রঘুনাথ শিরোমণি

রঘুনাথ শিরোমণি (IAST: Raghunātha Śiromaṇi) (আনু. ১৪৭৭ – ১৫৪৭[1]) চৈতন্য সমসাময়িক যুগে নবদ্বীপ[2] তথা ভারতের অন্যতম প্রধান নৈয়ায়িক, দার্শনিক ও সংস্কৃত পণ্ডিত। পঞ্চদশ শতকের আনুমানিক ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। অন্য একটি মতে, তাঁর জন্ম সিলেটের পঞ্চখণ্ডে।[3] খুব অল্প দিনের মধ্যেই তিনি ভারতখ্যাত নৈয়ায়িক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি নবদ্বীপকে নব্য ন্যায় চর্চার প্রাণকেন্দ্র করে তোলেন, যা ভারতীয় যুক্তি শাস্ত্রের চূড়ান্ত উন্নয়নকল্পে প্রতিনিধিত্বমূলক স্থান অর্জন করে।

রঘুনাথ শিরোমণি
স্থানীয় নাম
রঘুনাথ, ‘কানভট্ট’ শিরোমণি
জন্মখ্রিস্টীয় ১৫ শতক, আনু ১৪৭৭
নবদ্বীপ, নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ
মৃত্যু১৫৪৭
পেশা
  • নৈয়ায়িক
  • স্মার্ত পণ্ডিত
  • শাস্ত্রজ্ঞ লেখক
ভাষাবাংলা,সংস্কৃত
বাসস্থাননবদ্বীপ
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি
  • অনুমানদীধিতি
  • প্রত্যক্ষমণিদীধিতি
  • শব্দমণিদীধিতি
  • নঞবাদ
  • আখ্যাতবাদ

শিক্ষাজীবন

ছোটবেলায় মাত্র চার বছর বয়সে তার পিতৃবিয়োগ ঘটলে তার মা খুব কষ্ট করে তাকে লালন পালন করেন। সেই সময় ছেলের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় পেলে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি মায়ের আদেশে বাসুদেব সার্বভৌমের কাছে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যায়। রঘুনাথ শিরোমণি বাসুদেব সার্বভৌমের শিষ্য ছিলেন বলে জানা যায়। ছাত্রাবস্থায় ব্যঞ্জনবর্ণ পাঠ কালেই তিনি খুব তাড়াতাড়ি ব্যাকরণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করেন। সার্বভৌম তাঁকে ব্যাঞ্জনবর্ণ শেখানোর সময় রঘুনাথ ‘ক’-এর পর ‘খ’ হয় কেন?, দুটি ‘জ’,দুটি ‘ন’, দুটি ‘ব’ এবং তিনটি ‘শ’ কেন হয় এই প্রশ্ন করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। পরবর্তীকালে তিনি পক্ষধর মিশ্রের কাছে ন্যায়শাস্ত্র শিখতে মিথিলায় যান। ছোটবেলায় পোকার কামড়ে তার একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি চলে যাওয়ায়[4] তার অপর নাম ‘কানভট্ট’ শিরোমণি ছিল বলে অনেকে মনে করেন।[5] পক্ষধর মিশ্রের টোলে গেলে তিনি ‘ইন্দ্রের সহস্র চোখ, আমার দুটি। শিবের তিনটি চোখ, আর ওখানে ওই একচোখোটি কে?’ বলে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। তার প্রত্যুতরে রঘুনাথ বলে ‘যিনি অন্ধকে দেখতে শেখান, পণ্ডিতকে জ্ঞানের আলো দেখান, তিনিই আমার শিক্ষক হতে পারেন। অন্য কেউ নন। ’[4] এরপর পক্ষধর তাঁকে শিষ্য করেন। এরপর রঘুনাথ নৈয়ায়িক পক্ষধর মিশ্রের বিভিন্ন ভুল ধরিয়ে দিতে থাকে, এবং পক্ষধর মিশ্র রঘুনাথের কাছে নতি স্বীকার করেন। একদিন পক্ষধরের স্ত্রী তার স্বামীকে কৌতূহলবশত শরতের চাঁদের আলোর চেয়েও উজ্জ্বল ও দীপ্ত কিছু আছে নাকি জিজ্ঞাসা করলে, পক্ষধর বলেন- "আমার কাছে নবদ্বীপ থেকে রঘুনাথ নামে এক ছাত্র এসেছিল; তার বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্য ও দীপ্ততা শরতের চন্দ্রিমার মাধুর্যের চেয়েও অধিক।"[6] রঘুনাথ শিরোমণি মিথিলায় নবদ্বীপের ন্যায়চর্চার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে নবদ্বীপে ফিরে আসেন।[7] এই ঘটনা ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ হয়েছে বলে মনে করা হয়।[8] এই জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার ‘বাঙালী’ কবিতায় লেখেন- ‘‘...পক্ষধরের পক্ষশাতন করি, বাঙালীর ছেলে ফিরে এল ঘরে যশের মুকুট পরি। ’’[9]

মতান্তরে, রঘুনাথ শিরোমণি পক্ষাধরের ছাত্র ছিলেননা। মিথিলার নৈয়ায়িক পক্ষধর মিশ্র ন্যায়চর্চার সভা আয়োজন করলে নবদ্বীপের নৈয়ায়িক হিসেবে মধ্যমণি বাসুদেব সার্বভৌমের নিমন্ত্রণ আসে। বাসুদেব নিজে সেই বিচার সভায় না গিয়ে রঘুনাথ শিরোমণি সহ তার আরও দুই শিষ্যকে মিথিলায় পাঠান।[10] সেখানে গিয়ে তারা পরিচয় দেয়-

মিথিলার নৈয়ায়িকগণ এবং রঘুনাথেরা তর্কযুদ্ধ শুরু করলে মিথিলাপক্ষ বিপর্যস্ত হয়ে যায়। তখন পক্ষধর তর্কে অংশগ্রহণ করলেও রঘুনাথের যুক্তির জালে আটকে যান। স্বভাব কবি পক্ষধর তখন ক্ষিপ্ত হয়ে শ্লেষাত্মক শ্লোক রচনা করে আক্রমণ করেন- বক্ষোজপানকৃৎ কাণ ! সংশয়ে জাগ্রতি স্ফুটং। সামান্যলক্ষণা কম্মাদকম্মাদবলুপ্যতে। [11] তখন ন্যায়াধিক বিচারক তর্কযুদ্ধ সমাপ্ত করে ঘোষণা করেন মৈথিলী বৃদ্ধ পণ্ডিত পরাজিত হয়েছেন, কারণ তার যুক্তিতর্ক নৈব্যক্তিক নয়।[12]

কর্মজীবন

রঘুনাথ শিরোমণি নৈয়ায়িক পক্ষধর মিশ্রকে পরাজিত করে মিথিলায় নবদ্বীপের ন্যায়চর্চার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে নবদ্বীপে ফিরে আসেন ও হরি ঘোষ মহাশয়ের সাহায্যে নবদ্বীপে চতুষ্পাঠী স্থাপন করে অধ্যাপনা শুরু করেন।[13] তার অন্যতম দু’জন ছাত্র হল মথুরানাথ ও রামভদ্র। অনেকে রামভদ্রকে তার পুত্র মনে করেন। তবে কেউ রঘুনাথ শিরোমণিকে বিবাহের কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন- পুত্র ও কন্যার জন্যই বিবাহের প্রয়োজন। ‘ব্যুৎপত্তি-বাদ’ আমার পুত্র এবং ‘লীলাবতী’ আমার কন্যা।

সাহিত্যকর্ম

রঘুনাথ শিরোমণি রচিত যে এগারোটি অমূল্য গ্রন্থ তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল সেগুলি হল[3]-

  • অনুমানদীধিতি
  • প্রত্যক্ষমণিদীধিতি
  • শব্দমণিদীধিতি
  • আখ্যাতবাদ[14]
  • নঞবাদ
  • পদার্থখন্ডন
  • দ্রব্যকিরণাবলীপ্রকাশদীধিতি
  • গুণকিরণাবলীদীধিতি
  • আত্মতত্ত্ববিবেকদীধিতি
  • ন্যায়লীলাবতীপ্রকাশদীধিতি
  • মলিম্লু চ বিবেক

এছাড়া তত্ত্বচিন্তামণিদীধিতিটীকা, পদার্থতত্ত্ব-নিরূপণ[15], পদার্থরত্নমালা, আত্মতত্ত্ব-বিবেক টীকা, ব্যুৎপত্তিবাদ লীলাবতী টীকা, খণ্ডন-খণ্ড খাদ্য টীকা, ক্ষণভঙ্গুর বাদ, প্রামাণ্যবাদ, আখ্যাত-বাদ, ন্যায়কুসুমাঞ্জলি-টীকা, ন্যায়লীলাবতী-বিভূতি,ব্রহ্মসূত্র বৃত্তি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে অনুমানদীধিতি তার সর্বশ্রেস্ত রচনা। এই গ্রন্থের প্রতি পাতায় তার প্রতিভার প্রস্ফুটন ঘটেছে। তার রচিত আত্মতত্ত্ববিবেকদীধিতি গ্রন্থটি এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক মুদ্রিত হয়।

তথ্যসূত্র

  1. Vidyabhusana, Satis Chandra (১৯৮৮)। A History of Indian Logic: Ancient, Mediaeval and Modern Schools (ইংরেজি ভাষায়)। Motilal Banarsidass Publishe। পৃষ্ঠা ৪৬৩। আইএসবিএন 978-81-208-0565-1।
  2. "Raghunatha Shiromani | Indian philosopher"Encyclopedia Britannica (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪
  3. Ltd, IT Lab Solutions। "রঘুনাথ শিরোমণি নৈয়ায়িক পণ্ডিত ন্যায় শাস্ত্রের প্রবর্তক"dibalok.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪
  4. অশ্বঘোষ। "ন্যায়শাস্ত্র পড়া হত হরি ঘোষের গোয়ালে"anandabazar.com। ২০২০-০৬-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪
  5. Sanyal, Narayan (১৯৯০)। Rupamanjari। Dey's। পৃষ্ঠা ২১৬।
  6. দত্ত, রমেশচন্দ্র (১৮৯৫)। The Literature Of Bengal। পৃষ্ঠা ৮৭।
  7. "সম্পাদক সমীপেষু"anandabazar.com। ২০২০-০৬-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-১৪
  8. Mahamahopadhyaya Satis Chandra Vidyabhusana (১৯২০)। A History of Indian Logic (Ancient, Mediaeval and Modern Schools) (English ভাষায়)। Library Genesis। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা ৪৬৪। আইএসবিএন 978-81-208-0565-1।
  9. Sanyal, Narayan (১৯৯০)। Rupamanjari। Dey's। পৃষ্ঠা ২১৫।
  10. Basu, Nagendranath (১৯০৫)। Biswakosh Vol.16
  11. Bhattacharjya, Dineshchandra (১৯৫১)। Bangalir Saraswat Abadan Part. 1
  12. Sanyal, Narayan (১৯৯০)। Rupamanjari। Dey's। পৃষ্ঠা ২১৭।
  13. দত্ত, রমেশচন্দ্র (১৮৭৭)। Cultural Heritage Of Bengal। কলকাতা: পুঁথি পুস্তক প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ৬১।
  14. Śiromaṇi, Raghunātha (১৯৭৯)। Akhyatavada of Raghunatha Siromani : with Akhyatavada-vyakhya of Ramabhadra Sarvabhauma, treatise, with a classical commentary, on Sanskrit semantics, presenting the viewpoint of the neo-Nayaya school in Hindu philosophy (সংস্কৃত ভাষায়)। Sanskrit Pustak Bhandar।
  15. Potter K H (১৯৫৭)। Padarthatattvanirupanam of Raghunatha Siromani (English ভাষায়)। Cambridge: Harvard Univ. Press।
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.