লণ্ঠন
লণ্ঠন হচ্ছে একটি বহনযোগ্য আলোর উৎস যাতে সাধারণত মোমবাতি বা তৈলাক্ত সল্তে আলোক শিখা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটির চতুর্দিকে সুরক্ষামূলক ঢাকনা দিয়ে ঘেরা থাকে যার ফলে এটি সহজ বহন করা ও ঝুলিয়ে রাখা যায় এবং ঘরের বাইরে ও ঠাণ্ডা স্থানে অধিক নির্ভরযোগ্যভাবে ব্যবহার করা যায়।
লন্ঠন সাধারণত একটি ধাতব ফ্রেম থেকে তৈরি করা হয় যার চারিদিকে কয়েকটি জানালার মত পাশ থাকে (সাধারণত চারটি, তবে আটটি পর্যন্ত হয়ে থাকে), এবং এর উপরে সচরাচর একটি ধাতব আংটা বা কড়া লাগান থাকে। লন্ঠনের চারিপাশে ঈষদচ্ছ পদার্থ দিয়ে তৈরি জানালা লাগানো থাকে। বর্তমানে সেগুলো সাধারণত গ্লাস বা প্লাস্টিকের তৈরি হলেও, আগের দিনে প্রাণীর শিংএর পাতলা পাত, গর্ত বা নকশা করা টিনপ্লেট দিয়ে ঢাকা থাকত। যদিও কিছু প্রাচীন লণ্ঠনে কেবল একটি ধাতব ঝাঁজরি থাকতো, যা তাদের ভূমিকা পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত করে। সেটি নিচে বর্ণনা করা হল-
প্রাথমিকভাবে বাতাস, বৃষ্টি বা অন্যান্য কারণ থেকে জ্বলন্ত মোমবাতি বা সল্তেকে রক্ষা করার জন্য চারদিকে বেষ্টনী দেয়া হলেও, আগুনের স্ফুলিঙ্গ থেকে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি হ্রাস করাও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। বিশেষত, জাহাজে ডেকের নিচে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ কাঠের জাহাজে আগুন লাগলে তা একটি বড় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারত। অরক্ষিত আলোর উৎসের ব্যবহার এতই গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা হয়েছিল যে ডেকের নিচে অরক্ষিত আলোর পরিবর্তে লণ্ঠনের বাধ্যতামূলক ব্যবহারের কথা, জলদস্যু আইনের শাস্তি সম্পর্কিত অবশিষ্ট জ্ঞাত কয়েকটি উদাহরণে লিখিত ছিল (ক্যাপ্টেন জন ফিলিপসের নিবন্ধগুলির মধ্যে প্রবন্ধ VI এ)। প্রথম দিকে শিংএর তৈরি জানালা ব্যবহৃত হওয়ায়, "Lanthorn" শব্দটি ব্যবহার করা হত। [1]
সংকেত প্রদান, মশাল বা সাধারণ বাইরের আলোক উৎস হিসেবেও লন্ঠনের ব্যবহার হতে পারে। কম আলো সম্পন্ন লন্ঠন আলোকসজ্জা হিসাবে ব্যবহার করা যায়, যা বিভিন্ন রং এবং মাপের হতে পারে। সাধারণভাবে "লণ্ঠন" শব্দটি আলোর উৎস, অথবা আলোর উৎসের বেষ্টনী বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরুপ, হল কাঁচ-ঢাকা সড়ক বাতি, অথবা বাতিঘরের শীর্ষে ল্যাম্প এবং লেন্সের ঘর এর কথা উল্লেখযোগ্য।[2] আবার অনেক ক্ষেত্রে চীনা কাগজ লণ্ঠন বোঝাতেও লন্ঠন কথাটি ব্যবহৃত হয়।
ইতিহাস
লণ্ঠন শব্দটি ফরাসি মাধ্যমে ল্যাটিন lanterna শব্দ থেকে এসেছে,[3] from Latin lanterna যা সম্ভবত গ্রীক থেকে উদ্ভূত।[1]
প্রাচীনকাল থেকেই আলোকসজ্জার চেয়ে আলোক উৎস হিসেবে লন্ঠনের ব্যবহার বেশি ছিল, যাদের কিছু ছিল আবদ্ধ মোমদানি আর অন্যগুলো তেলের মধ্যে সল্তেঅলা থাকত।[4] কাঁচের পাত উদ্ভাবনের পূর্বে, পশুর শিঙ পাতলা এবং চ্যাপ্টা করে চেঁছে ঈষদচ্ছ জানালা হিসাবে ব্যবহৃত হত।
আলোকসজ্জার লণ্ঠনে বিভিন্ন ধরনের নকশা হয়ে থাকে। কিছু লন্ঠন ঝুলন্ত, আবার কিছু মাটির উপরে অথবা ঠিক উপরে স্থাপন করতে হয়। বিশ্বের বিভিন্ন সমাজে কাগজের লণ্ঠন তৈরি করা হয়। আধুনিক ক্ষেত্রে প্রায়ই নকশা করা কাঁচের অথবা প্লাস্টিকের মধ্যে একটি বৈদ্যুতিক আলো রাখা হয়।
লিজিয়াং, ইউনানে রাতের আকাশে প্রাসাদ লণ্ঠন প্রাচীন চীনারা কখনও কখনও স্বচ্ছ বা আধা স্বচ্ছ বাক্সে জোনাকি ধরে রাখত এবং তাদের (স্বল্পমেয়াদী) লণ্ঠন হিসাবে ব্যবহার করত। রেইজ দ্য রেড ল্যান্টারন নামের একটি চীনা চলচ্চিত্রে লণ্ঠনকে একটি মোটিফ হিসাবে বিশেষভাবে দেখানো হয়। অনেক এশিয়ান উৎসবে লণ্ঠন ব্যবহৃত হয়। গোস্ট ফেস্টিভালের সময়, পদ্মফুল আকৃতির লণ্ঠনগুলি নদী ও সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হয়, যা বিস্মৃত পূর্বপুরুষদের হারিয়ে যাওয়া আত্মাকে পথ প্রদর্শনের প্রতীক হিসেবে মানা হয়। চীনে প্রথম চান্দ্রমাসের ১৫তম দিনে লন্ঠন উৎসবের সময় সারা চীন জুড়ে অনেক লণ্ঠন দেখা যায়। অন্যান্য চীনা উৎসবের সময় আকাশে কংমিং লণ্ঠন উড়তে দেখা যায়। লণ্ঠন সিওল লণ্ঠন উৎসবের প্রধান বিষয়বস্তু।
স্বচ্ছ বাক্সে জোনাকির ব্যবহার প্রাচীন ভারতেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু এগুলি স্বল্পমেয়াদী সমাধান হওয়ায়, আগুনের মশালের ব্যবহার বেশি প্রচলিত ছিল।
ইস্টার্ন অর্থডক্স চার্চে, প্রচলিত ক্রুশের ব্যবহারের পূর্বে ধর্মীয় মিছিল এবং প্রবেশদ্বারে লণ্ঠনের ব্যবহার হত।
হলি উইকের গ্রেট স্যাটারডেতে চার্চ অব দ্য হলি সেপলকার থেকে হলি ফায়ার বহনের জন্যও লণ্ঠন ব্যবহার করা হয়।
"ল্যান্টার্ন জ" (lantern jaw) কথাটি এখনও লণ্ঠনের সাথে মুখের আকারের তুলনা করে দুটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানের মতে এটি দিয়ে "লম্বা পাতলা চোয়াল ও ফাঁপা গাল বিশিষ্ট চেহারাকে" বোঝায়। [5] ১৩৬১ সালে অবতল কাঁচের দেয়াল বিশিষ্ট লণ্ঠনের সাথে তুলনা করে এর ব্যবহার প্রথম রেকর্ড করা হয়। আরেকটি তুলনা করা হয় পঞ্চদশ শতাব্দীর ছড়ানো তলদেশের লণ্ঠনের সাথে (উপরে চিত্রিত), যা ম্যান্ডিবুলার প্রগন্যাথিজম বিশিষ্ট ব্যক্তির মুখের মত। [6] এটি হাবসবার্গ পরিবারের একটি বংশগত বৈশিষ্ট্য হওয়ায়, হাবসবার্গ চোয়াল বা হাবসবার্গ ঠোঁট নামেও পরিচিত (উদাহরণস্বরূপ, পঞ্চম চার্লস পবিত্র রোমান সম্রাট এর পোর্ট্রেট দেখুন)।
আধুনিক জ্বালানী লণ্ঠন
সমস্ত জ্বালানী লন্ঠনই কোন না কোনভাবে বিপজ্জনক। এর কারণ হিসেবে জ্বলন্ত এবং বিষাক্ত জ্বালানি, আগুন লাগা বা উচ্চ তাপমাত্রায় পুড়ে যাওয়া এবং বদ্ধ পরিবেশে ব্যবহারের ফলে কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়া উল্লেখযোগ্য।
সাধারণ সলতের লণ্ঠন এখনও পাওয়া যায়। এগুলো সস্তা ও টেকসই, কিন্তু কম আলো দেয় যা পড়ার অনুপযুক্ত। এই লন্ঠনে সলতে কিছু সময় পর পর ছেঁটে দিতে হয় এবং কাঁচের অভ্যন্তরের দেয়াল থেকে কালি পরিষ্কার করতে হয়।
ম্যান্টল লণ্ঠন বা হ্যাজাক বাতিতে একটি সিরামিকের বোনা গ্যাস ম্যান্টল ব্যবহৃত হয় যেটি একটি শিখা হিসেবে তাপ গ্রহণ ও দৃশ্যমান আলোরূপে পুনরায় বিকিরণ করে। ম্যান্টল পুড়ে যায় না (তবে প্রথম ব্যবহারের আগে সিরামিকযুক্ত কাপড়ের ম্যাট্রিক্সটি একটি দিয়াশলাই দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া উচিত)। যখন মূল শিখা দ্বারা উত্তপ্ত হয়ে হ্যাজাক ভাস্বর হয় এবং উজ্জ্বলভাবে জ্বলে। গ্যাস ,কেরোসিন বা চাপযুক্ত তরল যেমন "সাদা গ্যাস"(যা মূলত ন্যাফথা) দ্বারা তাপ সরবরাহ করা যায়। উচ্চ তাপমাত্রা থেকে সুরক্ষা এবং বায়ুপ্রবাহ স্থিতিশীল করতে, গ্লোব বা চিমনি নামের একটি নলাকার কাচের ঢাল ম্যান্টলের চারপাশে স্থাপন করা হয়।
হোয়াইট গ্যাস (কোলম্যান জ্বালানী বা "ক্যাম্প ফুয়েল" নামেও পরিচিত) ব্যবহার করা হস্তচালিত চাপযুক্ত ল্যান্টার্ন এক ও দুই-ম্যান্টল মডেলে কোলম্যান কোম্পানি কর্তৃক তৈরি হয়। কিছু মডেলে দ্বৈত জ্বালানী এবং পেট্রল ব্যবহৃত হতে পারে। তবে এগুলি [[তড়িৎকোষ|ব্যাটারি-চালিত]] ফ্লুরোসেন্ট বাতি এবং এলইডি মডেল দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে, যা অল্পবয়স্কদের হাতে এবং তাঁবুর অভ্যন্তরে নিরাপদ। কোলম্যানসহ অনেক নির্মাতারা ব্যাটারি-চালিত লণ্ঠন তৈরি করে। জ্বালানির সহজপ্রাপ্য়তার কারণে দৈনন্দিন ব্যবহারে তরল জ্বালানী লণ্ঠন অধিক জনপ্রিয়।
অনেক বহনযোগ্য হ্যাজাক লণ্ঠন এখন এমন জ্বালানি গ্যাস ব্যবহার করে, যেগুলো চাপ প্রয়োগে তরল হয়ে যায় যেমন, বিশুদ্ধ অথবা বিউটেন মিশ্রিত প্রোপেন। এ ধরনের লন্ঠনে সাধারণত জ্বালানী সরবরাহ করার জন্য একটি ছোট নিষ্পত্তিযোগ্য ইস্পাতের পাত্র থাকে। তরল জ্বালানী স্পর্শ না করেই জ্বালানি সরবরাহের সুবিধার ফলে নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায় এবং পাত্রগুলি আর্দ্রতা ও অতিরিক্ত তাপ থেকে সুরক্ষিত থাকলে (যাতে পাত্র ক্ষয় হতে পারে) এই লন্ঠন অনির্দিষ্টকালের জন্য কার্যকরী থাকে।
আধুনিক বৈদ্যুতিক লণ্ঠন
আলোর দৃঢ় স্থাপনা
স্থায়ী নকশার লন্ঠন গৃহসজ্জার কাজে, প্রাকৃতিক দৃশ্য অথবা রাস্তা আলোকিত করতে ব্যবহৃত হয়। এগুলোর নকশা প্রাচীন কালের পরিবেশ তৈরি, রাস্তার আসবাবপত্রের সমন্বয়সাধন করা বা নান্দনিক বিবেচনার উন্নতি করতে ব্যবহৃত হতে পারে। এগুলো বিভিন্ন পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহের উপযোগী করে তৈরি করা হয়।
কিছু চার্জযোগ্য ফ্লুরোসেন্ট লন্ঠন সর্বদা প্লাগে যুক্ত থাকে এবং বিদ্যুৎ চলে গেলে জ্বলে ওঠে, যা কিছু ক্ষেত্রে একটি কার্যকর বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় (অথবা দূরবর্তী ব্যবহারের জন্য), কোন মোটরগাড়ির ১২-ভোল্ট ব্যাটারি বা একটি মাঝারি আকারের সৌর-চালিত চার্জার থেকে সম্পূরক রিচার্জিং সরবরাহ করা যেতে পারে। উন্নয়নশীল দেশ সৌর চালিত লণ্ঠন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, কারণ এগুলো কেরোসিন আলোর থেকে নিরাপদ এবং একটি সস্তা বিকল্প।[7]
ব্যাটারি চালিত লণ্ঠন
এ ধরনের লন্ঠন বহনযোগ্য আলোর উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এগুলো অধিক সুবিধাজনক, নিরাপদ, এবং জ্বালানি লন্ঠনের চেয়ে কম তাপ উৎপাদন করে।
এলইডি
এলইডি লন্ঠন বর্তমানকালে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কারণ এটি অন্যান্য ধরনের লন্ঠনের তুলনায় বেশি শক্তি-সাশ্রয়ী, অধিক আলোর জন্য উপযোগী এবং দামেও সস্তা।
গ্যালারী
- কুমড়া লণ্ঠন
- দুইটি কেরোসিন লণ্ঠন
- সিঁড়ির উপরে একটি ঝুলন্ত লণ্ঠন
- ভারতের ছত্তিশগড়ের গ্রামীণ এলাকায় একটি বৈদ্যুতিক লণ্ঠন।
- ওয়েকা পাস রেলওয়েতে এনজেড্র্র লন্ঠন
- ঋষিকেশে লণ্ঠন বা হ্যারিকেন
তথ্যসূত্র
- "lantern"। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি (অনলাইন সংস্করণ)। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। (Sসাবস্ক্রিপশন বা পার্টিশিপেটিং ইনস্টিটিউট মেম্বারশিপ প্রয়োজনীয়.)
- "Terry Pepper, Seeing the Light, Lighthouse of the western Great Lakes, Illumination."। ২০০৯-০১-২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-০৬।
- Wedgwood, Hensleigh (১৮৫৫)। "On False Etymologies"। Transactions of the Philological Society (6): 66।
- "A rare Roman lantern"। Colchester and Ipswich Museums। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ মার্চ ২০১৮। A Roman lantern from 43-300AD.
- "lantern jaw"। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি (অনলাইন সংস্করণ)। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। (Sসাবস্ক্রিপশন বা পার্টিশিপেটিং ইনস্টিটিউট মেম্বারশিপ প্রয়োজনীয়.)
- "Lantern jaw"। Collins English Dictionary। সংগ্রহের তারিখ ১৬ মার্চ ২০১৮।
- "Ashden Awards case study on solar-powered lanterns in India"। ২৮ আগস্ট ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুলাই ২০১৯।
গ্রন্থপঞ্জি
- নীধাম, জোসেফ (১৯৮৫)। Science and Civilisation in China: Paper and Printing। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। আইএসবিএন 978-0-521-08690-5।