সর্বনাম
সর্বনাম অর্থ সর্বের নাম (ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস)। সাধারণ অর্থ সবার নাম বা সবার সংজ্ঞা। প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণে এটি একটি পদ হিসাবে স্বীকৃত । যা একটি অনুচ্ছেদে বিশেষ্য পদের পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য বিকল্প শব্দ হিসাবে ব্যবহার করা হয় [lower-alpha 1]। যেমনঃ
- সর্বনামহীন প্রাথমিক রূপ : আফতাব ভালো ছেলে। আফতাব লেখাপড়া করে।
- সর্বনামযুক্ত রূপ : আফতাব ভালো ছেলে। সে লেখাপড়া করে।
সংজ্ঞা
বাংলা ব্যাকরণ মতেঃ– বিশেষ্য পদের পরিবর্তে যে পদ ব্যবহৃত হয় তাকে সর্বনাম পদ বলে।[1][2]
আদিতে বাংলা ব্যাকরণের সর্বনাম পদের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছিলঃ– সংস্কৃত তথা পাণিনির ব্যাকরণ অনুসারে[lower-alpha 2]। কিন্তু পাণিনির নির্ধারিত সংজ্ঞা ও তার উদাহরণ সংস্কৃত ভাষার জন্য উপযুক্ত হলেও বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তা সর্বার্থে ব্যবহার করা যায় না।
বাংলা সর্বনামগুলির সঙ্গে ইংরাজি সর্বনামগুলির কিছুটা সাদৃশ্য আছে । এখানে প্রথম পুরুষ, দ্বিতীয় পুরুষ এবং তৃতীয় পুরুষের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা শব্দ ব্যবহার হয়। এই রীতি একবচন ও বহুবচন, এই দুইয়ের ক্ষেত্রেও শব্দগুলির ইংরাজি প্রতিরূপগুলির মত লিঙ্গভেদে পার্থক্য হয় না। অর্থাৎ, সে(পুং) বা সে(স্ত্রী) এই দুই ক্ষেত্রে একই সর্বনাম ব্যবহার হয়, কিন্তু নৈকট্যর জন্য, তৃতীয় পুরুষের ব্যবহার বিভিন্ন হয় ।
সর্বনামের শ্রেণীবিভাজন
সর্বনাম বাক্যের ভিতরে বিভিন্ন নির্দেশনার সূত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মূলতঃ বাক্যের ভিতর সর্বনামগুলোর প্রকৃতি কিরূপ হবে, তার উপর ভিত্তি করে সর্বনামকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।[4] যেমনঃ
ব্যক্তিবাচক বা পুরুষবাচক সর্বনাম ( Personal Pronoun )
যে সকল সর্বনাম ব্যক্তিবিশেষের বা ব্যক্তিসমূহকে নির্দেশ করে বা এদের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়, তাদেরকে ব্যক্তিবাচক সর্বনাম বলা হয়। এরই অপর নাম পুরুষবাচক সর্বনাম। এটি তিনটি ধারায় বিন্যস্তঃ
- মানুষ্যবাচক(সংজ্ঞাবাচক) : নাহিদ ভালো ছেলে। নাহিদের অনেক বন্ধু আছে। নাহিদ ভালো ছেলে। তার (বা এর) অনেক বন্ধু আছে।
- প্রাণীবাচক : গরু চতুষ্পদী প্রাণী। গরুর একটি লেজ আছে। গরু চতুষ্পদী প্রাণী। এর একটি লেজ আছে।
- বস্তুবাচক : বইটি দেখ। বইটির মলাটের রঙ লাল। বইটি দেখ। এর মলাটের রঙ লাল।
আত্মবাচক সর্বনাম (Reflexive Pronoun )
যে সকল সর্বনামের কর্তা নিজেই কর্মের অধীনে চলে যায় তাকে আত্মবাচক সর্বনাম বুঝায়। ব্যক্তিবাচক সর্বনামের ক্ষেত্রে আমরা দেখি কর্তা কাজ করে বা করায়, কিন্তু নিজেকে সুদৃঢ়ভাবে কর্মের ভিতর বিলীন করে দেয় না। আত্মবাচক সর্বনাম সুদৃঢ়ভাবকে প্রকাশ করে [lower-alpha 3]। যেমনঃ আমি নিজেই অফিস করি।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্তা নিজেই ক্রিয়ার অংশ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে আত্মবাচক সর্বনাম অনিবার্যভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে। যেমন- কাজটি আপনিই শেষ হয়ে গেল এক্ষেত্রে কাজটির আত্মবাচক সর্বনাম হলো আপনিই এবং তা সম্পন্ন হয় নিজে নিজেই। এই কারণে এই জাতীয় সর্বনাম হবে আত্মবাচক (স্ব-সিদ্ধ)।
সামীপ্যবাচক (Near Demonstrative Pronoun)
সামীপ্য-নির্দেশবাচক প্রচ্ছন্ন নির্দেশ বহন করে এবং নৈকট্য প্রকাশ করে। যেমনঃ ওই দেখা যায় তাল গাছ এখানে উত্তর, দক্ষিণ ইত্যাদি সুইনির্দিষ্ট কোন বিশেষ্যের পরিবর্তে বসেছে এবং দূরত্ব ও দিকের বিচারে নৈকট্য প্রকাশ করে [lower-alpha 4][4]। সামীপ্য-নির্দেশবাচক সর্বনামের বিভিন্নতা নিম্মরূপঃ
- প্রত্যক্ষ : অই বিষয় আমি স্বয়ং শুনেছি।
- পরোক্ষ : অই বিষয় আমি লোকমুখে শুনেছি।
- নিকটস্থ : ধেনু চরায়ে অই কাননে অদূর।
- দূরস্থিত : অই দেখা যায় তাল গাছ
- নির্দেশক (বিষয়): অই দুঃখে আমার দিন রাত যায়।
- (ব্যক্তি) : অই কি জানে স্ত্রীকলা। কবিকঙ্কন - চণ্ডী।
- বুদ্ধিস্থ : অই মম তপ, অই মম জপ। (স্বপ্নপ্রয়াণ/দ্বিজ্রেনাথ ঠাকুর)
- দশাস্থ : ওই দুঃখে আমার জনম গেল। ওই অবস্থা থেকে আমার মুক্তি নেই। [5]
সাকুল্যবাচক সর্বনাম (Inclusive Pronoun)
যে সকল সর্বনাম দ্বারা সমষ্টিগত ভাব প্রকাশ পায়, তাকেই সাকল্যবাচক সর্বনাম বলা হয়। যেমন- আদ্যোপান্ত, সকল, সব, সবাই, সমুদয়, তাবত্। যেমনঃ আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায় [lower-alpha 5][5]
প্রশ্নবাচক সর্বনাম (Interrogative Pronoun)
যে সকল সর্বনাম দ্বারা বক্তার প্রশ্ন প্রকাশ পায় বা নির্দেশিত হয়, তাদেরকে প্রশ্নবাচক সর্বনাম বলা হয়। এই শ্রেনীবিন্যাসের মাঝের সর্বনামগুলো- কে, কি, কী, কোন, কাহার, কার, কাহাদের, কাদের, কিসে, কে কে, কি কি, কোন কোন, কার কার। প্রশ্নের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে এই সর্বনামগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলোঃ
- সাধারণ প্রশ্নবাচকঃ কোন বিষয়ে খোঁজ খবর করার জন্য ব্যবহৃত সাধারণ প্রশ্নবাচক সর্বনাম। যেমনঃ কে, কি, কি হেতু, কি কারণে ইত্যাদি।
- প্রশ্ন-বিস্ময়সূচকঃ প্রশ্নবাচক সর্বনাম শুধুমাত্র প্রশ্নকেই প্রকাশ করে সীমাবদ্ধ থাকে না, একইসাথে বিস্ময় প্রকাশ ও করে থাকে এই সর্বনামের ব্যবহার রয়েছে। যেমনঃ কী কথা বলিস তুই, আমি যে তোর ভাষা বুঝি নে (চণ্ডালিকা। রবী্ন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
- অনিশ্চয়তাবাচকঃ যে সকল প্রশ্নবাচক সর্বনাম দ্বারা প্রশ্নকর্তার অনিশ্চিয়তা প্রকাশ পায়, তাকে অনিশ্চয়তাবাচক বলা হয়। যেমনঃ কেউ-কি আমার কথা শুনছো?
- ব্যতিহারঃ একই শব্দ দুই বার উল্লেখ করে প্রকাশ করার পদ্ধতিগত নাম হলো ব্যতিহার। প্রশ্নবাচক সর্বনামে এই জাতীয় শব্দ পাওয়া যায়। যেমনঃ কে কে, কোন কোন। [6]
অনির্দিষ্টতাজ্ঞাপক সর্বনাম (Indefinite Pronoun)
যে সকল সর্বনামের দ্বারা কোন সুনির্দিষ্ট দিকের পরিবর্তে অনির্দিষ্ট দিককে নিদের্শিত করে, তাদেরকে অনির্দিষ্টতাজ্ঞাপক সর্বনাম বলে। যেমনঃ কে, কার, কিছু, কেউ, কেহ, কোন। উদাহরণঃ কে আসবে না আসবে, আমি তার কিছু জানি না [lower-alpha 6]। [7]
সাপেক্ষ সর্বনাম (Relative Pronoun)
যে সকল সর্বনাম দ্বারা একটি বাক্যের সাপেক্ষে অন্য বাক্যকে যুক্ত করা হয়, তাদেরকে সাপেক্ষ সর্বনাম বলা হয়। এই সর্বনাম মূলত বাক্যাংশকে যুক্ত করে ফলে এর বৈশিষ্ট্য দাঁড়ায় অনেকটা সংযোজক অব্যয়ের মতো। যেমনঃ এই সেই লোক, যে গতকাল এখানে এসেছিল।[7]
অন্যাদিবাচক সর্বনাম (Denoting other or others)
যে সকল সর্বনাম দ্বারা অন্য, অপর, ভিন্ন, অসদৃশ্য, অন্যপ্রকার, অধিক ইত্যাদি নির্দেশিত হয়, সে সকল সর্বনামকে অন্যাদিবাচক সর্বনাম বলা হয়। যেমন: অন্য, অপর, ভিন্ন।
- অন্য (ভিন্নতর) : এ কথা রেখে অন্য কথা বল।
- অন্যপ্রকার : এটা আগেটার মতো নয়, অন্য রকম।
- অধিক, আরও : এছাড়াও অন্য কথা আছে।[7]
অনিশ্চয়বাচক যৌগিক সর্বনাম ( Indefinite Compound Pronoun)
যখন একাধিক শব্দ একত্রিত হয়ে একটি সর্বনাম তৈরি করে, তখন তাকে যৌগিক সর্বনাম বলে। যেমন- অন্য-কিছু, অন্য-কেউ, আর-কিছু, আর-কেউ, কেউ-না-কেউ, কেউ-বা, যা-কিছু, যা-তা, যে-কেউ, যে-কোন, যে-সে।[7]
টীকা
- সর্বনাম শুধু শব্দের পরিবর্তে বসে না, কোন বিশেষ্য বাচক বাক্য বা বাক্যাংশের পরিবর্তেও বসে। যেমন- গতদিনে তুমি যা বলেছিলে, তা সব ভুলে গেছি। এখানে 'তা' সর্বনামটি ‘গত দিনে তুমি যা বলেছিলে’ -এর পরিবর্তে বসেছে।
- পাণিনির মতেঃ সর্বনাম হলো সব কিছুর নাম বা সংজ্ঞা। এই সংজ্ঞা দ্বারা সর্বনামের প্রকৃত অর্থ পাওয়া যায়। সর্বনামের সার্বিক প্রকৃতি বুঝতে হলে পাণিনিকৃত সর্বনামের প্রকরণগুলো ভালভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন। পাণিনি সর্বনামগুলোকে ৫টি ভাগে ভাগ করেছেন। যেগুলো হলো– সব্বাদি, অন্যাদি, পূব্বাদি, যদাদি ও ইদিমাদি। এই ভাগগুলোরও রয়েছে একাধিক উপবিভাগ। এই সকল ভাগ ও উপভাগের বিচারে সর্বনামের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে মোট ৪১টি। এর ভিতরে প্রাথমিক বিচারে সর্বনাম সংখ্যা ৩৩টি। এগুলো হলো- সব্ব, বিশ্ব, উভ, উভয়, অন্য, অন্যতর, ইতর, ত্বত্, ত্ব, নেম, সম, সিম, পূব্ব, পর, অবর, দক্ষিণ, উত্তর, অপর, অধর, স্ব, অন্তর, ত্যদ্ তদ্, যদ্, এতদ্, ইদম, অদস্, এক, দ্বি, যুষ্মদ, অষ্মদ, ভবত্ ও ও কিম্। এছাড়া কিম্, যদ্, তদ্ ও এক শব্দের পরে ডতর ও ডতম প্রত্যয় করলে মোট আটটি পদ পাওয়া যায়। এই পদগুলো হলো- কতর, কতম, যতর, যতম, ততর, ততম, একতর, একতম।[3]
- কোনো ব্যক্তি যদি বলেন- আমি অফিস করি। এখানে আমি ব্যক্তিবাচক সর্বনাম। এখানে আমরা বুঝি যে কর্তার অফিসের কাজ অন্য কেউ করে না বা কর্তা অফিসের কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করায় না। কিন্তু এই বাক্যটি যদি কেউ বলেন- আমি নিজেই অফিস করি। এক্ষত্রে নিজেই শব্দের দ্বারা কর্তা প্রত্যক্ষভাবে কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয় এবং ওই ভাবকে সুদৃঢ়ভাবে প্রকাশ করে।
- নিকটস্থ, দূরস্থিত সর্বনামগুলো দিকের বিচারে সুনির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট হতে পারে। সুনির্দিষ্ট বলতে বক্তা জানেন এমন দিক বুঝায়। যেমন- ধেনু চরায়ে অই কাননে অদূর এখানে বক্তা জানেন কানন কোন দিকে। কিন্তু ওই কুহরিল পিক ললিত উচ্ছ্বাসে (হেমচন্দ্র)- বাক্যে জানা যায় না যে, কোকিল ঠিক কোন দিকে কুহরিল।
- ব্যাখ্যাঃ আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়
- এখানে সকল বলতে বুঝানো হয়েছে সাকল্য। সমষ্টিগত পরিচয় যায়, এমন বিশেষ্যের পরিবর্তে এই সর্বনাম ব্যবহৃত হয়।
- এই সর্বনাম কোন না কোন ব্যক্তিবাচ্য সর্বনামকে অনুসরণ করে, এক্ষেত্রে ব্যক্তিবাচ্য উহ্য রয়েছে (কোনো কোনো সময় উহ্য থাকতেও পারে)। যেমন- আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।
- কিন্তু বিষয়টি যখন একাধিক ভাব প্রকাশ করে, তখন একই সর্বনাম দুইবার ব্যবহার করা হয়। যেমন-কেকে, কার কার, কিছু কিছু, কেউ কেউ। সেক্ষেত্রে কে কে আসবে না আসবে, আমি তার কিছু জানি না বাক্যটি একাধিক ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বলা যায়, এবং এই কে কে বহুবচন নয় ব্যতিহারিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
তথ্যসূত্র
- "পদ-প্রকরণ"। এডুকেশন পিডিয়া অফ বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
- "বাংলা-২য়পত্র"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
- ব্যাকরণ কৌমুদী/ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ডিসেম্বর ২০০৩
- "সর্বনাম পদ"। অনুশীলন ডট অর্গানাইজেশন। সংগ্রহের তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
- "সামীপ্য-নির্দেশবাচক ও সাকল্যবাচক"। অনুশীলন ডট অর্গানাইজেশন। সংগ্রহের তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
- "প্রশ্নবাচক সর্বনাম"। অনুশীলন ডট অর্গানাইজেশন। সংগ্রহের তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
- "সর্বনামের শ্রেণীবিন্যাস"। অনুশীলন ডট অর্গানাইজেশন। সংগ্রহের তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭।