রোধক

রোধক বা রেজিস্টর তড়িৎ বর্তনীতে ব্যবহৃত, দুই প্রান্ত বিশিষ্ট একপ্রকার যন্ত্রাংশ। এর কাজ হল তড়িৎ প্রবাহকে রোধ করা বা বাধা দেয়া। অর্থাৎ পরিবাহকের যে ধর্মের জন্য এর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ বা তড়িৎ প্রবাহ বিঘ্নিত বা বাধাপ্রাপ্ত হয় তাকে রোধ বলে। তড়িৎ বর্তনীতে থাকা অবস্থায় রোধক তার দুই প্রান্তের মধ্যে বিভব পার্থক্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে তড়িৎ প্রবাহকে বাধা দেয়।

চিত্র-১: রেজিস্টর বা রোধক

তত্ত্ব

রোধকত্ব

মূল নিবন্ধ পড়ুনঃ বৈদ্যুতিক রোধকত্ব ও পরিবাহীতা (Electrical resistivity and conductivity)

রোধকত্ব (Resistivity) বস্তুর একটি বৈশিষ্ট্য। কোন বস্তুর তড়িৎ আধানের (Electric Charge) প্রবাহকে কী পরিমাণ বাধা দিবে তা তার রোধকত্বের উপর নির্ভর করে। একক দৈর্ঘ্যের, একক (সুষম) প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট কোন বস্তুর রোধই ওই বস্তুর রোধকত্ব। যে পদার্থের রোধকত্ব যত বেশি সে পদার্থ তড়িৎ আধানের প্রবাহকে তত বেশি বাধা দেয়। সাধারণত ধাতব পদার্থের রোধকত্ব কম হয়।

বস্তুর রোধকত্ব তার তাপমাত্রার উপরও নির্ভরশীল। সাধারণত গ্রীক অক্ষর ρ (উচ্চারণ: রো) দ্বারা রোধকত্বকে প্রকাশ করা হয়। রোধকত্বের আন্তর্জাতিক একক ওহম-মিটার (Ohm-meter), সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয় 𝛀 m।[1][2][3]

রোধ

চিত্র-১.১: পরিবাহীর রোধ

একটি রেজিস্টর তড়িৎ প্রবাহকে কী পরিমাণ বাধা দিবে তা নির্ভর করে তার রোধের (Resistance) উপর। মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গমিটার সুষম প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট কোন পরিবাহীর রোধ নিম্নোক্ত সূত্র দিয়ে নির্ণয় করা যায়:

যেখানে,

তারটি যে পদার্থের তৈরি সেটির রোধকত্ব।
বস্তুটির রোধের মান।

ও'মের সূত্র

তড়িৎ বর্তনীতে অবস্থিত কোন পরিবাহীর রোধ, এর মধ্যদিয়ে প্রবাহিত তড়িৎ প্রবাহের পরিমাণ এবং এর দুই প্রান্তের মধ্যে বিভব পার্থক্য নিম্নোক্ত ও'মের সূত্র দ্বারা বর্ণনা করা যায়:[4]

যেখানে,

= বিভব পার্থক্য (Volt),
= তড়িৎ প্রবাহের পরিমাণ (Ampere) এবং
= রোধ (Ohm)

প্রকারভেদ

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে রেজিস্টরের শ্রেনীবিভাগ করা যায়। তা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ

রেজিস্ট্যান্সের ধরনের উপর ভিত্তি করে রেজিস্টর দুই ধরনের হয়ে থাকেঃ

১। স্থির মানের রেজিস্টর

২। পরিবর্তনশীল মানের রেজিস্টর (পটেনশিওমিটার এবং রিহোস্ট্যাট)

রেজিস্টিভ উপাদানের (যে উপাদানে রেজিস্টর তৈরী হয়) উপর ভিত্তি করে নিম্নলিখিত প্রকারের হয়ে থাকেঃ

১। কার্বন কম্পোজিশন রেজিস্টর (সর্বদা স্থির মানের হয়)

২। ওয়্যার উন্ড রেজিস্টর (স্থির ও পরিবর্তনশীল উভয় মানের হয়)

৩। ফিল্ম-টাইপ রেজিস্টর (স্থির ও পরিবর্তনশীল উভয় মানের হয়)

৪। সারফেস মাউন্ট রেজিস্টর (সর্বদা স্থির মানের হয়)

৫। ফিউজ্যাবল রেজিস্টর (সর্বদা স্থির মানের হয়)

৬। আলোক সংবেদনশীল রেজিস্টর (সর্বদা পরিবর্তনশীল মানের হয়)

৭। তাপ সংবেদনশীল রেজিস্টর (সর্বদা পরিবর্তনশীল মানের হয়)

শ্রেণী সমবায়

ধরা যাক, প্রতিটি রোধকের দুটি প্রান্তকে যথাক্রমে দ্বারা সূচিত করা হল । এখন যদি দুই বা ততোধিক রোধ এমনভাবে যুক্ত করা হয় যেন প্রথমটির -প্রান্ত দ্বিতীয়টির -প্রান্তে, দ্বিতীয়টির -প্রান্ত তৃতীয়টির -প্রান্তে সংযুক্ত থাকে ফলে প্রতিটি রোধের মধ্যদিয়ে একই তড়িৎ প্রবাহ প্রবাহিত হয় তাহলে এধরনের সমবায়কে শ্রেণী (Series) সমবায় বলা হয়। চিত্র-১.৩(ক) তে শ্রেণী সমবায় দেখান হয়েছে।

চিত্র-১.৩(ক): শ্রেণী সমবায় রোধ

শ্রেণী সমবায়ের ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি রোধের মধ্যদিয়ে একই তড়িৎ প্রবাহ প্রবাহিত হতে হবে। একই তড়িৎ প্রবাহ বলতে একই মানের তড়িৎ প্রবাহ বুঝান হয় না। চিত্র-১.৩(খ) তে , , এবং এর মধ্যদিয়ে একই তড়িৎ প্রবাহ প্রবাহিত হচ্ছে, তাই , , এবং রোধক চারটি বিন্দুর মধ্যে শ্রেণী সমবায়ে যুক্ত আছে।

চিত্র-১.৩(খ) এর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এবং এর মধ্যদিয়ে প্রবাহিত তড়িৎ প্রবাহ , বিন্দুতে এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যথক্রমে এর মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে । এখন কিন্তু , , এবং রোধক চারটি বিন্দুর মধ্যে শ্রেণী সমবায়ে যুক্ত নেই। কারণ, এবং রোধক দুটির মধ্যদিয়ে তড়িৎ প্রবাহ প্রবাহিত হলেও এবং রোধক দুটির মধ্যদিয়ে তড়িৎ প্রবাহ প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে, সংজ্ঞা অনুযায়ী, , , এবং রোধক চারটি বিন্দুর মধ্যে শ্রেণী সমবায়ে যুক্ত নেই। ঠিক একইরকম যুক্তি দিয়ে বলা যায় যে, , এবং রোধক তিনটি বিন্দুর মধ্যে শ্রেণী সমবায়ে যুক্ত নেই, এবং , এবং রোধক তিনটিও বিন্দুর মধ্যে শ্রেণী সমবায়ে যুক্ত নেই। কিন্তু এবং রোধক দুটি বিন্দুর মধ্যে শ্রেণী সমবায়ে যুক্ত আছে।

তূল্য রোধ

ধরা যাক, বিন্দুর মধ্যে বিভব পার্থক্য [চিত্র-১.৩(খ)]। এখন , , এবং রোধকগুলোর পরিবর্তে যদি মানের এমন একটি রোধক যুক্ত করা হয় যেন বিন্দুর মধ্যে বিভব পার্থক্য এবং এর মধ্যদিয়ে তড়িৎ প্রবাহ এর কোন পরিবর্তন হয় না তাহলে কে , , এবং এর শ্রেণী সমবায়ের তূল্যরোধ (Equivalent Resistance) বলা হয়।

যদি , , , ..., এবং রোধকসমূহ শ্রেণী সমবায়ে যুক্ত থাকে তবে তাদের তূল্যরোধ, এর মান নিম্নোক্ত সূত্রের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়,

সমান্তরাল সমবায়

যদি দুই বা ততোধিক রোধের একপ্রান্ত এক বিন্দুতে এবং অন্যপ্রান্ত অন্য আরেকটি বিন্দুতে সংযুক্ত থাকে ফলে প্রতিটি রোধের বিভব পার্থক্য সমান হয় তাহলে এধরনের সমবায়কে সমান্তরাল সমবায় বলা হয়।

সমান্তরাল সমবায় বর্তনীর বৈশিষ্ট্য

১। সমান্তরাল সমবায় বর্তনীতে ( রোধকের মান যাই হোক না কেন ) প্রত্যেক রোধকের আড়াআড়িতে বিভব পার্থক্য সমান থাকে ।

২। এই বর্তনীতে সমতুল্য রোধকের বিপরীত মান প্রত্যেক রোধকের বিপরীত মানের যোগফলের সমান ।

৩। এই বর্তনীতে বিদ্যুৎ প্রবাহ বিভক্ত হয়ে যায় এবং প্রত্যেক রোধকে আলাদাভাবে প্রবাহিত বিদ্যুতের সম্মিলিত যোগফল বর্তনীতে প্রবাহিত মোট বিদ্যুতের সমান।

[5]

রোধকের মান

রোধকের মান প্রকাশ করা হয় রোধ দিয়ে যার পরিমাপের একক হল ওহম। এগুলোর গায়ে রং এর যে রিং থাকে তা হতে এর মান বুঝা যায়। কালার কোড টির একটি সহজ সূত্র হলো: B B R O Y Good Boy Very Good Worker (০ ১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮ ৯)।

রোধকের কালার ব্যান্ড
রোধকের কালার কোড

সাধারণত ১ম ৩টি রিং থেকে মান বের করা হয়, ৩য় রিংটির মান অনুযায়ী ০ বসাতে হয়। এ ছাড়া কাল রং মানে কোন মান হবে না যেমন: Brown Black Brown মানে ১ - ০ অর্থাৎ এটি ১০ ও'মের রোধক। ৪ ও ৫ নং ব্যান্ড বা রিং টলারেন্স নির্দেশ করে। ৪নং এর রং অনুযায়ী তার মানের থেকে /১০% মান এদিক সেদিক হতে পারে।

রেজিস্টরের পাওয়ার রেটিং

পাওয়ার রেটিং বলতে কোনো রেজিস্টর কি পরিমাণ তাপ সহ্য করতে পারে তা বুঝায় । অর্থাৎ এটির মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ কত পরিমাণ কারেন্ট প্রবাহিত হতে পারবে । এটিকে ওয়াটে (watt) প্রকাশ করা হয় । যে সমস্ত জায়গায় বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয় সে সব ক্ষেত্রে বেশি ওয়াটের রেজিস্টর ব্যবহার করা হয় । কারণ, এক্ষেত্রে কম ওয়াটের রেজিস্টর ব্যবহার করলে রেজিস্টরটি তাড়াতাড়ি গরম হয় এবং জ্বলে নষ্ট হয়ে যায় । রেজিস্টরের ওয়াটেজ যত বেশি হয় রেজিস্টরটি তত বেশি বড় অর্থাৎ লম্বা এবং মোটা হয় । সার্কিটে নষ্ট রেজিস্টর পরিবর্তনের সময় অবশ্যই সম ওয়াট বা তারও বেশি ওয়াটের রেজিস্টর ব্যবহার করতে হয় । অর্থাৎ, P = (Imax)2×R ওয়াট

Imax =

এখানে,

P = রেজিস্টরের ওয়াট

Imax = সর্বোচ্চ নিরাপদ কারেন্ট (A)

R = রেজিস্টরের রেজিস্ট্যান্স (Ohm) [6]

রোধের কিছু বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্য

১। রেজিস্টর একটি দুই টার্মিনাল বিশিষ্ট ডিভাইস

২। এটি নন-পোলার ডিভাইস

৩। এটি লিনিয়ার ডিভাইস

৪। এটি প্যাসিভ ডিভাইস

সাধারণতঃ রেজিস্টরের রেজিস্ট্যান্স দুই টার্মিনালের মধ্যে ক্রিয়া করে এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এর দুটি টার্মিনাল থাকে বলে একে দুই টার্মিনাল ডিভাইস বলে। তবে কিছু পরিবর্তনশীল মানের রেজিস্টর আছে যাদের তিনটি টার্মিনাল রয়েছে, যেমন পটেনশিওমিটার এবং রিহোস্ট্যাট। কোন সার্কিটের দুটি অংশের মাঝে পরিবর্তনশীল মানের রেজিস্ট্যান্স প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিংবা ভোল্টেজ ডিভাইডার হিসাবে এগুলি ব্যবহার হয়। এগুলির কার্যকরী উপাদান রেজিস্টর হলেও এগুলিকে সরাসরি রেজিস্টর নামে অভিহিত করা হয় না বরং বলা হয় পটেনশিওমিটার এবং রিহোস্ট্যাট।

নন-পোলার বলতে বুঝায়, যার কোন পোলারিটি বা ধনাত্বক-ঋণাত্বক প্রান্ত নেই। অনুরূপ রেজিস্টরের কোন পোলারিটি নেই। একে যে কোন ভাবে সার্কিটে সংযুক্ত করা যায় অর্থাৎ রেজিস্টরকে সার্কিটে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে পোলারিটি বিবেচনা করার প্রয়োজন হয় না।

লিনিয়ার ডিভাইস বলতে এমন ডিভাইস বুঝায়, যার আড়াআড়িতে প্রযুক্ত ভোল্টেজ এবং উক্ত ভোল্টেজ সাপেক্ষে প্রবাহিত কারেন্টের মধ্যে সম্পর্ক সর্বদা সরল রৈখিক হয়।[7]

তথ্যসূত্র

  1. Lowrie (2007-09-20). Fundamentals of Geophysics. Cambridge University Press. pp. 254–. ISBN 978-1-139-46595-3.
  2. Narinder Kumar (2003). Comprehensive Physics XII. Laxmi Publications. pp. 282–. ISBN 978-81-7008-592-8.
  3. Eric., Bogatin,। Signal integrity : simplified। Prentice Hall Professional Technical Reference। আইএসবিএন 9780130669469।
  4. Robert A. Millikan and E. S. Bishop (1917). Elements of Electricity. American Technical Society. p. 54.
  5. জেনারেল ইলেকট্রিশিয়ান-১ । বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা-১২০৭ । পুনর্মুদ্রণ : ২০০৭ ইং । পৃষ্ঠা : ৭৬-৭৭ ।
  6. বেসিক ইলেকট্রনিক্স-১ । মৌ প্রকাশনী । পরিমার্জিত সংস্করণ : ১লা জানুয়ারী, ২০০৭ ইং । পৃষ্ঠা : ৭০।
  7. voltage lab
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.