সুপ্তপর্ব (রোগবিস্তার বিজ্ঞান)
রোগবিস্তার বিজ্ঞানের আলোচনায়, বিশেষত সংক্রামক রোগের সঞ্চারতত্ত্ব (প্রতিমান নির্মাণ) বিষয়ক আলোচনায় সুপ্তপর্ব (Latent period বা Latency period) বা প্রাক-সংক্রামক পর্ব (Pre-infectious period) বলতে কোনও ব্যক্তি বা পোষক একটি রোগ সংক্রামক জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত বা আক্রান্ত হবার মূহূর্ত থেকে সংক্রামক হবার (অর্থাৎ অন্য ঝুঁকিগ্রস্ত ব্যক্তিদেরকে রোগ সংক্রামক জীবাণু সংবহনে সমর্থ হবার) মুহূর্ত পর্যন্ত যে সময়ের ব্যবধান, সেই সময়ের ব্যবধানটিকে বোঝানো হয়।[1][2][3]
সংক্রামক রোগের সঞ্চারতত্ত্বের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ধারণার সাথে সম্পর্ক
একটি সংক্রামক রোগের বা মহামারীর ছড়িয়ে পড়া বা সঞ্চারিত হওয়ার কর্মপদ্ধতি বুঝতে হলে তিনটি সময়ের পর্বের ধারণার মধ্যকার পার্থক্য সাবধানতার সাথে অনুধাবন করা আবশ্যক। এগুলি হল উন্মেষ পর্ব, প্রাক-সংক্রামক বা সুপ্তপর্ব এবং সংক্রামক পর্ব।[2] আরও দুইটি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ের পর্ব-জাতীয় ধারণা হল প্রজন্মকাল ও ক্রমিক কাল-ব্যবধান।
যখন কোনও সম্ভাব্য রোগ সৃষ্টিকারী সংক্রামক জীবাণু সফলভাবে একটি পোষকদেহ আরেকটি পোষকদেহে সংবাহিত হয়, তখন নতুন পোষকদেহটিতে রোগের সংক্রমণ শুরু হয়েছে বলা হয়।[3] রোগ সংক্রামক জীবাণুগুলি নতুন পোষকের দেহের প্রবেশ করার পরে সেই দেহের অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়াকে সামলে নেওয়া বা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এবং পোষকের দেহের পছন্দনীয় অবস্থানে ভ্রমণ করে প্রজনন বা প্রতিলিপিকরণ শুরু করার জন্য কিছু সময় নেয়।[3] যখন রোগসংক্রামক জীবাণুগুলি যথেষ্ট পরিমাণে সংখ্যাবহুল ও বিষাক্ত হয়ে ওঠে ও পোষকের দেহে ক্ষতিসাধন করতে শুরু করে, তখন পোষকটি একটি রোগী হিসেবে গণ্য হবার মতো লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ করতে শুরু করে (অর্থাৎ পোষকটি লক্ষণ-উপসর্গবাহী রোগীতে পরিণত হয়)।[3] রোগ সংক্রামক জীবাণুর আক্রমণের মুহূর্ত থেকে পোষকের দেহের রোগের লক্ষণ-উপসর্গের সূত্রপাতের (প্রথম প্রকাশ) মুহূর্তের মধ্যে সময়ের যে ব্যবধান, সেই সময়ের ব্যবধানটিকে রোগের "উন্মেষ পর্ব" (Incubation period) বলে।[3] উন্মেষ পর্ব শেষ হবার পরে পোষকটি লক্ষণ-উপসর্গবাহী পর্বে (Symptomatic period) প্রবেশ করে। অধিকন্তু, রোগ সংক্রমণের কিছু সময় পরে পোষকটি রোগ সংক্রামক জীবাণুগুলিকে অন্য ঝুঁকিগ্রস্ত পোষকের দেহে ছড়িয়ে দেবার সামর্থ্য অর্জন করে, অর্থাৎ পোষকটি নিজেই সংক্রামক প্রাণীতে পরিণত হয়।[3] রোগের উপর নির্ভর করে পোষক ব্যক্তিটি উন্মেষ পর্বের সময় সংক্রামক প্রাণীতে পরিণত হতেও পারে বা না-ও হতে পারে।[3] উন্মেষ পর্বটি রোগ সংবহনের সঞ্চারতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, কেননা এটি সংক্রমণের মুহূর্তের সাপেক্ষে উপসর্গের ভিত্তিতে রোগ শনাক্ত করার মুহূর্তটি নির্ণয় করে,[1] যা সংক্রামক রোগের উপসর্গভিত্তিক নজরদারির উপর ভিত্তি করে গৃহীত রোগ নিয়ন্ত্রণকারী ব্যবস্থাগুলির কার্যকারিতা বা সফলতার মূল্যায়নে সহায়ক হতে পারে।[1]
সংক্রমিত হবার মুহূর্ত থেকে সংক্রামকে পরিণত হবার মুহূর্ত পর্যন্ত সময়কালকে প্রাক-সংক্রামক পর্ব বা সুপ্তপর্ব বলে। সুপ্তপর্বের সময় একজন পোষক লক্ষণ-উপসর্গ প্রদর্শন বা অনুভব করতেও পারে বা না-ও করতে পারে (অর্থাৎ উন্মেষপর্বটি শেষ হতেও পারে বা না-ও হতে পারে), কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই পোষক অন্য পোষকদেরকে সংক্রমিত করতে তথা অন্য পোষকের দেহে রোগ সংক্রামক জীবাণু সংবহন করতে সমর্থ হয় না। তাই উন্মেষ পর্ব নয়, বরং সুপ্তপর্বই কোনও সংক্রামক রোগ বা মহামারীর সঞ্চারণতত্ত্বে অধিকতর প্রভাব বিস্তার করে।[1]
যে পর্বে বা সময়কালে পোষকটি সংক্রামক থাকে, অর্থাৎ যে পর্বে রোগ সংক্রামক জীবাণুগুলি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সংক্রমিত পোষক থেকে অন্য কোনও ব্যক্তিতে সংবাহিত হতে পারে, সেই পর্বটিকে সংক্রামক পর্ব (infectious period বা period of communicability) বলে। প্রাক-সংক্রামক পর্ব বা সুপ্তপর্বের সমাপ্তি থেকে যে মুহূর্তের পর পোষক আর অন্য কোনও ব্যক্তির দেহে রোগ ছড়াতে পারে না, এই দুই মুহূর্তের মধ্যবর্তী সময়কালটি দ্বারা সংক্রামক পর্বকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। সংক্রামক পর্বের সময় একটি পোষক লক্ষণ-উপসর্গ প্রদর্শন করতেও পারে বা না-ও করতে পারে, কিন্তু সেটি অন্য পোষকদের সংক্রামিত করার সামর্থ্য রাখে। সংক্রমিত পোষকের দেহ অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার কতটুকু ক্ষমতা রাখে, তার উপর সংক্রামক পর্বের স্থায়িত্বকাল তার উপর নির্ভর করে।[2]
কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রাক-সংক্রামক বা সুপ্তপর্বটি ও উন্মেষপর্বটি একই সময়ে ঘটে এবং প্রায় একই স্থায়িত্বকালের অধিকারী হয়। এই ক্ষেত্রে সংক্রমিত ব্যক্তিটি লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ করার কাছাকাছি সময়েই সংক্রামক পোষকে পরিণত হয়। আবার অন্য কিছু কিছু রোগের ক্ষেত্রে, যেমন জলবসন্ত বা সার্স (তীব্র প্রকট শ্বাসযন্ত্রীয় সংলক্ষণ) রোগের ক্ষেত্রে,[4] পোষক প্রাণীটি লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ার কিছু পরে সংক্রামক প্রাণীতে পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে সুপ্তপর্বটি উন্মেষ পর্ব অপেক্ষা দীর্ঘতর হয়। উপরোক্ত দুই ধরনের ক্ষেত্রে লক্ষণ-উপসর্গ নজরদারি করে কার্যকরভাবে সংক্রামক রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।[1] একটি সংশ্লিষ্ট ধারণা হল মোচন পর্ব (shedding period), যা হল কোনও পোষক বা রোগী তার লালা, থুথু, মূত্র, মল বা অন্যান্য দেহজ তরলের মাধ্যমে দেহ থেকে রোগ সংক্রামক জীবাণু নিষ্ক্রান্ত করে পরিবেশে ছড়াতে পারে।
এর বিপরীতে কিছু কিছু সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে পোষকটি সংক্রামকে পরিণত হবার কিছু পরে চিকিৎসাযোগ্য রোগের লক্ষণ-উপসর্গগুলি প্রকাশ পেয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রে, প্রাক-সংক্রামক বা সুপ্তপর্বটির স্থায়িত্বকাল উন্মেষ পর্ব অপেক্ষা হ্রস্বতর হয়, উন্মেষপর্ব শেষ হবার আগেই সংক্রামক পর্বটি শুরু হয়ে যায় এবং পোষকটি কোনও পর্যবেক্ষণযোগ্য লক্ষণ-উপসর্গ ছাড়াই অন্যদেরকে সংক্রমিত করতে পারে। এই প্রারম্ভিক ও মৃদু প্রকৃতির সংক্রমণ যার লক্ষণ-উপসর্গগুলি ডাক্তারি পরীক্ষায় শনাক্ত করা যায় না, তাকে অপ্রকাশ্য সংক্রমণ (subclinical infection) বলে।[5] সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটিকে রোগটির একজন লক্ষণ-উপসর্গহীন বাহক বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, এইচআইভি/এইডস (অর্জিত অনাক্রম্যতার অভাবজনক সংলক্ষণ) রোগের ক্ষেত্রে উন্মেষ পর্বটি সুপ্তপর্বের তুলনায় বহু বছর দীর্ঘ হতে পারে। একারণে এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত কোনও ব্যক্তি কোনও লক্ষণ-উপসর্গ প্রদর্শন করা ছাড়াই নিজের অজান্তে ঝুঁকিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দেহে বছরের পর বছর ধরে জীবাণুটি ছড়িয়ে দিতে পারেন। করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯ বা কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে সংক্রামক পর্বটি লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশের প্রায় ২ দিন আগে শুরু হয় এবং এই প্রাক-উপসর্গ পর্বে দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তিতে সংক্রমণগুলির ৪৪% সংঘটিত হয়ে থাকে।[4] এই ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক প্রাক-উপসর্গ (বা লক্ষণ-উপসর্গহীন) সংবহনের ক্ষেত্রগুলিতে লক্ষণ-উপসর্গের নজরদারির উপর নির্ভরশীল রোগ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলির (যেমন অন্তরণ, সংক্রামক বাহক অনুসন্ধান, উন্নত স্বাস্থ্যবিধি পালন, ইত্যাদি) কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কেননা লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশের আগেই তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যায় অন্য ব্যক্তিতে সংবহন ঘটে যেতে পারে। তাই সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপগুলি নকশা বা পরিকল্পনা করার আগে এই ব্যাপারটি গণনায় ধরতে হয়।[1][4]
আরও দেখুন
- উন্মেষপর্ব (Incubation period)
- সংক্রামক পর্ব (Infectious period)
- ভাইরাস মোচন (Viral shedding)
- প্রজন্মকাল (Generation time)
- ক্রমিক কাল-ব্যবধান (Serial interval)
- মৌলিক জনন সংখ্যা (Basic reproduction number)
- লক্ষণ-উপসর্গহীন বাহক (Asymptomatic carrier)
তথ্যসূত্র
- Kenrad E. Nelson; Carolyn Masters Williams, সম্পাদকগণ (২০১৪), Infectious disease epidemiology: Theory and Practice (3rd সংস্করণ), Jones & Bartlett Learning, পৃষ্ঠা 135-136
- Emilia Vynnycky; Richard G. White (২০১০), An Introduction to Infectious Disease Modelling, Oxford University Press, পৃষ্ঠা 2-3
- Michael Y. Li (২০১৮), An Introduction to Mathematical Modeling of Infectious Diseases, Springer International Publishing AG, পৃষ্ঠা 25
- He X, Lau EHY, Wu P, Deng X, Wang J, Hao X; ও অন্যান্য (২০২০)। "Temporal dynamics in viral shedding and transmissibility of COVID-19."। Nat Med। 26 (5): 672–675। ডিওআই:10.1038/s41591-020-0869-5 । পিএমআইডি 32296168
|pmid=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। - HIV/AIDS Glossary, National Library of Medicine, National Institutes of Health, U.S. Department of Health and Human Services, ৭ আগস্ট ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ৭ আগস্ট ২০২১