সৈয়দ হাসান ইমাম

সৈয়দ হাসান ইমাম (জন্ম: ২৯ জুলাই, ১৯৩৫) বাংলাদেশের একজন অভিনেতা, আবৃত্তিকার এবং স্বৈরাচারসাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব।[2]

সৈয়দ হাসান ইমাম
সৈয়দ হাসান ইমাম
জন্ম
সৈয়দ হাসান ইমাম

(1935-07-29) ২৯ জুলাই ১৯৩৫
বর্ধমান, ব্রিটিশ ভারত
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সালের পূর্বে)
 পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
 বাংলাদেশ (১৯৭১ সালের পর)
পেশাব্যাংক কর্মকর্তা [1]
পরিচিতির কারণস্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, অভিনেতা, আবৃত্তিকার, পরিচালক
পুরস্কারএকুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার

প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা

জন্ম বর্ধমানে। ছেলেবেলা পশ্চিমবঙ্গে কেটেছে। বাবা সৈয়দ সোলেমান আলী আয়কর কর্মকর্তা ছিলেন। হাসান ইমাম মাত্র দুই বছর বয়সে তার বাবাকে হারান। পৈতৃক নিবাস বাগেরহাটে এবং মাতৃনিবাস বর্ধমানেই[1] সৈয়দ হাসান ইমামের শিক্ষাজীবন শুরু হয় বর্ধমান টাউন স্কুলে। তারপর তিনি অধ্যয়ন করেন ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রাজ কলেজ ও ১৯৫৪ সালে থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত টেকনিক্যাল কলেজে।

পূর্ব পাকিস্তান পর্ব

১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। সে বছরই প্রথমে দর্শনার চিনিকলে এবং পরে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে যোগ দেন।[1] সৈয়দ ইমাম রাজ কলেজের সাংস্কৃতিক সম্পাদক, কমনরুম সম্পাদক নিযুক্ত হন। বর্ধমান জেলা গণনাট্য সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। ছাত্রজীবনে ১৯৫২ সালে অল ইন্ডিয়া ইয়ুথ ফেস্টিভালে তিনি রবীন্দ্রসংগীতে প্রথম স্থান পেয়েছিলেন। বর্ধমানে মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করে বিশেষ প্রশংসিত হন এবং ১৯৫৫ সালে কলেজের অনুষ্ঠানে তার গান শুনে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় তাঁকে বিনা পারিশ্রমিকে গান শেখানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু মাত্র এক বছর তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতে তামিল নেন।

কর্মজীবন

১৯৬০ সাল থেকে ইমামের অভিনয় জীবন শুরু হয়। ১৯৬১ সালে প্রতিকূল পরিস্থিতে প্রতিবাদী শিল্পী সমাজের নেতৃত্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন করেন। ১৯৬০ সাল থেকে তিনি চলচ্চিত্রে এবং ১৯৬৪ সাল থেকে টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন। তার প্রথম দিকের ছবির মধ্যে রাজা এল শহরে, শীত বিকেল, জানাজানি, ধারাপাত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৫ সালে সমগ্র পাকিস্তানের চলচ্চিত্র উৎসবে হাসান ইমাম শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান লাভ করেন খান আতাউর রহমানের অনেক দিনের চেনা ছবিতে অভিনয়ের জন্য।

রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের কেন্দ্রীয় উৎসবে ডামা সার্কেল প্রযোজিত তাসের দেশ, রাজা ও রানী এবং রক্তকরবী নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী ছিলেন ১৯৬৪ সালে অভিষিক্ত হন টেলিভিশন নাটকে। বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি নাটকে নিয়মিত অংশ নেন। টিভির দুই শতাধিক নাটকের মধ্যে তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাটক, মুস্তাফা মনোয়ার নির্দেশিত শেক্সপিয়ারের মুখরা রমণী বশীকরণ, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী, মোস্তফা কামাল সৈয়দ প্রযোজিত স্বপ্ন বিলাস ইত্যাদি। ১৯৬৬ থেকে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের মঞ্চে নাটক-নাটিকা ও গণসঙ্গীত পরিচালনা করেন। হাসান ইমাম পরিচালিত অন্য নাটকগুলোর মধ্যে ম্যাক্সিম গোর্কীর মা, সোমেন চন্দের না ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনের সময় সংস্কৃতি সংসদ আয়োজিত প্রায় ১০ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে বাংলা একাডেমির বটমূলে মঞ্চায়িত রক্তকরবী নাটকটি বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। তার ভাষ্যে:

[1]

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা

১৯৭১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে হাসান ইমামকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় শিল্পীদের প্রতিবাদী সংগঠন বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জন করেন। গণআন্দোলনের চাপে পাকিস্তানি সরকার ৮ মার্চ থেকে বেতার টেলিভিশনের দায়িত্ব বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চের পর হাসান ইমাম মুজিব নগরের চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ১৯৭১-এ স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের নাট্য বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। সৈয়দ হাসান ইমাম মুজিবনগর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সালেহ আহমেদ ছদ্মনামে বাংলা সংবাদ পাঠ করতেন। হাসান ইমাম ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সংবাদ পাঠ এবং নাট্য বিভাগের দায়িত্বভার বহন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হানকে সভাপতি ও হাসান ইমামকে সাধারণ সম্পাদক করে মুজিব নগরে চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি গঠন করা হয়, যাঁদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দলিল 'লেট দেয়ার বি লাইট' নির্মিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় হাসান ইমাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।[1]

স্বাধীনতার পর

সৈয়দ হাসান ইমাম জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের প্রধান মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’-এর আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসায় হাসান ইমাম দেশত্যাগে বাধ্য হন।[1] দেশত্যাগের আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীসহ বহু সংগঠনের সভাপতি-আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। হাসান ইমাম টেলিভিশন নাট্যকার, নাট্যশিল্পী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন সুদীর্ঘ ৩৮ বছর যাবৎ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা চক্রান্তের ওপর রচিত আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত 'পলাশী থেকে ধানমণ্ডি' পরিচালনার কাজেও তিনি নিয়োজিত ছিলেন। চলচ্চিত্রটি তার নির্দেশনায় সফলভাবে মঞ্চায়িত হয় ২০০৪ সালের ২৮ মার্চ লন্ডনের লোগান হলে। রাজনীতি প্রসঙ্গে হাসান ইমাম বলেন:

[3]

ব্যক্তিগত জীবন

হাসান ইমাম শিল্পী লায়লা হাসানকে বিয়ে করেন। লায়লা হাসানের বাবা আওয়াল সাহেব ব্যাংকে যাতায়াত করতেন লেনদেনের কাজে। এভাবে তিনি হাসান ইমামের সাথে পরিচিত হন। পরবর্তীকালে হাসান ইমামের শ্বশুর হন। লায়লা হাসান বলেন:

স্বামী হিসেবে হাসান ইমাম এক কথায় অতুলনীয়, যা প্রতিটি মেয়ের একান্ত কাম্য। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্বামী, বন্ধু, গাইড ও অভিভাবক। উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। ওঁর ঐকান্তিক অনুপ্রেরণা ও ইচ্ছাই আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে বাধ্য করেছে। বিবাহিত জীবনে শিল্পী হিসেবে যে প্রতিষ্ঠা আমি পেয়েছি, তার মূলেও তিনিই।

[4]

সম্মাননা

সৈয়দ হাসান ইমাম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার পান। মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ অবদানের জন্য সিকোয়েন্স পুরস্কার লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকসহ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে হাসান ইমাম জুরির দায়িত্ব পালন করেন। তার সম্পর্কে আতিকুল হক চৌধুরী বলেন:

বাংলাদেশের নাট্যশিল্পীদের জন্য এত দরদ দিয়ে সংগঠন তৈরি করা, সংগঠন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা, সাংগঠনিক কাজ করা এবং বিপদাপদে সংগঠনের শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো; এসব কাজে বাংলাদেশে হাসান ইমামের মতো নিষ্ঠাবান মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি।

এছাড়া ২০১৬ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৬ লাভ করেন।[5] ২০১৮ সালে দ্য ডেইলি স্টার-স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড জীবনের জয়গান আজীবন সম্মাননা পান।[6]

তথ্যসূত্র

  1. "এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকার: সৈয়দ হাসান ইমাম"বিবিসি বাংলা
  2. "'পর্দার নায়িকার মতো না হলেও মা মা-ই'"। দৈনিক প্রথম আলো। ৪ জানুয়ারি ২০২০।
  3. "পর্দার নায়িকার মতো না হলেও মা মা-ই"
  4. হাসান, লায়লা (২৭ জুলাই ২০১০)। "চিরপথের সঙ্গী আমার"দৈনিক প্রথম আলো। ২৮ জুলাই ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জানুয়ারি ২০১১
  5. "স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন ১৫ ব্যক্তি ও নৌ-বাহিনী"দৈনিক জনকণ্ঠ। ২৪ মার্চ ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১৬
  6. "আশ্বিনের আঙ্গিনায় 'জীবনের জয়গান' উৎসব"The Daily Star Bangla। ২০১৮-১০-১১। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-১৬

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.