সংবেদনশীলতা ও নির্দিষ্টতা
চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোনও রোগনির্ণায়ক পরীক্ষা বা বাছাই পরীক্ষার নির্ভরযোগ্যতা অনেকাংশে সেটির সংবেদনশীলতা ও নির্দিষ্টতার উপরে নির্ভর করে।
সংবেদনশীলতা
কোনও রোগনির্ণায়ক পরীক্ষা বা বাছাই পরীক্ষার সংবেদনশীলতা (ইংরেজি: Sensitivity) বলতে কোনও রোগে আক্রান্ত অনেকগুলি ব্যক্তিদের মধ্যে উক্ত পরীক্ষাটি শতকরা সর্বোচ্চ কতজন ব্যক্তিকে সঠিকভাবে রোগাক্রান্ত (সত্য ইতিবাচক ফলাফল) হিসেবে শনাক্ত করতে পারে, সেই নির্ভরযোগ্যতার পরিমাপকে বোঝায়। অর্থাৎ একটি পরীক্ষা সমস্ত ইতিবাচক ফলাফলের যে ভগ্নাংশটি শনাক্ত করতে পারে, সেটিকে শতকরা হারে প্রকাশ করলে পরীক্ষাটির সংবেদনশীলতা পাওয়া যায়। সংবেদনশীলতাকে সত্য ইতিবাচক ফলাফলের হারও বলা হয়।
যেমন যদি ১০০ জন ব্যক্তির মধ্যে ৯০ জন রোগে আক্রান্ত হয়, কিন্তু পরীক্ষার মাধ্যমে এদের মধ্যে ৮০ জনকে যদি সঠিকভাবে রোগাক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা যায়, তাহলে সমস্ত ইতিবাচক ফলাফল হল ৯০, সত্য ইতিবাচক ফলাফল হল ৮০ এবং পরীক্ষাটির সংবেদনশীলতা হল (৮০/৯০) = ৮৮.৮৮ %। অন্যদিকে (৯০-৮০) = ১০ জন ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে রোগাক্রান্ত হলেও তাদের জন্য ঐ পরীক্ষাতে মিথ্যা নেতিবাচক ফলাফল আসবে। সুতরাং এক্ষেত্রে (১০/৯০) = ১১.১১ % রোগাক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরীক্ষাটি মিথ্যা নেতিবাচক ফলাফল প্রদান করবে। যদি কোনও পরীক্ষার সংবেদনশীলতা কম হয়, তাহলে মিথ্যা নেতিবাচক ফলাফল অনেক বেশি হবে, অর্থাৎ রোগ থাকলেও অনেক ব্যক্তিকে রোগমুক্ত দেখাবে। পরীক্ষার সংবেদনশীলতা যত বেশি হবে, মিথ্যা নেতিবাচক ফলাফলের শতকরা হার তত কম হবে। তাই একটি পরীক্ষাকে নির্ভরযোগ্য হতে হলে এর সংবেদনশীলতা অনেক উচ্চ হতে হয়, অর্থাৎ মিথ্যা নেতিবাচক ফলাফল খুব কম হতে হয়।
একটি পরীক্ষার সংবেদনশীলতা কোনও ব্যক্তির দেহে রোগের উপস্থিতি বাতিল বা নাকচ করে দেওয়ার জন্য উপকারী একটি পরিমাপ। কেননা যদি কোনও পরীক্ষা ১০০% সংবেদনশীল হয় এবং যদি একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফলাফল নেতিবাচক হয়, তাহলে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে যে ব্যক্তিটির আলোচ্য রোগ নেই, কারণ ১০০% সংবেদনশীল পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোনও মিথ্যা নেতিবাচক ফলাফল হয় না। তবে ১০০% সংবেদনশীল পরীক্ষাও কম-বেশি মিথ্যা ইতিবাচক ফলাফল দিতে পারে, অর্থাৎ কোনও ব্যক্তি রোগাক্রান্ত না হলেও ইতিবাচক ফলাফল দিতে পারে।
নির্দিষ্টতা
কোনও রোগনির্ণয় পরীক্ষা বা বাছাই পরীক্ষার নির্দিষ্টতা (ইংরেজি: Specificity) বলতে কোনও রোগে আক্রান্ত নয়, এমন অনেকগুলি ব্যক্তির মধ্যে উক্ত পরীক্ষাটি শতকরা সর্বোচ্চ কতজন ব্যক্তিকে সঠিকভাবে রোগমুক্ত (সত্য নেতিবাচক ফলাফল) হিসেবে শনাক্ত করতে পারে, সেই নির্ভরযোগ্যতার পরিমাপকে বোঝায়। অর্থাৎ একটি পরীক্ষা সম্ভাব্য সমস্ত নেতিবাচক ফলাফলের যে ভগ্নাংশটি শনাক্ত করতে পারে, সেটিকে শতকরা হারে প্রকাশ করলে পরীক্ষাটির নির্দিষ্টতা পাওয়া যায়। নির্দিষ্টতাকে সত্য নেতিবাচক ফলাফলের হারও বলা হয়।
যেমন যদি ১০০ জন ব্যক্তির মধ্যে ১০ জন রোগে আক্রান্ত না হয়, কিন্তু পরীক্ষার মাধ্যমে এদের মধ্যে ৮ জনকে যদি সঠিকভাবে রোগমুক্ত হিসেবে শনাক্ত করা যায়, তাহলে সম্ভাব্য সমস্ত নেতিবাচক ফলাফল হল ১০, সত্য নেতিবাচক ফলাফল হল ৮, এবং পরীক্ষাটির নির্দিষ্টতা (৮/১০) = ৮০ % । অন্যদিকে (১০-৮) = ২ জন ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে রোগমুক্ত হলেও তাদের জন্য ঐ পরীক্ষাতে মিথ্যা ইতিবাচক ফলাফল আসবে। সুতরাং এক্ষেত্রে (২/১০) = ২০% রোগমুক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরীক্ষাটি মিথ্যা ইতিবাচক ফলাফল প্রদান করবে। যদি কোনও পরীক্ষার নির্দিষ্টতা কম হয়, তাহলে মিথ্যা ইতিবাচক ফলাফল অনেক বেশি হবে, অর্থাৎ রোগ না থাকলেও অনেক ব্যক্তিকে রোগাক্রান্ত দেখাবে। পরীক্ষার নির্দিষ্টতা যত বেশি হবে, মিথ্যা ইতিবাচক ফলাফলের শতকার হার তত কম হবে। একটি ভালো পরীক্ষার নির্দিষ্টতা তাই অনেক উচ্চ হতে হয়, অর্থাৎ মিথ্যা ইতিবাচক ফলাফল খুব কম হতে হয়।
একটি পরীক্ষার নির্দিষ্টতা কোনও ব্যক্তির দেহে রোগের উপস্থিতির ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্য উপকারী একটি পরিমাপ। কেননা যদি কোনও পরীক্ষা ১০০% নির্দিষ্ট হয় এবং যদি একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফলাফল ইতিবাচক হয়, তাহলে এটা সম্পূর্ণ নিশ্চিতভাবে বলা যাবে যে ব্যক্তিটি আলোচ্য রোগে আক্রান্ত, কারণ ১০০% নির্দিষ্ট পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোনও মিথ্যা ইতিবাচক ফলাফল হয় না। তবে ১০০% নির্দিষ্ট পরীক্ষা কম-বেশি মিথ্যা নেতিবাচক ফলাফল দিতে পারে, অর্থাৎ কোনও ব্যক্তি রোগাক্রান্ত হলেও নেতিবাচক ফলাফল দিতে পারে।
গাণিতিক প্রকাশ
ধরা যাক
- P = বাস্তবিকভাবে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা
- N = বাস্তবিকভাবে রোগমুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা
- TP = যেসব রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে পরীক্ষাতে সঠিকভাবে রোগাক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের সংখ্যা
- FP = যেসব রোগমুক্ত সুস্থ ব্যক্তিকে পরীক্ষাতে ভুল করে রোগাক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের সংখ্যা
- TN = যেসব রোগমুক্ত সুস্থ ব্যক্তিকে পরীক্ষাতে সঠিকভাবে রোগমুক্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের সংখ্যা
- FN = যেসব রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে পরীক্ষাতে ভুল করে সুস্থ ও রোগমুক্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের সংখ্যা
- TPR = সংবেদনশীলতা বা সত্য ইতিবাচক ফলাফলের হার
- TNR = নির্দিষ্টতা বা সত্য নেতিবাচক ফলাফলের হার
তাহলে
- সংবেদনশীলতা তথা
- নির্দিষ্টতা তথা
গুরুত্ব
একটি আদর্শ পরীক্ষা ১০০% সংবেদনশীল ও ১০০% নির্দিষ্ট। এই পরীক্ষাটি নির্ভুলভাবে সব রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল দেবে ও একটিও মিথ্যা নেতিবাচক ফলাফল দেবেনা, এবং একই সাথে নির্ভুলভাবে সব রোগমুক্ত ব্যক্তির জন্য নেতিবাচক ফলাফল দেবে ও একটিও মিথ্যা ইতিবাচক ফলাফল দেবে না। দুর্ভাগ্যবশত বাস্তব বিশ্বে এরকম কোনও পরীক্ষার অস্তিত্ব নেই।
উচ্চ সংবেদনশীলতাবিশিষ্ট পরীক্ষা রোগের উপস্থিতি নাকচ করতে এবং উচ্চ নির্দিষ্টতাবিশিষ্ট পরীক্ষা রোগের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে উপকারী।