শ্রীকৃষ্ণবিজয়

শ্রীকৃষ্ণবিজয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে মালাধর বসু রচিত একটি বাংলা কাব্য। বাংলা সাহিত্যে প্রথম সাল তারিখযুক্ত গ্রন্থ এটি। হিন্দুদের অষ্টাদশ মহাপুরাণের অন্যতম ভাগবত পুরাণ অবলম্বনে রচিত হয়েছে এটি। এর অপর নাম গোবিন্দমঙ্গল কাব্য। এই কাব্যে কৃষ্ণের ঐশ্বর্যলীলা গুরুত্ব পেয়েছে।

মালাধর বসুর আগে কেউই সংস্কৃত থেকে বাংলা বা অন্য কোনো আঞ্চলিক ভাষায় ভাগবত অনুবাদ করেননি। সেই অর্থে, মালাধর বসুই ভাগবত অনুবাদ-ধারার প্রবর্তক।[1] তিনি মধ্যযুগের বাংলা ভাষায় প্রচলিত পাঁচালীর ঢঙে শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য রচনা করেন।[2] কৃত্তিবাস ওঝার শ্রীরাম পাঁচালীর মতো তার শ্রীকৃষ্ণবিজয়েও বাঙালিয়ানা ও বাঙালি সমাজের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।[3]

নামকরণ

শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের নামকরণের তাৎপর্য নিয়ে দুটি মত প্রচলিত। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতটি হল, কাব্যনামে "বিজয়" শব্দটি যুক্ত হয়েছে গৌরব বা মাহাত্ম্য বর্ণন অর্থে। কারণ, গ্রন্থের উদ্দেশ্য শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্যলীলা ও গৌরবকথা বর্ণনা। অন্যমতে, "বিজয়" কথাটি মৃত্যু বা মহাপ্রয়াণ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ, গ্রন্থ সমাপ্ত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগের কথা বর্ণনায়।[2]

শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের অপর নাম গোবিন্দবিজয় বা গোবিন্দমঙ্গল।[2] অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, মঙ্গলকাব্যে যেমন দেবতার গৌরবপ্রচারের প্রতীকশব্দ রূপে "মঙ্গল" শব্দটি ব্যবহৃত হত, তেমনি মালাধর বসু একই অর্থে এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন।[2]

কাহিনি-উৎস

ভাগবত পুরাণ সংস্কৃত ভাষায় রচিত আঠারোটি মহাপুরাণ ও ছত্রিশটি উপপুরাণের অন্যতম। সকল পুরাণের মধ্যে ভাগবত পুরাণই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এই পুরাণ বারোটি স্কন্দ বা খণ্ডে বিভক্ত। মালাধর বসু ভাগবত পুরাণের দশম ও একাদশ স্কন্দের ভাবানুবাদ করেছেন তার শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যে।[4] দশম স্কন্দে শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা থেকে দ্বারকালীলা পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে। এই দশম স্কন্দ পুরোপুরি অনুবাদ করেছেন মালাধর। একাদশ স্কন্দে শ্রীকৃষ্ণের কাহিনির যে সামান্য অংশ রয়েছে মালাধর তাই গ্রহণ করেছেন। তবে এই অংশে যে বিস্তারিত তত্ত্বকথা বর্ণিত আছে, তার অল্পই নিয়েছেন তিনি। যেটুকু নিয়েছেন, সেটুকুও কাহিনির প্রয়োজনে। ভাগবত ছাড়াও বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশ থেকে বৃন্দাবনলীলা, রাসলীলা, নৌকালীলা ও দানলীলার গল্প এবং চতুর্দশ শতাব্দীর আগে থেকে বাংলায় প্রচলিত রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক লোককথা থেকেও উপাদান সংগ্রহ করেছেন।[4]

তার কাব্যের ভূমিকায় রয়েছে:

ভাগবত-অর্থ যত পয়ারে বান্ধিয়া
লোক নিস্তারিতে যাই পাঁচালী রচিয়া।
ভাগবত শুনিতে অনেক অর্থ চাহি
তে-কারণে ভাগবত গীতছন্দে গাহি।
কলিকালে পাপচিত্ত হব সব নর
পাঁচালীর রসে লোক হইব বিস্তার।
গাহিতে গাাহিতে লোক পাইব নিস্তার
শুনিয়া নিষ্পাপ হব সকল সংসার।

রচনাকাল

বাংলা সাহিত্যে শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যেই প্রথম স্পষ্ট তারিখের উল্লেখ পাওয়া যায়। কেদারনাথ দত্ত সম্পাদিত এই কাব্যের প্রামাণ্য সংস্করণে কালজ্ঞাপক দুটি ছত্র পাওয়া যায়।[4]

অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনার কাজ শুরু হয় ১৩৯৫ শকাব্দে (১৪৭৩ খ্রিষ্টাব্দে) এবং শেষ হয় ১৪০২ শকাব্দে (১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে)।

কাহিনি-বিন্যাস

শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের কাহিনি-বিন্যাসের ক্ষেত্রে মালাধর বসু ভাগবত পুরাণকে অনুসরণ করেননি। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের কাহিনি তিনটি পর্বে বিন্যস্ত। যথা: আদ্যকাহিনি বা কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা, মধ্যকাহিনি বা কৃষ্ণের মথুরালীলা ও অন্ত্যকাহিনি বা কৃষ্ণের দ্বারকালীলা।[4]

আদ্যকাহিনি

আদ্যকাহিনির অন্তর্গত ঘটনাগুলি হল কৃষ্ণের জনক-জননী বসুদেব ও দেবকীর বিবাহ, দেবকীর অষ্টম গর্ভে বিষ্ণুর অবতার রূপে কৃষ্ণের জন্মগ্রহণ, নন্দালয়ে যশোদা-কর্তৃক কৃষ্ণের লালনপালনের বৃত্তান্ত, বৃন্দাবনে কৃষ্ণের নানা অলৌকিক লীলা প্রদর্শন এবং কংস বধের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণ ও বলরামের মথুরায় গমন।[4]

মধ্যকাহিনি

মধ্যকাহিনির অন্তর্গত ঘটনাগুলি হল কৃষ্ণ ও বলরামের মথুরায় আগমন, কংসবধ, কংসের পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনে স্থাপন, উগ্রসেনের নির্দেশে মথুরার শাসনভার গ্রহণ ইত্যাদি।[4]

অন্ত্যকাহিনি

অন্ত্যকাহিনিতে আছে দ্বারকায় কৃষ্ণের রাজধানী স্থাপন, কালযবন বধ, শিশুপাল বধ, কৃষ্ণ ও রুক্মিণীর বিবাহ, কৃষ্ণ ও জাম্বুবতীর বিবাহ, কৃষ্ণ ও সত্যভামার বিবাহ, পারিজাত পুষ্প লাভের জন্য ইন্দ্রের সঙ্গে বিরোধ, জরাসন্ধ বধ, সুভদ্রা হরণ, ঋষিদের অভিশাপ, কৃষ্ণের সাধনতত্ত্ব ব্যাখ্যা, দ্বারকাপুরী ধ্বংস, যদুবংশ ধ্বংস, কৃষ্ণের দেহত্যাগ প্রভৃতি ঘটনা।[2]

তথ্যসূত্র

  1. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, কালীপদ চৌধুরী, বাণী সংসদ, পৃ. ৫৫
  2. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, কালীপদ চৌধুরী, বাণী সংসদ, পৃ. ৫৭
  3. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, কালীপদ চৌধুরী, বাণী সংসদ, পৃ. ৫৭-৫৮
  4. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, কালীপদ চৌধুরী, বাণী সংসদ, পৃ. ৫৬
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.