রঘুনন্দন ভট্টাচার্য্য

রঘুনন্দন ভট্টাচার্য্য চৈতন্য মহাপ্রভু সমসাময়িক যুগের বাঙালি শাস্ত্রজ্ঞ স্মার্ত্ত পণ্ডিত ও বিখ্যাত লেখক ছিলেন। তিনি খ্রিস্টীয় ১৬ শতকে চৈতন্য মহাপ্রভু জন্মের প্রায় ২৫ বছর পর নবদ্বীপ ধামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নিবাস ছিলো নবদ্বীপ। পূর্ব ভারতের অধিকাংশ হিন্দু অনুষ্ঠান,পূজা এবং পার্বণগুলো তাঁর লিখিত শাস্ত্র ও গ্রন্থগুলোর বিধান অনুসারেই অনুষ্ঠিত হয়। তিনি অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেন। রঘুনন্দন দুর্গাপুজোর বিধান সম্পর্কিত তিনটি গ্রন্থ রচনা করেন।[1]

রঘুনন্দন ভট্টাচার্য্য
স্থানীয় নাম
স্মার্ত্ত ভট্টাচার্য/স্মার্ত্ত রঘুনন্দন
জন্মখ্রিস্টীয় ১৬ শতক
নবদ্বীপ, নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ, চৈতন্য সমসাময়িক যুগ
পেশা
  • স্মার্ত পণ্ডিত
  • শাস্ত্রজ্ঞ লেখক ও বিধানদাতা
ভাষাবাংলা,সংস্কৃত
বাসস্থাননবদ্বীপ
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি
  • অষ্টবিংশতিতত্ত্ব
  • দুর্গোৎসবতত্ত্ব
  • দুর্গাপূজাতত্ত্ব
  • কৃত্যতত্ত্ব
  • মলমাসতত্ত্বম

প্রথম জীবন

রঘুনন্দন চৈতন্য মহাপ্রভু আবির্ভাবের প্রায় ২৫ বৎসর পর নবদ্বীপে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ভট্টাচার্য্য। হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ভট্টাচার্য স্মৃতিশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। নবদ্বীপে তাঁর সংস্কৃত টোল ছিল। রঘুনন্দন মাত্র ২৫ বছর বয়সে স্মৃতিগ্রন্থ বা "অষ্টবিংশতিতত্ত্ব' প্রণয়ন করেন। এই ২৫ বৎসর বয়সেই তিনি কঠোর পরিশ্রম করে নানা দেশ ভ্রমণ করে, নানাবিধ শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলিত করে এই গ্রন্থটি রচনা করেন। এই গ্রন্থটি প্রণয়নের পর অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, কাঞ্চীদেশ, কাশীদেশ ও দ্রাবিড় দেশে স্মার্ত্ত পণ্ডিত বা স্মার্ত্ত রঘুনন্দন নামে তাঁর যশ ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।[2]

শেষ জীবন

"অষ্টবিংশতিতত্ত্ব" গ্রন্থ রচনার কয়েক বছর পর তিনি পিতৃপুরুষের পিণ্ডদানের জন্য গয়াধাম যান। কিন্তু, পিণ্ডদানের জন্য পাণ্ডারা অধিক অর্থ দাবি করলে তিনি গয়াক্ষেত্রে পরিমাপ এক ক্রোশ পরিমাপ করে একেবারে শেষ প্রান্তরে এসে পিণ্ডদান করতে উদ্যত হন। পাণ্ডারা পণ্ডিতের আসল পরিচয় পেয়ে বিপদে পড়েন। পাণ্ডারা দেখলেন যদি স্মার্ত্ত ভট্টাচার্য্য মাঠেই পিণ্ডদান করেন তাহলে পাণ্ডা সমাজের ঘোর বদনাম ঘটে যাবে। তাই তাঁরা পণ্ডিতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নম্র ব্যবহারে পণ্ডিতকে সন্তুষ্ট করে মন্দিরেই পিণ্ড দানের ব্যবস্থা করেন। রঘুনন্দন পণ্ডিত সারা জীবন শাস্ত্রালোচনা ও গ্রন্থরচনার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে আনুমানিক ৭০ বছর বয়সে প্রাণ ত্যাগ করেন।

বাঙালি হিন্দু সমাজ সংস্কারে ভূমিকা

ষোড়শ শতকে নবাব হোসেন শাহের অত্যাচারে বাংলার হিন্দু সমাজ বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিল। নবাব ও উচ্চবর্ণের সমাজপতিদের যুগপৎ অত্যাচারে বিশেষতঃ নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন/করতে বাধ্য হন। রঘুনন্দন ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু সমাজকে রক্ষা করতে হিন্দুসমাজ সংস্কারমূলক গ্রন্থ "অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব"(স্মৃতিগ্রন্থ) প্রণয়ন করেন। তৎকালীন হিন্দু সমাজের সাথে রঘুনন্দনের স্মৃতিগ্রন্থের মতবাদের বিরোধ বাধায় বাংলার বহু পণ্ডিত তাঁর বিরুদ্ধে বিচারসভা বসান। কিন্তু, রঘুনন্দন বিচারে জয়ী হন। তাঁর খ্যাতি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে শিষ্য হওয়ার জন্য লোকেরা আসতে থাকেন। শিষ্যরা তাঁর "অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব" (স্মৃতিগ্রন্থ) অধ্যয়ন ও প্রচার শুরু করেন ।স্বল্প সময়ের মধ্যে এই গ্রন্থ বাংলার হিন্দুর সমাজের মধ্যে আদৃত হয়। হিন্দু সমাজের শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকাণ্ড "অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব" অনুসারে সম্পন্ন হতে থাকে।

দুর্গোৎসবের বিধান

রঘুনন্দন নির্দেশিত পূজা পদ্ধতি অনুযায়ী বর্তমান কালের অধিকাংশ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি দুর্গোৎসব সম্পর্কিত তিনটি গ্রন্থ রচনা করেন, সেগুলি যথাক্রমে "দুর্গোৎসব তত্ত্ব", "দুর্গাপূজা তত্ত্ব" ও "কৃত্যতত্ত্ব"। গ্রন্থগুলিতে তন্ত্র ও পুরাণের উল্লেখ এবং প্রভাব উল্লেখনীয়। গ্রন্থগুলিতে তান্ত্রিক আচার অনুষ্ঠানকে পূজার অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।রঘুনন্দন গ্রন্থগুলিতে দুর্গোৎসবের সাতটি কল্পের বিধান দিয়েছেন। সেই গুলি হলো যথাক্রমে কৃষ্ণনবম্যাদি কল্প, প্রতিপদাদি কল্প, ষষ্ঠ্যাদি কল্প, সপ্তম্যাদি কল্প, মহাষ্টম্যাদি কল্প, কেবল অষ্টমী এবং কেবল নবমী কল্প। এর মধ্যে বঙ্গদেশ, বিহার, ওড়িশা এবং আসাম অঞ্চলে ষষ্ঠ্যাদিকল্প বহুল প্রচলিত। রঘুনন্দনের মতানুসারে ষষ্ঠ্যাদি কল্পে ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় বেলগাছের তলায় দেবীর বোধন সম্পন্ন হয়, তারপর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। ওই দিনের পূজা হয় ঘটে, পরের দিন অর্থাৎ সপ্তমী থেকে নবমী অবধি মৃন্ময়ী প্রতিমায় পূজাপাঠ হয়। রঘুনন্দনের মতে দুর্গোৎসবের সকল তিথির পূর্বে "মহা" বিশেষণটি যোগ করা যায় না। যেমন- "মহাষষ্ঠী" ও "মহাসপ্তমী" কথা দুটি মোটেও শাস্ত্রসম্মত নয়। রঘুনন্দনের মতানুসারে কেবল অষ্টমী ও নবমী তিথি দুটি এই অভিধা পেতে পারে, অর্থাৎ মহাষ্টমী ও মহানবমী। রঘুনন্দন বলেছেন

অর্থাৎ মহাশক্তি দুর্গার আবির্ভাবে মহাবিপদ কেটে গেলো বলে অষ্টমী তিথির নাম হলো মহাষ্টমী এবং মহাসম্পদ লাভ হলো বলে নবমী তিথি হলো মহানবমী।[1]

বাংলা পঞ্জিকা প্রবর্তন

খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন ও রাঘবানন্দ যৌথভাবে প্রথম বাংলা পঞ্জিকা প্রণয়ন করেন। পরে সে পঞ্জিকা নবদ্বীপ পঞ্জিকা নামে পরিচিত হয়। কারণ সেই যুগে নদিয়া জেলার নবদ্বীপ ছিল হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র। ভারতে মুদ্রণযন্ত্র এসেছে প্রায় সমসাময়িক কালেই কিন্তু তখনও পর্যন্ত তা বঙ্গদেশে এসে পৌঁছয়নি বলে, রঘুনন্দন-রাঘবানন্দদের ওই পঞ্জিকা ছিল পুঁথি আকারে এবং হাতে লেখা।[3]

মলমাসের ধারণা ও গণনা

তিনি প্রথম "মল" বা "অধিক" মাসের ধারণা দেন। এই বিষয়ে স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন ‘মলমাসতত্ত্বম’ গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন, যদি সূর্য এক রাশিতে অবস্থিত থেকে দু’টি অমাবস্যা তিথিকে অতিক্রম করে তা হলে সেই মাসকেই মলমাস বলে। মলমাসের অর্থ অধিকমাস।[4]

তথ্যসূত্র

  1. স্বামী দিব্যানন্দ। দুর্গাপূজার দু এক কথা (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮
  2. dspace (পিডিএফ)। ৩০ মার্চ ২০১৫ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮
  3. "নববর্ষ ও বাংলা পঞ্জিকা ৩"Eisamay Blog। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৯-২৮
  4. "মঙ্গলে শুরু মলমাস। কেউ বশ করতেই পারে আপনাকে, শাস্ত্র জেনে সাবধান থাকুন"ebela.in। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৯-২৮
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.