রমা চৌধুরী

রমা চৌধুরী (১৪ অক্টোবর, ১৯৪১ - ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতিত একজন বীরাঙ্গনা।[1][2] ১৯৭১ সালের ১৩ মে ভোরে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিজ বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হন। সম্ভ্রম হারানোর পর পাকিস্তানি দোসরদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে আত্মরক্ষা করেছিলেন। হানাদাররা গানপাউডার লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তার ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ। তিনি তার উপর নির্যাতনের ঘটনা একাত্তরের জননী নামক গ্রন্থে প্রকাশ করেন।[2]

রমা চৌধুরী
জন্ম(১৯৪১-১০-১৪)১৪ অক্টোবর ১৯৪১
মৃত্যু৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮(2018-09-03) (বয়স ৭৬)
জাতীয়তাবাংলাদেশি
শিক্ষাস্নাতকোত্তর
মাতৃশিক্ষায়তনঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পেশাশিক্ষিকা, লেখিকা
সন্তান
পুরস্কারবেগম রোকেয়া পদক ২০১৮ (মরণোত্তর)

জন্ম ও কর্মজীবন

রমা চৌধুরী ১৯৪১ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ)।[1] তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।[1] রমা চৌধুরী ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কর্মজীবন শুরু করেন। পরে দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।[2]

মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তিন পুত্রসন্তানের জননী।[3] থাকতেন পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায়। তার স্বামী ভারতে চলে যান। ১৩ মে সকালবেলা পাকিস্তানি হানাদাররা এসে চড়াও হয় তার ঘরে। তাকে জোর করে নিয়ে যায় পাশের নির্জন ঘরে। হারান সম্ভ্রম। সন্তানের মায়ায় আত্মহনন থেকে নিবৃত্ত থাকলেও মানসিক এক অসীম কষ্ট সেই থেকে বয়ে বেড়ান। সম্ভ্রম হারানোর পর তাদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে যখন আত্মরক্ষার জন্য লুকিয়েছেন, তখন হানাদাররা গানপাউডার লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তার ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ। ঘরবাড়িহীন বাকি আটটি মাস তাকে তিনটি শিশুসন্তান আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াতে হয়েছে। রাতের বেলায় পোড়া ভিটায় এসে কোনোমতে পলিথিন বা খড়কুটো নিয়ে মাথায় আচ্ছাদন দিয়ে কাটিয়েছেন। এসব ঘটনার বিবরন পাওয়া যায় তার লেখা একাত্তরের জননী গ্রন্থে।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সংগ্রাম

১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আগের রাতে ১৫ ডিসেম্বর থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তার সন্তান সাগরের। ২০ ডিসেম্বর রাতে মারা যায় সাগর।[2] একাত্তরের জননী গ্রন্থের ২১১ পৃষ্ঠায় রমা চৌধুরী লিখেছেন, “ঘরে আলো জ্বলছিল হ্যারিকেনের। সেই আলোয় সাগরকে দেখে ছটফট করে উঠি। দেখি তার নড়াচড়া নেই, সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে, নড়চড় নেই। মা ছটফট করে উঠে বিলাপ ধরে কাঁদতে থাকেন, `আঁর ভাই নাই, আঁর ভাই গেইয়্যে গোই” (আমার ভাই নেই, আমার ভাই চলে গেছে)। একই অসুখে আক্রান্ত দ্বিতীয় সন্তানও। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্ধউন্মাদিনী রমা চৌধুরী নিজের ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তার শ্বাসরোধ হয়ে যায়। এতে মারা যায় টগর। প্রথম সংসারের পরিসমাপ্তির পরে দ্বিতীয় সংসার বাঁধতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।

১৯৭১ পরবর্তী পেশা

স্বাধীনতার পরে ২০ বছর তিনি লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। প্রথমে তিনি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তার জীবন-জীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে বর্তমানে তিনি নিজের ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।[1][2]

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ

  • একাত্তরের জননী।
  • ১০০১ দিন যাপনের পদ্য।
  • আগুন রাঙা আগুন ঝরা অশ্রু ভেজা একটি দিন।
  • ভাব বৈচিত্রে রবীন্দ্রনাথ।
  • অপ্রিয় বচন।
  • লাখ টাকা।
  • হীরকাঙ্গুরীয়।

রমা চৌধুরীর সামাজিক আচরণ

তার তিন সন্তানকেই ধর্মীয় রীতিমতো সমাধিস্তত করা হয়েছে । মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পরেননি রমা চৌধুরী। এরপর নিকটজনের পীড়াপিড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পড়া শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাবার পর আবার ছেড়ে দিয়েছেন জুতো পায়ে দেয়া। এরপর ১৫ বছর ধরে জুতো ছাড়াই চলেন রমা চৌধুরী।

মৃত্যু

২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বাসায় পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাড়ের ব্যথাসহ নানা রোগে ভোগার পর ২০১৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর সোমবার ভোররাত ৪টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন একাত্তরের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।[4]

সমাধি

রমা চৌধুরীর শেষ ইচ্ছা অনুসারে বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে তার সন্তান টুনুর সমাধির পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।[5]

তথ্যসূত্র

  1. শরিফুল হাসান (জুলাই ২৭, ২০১৩)। "প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কষ্ট বিনিময় রমা চৌধুরীর"দৈনিক প্রথম আলো। কারওয়ান বাজার, ঢাকা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ জুলাই ২০১৩
  2. খোকন, আলাউদ্দিন (১৫ ডিসেম্বর ২০১০)। "একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী"দৈনিক প্রথম আলো। ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮
  3. "প্রধানমন্ত্রীকে কষ্টের কথা বলে কাঁদলেন রমা চৌধুরী"। ৩০ জুলাই ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ জুলাই ২০১৩
  4. "চলে গেলেন রমা চৌধুরী"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৯-০৩
  5. "ছেলের পাশে চিরঘুমে রমা চৌধুরী"বিডিনিউজটুয়েন্টিফোর। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৯-০৩
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.