রৈখিক গতি
একটি সরল রেখা বরাবর একমাত্রিক গতিই রৈখিক গতি। রৈখিক গতি শুধু একটি রেখা বরাবর গতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ায় একে স্থানের কেবল একটি মাত্রার (spatial dimension) মাধ্যমে গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। একে একমাত্রিক গতিও বলা হয়। ইংরেজি বলয়ে রৈখিক গতি বোঝাতে linear শব্দটির পাশাপাশি rectilinear শব্দটিও ব্যবহার করা হয়।[1] রৈখিক গতি দুই ধরনের হতে পারে: ধ্রুব বেগ বা শূন্য ত্বরণযুক্ত সুষম রৈখিক গতি এবং পরিবর্তনশীল বেগ বা অশূন্য ত্বরণযুক্ত অ-সুষম বা অসম রৈখিক গতি। একটি রেখা বরাবর কোনো কণার (বিন্দুপ্রতিম বস্তু) গতিকে এর অবস্থান -এর মাধ্যমে বর্ণনা করা যেতে পারে, যেখানে এই অবস্থান , সময় -এর পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয়। একটি সোজা ট্র্যাক বরাবর একজন দৌড়বিদের ১০০ মিটার দৌড়ানোকে রৈখিক গতির একটি উদাহরণরূপে ধরা যেতে পারে।[2]
সকল গতির মধ্যে রৈখিক গতি সবচেয়ে মৌলিক। নিউটনের প্রথম গতিসূত্র অনুযায়ী, নিট বল প্রযুক্ত হয়নি এমন একটি (গতিশীল) বস্তু যতক্ষণ পর্যন্ত একটি নিট বলের কার্যক্ষেত্র বা প্রয়োগক্ষেত্র হয়ে না উঠছে অর্থাৎ বস্তুটির ওপর যতক্ষণ পর্যন্ত নিট বল প্রযুক্ত না হচ্ছে, বস্তুটি ততক্ষণ পর্যন্ত একটি সরল রেখা বরাবর একটি ধ্রুব বেগ সহকারে চলতে থাকবে। আমাদের পরিপার্শ্বের দৈনন্দিন ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে, মাধ্যাকর্ষণ এবং ঘর্ষণের মতো বাহ্যিক বলগুলো বস্তুর গতির দিকের পরিবর্তন ঘটায়, যার কারণে এসব বস্তুর গতিকে রৈখিক হিসেবে বর্ণনা করা যায় না।[3]
রৈখিক গতিকে সাধারণ গতির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। সাধারণ গতির ক্ষেত্রে, কণার অবস্থান ও বেগকে সদিক রাশি বা ভেক্টরের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়, যেখানে সদিক রাশি হচ্ছে এমন একটি রাশি যার মান ও দিক উভয়ই রয়েছে। আর রৈখিক গতির ক্ষেত্রে, সিস্টেমের বর্ণনাকারী প্রতিটি ভেক্টরের দিক সমান বা একই এবং ধ্রুব, যার অর্থ হলো, বস্তুটি একই অক্ষ বরাবর গতিশীল এবং এর দিকের পরিবর্তন ঘটছে না। এই কারণে, সংশ্লিষ্ট ভেক্টরের দিক-উপাংশগুলোকে পরিহার করে এবং শুধু মান দিয়ে এ ধরনের সিস্টেমের বিশ্লেষণকে সোজাসাপ্টাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।[2]
সরণ
কোনো বস্তুর সকল কণা যদি একই সময়ের ব্যবধানে একই দিকে একই দূরত্ব অতিক্রম করে তাহলে বস্তুটির এই গতিকে চলন গতি বা স্থানান্তর গতি (translatory motion) বলা হয়। চলন গতি দু ধরনের হয়; যথা: সরল চলন গতি (rectilinear motion) এবং বক্র চলন গতি (curvilinear motion)। রৈখিক গতির ক্ষেত্রে এটি স্থানের কেবল একটি একক মাত্রা বরাবর সম্পন্ন হওয়ায়, এই গতিযুক্ত একটি বস্তুর নির্দিষ্ট দিকে অতিক্রান্ত দূরত্ব হবে সরণ ভেক্টরের অনুরূপ।[4] সরণের এসআই একক হলো মিটার[5][6] যদি কোনো বস্তুর আদি অবস্থান এবং শেষ অবস্থান হয়, তাহলে গাণিতিকভাবে এর সরণ হবে নিম্নরূপ:
ঘূর্ণন গতির ক্ষেত্রে সরণের অনুরূপ রাশি হলো রেডিয়ান এককে পরিমাপকৃত কৌণিক সরণ । কোনো বস্তুর সরণ বস্তুটির অতিক্রান্ত দূরত্ব অপেক্ষা বৃহত্তর হতে পারবে না; কারণ হলো, সরণও একটি দূরত্ব, বরং এটি হচ্ছে ক্ষুদ্রতম দূরত্ব। ঘর থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে কাজ শেষে কোনো ব্যক্তি আবারও ঘরে ফিরে এলে, তার অতিক্রান্ত দূরত্ব শূন্য না হলেও, তার সরণ কিন্তু শূন্য হবে। কারণ, তিনি যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেখানেই ফিরে এসে যাত্রা শেষ করেছেন।
বেগ
বেগ বলতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নির্দিষ্ট একটি দিকে সরণকে বোঝাানো হয়। একে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সরণের পরিবর্তনের হাররূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়।[7] বেগ দিকযুক্ত একটি রাশি, যা একটি দিকের এবং অবস্থান পরিবর্তনের হারের (মানের) প্রতিনিধিত্ব করে। বেগের মানকে বলা হয় দ্রুতি, যার এসআই একক হলো মিটার প্রতি সেকেন্ড বা [6]।
গড় বেগ
একটি চলমান বস্তু তার আদি অবস্থান থেকে শেষ অবস্থানে পৌঁছালে এর মোট সরণকে প্রয়োজনীয় মোট সময় দিয়ে ভাগই বস্তুটির গড় বেগ। একটি দূরত্ব অতিক্রম করতে যে অনুমিত বেগের প্রয়োজন এটা হচ্ছে সেই বেগ। গাণিতিকভাবে একে লেখা যায়:[8][9]
যেখানে,
- হলো সেই সময় যখন বস্তুটি অবস্থানে ছিল এবং
- হলো সেই সময় যখন বস্তটি অবস্থানে পৌঁছে
গড় বেগ -এর মান -কে গড় দ্রুতি বলা হয়।
আপেক্ষিক বেগ
দুটি গতিশীল বস্তুর মধ্যে তুলনামূলক যে বেগ তাই আপেক্ষিক বেগ।
তাৎক্ষণিক বেগ
নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সামগ্রিক গতির প্রতিনিধিত্বকারী গড় বেগের বিপরীতে, কোনো বস্তুর তাৎক্ষণিক বেগ সময়ের একটি বিশেষ মুহূর্তে বস্তুটির গতির অবস্থার বর্ণনা দেয়। সময়ের ব্যবধান শূন্যের সমীপবর্তী হলে গড় বেগের জন্য যে সীমান্তিক মান বের হবে সেটিই তাৎক্ষণিক বেগ। অক্ষ বরাবর গতির ক্ষেত্রে, সময়ের ব্যবধান -এর দৈর্ঘ্যকে শূন্যসন্নিকর্ষী ধরে তাৎক্ষণিক বেগকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যেখানে তাৎক্ষণিক বেগ হলো সময়ের ফাংশনের মতোই সরণের সময়-অন্তরজ
তাৎক্ষণিক বেগ -এর মানকে তাৎক্ষণিক দ্রুতি বলা হয়।
ত্বরণ
ত্বরণকে সময়ের সাপেক্ষে বেগের পরিবর্তনের হার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ত্বরণ হলো সরণের দ্বিতীয় অন্তরজ। অর্থাৎ, অবস্থানকে সময়ের সাপেক্ষে দুইবার ব্যবকলন করা হলে কিংবা, বেগকে সময়ের সাপেক্ষে একবার ব্যবকলন করা হলে ত্বরণ পাওয়া যায়।[10] ত্বরণের এসআই একক হলো মিটার প্রতি বর্গসেকেন্ড অর্থাৎ, [6]।
যদি সময় ব্যবধানে বেগের পরিবর্তন হয়, তাহলে গড় ত্বরণ -এর গাণিতিক রাশিমালা হবে:
এখন, তাৎক্ষণিক ত্বরণ হলো, সময় ব্যবধান হওয়ার শর্তাধীনে, ও -এর অনুপাতের লিমিট।
অর্থাৎ,
জার্ক
সময়ের সাপেক্ষে ত্বরণের পরিবর্তনের হার, অর্থাৎ সরণের তৃতীয় সময় অন্তরজ জার্ক নামে পরিচিত।[11] জার্কের এসআই একক হলো । যুক্তরাজ্যে এ রাশিটি জোল্ট নামেও পরিচিত।
জাউন্স
সময়ের সাপেক্ষে জার্কের পরিবর্তনের হার তথা সরণের চতুর্থ অন্তরজ জাউন্স নামে পরিচিত।[11] এর এসআই একক হলো , যাকে পড়া হয় মিটার প্রতি চতুর্ঘাতীসেকেন্ড। জাউন্সকে স্ন্যাপ নামেও অভিহিত করা হয়।
সৃতিবিদ্যার সমীকরণসমূহ
ধ্রুব ত্বরণের ক্ষেত্রে সময়, সরণ, বেগ ও ত্বরণ এই চারটি ভৌত রাশির পারস্পরিক সম্পর্ক গতির নিম্নোক্ত সমীকরণগুলোর মাধ্যমে নির্ধারণ করা যেতে পারে:[12][13][14]
এখানে,
হলো আদি বেগ
হলো শেষ বেগ
হলো ত্বরণ
হলো সরণ
এবং
হলো সময়
লেখচিত্রের মাধ্যমে এই সম্পর্কগুলো দেখানো যেতে পারে। সরণ বনাম সময় লেখচিত্রে রেখার (সরণের) নতিমাত্রা বেগের প্রতিনিধিত্ব করে। বেগ বনাম সময় লেখচিত্রের নতিমাত্রা ত্বরণকে নির্দেশ করে। বেগ বনাম সময় লেখচিত্রের আবদ্ধ ক্ষেত্র থেকে সরণ পাওয়া যায়। এবং ত্বরণ বনাম সময়-এর লেখের অধীনস্থ ক্ষেত্র থেকে বেগের পরিবর্তন পাওয়া যায়।
বৃত্তীয় গতির সাথে তুলনা
তালিকাভুক্ত সমীকরণগুলো নির্দিষ্ট অক্ষের সাপেক্ষে ঘূর্ণনরত দৃঢ় বস্তুর ক্ষেত্রে নির্দেশ করা হয়েছে। এখানে, হলো আর্ক দৈর্ঘ্য, হলো অক্ষ থেকে যেকোনো বিন্দুর দূরত্ব, এবং হলো স্পর্শকীয় ত্বরণ, যা ত্বরণের উপাংশ এবং গতির দিকের সাথে সমান্তরাল। পক্ষান্তরে, কেন্দ্রমুখী বল , যা গতির দিকের সাথে লম্ব। গতির সমান্তরাল দিকে তথা, অক্ষের যে বিন্দুতে বল প্রয়োগ করা হচ্ছে সেই বিন্দুর সাথে যুক্ত রেখার লম্ব দিকে বলের উপাংশ হলো । সমষ্টিটি, থেকে সংখ্যক কণা এবং/অথবা বিন্দুর জন্য প্রয়োজ্য।
রৈখিক গতি | ঘূর্ণন গতি | সংজ্ঞা নির্দেশক সমীকরণ |
---|---|---|
সরণ = | কৌণিক সরণ = | |
বেগ = | কৌণিক বেগ = | |
ত্বরণ = | কৌণিক ত্বরণ = | |
ভর = | জড়তা = | |
বল = | টর্ক = | |
ভরবেগ = | কৌণিক ভরবেগ = | |
গতিশক্তি = | গতিশক্তি = | |
নিচের ছকে রৈখিক গতি এবং ঘূর্ণন গতির এসআই এককগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য দেখানো হলো:
রৈখিক গতির রাশির নাম | একক | ঘূর্ণন গতির রাশির নাম | একক |
---|---|---|---|
সরণ | মিটার | কৌণিক সরণ | রেডিয়ান |
বেগ | ? | কৌণিক বেগ | ? |
ত্বরণ | ? | কৌণিক ত্বরণ | ? |
ভর | কেজি | জড়তা | ? |
বল | নিউটন | টর্ক | ? |
ভরবেগ | ? | কৌণিক ভরবেগ | ? |
গতিশক্তি | জুল | গতিশক্তি | ? |
তথ্যসূত্র
- Resnick, Robert and Halliday, David (1966), Physics, Section 3-4
- "Basic principles for understanding sport mechanics"। ২৮ জুন ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ এপ্রিল ২০২২।
- "Motion Control Resource Info Center"। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জানুয়ারি ২০১১।
- "Distance and Displacement"।
- "SI Units"। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ এপ্রিল ২০২২।
- "SI Units"।
- Elert, Glenn (২০২১)। "Speed & Velocity"। The Physics Hypertextbook।
- "Average speed and average velocity"।
- "Average Velocity, Straight Line"।
- "Acceleration"। ২০১১-০৮-০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- "What is the term used for the third derivative of position?"।
- "Equations of motion" (পিডিএফ)।
- "Description of Motion in One Dimension"।
- "What is derivatives of displacement?"।
- "Linear Motion vs Rotational motion" (পিডিএফ)।