য হাথোর-সংক্রান্ত উৎসবগুলির উল্লেখ থাকলেও থাকতে পারে। এই ধরনের উৎসবের অন্যতম "মাতলামির উৎসব" বা সেই সব ব্যক্তিগত ভোজসভা যেগুলির সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এই সব ভোজসভায় (যেমন মাতলামির উৎসবের ক্ষেত্রে) মদ্যপান ও নৃত্যের উদ্দেশ্য সম্ভবত ছিল মৃতের আত্মার সঙ্গে যোগস্থাপনের জন্য অংশগ্রহণকারীদের মদোন্মত্ত করে তোলা।[174]

অন্ততপক্ষে পুরনো রাজ্যের আমল থেকেই মিশরীয়দের ধারণা ছিল যে, হাথোর মৃত ব্যক্তিদের রসদ যোগান দেন এবং অন্ততপক্ষে মধ্য রাজ্যের শবাধার লিপিগুলিতে পরলোকে তাঁর ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে যোগ দানে পুরুষ ও নারী উভয়কে সক্ষম করে তোলার উদ্দেশ্যে রচিত মন্ত্রগুলি খোদাই করা হতে থাকে।[92] কয়েকটি সমাধিদ্রব্যের গায়ে অঙ্কিত দেবীরূপিণী মৃত নারীর চিত্র সম্ভবত হাথোরের অনুগামিনী এই সকল নারীরই ছবি। যদিও এই চিত্রকল্পের মাধ্যমে হাথোর বা আইসিসকে বোঝানো হত কিনা তা জানা যায় না। হাথোর ও মৃত নারীর সংযোগটি অবলুপ্তির পূর্বে প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের শেষ পর্যায় রোমান যুগ অবধি রক্ষিত হয়েছিল।[176]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. হার্ট ২০০৫, পৃ. ৬১
  2. হাসান ১৯৯২, পৃ. ১৫।
  3. লেসকো ১৯৯৯, পৃ. ১৫–১৭।
  4. উইলকিনসন ১৯৯৯, পৃ. ২৪৪–২৪৫।
  5. গিলাম ১৯৯৫, পৃ. ২১৪।
  6. ফিশার ১৯৬২, পৃ. ১১–১৩।
  7. ট্রয় ১৯৮৬, পৃ. ৫৪।
  8. লেসকো ১৯৯৯, পৃ. ৮১–৮৩।
  9. ফিশার ১৯৬২, পৃ. ৭, ১৪–১৫।
  10. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ৭৭, ১৪৫।
  11. গিলাম ১৯৯৫, পৃ. ২১৭–২১৮।
  12. ব্লিকার ১৯৭৩, পৃ. ৭১–৭২।
  13. ট্রয় ১৯৮৬, পৃ. ৫৩–৫৪।
  14. ব্লিকার ১৯৭৩, পৃ. ৩১–৩৪, ৪৬–৪৭।
  15. গ্রেভস-ব্রাউন ২০১০, পৃ. ১৩০।
  16. বিলিং ২০০৪, পৃ. ৩৯।
  17. ব্লিকার ১৯৭৩, পৃ. ২৫, ৪৮।
  18. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ১৪০।
  19. রিকটার ২০১৬, পৃ. ১২৮, ১৮৪–১৮৫।
  20. Wilkinson 2003, পৃ. 156।
  21. Pinch 1993, পৃ. 155।
  22. কার্ক ২০০১, পৃ. ১০২–১০৫।
  23. গিলাম ১৯৯৫, পৃ. ২১৮।
  24. ট্রয় ১৯৮৬, পৃ. ২১-২৩, ২৫–২৭।
  25. পিঞ্চ ২০০২, পৃ. ১২৯–১৩০।
  26. রিটনার ১৯৯০, পৃ. ৩৯।
  27. গ্রেভস-ব্রাউন ২০১০, পৃ. ১৬৯–১৭০।
  28. পিঞ্চ ২০০২, পৃ. ৭১–৭৪।
  29. পিঞ্চ ২০০২, পৃ. ১৩০।
  30. হ্যারিংটন ২০১৬, পৃ. ১৩২–১৩৪।
  31. ফিনেস্টাড ১৯৯৯, পৃ. ১১৩–১১৫।
  32. ম্যানিচ ২০১০, পৃ. ১৩–১৪, ১৬–১৭।
  33. পু ২০০৯, পৃ. ১৫৩–১৫৭।
  34. ব্লিকার ১৯৭৩, পৃ. ৫৭।
  35. ডারনেল ১৯৯৫, পৃ. ৪৮।
  36. ডারনেল ১৯৯৫, পৃ. ৫৪, ৬২, ৯১–৯৪।
  37. পিঞ্চ ২০০২, পৃ. ১৩৮।
  38. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ৯৯, ১৪১, ১৫৬।
  39. ক্রুজ-উরিবে ১৯৯৪, পৃ. ১৮৫, ১৮৭–১৮৮।
  40. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ১৫৫।
  41. লেসকো ১৯৯৯, পৃ. ১২৭।
  42. ডারনেল ১৯৯৫, পৃ. ৪৭, ৬৯।
  43. পিঞ্চ ২০০২, পৃ. ১৯৭।
  44. শ্নেইডার ২০০৭, পৃ. ৩১৫–৩১৭।
  45. মরিস ২০০৭, পৃ. ১৯৮–১৯৯, ২০১, ২০৭।
  46. সেলডেন ১৯৯৮, পৃ. ৩৪৬–৩৪৮।
  47. ব্লিকার ১৯৭৩, পৃ. ৪০–৪১।
  48. লেসকো ১৯৯৯, পৃ. ৮২–৮৩।
  49. হার্ট ২০০৫, পৃ. ৬২।
  50. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ১৭৫–১৭৬।
  51. পিঞ্চ ২০০২, পৃ. ১৩১–১৩২।
  52. মিকস ও ফাভার্ড-মিকস ১৯৯৬, পৃ. ১৮৩–১৮৪।
  53. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ১৩২–১৩৩।
  54. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ১২৩, ১৬৮।
  55. হার্ট ২০০৫, পৃ. ৭১।
  56. রবার্টস ২০০০, পৃ. ২৬–২৭।
  57. রিকটার ২০১৬, পৃ. ১৭৯–১৮২।
  58. ম্যাকক্লেইন ২০১১, পৃ. ৩–৬।
  59. রিকটার ২০১৬, পৃ. ১৬৯–১৭২, ১৮৫।
  60. হফমেয়ার ২০০১, পৃ. ৫০৭–৫০৮।
  61. Griffiths ২০০১, পৃ. ১৮৯।
  62. তে ভেলদে ২০০১, পৃ. ৪৫৫।
  63. হলিস ২০০৯, পৃ. ২।
  64. এস্পিনেল ২০০২, পৃ. ১১৭–১১৯।
  65. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ১৩৯।
  66. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ১৩৭।
  67. কর্নেলিয়াস ২০০৪, পৃ. ৪৫।
  68. কর্নেলিয়াস ২০০৪, পৃ. ৯৬–৯৭।
  69. হার্ট ২০০৫, পৃ. ১৩২।
  70. ব্লিকার ১৯৭৩, পৃ. ৭২–৭৪।
  71. ডারনেল ১৯৯৫, পৃ. ৯৩–৯৪।
  72. Hart 2005, পৃ. 65।
  73. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ৫২।
  74. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ৪৯–৫০।
  75. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ১৪৩।
  76. এস্পিনেল ২০০৫, পৃ. ৬১, ৬৫–৬৬।
  77. ইয়েলিন ২০১২, পৃ. ১২৫–১২৮।
  78. উইলকিনসন ২০০০, পৃ. ২২৭–২৩০।
  79. অ্যাজমান ২০০৫, পৃ. ১৫৩।
  80. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ১৪৫–১৪৬।
  81. গ্রেভস-ব্রাউন ২০১০, পৃ. ১৬৬।
  82. মিকস ও ফাভার্ড-মিকস ১৯৯৬, পৃ. ৮৮, ১৬৪।
  83. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ১৭৯–১৮০।
  84. ভিসচাক ২০০১, পৃ. ৮২।
  85. অ্যাজমান ২০০৫, পৃ. ১৭০–১৭৩।
  86. লেসকো ১৯৯৯, পৃ. ৩৯–৪০, ১১০।
  87. অ্যাজমান ২০০৫, পৃ. ১৫২–১৫৪, ১৭০–১৭৩।
  88. বিলিং ২০০৪, পৃ. ৪২–৪৩।
  89. বিলিং ২০০৪, পৃ. ৩৭–৩৮।
  90. Cooney 2010, পৃ. 227–229।
  91. কুনি ২০১০, পৃ. ২২৭–২২৯, ২৩৫–২৩৬।
  92. স্মিথ ২০১৭, পৃ. ২৫১–২৫৪।
  93. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ১৪৩–১৪৪, ১৪৮।
  94. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ৭৭, ১৭৫।
  95. পিঞ্চ ২০০২, পৃ. ১৯৮–১৯৯।
  96. রবার্টস ১৯৯৭, পৃ. ৮–১০।
  97. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ১৯০–১৯৭।
  98. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ১৬৮–১৬৯।
  99. গ্রাহাম ২০০১, পৃ. ১৬৬।
  100. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ১৫৩–১৫৯।
  101. উইলকিনসন ১৯৯৩, পৃ. ৩২, ৮৩।
  102. হার্ট ২০০৫, পৃ. ৬৫।
  103. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ২৭৮।
  104. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ১৩৫–১৩৯।
  105. লেসকো ১৯৯৯, পৃ. ৪৮–৪৯।
  106. গিলাম ১৯৯৫, পৃ. ২১৫।
  107. গোয়েডিক ১৯৭৮, পৃ. ১১৮–১২৩।
  108. মরিস ২০১১, পৃ. ৭৫–৭৬।
  109. গিলাম ১৯৯৫, পৃ. ২২২–২২৬, ২৩১।
  110. গিলাম ১৯৯৫, পৃ. ২৩১।
  111. গ্রেভস-ব্রাউন ২০১০, পৃ. ১৩৫–১৩৬।
  112. গিলাম ১৯৯৫, পৃ. ২৩৪।
  113. গ্রেভস-ব্রাউন ২০১০, পৃ. ১৩২–১৩৩।
  114. লেসকো ১৯৯৯, পৃ. ১০৫–১০৭।
  115. রবিনস ১৯৯৯, পৃ. ১০৭–১১২।
  116. লেসকো ১৯৯৯, পৃ. ১১৯–১২০, ১৭৮–১৭৯।
  117. লেসকো ১৯৯৯, পৃ. ১২৯।
  118. সেলদেন ১৯৯৮, পৃ. ৩১২, ৩৩৯।
  119. উইলকিনসন ২০০৩, পৃ. ১৪১।
  120. চেশায়ার ২০০৭, পৃ. ১৫৭–১৬৩।
  121. গিলাম ১৯৯৫, পৃ. ২১৯–২২১।
  122. উইলকিনসন ২০০০, পৃ. ১০৮, ১১১।
  123. গিলাম ১৯৯৫, পৃ. ২২৬, ২২৯।
  124. গোয়েডিকে ১৯৯১, পৃ. ২৪৫, ২৫২।
  125. উইলকিনসন ২০০০, পৃ. ১৮৯–১৯০।
  126. গিলাম ১৯৯৫, পৃ. ২২৭।
  127. ভিসচাক ২০০১, পৃ. ৮৩।
  128. উইলকিনসন ২০০০, পৃ. ১৪৯–১৫১।
  129. লেসকো ১৯৯৯, পৃ. ২৪০–২৪১।
  130. গিলাম ১৯৯৫, পৃ. ২৩৩–২৩৪।
  131. লেসকো ১৯৯৯, পৃ. ২৪৩–২৪৪।
  132. থম্পসন ২০০১, পৃ. ৩২৮।
  133. মিকস ও ফাভার্ড-মিকস ১৯৯৬, পৃ. ১২৬–১২৮।
  134. পু ২০১০, পৃ. ২–৩।
  135. ডেরিকস ২০০১, পৃ. ৪২১–৪২২।
  136. গ্রেভস-ব্রাউন ২০১০, পৃ. ১৬৬–১৬৯।
  137. ফ্রান্ডসেন ১৯৯৯, পৃ. ১৩১, ১৪২–১৪৩।
  138. টিটার ২০১১, পৃ. ৬৭–৬৮।
  139. সাদেক ১৯৮৮, পৃ. ৪৯।
  140. টিটার ২০১১, পৃ. ৭০।
  141. মিকস ও ফাভার্ড-মিকস ১৯৯৬, পৃ. ১৯৩–১৯৮।
  142. ব্লিকার ১৯৭৩, পৃ. ৯৩।
  143. রিকটার ২০১৬, পৃ. ৪।
  144. ব্লিকার ১৯৭৩, পৃ. ৯৪।
  145. ভারনার ২০১৩, পৃ. ৪৩৭–৪৩৯।
  146. স্ট্যাডলার ২০০৮, পৃ. ৪–৬।
  147. ব্লিকার ১৯৭৩, পৃ. ৯৮–১০১।
  148. রিকটার ২০১৬, পৃ. ৪, ২০২–২০৫।
  149. ভারনার ২০১৩, পৃ. ৪৩।
  150. এস্পিনেল ২০০২, পৃ. ১১৬–১১৮।
  151. ট্রনেকার ২০০১, পৃ. ১১০।
  152. জারনেকে ২০১৩, পৃ. ২২৭–২৩০।
  153. হলিস ২০০৯, পৃ. ৪–৫।
  154. লোবেল ২০২০
  155. উইলকিনসন ২০০০, পৃ. ২৩৮–২৩৯।
  156. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ৫৫–৫৭।
  157. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ৫৯–৬৯।
  158. মরকোট ২০১২, পৃ. ৩২৫–৩২৬।
  159. ফিশার ২০১২, পৃ. ৩৫৭–৩৫৮।
  160. কেন্ডাল ২০১০বি
  161. কেন্ডাল ২০১০এ, পৃ. ১, ১২।
  162. ইয়েলিন ২০১২, পৃ. ১২৮, ১৩৩।
  163. রিটনার ২০০৮, পৃ. ১৭৩–১৭৫, ১৮১।
  164. মরিস ২০০৭, পৃ. ২১৮–২১৯।
  165. সান্দ্রি ২০১২, পৃ. ৬৩৭–৬৩৮।
  166. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ৩৪৯–৩৫১।
  167. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ১১৯, ৩৪৭, ৩৫৪–৩৫৫।
  168. পিঞ্চ ১৯৯৩, পৃ. ১৫৭–১৫৮।
  169. লেসকো ২০০৮, পৃ. ২০৩–২০৪।
  170. সাদেক ১৯৮৮, পৃ. ৮৯, ১১৪–১১৫।
  171. লেসকো ১৯৯৯, পৃ. ১১০।
  172. অ্যাজমান ২০০৫, পৃ. ১৭১।
  173. উডস ২০১১, পৃ. ৩১৪–৩১৬।
  174. হ্যারিংটন ২০১৬, পৃ. ১৩২–১৩৬, ১৪৪–১৪৭।
  175. অ্যাজমান ২০০৫, পৃ. ২২৫।
  176. স্মিথ ২০১৭, পৃ. ৩৮৪–৩৮৯।

উল্লেখপঞ্জি

বহিঃসংযোগ

  • উইকিমিডিয়া কমন্সে হাথোর সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.