যাচাইকরণ নীতি
যাচাইকরণ নীতি হলো যৌক্তিক ইতিবাদী দার্শনিকদের ভাষা বিশ্লেষণ ও পরিষ্করণের নীতি। এ-নীতি প্রয়োগ করে তারা অধিবিদ্যা তথা এর ভাষার অসারতা প্রমাণ করেন। দার্শনিকমহলে এ-নীতির ব্যাপক প্রিয়তা রয়েছে। কোনোকোনো লেখক একে যাচাইকরণবাদ, যাচাইকরণের মূলনীতি (Verification Principle) হিসেবেও উল্লেখ করেন।
যাচাইকরণ নীতি ও মরিস শ্লিক
মরিস শ্লিক বাক্যের অর্থ নিরূপণের উপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করেন, বাক্যের অর্থ তার যাচাই বা পরখ করার পদ্ধতিতেই নিহিত বলে তিনি মনে করেন। যাচাই করার অর্থ হচ্ছে যাচাই করার সম্ভাব্যতা। কোন বাক্য যদি নীতিগতভাবে অপরখযোগ্য হয়, তবে তা অর্থহীন হয়ে পড়ে। তিনি উল্লেখ করেন, অধিবিদ্যক বাক্যগুলো অর্থহীন, কারণ এইসব বাক্য প্রচলিত ভাষা প্রয়োগের নিয়ম ও যৌক্তিক নিয়মাবলি খণ্ডন করে। এইসব বাক্যের অর্থ প্রতিপাদন করা কোনোভাবেই যাচাই করার সম্ভাব্যতার আওতায় পড়ে না।[1] যাচাইকরণ নীতি সংকীর্ণ ও ব্যাপক অথবা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ- এই দু’অর্থে ব্যবহৃত হয়। সংকীর্ণ অর্থে অর্থপূর্ণ উক্তিকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সত্য বা মিথ্যা বলে প্রতিপাদনযোগ্য হতে হবে। শ্লিক প্রথমে অর্থপূর্ণ উক্তির এই "সংকীর্ণ অর্থের" উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু এটি কঠোরভাবে সমালোচিত হওয়ায় "ব্যাপক অর্থে" যাচাইকরণ নীতি অবলম্বন করেন। এই নীতি অবলম্বনকে "সংকীর্ণ অর্থের" সংশোধনও বলা হয়ে থাকে। "ব্যাপক অর্থে" তিনি বলেন, বাক্য ও শব্দ বাস্তবে (in practical) যাচাইযোগ্য না হলেও চলবে। তবে তিনি পাশাপাশি এও বলে রেখেছেন, বাস্তবে না হলেও এগুলোকে অবশ্যই নীতিগতভাবে (in theory of principle) প্রতিপাদনযোগ্য হতে হবে।
যাচাইকরণ নীতি ও রুডলফ কারণাপ
রুডলফ কারণাপ অন্যান্য যৌক্তিক ইতিবাদীর মতোই উল্লেখ করেন, কোনো বাক্য অর্থপূর্ণ হতে হলে তার যাচাইযোগ্যতা (verifiability) থাকতে হবে। তিনি দু’ধরনের যাচাইয়ের কথা উল্লেখ করেন: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। প্রটোকল (protocol) উক্তি বা বাক্যকেই সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায়। কারণ এগলো অভিজ্ঞতার আওতায় রয়েছে। পক্ষান্তরে, অন্যান্য বাক্য, যেমন- একক বা বিশিষ্ট (singular proposition) ও সঠিক জাতীয় বাক্য কেবল পরোক্ষভাবে যাচাই করা যায়। পরোক্ষ যাচাই বলতে কারণাপ বুঝিয়েছেন যে, যাচাইযোগ্য কোনো বাক্যকে অন্যান্য পূর্ব-যাচাইকৃত বাক্যের সাথে এমনভাবে নেওয়া যায়, যার ফলে এগুলোকেও প্রত্যক্ষভাবে যাচাইযোগ্য করা যায়। ‘পরম সত্তা অস্তিত্বশীল’ জাতীয় তত্ত্ববিদ্যক বা অধিবিদ্যক বাক্যকে কোনোভাবেই যাচাই করা যায় না। সুতরাং এ-জাতীয় বাক্য সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়, বরং অর্থহীন।
কারণাপ পরবর্তীতে ‘যাচাইযোগ্য’ (verifiable) শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পরীক্ষাযোগ্য’ (testable) ও ‘নিশ্চয়যোগ্য’ (confirmable) শব্দের পেছনে ধাবিত হন।[2] যে বাক্যের অভিজ্ঞতাভিত্তিক বা প্রায়োগিক মূল্য নেই সেই বাক্য অর্থহীন বলে তিনি মত দেন। অধিবিদ্যা ও নীতিবিদ্যার বাক্যগুলো অভিজ্ঞতাভিত্তিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না বলে এগুলো অর্থহীন।
যাচাইকরণ নীতি ও এ. জে. এয়ার
এয়ার মনে করেন, কোনো বাক্যের অর্থ সেই বাক্যের যাচাইকরণ নীতির উপর নির্ভরশীল। তিনি ব্যবহারিক যাচাইকরণ ও নীতিগত যাচাইকরণের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন। ব্যবহারিক যাচাইকরণ নীতি হলো কোনো বাক্যকে সরাসরি যাচাই করা। কিন্তু এমন অনেক তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য রয়েছে, যাদের সরাসরি যাচাই করা যায় না। সেগুলোকে নীতিগতভাবে যাচাই করতে হয়। যেমন: ‘চাঁদে সাপ আছে’- এ-বাক্যকে ব্যবহারিক বা সরাসরিভাবে যাচাই করা যায় না, নীতিগতভাবে যাচাই করতে পারি। কারণ চাঁদে গিয়ে এ-বাক্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করা যাবে। ফলে এ-বাক্যের ব্যবহারিক যাচাইযোগ্যতা না থাকলেও নীতিগত যাচাইযোগ্যতা রয়েছে এবং এ-কারণেই এটি অর্থপূর্ণ। কিন্তু অধিবিদ্যক বাক্য, যেমন, ‘পরমসত্তা অস্তিত্বশীল’-এধরনের বাক্য নীতিগত দিক থেকেও যাচাই করা যায় না। কীভাবে এগুলো যাচাই করা সম্ভবপর হবে, আমরা তাও জানি না। ফলে, অধিবিদ্যক বাক্যগুলো অর্থহীন। এয়ার সবল ও দুর্বল অর্থেও যাচাইকরণ নীতির পার্থক্য নির্দেশ করেন। যে যাচাইয়ের সাহায্যে কোনো বাক্যকে নিশ্চিতরূপে প্রতিপাদন করা যায়, এয়ার তাকে সবল যাচাইকরণ নীতি বলেছেন। এই নীতি অত্যন্ত কঠোর, কারণ এটি মেনে নিলে অণেক সার্বিক বাক্যকে অর্থপূর্ণ বলে গ্রহণ করা যায় না। যেমন: ‘সকল মানুষ মরণশীল’- এ-জাতীয় সার্বিক বচন সবল অর্থে যাচাইযোগ্য নয়। এ-অসুবিধে দূর করার জন্য এয়ার দুর্বল যাচাইকরণ নীতির আশ্রয় নেন। যে যাচাইকরণ নীতির মাধ্যমে কোনো বাক্যের অর্থ নিশ্চিতরূপে যাচাই করা না গেলেও সম্ভাব্যভাবে তার অর্থ প্রতিপাদন করা যায় তাকে তিনি দুর্বল যাচাইকরণ নীতি বলেছেন। তার দুর্বল যাচাইকরণ নীতি অনুসারে তথ্যসম্পর্কিত বাক্য ব্যতিরেকেও সাধারণ বাক্য এবং অতীত বা ঐতিহাসিক ঘটনাবলি সম্পর্কিত বাক্যের অর্থ ও তাৎপর্য নির্ধারণ করা যায়।
যাচাইকরণ নীতি ও হেমপেল
হেমপেল প্রদত্ত যৌক্তিক ইতিবাদ অনেকটা উদার। তিনি অর্থের যাচাইকরণ নীতি সম্পর্কীয় বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যের বিচারমূলক আলোচনা করেন এবং অনুবাদযোগ্যতা মানদণ্ডের সুপারিশ করেন। এই মানদণ্ড অনুযায়ী একটা বচন তখনই অর্থপূর্ণ হবে যখন তা একটা অভিজ্ঞতাভিত্তিক বচনের অনুবাদযোগ্য হবে। তিনি উল্লেখ করেন যে, জ্ঞানজ অর্থপূর্ণতা এবং অর্থহীনতার মধ্যকার তীব্র দ্বি-কোটিক বিভাগকে ক্রমাগত পার্থকরণ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে হবে এবং ঐ-ধরনের বচনমণ্ডলিকে অর্থপূর্ণতার চরম একক বলে গ্রহণ করতে হবে।
আরও দেখুন
- সত্যের জ্ঞানীয় তত্ত্ব
তথ্যসূত্র
- ইসলাম, আমিনুল, পাশ্চাত্য দর্শন : আধুনিক ও সাম্প্রতিককাল
- হালিম, মো. আবদুল, দার্শনিক প্রবন্ধাবলি : তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ, মে ২০০৩, বাংলা একাডেমি, ঢাকা