সরস্বতী পূজা

সরস্বতী পূজা হিন্দু বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় একটি অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা আয়োজিত হয়। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, নেপালবাংলাদেশে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। শ্রীপঞ্চমীর দিন অতি প্রত্যুষে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের গৃহ ও সার্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃতর্পণের প্রথাও প্রচলিত। পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সার্বজনীন পূজামণ্ডপগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়। পূজার পরের দিনটি শীতলাষষ্ঠী নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে কোনো কোনো হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পূজার পরদিন অরন্ধন পালনের প্রথা রয়েছে।

সরস্বতী পূজা
মা সরস্বতী
আনুষ্ঠানিক নামবসন্ত পঞ্চমী[1]
অন্য নামবসন্ত পঞ্চমী, সারস্বত উৎসব
পালনকারীভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, জাভা এবং বালি (ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য অনেক দেশে) হিন্দু, শিখ এবং জৈনরা[2]
ধরনসাংস্কৃতিক
তাৎপর্যবসন্ত, বিদ্যার দেবী,দেবী সরস্বতী[2]
উদযাপনদেবী সরস্বতীর পূজা[2][3]
তারিখ মাস (আমান্ত) / মাস (পূর্ণিমান্ত), পক্ষ, তিথি
বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে সরস্বতী বিসর্জন

ইতিহাস

সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজা বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীন কালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়।[4] ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াতকলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন। বর্ধমান মহারাজার পূজায় বিশেষ সমারোহের আয়োজন করা হয়। দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এই পূজার বিসর্জন দেখতে আসত। পূজা উপলক্ষে দুই ঘণ্টা আতসবাজিও পোড়ানো হত। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।[5]

পূজা

শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা যায়। সরস্বতীর পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যথা: অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ। পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাঁচার অনুসারে, ছাত্রছাত্রীরা পূজার পূর্বে কুল ভক্ষণ করেন না। পূজার দিন কিছু লেখাও নিষিদ্ধ। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম), পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। এই দিন ছোটোদের হাতেখড়ি দিয়ে পাঠ্যজীবন শুরু হয়।পূজান্তে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের দল বেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়।

পূজার পরদিন পুনরায় পূজার পর চিড়ে ও দই মিশ্রিত করে দধিকরম্ব বা দধিকর্মা নিবেদন করা হয়। এরপর পূজা সমাপ্ত হয়। সন্ধ্যায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।

উৎসবের গুরুত্ব

বসন্তের আগমনে ফুটে ওঠে প্রকৃতির প্রতিটি কণা। এমনকি পশু-পাখিরাও আনন্দে ভরে ওঠে। প্রতিদিন নতুন উদ্যমে সূর্যোদয় হয় এবং নতুন চেতনা দিয়ে পরের দিন আবার আসার আশ্বাস দিয়ে চলে যায়। [6]

যদিও এই পুরো মাঘ মাস উত্সাহজনক, কিন্তু বসন্ত পঞ্চমী (মাঘ শুক্লা পঞ্চমী) এর উত্সব ভারতীয়দের কাছে নানাভাবে প্রভাবিত করে। প্রাচীনকাল থেকে, এটি জ্ঞান ও শিল্পের দেবী সরস্বতীর জন্মদিন হিসাবে বিবেচিত হয়। যে শিক্ষাবিদরা ভারত এবং ভারতীয়তাকে ভালবাসেন তারা এই দিনে মা সারদেকে পূজা করেন এবং আরও জ্ঞানী হওয়ার জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করেন। শিল্পীদের কী হবে? সৈন্যদের অস্ত্র এবং বিজয়াদশমীর জন্য যে গুরুত্ব রয়েছে, পণ্ডিতদের তাদের বই এবং ব্যাস পূর্ণিমা, তাদের দাঁড়িপাল্লা, ওজন, বই এবং দীপাবলির ব্যবসায়ীদের জন্য, বসন্ত পঞ্চমীর মতো শিল্পীদের জন্যও একই গুরুত্ব রয়েছে। কবি হোক বা লেখক, গায়ক হোক বা যন্ত্রশিল্পী, নাট্যকার বা নৃত্যশিল্পী, প্রত্যেকেই তাদের যন্ত্রের আরাধনা এবং মা সরস্বতীর পূজা দিয়ে দিন শুরু করেন।

পাকিস্তান

লাহোরে ঘুড়ি ওড়ানো যা শতাব্দীর প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এটি একটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক খেলায় বিকশিত হয় যা কেবল বসন্ত মৌসুমে এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রয়েছে আঞ্চলিক দল, প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার। ঘুড়ি তৈরি করার মধ্য পাঞ্জাব জুড়ে একটি শিল্প যা হাজার হাজার মানুষের জীবিকা নির্বাহ করে।

ভারতীয় উপমহাদেশে ভাগ করা ইতিহাস এবং সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে, লাহোর এবং এর আশেপাশের পাঞ্জাবি মুসলমানরাও বসন্ত মৌসুমে বাড়ির ছাদে পাকিস্তানে একটি খেলা হিসেবে উদযাপন করে।[7]

দরগায় বসন্ত উদযাপন

সুফি মুসলিম বসন্ত

লোচন সিং বক্সির মতে, বসন্ত পঞ্চমী হল একটি হিন্দু উৎসব যা ১২শ শতাব্দীতে কিছু ভারতীয় মুসলিম সুফিদের দ্বারা গৃহীত হয়েছিল, যা দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মুসলিম সুফি সন্ত দরগাহের কবরকে চিহ্নিত করে এবং তখন থেকেই চিশতী আদেশে পালন করা হয়ে আসছে। স্থানীয় সুফি ঐতিহ্য অনুসারে, কবি আমীর খসরু হিন্দু মহিলাদের বসন্তের একটি মন্দিরে হলুদ ফুল বহন করতে দেখেছিলেন এবং তারা হলুদ পোশাক পরেছিলেন এবং তিনি এই অনুশীলনটি গ্রহণ করেছিলেন, সুফি ভারতীয় মুসলমানদের চিশতী ক্রমের একটি অনুশীলন অব্যাহত রয়েছে।[8][9]

পাদটীকা

  1. "National Portal यफ India"
  2. যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, পূজা-পার্বণ, (পরিচ্ছেদ: "সরস্বতীর প্রতিমা"), বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা, ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৩৮
  3. যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, পূজা-পার্বণ, (অধ্যায়: "শ্রীশ্রীসরস্বতী-পূজা"), বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা, ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৩৩
  4. "Basant Panchami 2021: 16 फरवरी को है बसंत पंचमी, जानिए शुभ मुहूर्त, पूजा विधि, महत्‍व और मान्‍यताएं"NDTVIndia। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০২-১৪
  5. Lochan Singh Buxi (১৯৯৪)। Prominent Mystic Poets of Punjab: Representative Sufi Poetry in Punjabi, with English Rendering। পৃষ্ঠা 49–50। আইএসবিএন 978-81-230-0256-9।
  6. Paul E Losensky (২০১৩)। In the Bazaar of Love: The Selected Poetry of Amir Khusrau। Penguin Books। পৃষ্ঠা 27। আইএসবিএন 978-81-8475-522-0।
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.