লোকনাথ ব্রহ্মচারী
লোকনাথ ব্রহ্মচারী (জন্ম: ১৭৩০[6] - মৃত্যু: ১৮৯০[7]) ছিলেন একজন হিন্দু সিদ্ধপুরুষ। তিনি বাবা লোকনাথ নামেও পরিচিত। হিন্দুধর্মানুশারীদের নিকট লোকনাথ ব্রহ্মচারী অত্যন্ত পূজনীয় ব্যাক্তিত্ব। তিনি দেহত্যাগের পূর্বপর্যন্ত বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বারদী আশ্রমে অবস্থান করেছিলেন। বাবা লোকেনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার বারদীতে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু তীর্থভূমি। বিশেষত বাঙালি হিন্দুর কাছে এটি একটি জনপ্রিয় তীর্থস্থান।[8][3]
লোকনাথ ব্রহ্মচারী | |
---|---|
![]() | |
জন্ম | লোকনাথ ঘোষাল ৬ আগস্ট ১৭৩০[1] কচুয়া, ভারত |
মৃত্যু | ১ জুন ১৮৯০[2] (বয়স ১৬০)[3][4][5] বারদি, ঢাকা, বাংলাদেশ, ব্রিটিশ ভারত |
গুরু | ভগবান গাঙ্গুলি |
উদ্ধৃতি | ১. "রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়বি, আমাকে স্মরণ করবি, আমিই রক্ষা করবো।"
২. "আমার বিনাশ নেই, শ্রাদ্ধও নেই, আমি নিত্য পদার্থ। অর্থাৎ এই ‘আমি’ হলাম গীতায় বর্ণিত ‘পরমাত্মা’।" ৩. "দেখ-অর্থ উপার্জন করা , তা রক্ষা করা, আর তা ব্যয় করবার সময় বিষয় দু:খ ভোগ করতে হয়। অর্থ সকল অবস্থাতেই মানুষকে কষ্ট দেয়। তাই অর্থ ব্যয় হলে বা চুরি হলে তার জন্যে চিন্তা করে কোন লাভই হয় না।" ৪. "গরজ করবি, কিন্তু আহাম্মক (নির্বোধ) হবি না। ক্রোধ করিব কিন্তু ক্রোধান্ধ হবি না।" ৫. "আমার চরণ ধরিস না, আচরণ ধর।" ৬. "যৎ তে কল্যাণরূপং তৎ তে পশ্যামি।।" ৭. "প্রতিদিন কার্যসিদ্ধি সমাপ্ত করার পর ঘুমোতে যাওয়ার আগে ভেবে নিবি সারাদিন কি কি করেছিস। কোনটা ভালো কাজ, কোনটা খারাপ কাজ- তার হিসাব করবি। যদি এসব খারাপ কাজ ছেড়ে দিস,তাহলে দেখবি তুই পাপ কাজ থেকে মুক্তি পেয়ে যাবি।" [তথ্যসূত্র: বারদী আশ্রম এবং ধর্মসংক্রান্ত গ্রন্থ] |
বাল্য জীবন
বাবা লোকনাথ শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি জন্মাষ্টমীতে ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ আগস্ট[1] (২৫ শ্রাবণ, ১১৩৭ বঙ্গাব্দ) কলকাতা থেকে কিছু দূরে বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার চৌরাশীচাক্লা গ্রামে (চাকলাধাম নামে পরিচিত) একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।(লোকনাথে জন্মস্থান নিয়ে শিষ্যদেরও ভেতরে বিতর্ক আছে। নিত্যগোপাল সাহা এ বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা করেন ও রায় অনুযায়ী তার জন্মস্থান কচুয়া বলে চিহ্নিত হয়।) তার পিতার নাম রামনারায়ণ ঘোষাল এবং মাতা শ্রীমতী কমলা দেবী। তিনি ছিলেন তার বাবা-মায়ের ৪র্থ পুত্র।[3]
পিতা রামনারায়ণ ঘোষাল ছিলেন ধর্মপরায়ণ ব্যাক্তি এবং গুপ্তসাধক। তার বাসনা ছিলো একজন সন্তানকে ব্রহ্মচারী করবেন। কিন্তু মাতৃমায়ায় আচ্ছন্ন মা তাঁর পুত্রদের ব্রহ্মচারী হতে সম্মতি দিতে চাইছিলেন না। শেষে চতুর্থ সন্তান লোকনাথের জন্ম হলে মাতা কমলা দেবী নিজ হতেই ব্রহ্মচারী হওয়ার সম্মতি দেন।[3]
এরপর রামনারায়ণ, আচার্য গাঙ্গুলী(ভগবান চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়)-কে লোকনাথের আচার্য রূপে উপনয়ন সংস্কার করিয়ে আধ্যাত্ম জীবনের গুরুভার গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানালেন। আচার্য গাঙ্গুলী ছিলেন পরম নিষ্ঠাবান এবং সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত গৃহী সন্ন্যাসী। তিনি চৌরাশীচাকলা গ্রামের নিকটে কাঁকড়া গ্রামে বাস করতেন। গ্রামটি কচুয়া নামে পরিচিত ছিল। উপনয়নের জন্য লোকনাথ আচার্য গাঙ্গুলীর শিষ্যত্ব লাভ করেন। একই সঙ্গে তাঁর প্রিয় সখা বেণীমাধব চক্রবর্তী ভগবান গাঙ্গুলীর শিষ্যত্ব লাভ করেন। এ সময় লোকনাথ ও সখা বেণীমাধবের বয়স ছিল ১১ বছর এবং আচার্য গাঙ্গুলীর বয়স তখন ৬০। এরপর আচার্য গাঙ্গুলীর সাথে দুজন বালক বেদোক্ত বিধিমত নৈষ্ঠিক-ব্রহ্মচারী হয়ে গৃহস্থাশ্রম ত্যাগ করেন।[3]
সিদ্ধিলাভ
গৃহ ত্যাগের পর বাংলা ১১৪৮ সনে আচার্য গাঙ্গুলী তাদের নিয়ে আসেন কালীঘাটের শক্তিপীঠে। একান্ন পিঠের অন্যতম মহাপীঠ কালীঘাট। তৎকালে কালীঘাট ছিল ঘন জঙ্গলময়। কালীঘাটে আসার পর বাল্য ব্রহ্মচারীদ্বয় আচার্যকে সাধন-ভজন শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেন। সাধন-ভজনের জন্য নির্জন স্থানের উদ্দেশ্যে তারা কালীঘাট ত্যাগ করেন। নির্জন স্থানে এসে শিষ্যদ্বয় কঠোর সংযম পালন করেন এবং দীর্ঘ ৩০-৪০ বছর নক্ত-ব্রত (দিনে অনাহারী থেকে রাত্রে আহার) ধারণ করেন। এরপর একান্তরা-ব্রত (একদিন উপবাসের পর দিন আহার), ত্রিরাত্রি, পঞ্চহ, নবরাত্রি ব্রত পালন করে করেন। আচার্য গাঙ্গুলী তাদের ধ্যান ও যোগ শিক্ষা দেন। এরপর সিদ্ধলাভের জন্য তারা হিমালয়ের বরফাবৃত এক নির্জন স্থানে উপস্থিত হলেন। পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় কঠিন তপস্যা দ্বারা লোকনাথ সমাধির উচ্চতম শিখরে পৌছান এবং পরমতত্ত্ব লাভ করেন। তখন তার বয়স ৯০ বছর।[3]
ভ্রমণ
মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা
শিষ্যদের সিদ্ধি লাভের পর ভগবান গাঙ্গুলী তাদের নিয়ে মক্কা দর্শনের অভিলাস করেন। তারা পায়ে হেঁটে রওনা হলেন মক্কার উদ্দেশ্যে। প্রথমে তারা উপস্থিত হলেন কাবুলে। সেখানে ‘মোল্লা সাদি’ নামে একজন ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ ধার্মিক মুসলমানের সাথে তাদের পরিচয় হয়। তার সাথে কুরআন ও ইসলাম ধর্ম বিষয়ে নানা আলোচনা হয়। এখানে লোকনাথ কোরআন শিক্ষা করেছিলেন। তারা উপলব্ধি করলেন, বাহ্যিক আচার-আচরণ ছাড়া দুই ধর্মের মাঝে প্রভেদ নেই।
কাবুলের পর তারা আসেন মদিনায়। এখানেও বেদ ও কুরআন নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা হয়। এখান থেকে তারা মক্কার পথে যাত্রা করেন। যাত্রা পথে ‘আব্দুল গফুর’ নামে ৪০০ বছর বয়সী এক উচ্চস্তরের মুসলমান ফকিরের দর্শনের জন্য তাঁর আস্থানায় যান। তিনি সবসময় মৌন এবং সমাধি অবস্থায় থাকতেন। সিদ্ধপুরুষ লোকনাথকে দেখে তার সমাধি ভঙ্গ হয় এবং তাকে আলিঙ্গন করেন। এরপর দুর্গম পথ অতিক্রম করে তারা মক্কায় পৌছান।[3]
কাশীধাম যাত্রা
মক্কায় কয়েকদিন অবস্থানের পর তাঁরা বারাণসীর কাশীধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানে মহাযোগী ত্রৈলঙ্গস্বামীর পর্ণকুটির অবস্থিত। বৃদ্ধ গাঙ্গুলী তার শিষ্যদ্বয়ের সমস্ত দায়িত্ব ত্রৈলঙ্গস্বামীর হাতে তুলে দিয়ে গঙ্গার তীরে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় মহাপ্রস্থান হন। ত্রৈলঙ্গস্বামী মূলত পণ্ডিত হিতলাল মিশ্র। সেখানে স্বামীজীর সাথে তাঁরা কিছুকাল যোগশিক্ষা করে ভ্রমণে বের হন।[3]
বিশ্ব ভ্রমণ
ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তারা ভারতের পশ্চিমে আফগানিস্তান, আরব, ইসরায়েল, পারস্য, ইউরোপ ইত্যাদি স্থান অতিক্রম করে আটলান্টিক মহাসাগর উপকূল পর্যন্ত গমন করেছিলেন। এরপরে তারা ভারতে ফিরে পুনরায় উত্তরের পথে গমন করেন। তারা বরফাচ্ছন্ন সুমেরু এলাকা গমনের ইচ্ছায় প্রাক-প্রস্তুতি উপলক্ষে শৈত্যপ্রধান এলাকা হিসেবে বদ্রীনাথ শ্রীমন্দিরের আশ্রমে অবস্থান করেন। সেখান থেকে আধুনিক পরিজ্ঞাত সীমা অতিক্রম করে উত্তরে বহুদূরে চলে যান। তারা হেঁটে হেঁটে সাইবেরিয়াতে চলে আসেন। সেখানে সূর্যোদয় না হওয়ায় সময় নির্ণয় করা যায় নাই; তবে তারা সে পথে ২০ বার বরফ পড়তে ও গলতে দেখেছিলেন। কয়েকটি বরফের স্তম্ভের কাছে এসে তারা যাত্রা সমাপ্ত করলেন। এরপর পূর্ব দিকে গমন করে চীন দেশে উপস্থিত হন। সেখান থেকে ত্রৈলঙ্গস্বামী উদায়াচলের পথে যাত্রা করেন। লোকনাথ ও বেণীমাধব তিব্বত ও বদ্রীনাথ পাহাড়ে অবস্থান করলেন। তারপর বেণীমাধব কামাখ্যার উদ্দেশ্যে চলে যান এবং লোকনাথ চলেন চন্দ্রনাথ পহাড় সংলগ্ন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে।[3]
বারদীতে অবস্থান
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাত্রাকালে হঠাৎ জঙ্গলে আগুন লেগে যায়। তিনি লক্ষ করলেন বৃক্ষতলায় এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসী ধ্যানমগ্ন আছেন। তিনি যোগবলে তাকে নিরাপদে নিয়ে আসেন। ইনি ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী।
এরপর লোকনাথ ত্রিপুরা জেলার দাউদকান্দি গ্রামে আসেন। বারদী গ্রামের ডেঙ্গু কর্মকার নামে এক ব্যাক্তি সেসময় ফৌজদারী মামলার আসামি হয়ে দাউদকান্দিতে ছিল। উদভ্রান্ত ডেঙ্গু কর্মকার লোকনাথকে দেখতে পেয়ে সব ঘটনা খুলে বলেন। তখন লোকনাথ তাকে নির্ভয়ে থাকতে বলেন। পরদিন বিচারপতি ডেঙ্গুকে বেকসুর খালাস রায়ে দেন। লোকনাথকে ডেঙ্গু তার বাড়িতে নিয়ে আসেন।
ডেঙ্গুর মৃত্যুর পর বারদ্রীর জমিদার তাকে নিয়ে আসেন জমিদার বাড়িতে। জমিদার তাকে ‘ছাওয়াল বাঘিনী’ নদীর তীরে একটি নিষ্কর শ্মশানে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে দেন। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর তিনি সেখানে অবস্থান করেন। সে সময় থেকেই “বারদী’র ব্রহ্মচারী” হিসেবে লোকনাথ পরিচিতি পান।[3]
মহাপ্রয়াণ
বারদী অবস্থান কালে ভক্তগণ কৃপার জন্য তার নিকট আসতেন। এক ভক্ত তার পুত্রের দুরারোগ্য যক্ষ্মার মুক্তির জন্য তার নিকট আসেন। লোকনাথ বুঝতে পারেন সেই পুত্রের আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। তবুও ভক্তকে কৃপা করে যক্ষ্মা রোগ নিজ শরীরে গ্রহণ করেন। পুত্র ধিরে ধিরে রোগ মুক্ত হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তার মৃত্য হয়। কিন্তু যক্ষ্মা রোগ লোকনাথের শরীরে ক্রমে ক্রমে বাড়তে থাকে। এরপর ১৯ জৈষ্ঠ্য তিনি তার দেহত্যাগের ঘোষণা দেন। এই সংবাদ পেয়ে ভারাক্রান্ত ও অশ্রুসিক্ত ভক্তগণ দলে দলে আসতে থাকে বারদীর আশ্রমে। সেখানে তিনি সবাইকে প্রসাদ গ্রহণ করতে বললেন।[3]
এরপর ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৭ বঙ্গাব্দে(১ জুন ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ)[2], এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ১১টা ৪৫ মিনিটে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বারদী আশ্রমে মহাসমাধি মগ্ন হলেন। এসময় তার বয়স ছিল ১৬০ বছর।[3]
উক্তি
তথ্যসূত্র
- ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দের গ্রেগোরিয়ান ও বাংলা বর্ষপঞ্জী
- "পঞ্জিকা ১২৯৭ বঙ্গাব্দ"। usingha.com। সংগ্রহের তারিখ ৬ জানুয়ারি ২০২২।
- সিদ্ধজীবনী - ব্ৰহ্মানন্দ ভারতী, ১৯৫৭, কলকাতা।
- জয়নাল হোসেন কর্তৃক লিখিত "রাজা ভাওয়াল সন্ন্যাসী ও ভাওয়াল পরগনা গ্রন্থ।"
- খ্রিস্টাব্দের গ্রেগোরিয়ান ও বাংলা বর্ষপঞ্জী
- "পঞ্জিকা ১১৩৭ বঙ্গাব্দ"। usingha.com। সংগ্রহের তারিখ ৬ জানুয়ারি ২০২২।
- "পঞ্জিকা ১২৯৭ বঙ্গাব্দ"। usingha.com। সংগ্রহের তারিখ ৬ জানুয়ারি ২০২২।
- "লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমে একদিন"। এনটিভি বিডি। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুন ২০২০।
- "বাণী চিরন্তণী"। ১৩ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ আগস্ট ২০১৬।
- "বাণী চিরন্তণী"। ১৩ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ আগস্ট ২০১৬।
- "বাণী চিরন্তণী"। ৩১ আগস্ট ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ আগস্ট ২০১৬।