লাল বোম্বেটের গুপ্তধন

লাল বোম্বেটের গুপ্তধন (ফরাসি: Le Trésor de Rackham le Rouge) বেলজীয় কার্টুনিস্ট হার্জের দুঃসাহসী টিন‌টিন সিরিজের বারোতম কমিকস বই। বেলজিয়ামের ফরাসিভাষি দৈনিক লে সয়ারে ধারাবাহিকভাবে এটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ এর ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত; সেসময় বেলজিয়াম ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাজি সৈন্যদের দখলে। কমিকসে তরুণ প্রতিবেদক টিনটিন ও তার বন্ধু ক্যাপ্টেন হ্যাডক ক্যারিবীয় সাগরে যাত্রা করে জলদস্যু লাল বোম্বেটের ধনসম্পদ উদ্ধার করতে।

লাল বোম্বেটের গুপ্তধন
(Le Trésor de Rackham le Rouge)
লাল বোম্বেটের গুপ্তধন কমিকসের প্রচ্ছদ
তারিখ১৯৪৪
সিরিজদুঃসাহসী টিন‌টিন
প্রকাশককাস্টরম্যান
সৃজনশীল দল
উদ্ভাবকরাহার্জ
মূল প্রকাশনা
প্রকাশিত হয়েছিললে সয়ার জেনেস
প্রকাশনার তারিখ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩ – ২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪৩
ভাষাফরাসি
অনুবাদ
প্রকাশকআনন্দ পাবলিশার্স
তারিখ১৯৯৫
অনুবাদকনীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
কালপঞ্জি
পূর্ববর্তীবোম্বেটে জাহাজ (১৯৪৩)
পরবর্তীমমির অভিশাপ (১৯৪৮)

লাল বোম্বেটের গুপ্তধন ব্যবসায়িক সাফল্য পায় এবং পত্রিকায় প্রকাশের পরের বছরই কাস্টরম্যান এটি গ্রন্থাকারে ছাপে। হার্জ দুঃসাহসী টিনটিন সিরিজ চালিয়ে যান পরবর্তী কমিকস মমির অভিশাপ দিয়ে। ততদিনে টিনটিন সিরিজটি ফ্রাঙ্কো-বেলজীয় কমিকস ধারার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। লাল বোম্বেটের গুপ্তধনকে বলা হয় সিরিজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্ব কারণ এখানেই প্রথম দেখা দেন ছিটগ্রস্ত বিজ্ঞানী কাথবার্ট ক্যালকুলাস। কমিকসটির রূপায়িত হয়েছে বেলভিশিয়ান এনিমেটেড সিরিজ হার্জে'স অ্যাডভেঞ্চারস অফ টিনটিন (১৯৫৭), এবং নেলভানা ও এলিপসের তৈরি অ্যাডভেঞ্চারস অফ টিনটিন (১৯৯১) এনিমেটেড টিভি সিরিজে, আর আংশিকভাবে দি অ্যাডভেঞ্চার্স অব টিনটিন (২০১১) ফিচার ফিল্মে।

কাহিনীসংক্ষেপ

এই কাহিনীর প্রথমাংশ বোম্বেটে জাহাজ

জলদস্যু লাল বোম্বেটের গুপ্তধন উদ্ধারের জন্যে টিনটিনক্যাপ্টেন হ্যাডক মাছধরার ট্রলার সাইরাস নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে পাড়ি দেবার পরিকল্পনা আঁটে। ক্যাপ্টেনের পূর্বপুরুষ স্যার ফ্রান্সিস হ্যাডকের রেখে যাওয়া তিনটি ভূর্জপত্র পড়ে তারা ইউনিকর্ন জাহাজ যেখানে ডুবেছিল তার অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ জেনেছে। সেই জাহাজেই লাল বোম্বেটের ধনসম্পদ থাকার কথা। তাদের সাহায্য করতে আসে এক খামখেয়ালি কানে-কম-শোনা আবিস্কারক প্রফেসর কাথবার্ট ক্যালকুলাস, তার তৈরি হাঙর-আকৃতি এক-আরোহী ডুবোজাহাজ নিয়ে। তবে তারা তাকে ফিরিয়ে দেয়।[1]

সমুদ্রে যাত্রা করার পর তাদের সাথে এসে যুক্ত হয় পুলিশের গোয়েন্দা জনসন ও রনসন। দুদিন বাদে জানা যায় প্রফেসর ক্যালকুলাসও লুকিয়ে জাহাজে উঠেছেন, তার ডুবোজাহাজসহ। তারা ভূর্জপত্রের লেখানুযায়ী ভৌগোলিক অবস্থানে পৌছলেও কোনো দ্বীপ খুঁজে পায়নি। হতাশ হয়ে ক্যাপ্টেন ফিরে যাবার কথা ভাবতে থাকে। তখন টিনটিন সমস্যাটি ধরতে পারে: যদি স্যার ফ্রান্সিস অবস্থান নির্ণয়ে ইংরেজি মানচিত্রের বদলে ফরাসী মানচিত্র ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে স্থানাঙ্ক হবে ফরাসী মূল মধ্যরেখা অনুসারে, গ্রীনউইচ মধ্যরেখা নয়। আর গ্রীনউইচ অনুসরণ করে তারা অনেক বেশি পশ্চিমে চলে এসেছে।

এবার সঠিক অবস্থানে পৌঁছে তারা এক অজানা দ্বীপ আবিষ্কার করে। দ্বীপে স্যার ফ্রান্সিস হ্যাডকের একটি মূর্তি পাওয়া যায়। সেখানকার টিয়াপাখিগুলোও স্যার ফ্রান্সিসের থেকে শোনা গালিগুলো ব্যবহার করে। এসব থেকে টিনটিন এ সিদ্ধান্তে আসে যে ফ্রান্সিস হ্যাডক এ দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলেন আর ইউনিকর্ন জাহাজও কাছাকাছি কোথাও ডুবেছে। তারা ক্যালকুলাসের ডুবোজাহাজ ব্যবহার করে ইউনিকর্নের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করে এবং কিছু প্রত্নবস্তুও উদ্ধার করে, তবে গুপ্তধন পায়নি। প্রত্নবস্তুগুলোর মধ্যে একটি সিন্দুকে থাকা পুরনো দলিলপত্র থেকে জানা যায়, মার্লিনস্পাইক হল আসলে স্যার ফ্রান্সিস হ্যাডকের সম্পত্তি। বেলজিয়ামে ফিরে, ক্যালকুলাস তার ডুবোজাহাজের নকশা বিক্রি করে পাওয়া টাকা দিয়ে ক্যাপ্টেনকে মার্লিনস্পাইক হল কিনে দেয়। টিনটিন আর ক্যাপ্টেন হলের ভূগর্ভস্থ গুদামে খোঁজাখুজি করার সময় সেন্ট জন দ্য ইভানজেলিস্টের একটি মূর্তি পায়, যার হাতে ক্রুশ এবং পায়ের কাছে একটি গ্লোব ও ঈগল। টিনটিনের মনে পড়ে যে, স্যার ফ্রান্সিস হ্যাডকের ভূর্জপত্রগুলোয় বলা ছিল, "আলো থেকেই আসে আলো... তাতেই আঁধার কাটে... ঈগল ক্রস"। সে বুঝতে পারে এই বার্তা আসলে সেন্ট জন দ্য ইভানজেলিস্টকে ইঙ্গিত করছে, ঈগল তার ঐতিহ্যবাহী প্রতীক। এরপর গ্লোবে আঁকা সেই দ্বীপে টিপতেই তার ঢাকনা খুলে যায় এবং বেরিয়ে আসে লাল বোম্বেটের লুকানো ঐশ্বর্য।[2]

ইতিহাস

প্রেক্ষাপট

১৯৪০ সালে পূর্ব বেলজিয়ামে জার্মান সৈন্যদল। লাল বোম্বেটের গুপ্তধন ও এর পরবর্তী কমিকসটি লেখা হয়েছিল যখন বেলজিয়াম ছিল জার্মানদের দখলে।

১৯৪০ সালে হার্জের লে সয়ারে যোগদান করার সময় এটি ছিল বেলজিয়ামের সর্ববৃহৎ ফরাসীভাষী পত্রিকা। লে সয়ারের শিশুতোষ ক্রোড়পত্র লে সয়ার জেনেস-এর খ্যাতিমান সম্পাদক হয়ে ওঠেন হার্জ। সহকারী ছিলেন তার পুরনো বন্ধু পল জেমিওন এবং কার্টুনিস্ট জ্যাক ভ্যান মেল্কবিকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানি বেলজিয়াম দখল করে, লে সয়ার পত্রিকাও বাজেয়াপ্ত হয়। পরে তা আবার প্রকাশিত হয় জার্মান যুদ্ধনীতি ও ইহুদিবিদ্বেষের সমর্থনে।[3] এরূপ জার্মান নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও লে সয়ারের বিপুল পাঠকগোষ্ঠী (প্রায় ৬ লক্ষ)[4] থাকায় হার্জ তা ছাড়তে পারেননি। তবে এরপর থেকে তিনি কমিকসে আর স্পষ্টভাবে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনা ব্যবহার না করে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করতে থাকেন।[5] লেখক হ্যারি থম্পসনের পর্যবেক্ষণে, তখন রাজনৈতিক ব্যঙ্গ বা প্রহসনের বদলে "হার্জ বেশি মনোযোগ দিচ্ছিলেন [কমিকসের] কাহিনীতে এবং নতুনভাবে চরিত্রগুলোতে রসসৃষ্টিতে। পাঠকেরা তা ইতিবাচকভাবেই নিয়েছিলেন।"[6]

লাল বোম্বেটের গুপ্তধন ছিল সেই অভিযানের দ্বিতীয় অংশ যা শুরু হয়েছিল বোম্বেটে জাহাজেফারাওয়ের চুরুটনীলকমলের পর এটিই ছিল হার্জের প্রথম দুই-অংশবিশিষ্ট গল্প।[7] অবশ্য টিনটিনবিদ মাইকেল ফার মন্তব্য করেছেন,ফারাওয়ের চুরুটনীলকমল ছিল অনেকবেশি "আত্মগত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ", সে তুলনায় বোম্বেটে জাহাজলাল বোম্বেটের গুপ্তধনের মাঝে সংযোগ বহুদূর ঘনিষ্ঠ।[8]

প্রকাশনা

দুঃসাহসী টিনটিন সিরিজে বোম্বেটে জাহাজলাল বোম্বেটের গুপ্তধন কমিকসদুটোই প্রথম ইংরেজিতে অনূদিত হয়। ক্যাস্টরম্যান প্রকাশিত সংস্করণদুটির বিক্রি খুব কম হয় এবং এখন কেবল অল্প কয়েকজনের সংগ্রহে তা আছে।[9] সাত বছর পর ম্যাথুয়েন গল্পদুটি পুনর্প্রকাশ করে, অনুবাদ করেন লেসলি লন্সডেল-কুপার এবং মাইকেল টার্নার।[10] মাইকেল ফার জানিয়েছেন, লাল বোম্বেটের গুপ্তধন টিনটিন সিরিজের সর্বোচ্চ-বিক্রিত কমিকস,[8] আর হ্যারি থম্পসন বোম্বেটে জাহাজলাল বোম্বেটের গুপ্তধন ধারাগল্পটিকে বলেছেন "টিনটিনের সবগুলো অভিযানের মধ্যে সবচেয়ে সফল"।[11]

রূপায়ণ

১৯৫৭ সালে অ্যানিমেশন কোম্পানি বেলভিশিয়ান স্টুডিওস তৈরি করে হার্জে'স অ্যাডভেঞ্চারস অফ টিনটিন, হার্জের কমিকস অবলম্বন করে কার্টুন সিরিজ। পুরো রঙিন এই সিরিজটি প্রতিদিন ৫ মিনিট করৈ দেখানো হতো। এর দ্বিতীয় পর্বে ৫ম কার্টুন হিসেবে বোম্বেটে জাহাজ রূপায়িত হয়। সিরিজটির পরিচালনা করেন রে গুসেন এবং কাহিনী লেখেন সুপরিচিত কার্টুনিস্ট গ্রেগ, পরে যিনি টিনটিন ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক হয়েছিলেন।[12]

২০১১ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে মুক্তি পায় মোশন ক্যাপচার চলচ্চিত্র দি অ্যাডভেঞ্চার্স অফ টিনটিন: দ্য সিক্রেট অফ দি ইউনিকর্ন; পরিচালক ছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গ এবং প্রযোজক পিটার জ্যাকসনকাঁকড়া রহস্য, বোম্বেটে জাহাজলাল বোম্বেটের গুপ্তধন - এই তিনটি কমিক বই অবলম্বনে মূলত ছবিটি তৈরি হয়েছে।[13] এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি ভিডিও গেমও পরের মাসে মুক্তি দেয়া হয়।[14]

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.