সূর্যগ্রহণ
চাঁদ যখন পরিভ্রমণরত অবস্থায় কিছু সময়ের জন্য পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন পৃথিবীর কোন দর্শকের কাছে সূর্য আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায় (কিছু সময়ের জন্য)। এই ঘটনাকে সূর্যগ্রহণ বলা হয়। অমাবস্যার পরে নতুন চাঁদ উঠার সময় এ ঘটনা ঘটে। পৃথিবীতে প্রতি বছর অন্তত দুই থেকে পাচঁটি সূর্যগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়। এর মধ্যে শূন্য থেকে দুইটি সূর্যগ্রহণ পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয়।
২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ শেষ সূর্যগ্রহণ হয়। এইদিনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয় এবং রিং অফ ফায়ার তৈরি হয়। আরব ভূখণ্ড থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত সূর্যগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়।[1]
ইতিহাস
সারোস চক্র
ব্যাবিলনীয় সভ্যতা থেকে পরিচিত সূর্যগ্রহণের পর্যায়কাল। ১০০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দেও গ্রহণের পূর্বাভাস মানুষ দিতে পারত। ঐ সময় ক্যালান্ডরে জ্যোতিষীরা গ্রহণ সম্বন্ধে একটা আশ্চর্য মিল লক্ষ করেন। তারা দেখেন যে ১৮ বছর ১০ দিন পরপর গ্রহণ পুনরাবর্তিত হয়। এই থেকে সারোস চক্র দিয়ে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণগুলি চিহ্নিত করার প্রথা চালু হয়। সারোস[3] কথাটির লাতিন অর্থ পুনরাবৃত্তি। ২২ জুলাই, বাংলাদশে থেকে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যায় তা ছিল ১৩৬ সারোসচক্রের ৩৭ তম গ্রহণ মোট সংখ্যা ৭১টার মধ্যে। প্রতিটি সারোসচক্র প্রায় ৭৫টি গ্রহণে সমাপ্ত হয়। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণে হঠাৎ দিনের বেলা রাতের অন্ধকার নেমে আসে এবং চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশে হঠাৎ একটা পরিবর্তন আসে। পাখিরা সন্ধ্যার আভাস পেয়ে ফিরে যেতে থাকে বনে, বাতাস স্থির হয়ে যায়, হঠাৎ তাপমাত্রা কমতে থাকে।
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চন্দ্রগ্রহণের চেয়ে সূর্যগ্রহণ বেশিবার হয়। প্রতি সাতটি গ্রহণের মধ্যে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের অনুপাত ৫:২ বা ৪:৩। তবে অধিকাংশ সূর্যগ্রহণ সমুদ্রপৃষ্ঠে বা পর্বতমালার ওপর দিয়ে গেলে নজড়ে পড়ে না। জনাকীর্ণ লোকালয়ের ওপর দিয়ে তা গেলে তবেই প্রাধান্য পায়, যেখানে যন্ত্রপাতি দিয়ে বিশেষভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পাওয়া যায়। এই সুযোগ সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা নিজ নিজ বিষয়ে নানা গবেষণা চালাবার সুযোগ নেন। যদিও গ্রহণ ছাড়া কৃত্রিমভাবে করোনোগ্রাফ দিয়ে সূর্যকে ঢেকে ছটামণ্ডলের ছবি তোলা বা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, কিন্তু পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ ছাড়া কতগুলি বিশেষ বিষয় পর্যবেক্ষণ সম্বব হয় না। তাছাড়া অন্যভাবে প্রাপ্ত তথ্যাবলী এই সময়ে মিলিয়ে নেওয়া হয়। সূর্যের সাধারণ অবস্থায় আমরা এর আলোকমণ্ডল দেখে থাকি। কিন্তু সূর্যের ছটামণ্ডল, আবহমণ্ডল, ক্রোমোস্ফীয়ার ইত্যাদি দেখা যায় না। শুধু সূর্যগ্রহণেই তাদের ছটা দেখার সুযোগ আসে। এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে ১৮৬৮ সালের ১৮ই আগস্টের পূর্ণগ্রাস সূর্যগহণের সময় ভারতের মানমন্দির থেকে প্রথম আবহাওয়ায় হিলিয়ামের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। এর আরও ২৭ বছর পরে পৃথিবীতে হিলিয়ামের আবিষ্কার সম্ভব হয়। সূর্যের অভ্যন্তরে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬৫.৭ কোটি টন হাইড্রোজেন সংযোজিত হয়ে ৬৫.২৫৬ কোটি টন হিলিয়ামে রূপান্তরিত হচ্ছে, যা সূর্যের শক্তির উৎস। ১৯১৯ সালের পূর্ণগ্রাস সূর্যগহণের সময় ব্রিটেনের রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, আইনস্টাইনের বক্তব্য যে আলোর ভর আছে এবং তা মাধ্যাকর্ষণের দ্বারা আকর্ষিত হয়, এ বিষয়ে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন এবং ব্রাজিলের সরোবন এবং গিনি উপসাগরের প্রিনসিপ দ্বীপে দুটি গবেষণাদল পাঠানো হয়, যারা ঐ তথ্যের সত্যতা প্রমাণ করেন।[4]
ধরন
চার প্রকারের সূর্যগ্রহণ দেখা যায়
- পূর্ণ সূর্যগ্রহণ - সূর্যগ্রহণে চাঁদ সূর্যকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলতে পারে, ফলে কোনো স্থানে তখন হয় পূর্ণ সূর্যগ্রহণ। পূর্ণ সূর্যগ্রহণে সূর্য পুরো ঢাকা পড়ে যায় বলে সৌরমুকুট দেখা যায়।
- বলয় সূর্যগ্রহণ - কিন্তু চাঁদের কৌণিক ব্যাস সূর্যের চেয়ে ছোট হলে হবে বলয় গ্রহণ। অমাবস্যার সময়ে সূর্যগ্রহণ হয় তবে সব অমাবস্যায় সূর্যগ্রহণ হয় না, কারণ চাঁদ ভূ-কক্ষের সাথে ৫ ডিগ্রী হেলে থাকে।
- হাইব্রিড সূর্যগ্রহণ
- আংশিক সূর্যগ্রহণ - অন্যত্র তখন চাঁদ সূর্যের আংশিক ঢেকে রাখায় সংঘটিত হয় আংশিক সূর্যগ্রহণ।
প্রচ্ছায়া
কোনো গ্রহ/উপগ্রহের ছায়ার কেন্দ্রীয় গাঢ়, অন্ধকার অঞ্চল।
উপচ্ছায়া
সূর্যালোকে আলোকিত পৃথিবী বা অন্য কোনো বস্তুর মূল ছায়ার কোণের চারপাশে আংশিক ছায়ার যে অংশ দেখা যায়। এ অঞ্চলে আংশিক গ্রহণ হয়।
গ্রহণের স্থিতি
পৃথিবী থেকে বেশিক্ষণ ধরে এবং বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সূর্যগ্রহণ দেখতে পাওয়ার শর্ত হল:
- সূর্য বেশি দূরত্বে থাকার ফলে তুলনামূলকভাবে ছোট মনে হবে।
- চাঁদ কাছে থাকবে ফলে চাঁদের বড় গোলক সূর্যকে বেশিক্ষণ ধরে আড়াল করে রাখতে পারবে।
- চাঁদ কাছে থাকলে তার ছায়াও বৃহত্তর ভূখন্ডের ওপর পড়বে।
- মূলমধ্যরেখার যত কাছে থাকা যাবে গ্রহণ তত দীর্ঘস্থায়ী হবে।
পর্যবেক্ষণের বিষয়সমূহ
মুক্তারমালা
চাঁদের আড়ালে সূর্য পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে চাঁদের পূর্বপ্রান্ত ঘিরে একটি সরু আলোর রেখা আর তার মাঝে মাঝে আলোকবিন্দু দেখা যায়, একে বাংলায় বলে মুক্তমালা। আবার চাঁদের পাহাড়, পর্বত, উপত্যকার ফাঁক দিয়ে আলো এসে হীরার আংটি বা ডায়মন্ড রিং এর মতোই দেখায় সূর্যগ্রহণের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্পর্শের সময়।
তাপমাত্রার হ্রাস
সূর্যগ্রহণের সময় আবহাওয়ার তাপমাত্রা দ্রুত হ্রাস পায়। সেই তাপমাত্রা কিরকম কমছে প্রতি ১৫ সেকেণ্ড অন্তর একটা গ্রাফ কাগজে সারি করে সংগ্রহ করা যেতে পারে। গ্রহণের ১০ মিনিট আগে থেকে শুরু করে শেষ হওয়ার ১০ মিনিট পর পর্যন্ত। শুধু একটা ঘড়ি ও থার্মোমিটার হলেই চলবে। তবে আবহাওয়ার চেয়ে মাটি, পাথর ইত্যাদির তাপমাত্রা তাড়াতাড়ি বাড়ে ও কমে।
প্রাণীর আচরণ
পাখি, পোকামাকড় ও জন্তু-জানোয়ার হঠাৎ দিনের বেলা সূর্যের আলো কমতে থাকায় বিহ্বল হয়ে পড়ে, তাদের আচার আচরণের ওপরও নজর রাখা যেতে পারে। মানুষের আচরণ নিয়েও গবেষণা করতে পারা যায়, অবশ্যই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে।
ছায়ালহরী
গ্রহণের সময় সূর্য যেমনি ঢাকা পড়তে আরম্ভ করে গাছের নিচে পাতার ফাঁক দিয়ে যে আলো মাটিতে পড়ে তাদের প্রতিবিম্বতেও ঐ সূর্যের আকারের প্রভাব থাকে। এইসময় অন্ধকার হওয়ার কয়েক মিনিট আগে আলোছায়ার ঢেউ বা ছায়ালহরী ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলেই তবেই দেখা যায়। গাছের তলায় সাদা চাদর বিছিয়ে ছায়ালহরী দেখতে হয়।
কুসংস্কার
গ্রহণ নিয়ে সমাজে অনেক ধরনের কুসংস্কার আছে। ঐ সময়ে খেতে নেই, তৈরি করা খাবার ফেলে দিতে হয় ইত্যাদি। গ্রহণ দেখাও অনেকের কাছে নিষেধ। সূর্যকে গিলে ফেলা রাহুর ভয়ে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে বলে জ্যোতিষীরা দাবী করেন। কিন্তু আজকের দিনে আমরা যখন পরিষ্কার বুঝতে পারি পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে চাঁদ এসে যাওয়ার ফলে গ্রহণ হচ্ছে, তাই নতুন জীবাণুর জন্ম, রশ্মির বেশি প্রভাব ইত্যাদি প্রশ্ন অবান্তর।
পূর্ণ সূর্যগ্রহণ একটি চমৎকার প্রাকৃতিক ঘটনা যা পর্যবেক্ষণের জন্য অনেক লোক দূর-দূরান্তেও ভ্রমণ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ৯ মার্চ ২০১৬ পূর্ণ সূর্যগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়। যা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের মাঝে এ ঘটনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
দর্শন
ফটোস্ফিয়ারটি যে তীব্র দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য রেডিয়েশনের দ্বারা নির্গত হয় তার জন্য সরাসরি সূর্যের আলোকক্ষেত্রটি (সূর্যের উজ্জ্বল ডিস্কটি) কেবল কয়েক সেকেন্ডের জন্যও চোখের রেটিনা স্থায়ীভাবে নষ্টের কারণ হতে পারে। এইভাবে চোখের ক্ষতির ফলে দৃষ্টি ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং অন্ধত্ব পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত হতে পারে৷ রেটিনার ব্যথার প্রতি কোন সংবেদনশীলতা নেই, এবং রেটিনাল ক্ষতির প্রভাব কয়েক ঘণ্টার জন্য দেখা নাও যেতে পারে, তাই এই আঘাতের ঘটনার এমন কোনও সতর্কতা নেই।[5][6]
সাধারণ পরিস্থিতিতে, সূর্য এত উজ্জ্বল যে সরাসরি এটি তাকানো কঠিন। যাইহোক, গ্রহণের সময় সূর্যের অনেক অংশ আবৃত থাকায় এটি তাকাতে আরও সহজ এবং লোভনীয় হয়। যে কোনও ধরনের অপটিক্যাল এইড (বাইনোকুলারস, একটি টেলিস্কোপ, এমনকি একটি অপটিক্যাল ক্যামেরা ভিউফাইন্ডার) এর মাধ্যমে সূর্যের চাকতি দেখা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে অপরিবর্তনীয় চোখের ক্ষতি করতে পারে। [7][8]
আংশিক এবং বার্ষিকী গ্রহণ
আংশিক এবং বার্ষিক গ্রহণের (সূর্য এবং সংক্ষিপ্ত সামগ্রিক সংক্ষিপ্ত সময়ের বাইরে মোট গ্রহণ) সময় সূর্য দেখার জন্য বিশেষ চোখের সুরক্ষা বা বিদেশী দেখার পদ্ধতি প্রয়োজন হয় যাতে চোখের ক্ষতি এড়ানো হয়। সূর্যের বিকিরণ ক্ষতিকারক অংশ বন্ধ করার জন্য সূর্যের চাকতি যথাযথ পরিস্রাবণ ব্যবহার করা যেতে পারে। সাধারণ চমশা দিয়ে এই দৃশ্য দেখা নিরাপদ নয়। শুধুমাত্র সঠিকভাবে ডিজাইন এবং প্রত্যয়িত সৌর ছাঁকনি (চশমা) সূর্যের চাকতির সরাসরি দেখার জন্য ব্যবহার করা উচিত। [9] বিশেষ করে, স্বতঃপূর্ণ ছাঁকনি যেমন একটি ফ্লপি চাকতি যেমন একটি মাপের ডিস্ক, একটি কম্প্যাক্ট ডিস্ক, একটি কালো রঙ স্লাইড ফিল্ম, ধূমপান গ্লাস ইত্যাদি ব্যবহার করে।[10][11]
তথ্যসূত্র
- Littmann, Mark (২০০৮)। Totality: Eclipses of the Sun। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 18-19। আইএসবিএন 0199532095। একের অধিক
|লেখক=
এবং|শেষাংশ=
উল্লেখ করা হয়েছে (সাহায্য) - গ্যালারি
- সারোস ইতিহাস পৃ:৯
- নাসার ওয়েব পৃষ্ঠা
- Espenak, Fred (জুলাই ১১, ২০০৫)। "Eye Safety During Solar Eclipses"। NASA Eclipse web site। NASA Goddard Space Flight Center। জুলাই ১৬, ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ১৫, ২০১২।
- Dobson, Roger (আগস্ট ২১, ১৯৯৯)। "UK hospitals assess eye damage after solar eclipse"। British Medical Journal। 319 (7208): 469। ডিওআই:10.1136/bmj.319.7208.469। পিএমআইডি 10454393। পিএমসি 1116382 ।
- MacRobert, Alan M.। "How to Watch a Partial Solar Eclipse Safely"। Sky & Telescope। আগস্ট ২৫, ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ৪, ২০০৭।
- Chou, B. Ralph (জুলাই ১১, ২০০৫)। "Eye safety during solar eclipses"। NASA Eclipse web site। NASA Goddard Space Flight Center। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ১৫, ২০১২।
- Littmann, Mark; Willcox, Ken; Espenak, Fred (১৯৯৯)। "Observing Solar Eclipses Safely"। MrEclipse.com। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ১৫, ২০১২।
- Chou, B. Ralph (জানুয়ারি ২০, ২০০৮)। "Eclipse Filters"। MrEclipse.com। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ৪, ২০১২।
- "Solar Viewing Safety"। Perkins Observatory। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ১৫, ২০১২।