মেহেত-ওয়েরেত

প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে মেহেত-ওয়েরেত বা মেহ্তুর্ত (প্রাচীন মিশরীয়: mḥt-wrt) ছিলেন আকাশের অন্যতম দেবী। তাঁর নামের অর্থ "মহতী বন্যা"।

গো-দেবীর (মেহেত-ওয়েরেত অথবা হাথোর) মস্তক, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৩৯০-১৩৫২ অব্দ, প্রাচীন মিশর

মেহেতওয়েরেত[1]
চিত্রলিপিতে

পিরামিড লিপিগুলিতে মেহেত-ওয়েরেতের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন মিশরীয় সৃষ্টিপুরাণে বলা হয়েছে যে, সৃষ্টির আদিতে তিনি সূর্যের জন্মদান করেছিলেন। মিশরীয় শিল্পে তাঁকে শিং-এর মাঝখানে সৌর-চাকতি সহ এক গোরুর রূপে চিত্রিত করা হত। তাঁকে দেবী নেইথ, হাথোরআইসিসের সঙ্গে যুক্ত করা হত, যাঁরা সকলেই একই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বহন করতেন এবং এঁরা সকলেই "রা-এর চোখ" নামে পরিচিত ছিলেন।[2]

শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলির জন্য মেহেত-ওয়েরেত প্রাথমিকভাবে "মহাজাগতিক গোরু" বা "গো-দেবী" হিসেবে পরিচিত। কিন্তু জগতে তাঁর অবদান আরও অনেক পন্থায় ঘটেছিল বলে মিশরীয়রা বিশ্বাস করত। তিনি ছিলেন জল, সৃষ্টি ও পুনর্জন্মেরও দেবী। মিশরীয় পুরাণে মেহেত-ওয়েরেতকে জীবনের সৃজন ও রক্ষার অন্যতম প্রধান উপাদানও মনে করা হত।[3]

উৎস

মেহেত-ওয়েরেতকে প্রতিদিন আকাশে সূর্যোদয়ের কারণ বলে মনে করা হত। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে, তিনি তাঁর উপাসকদের শস্যের জন্য আলোর জোগান দেন এবং সেই সঙ্গে জল দিয়ে শস্যক্ষেত্রকে উর্বর করে তুলতে প্রতি বছর নীল নদে বন্যা ডেকে আনেন। প্যাট্রিশিয়া মোনাগনের দি এনসাইক্লোপিডিয়া অফ গডেসেস অ্যান্ড হিরোইনস গ্রন্থে প্রতিদিন সূর্যের জন্মদান এবং উপাসকদের জন্য জীবন সৃষ্টি করার জন্য তাঁকে সৃষ্টির দেবী আখ্যা দেওয়া হয়েছে।[4]

মিশরীয় পুরাণে মেহেত-ওয়েরেত জল ও সৃষ্টির দেবী হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি রাত্রিকালীন আকাশের একটি খণ্ড ছিলেন বলে একটি ধারণার উল্লেখ করেন গেরাল্ডাইন পিঞ্চ। তাঁকে আকাশগঙ্গা নামে পরিচিত তারার এক নদীর সত্ত্বা হিসেবেও উল্লেখ করা হত। কারণ তাঁর শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল নীল নদের বার্ষিক বন্যার জন্য দায়ী।[5]

রা-এর জন্মদান

মেহেত-ওয়েরেতকে প্রাচীন মিশরীয় সূর্যদেবতা রা-এর মা হিসেবে বর্ণনা করা হত। সৃষ্টির দেবী রূপে তিনি প্রতি সূর্যের জন্মদান করেন এবং তাঁর জন্যই জগৎ অন্ধকার হয় না বলে মিশরীয়রা মনে করত। তাঁর শারীরিক বিবরণে দেখা যায়, তিনি তাঁর শিং-এর ফাঁকে একটি সৌর চাকতি ধারণ করে রয়েছেন। তিনি ঠিক একজন মায়ের মতো তাঁর পুত্র রা-কে রক্ষা করেন এবং তাঁর কাছে কাছে রাখেন।[3]

শারীরিক বিবরণ

মেহেত-ওয়েরেতের শরীরটি ছিল নারীর এবং মাথাটি ছিল গোরুর। এই জন্য তাঁকে কখনও কখনও গো-দেবী নামেও অভিহিত করা হত। তাঁর দুই শিং-এর ফাঁকে একটি সৌর চাকতি অঙ্কিত হত, যেটির মাধ্যমে তাঁকে সূর্য সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত করা হত।[3]

খোনসুর প্রস্তর-শবাধার

খোনসুর প্রস্তর-শবাধারে মেহেত-ওয়েরেতের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শবাধারের বাইরের দিকে চিত্রিত চিত্রলিপগুলি মৃতকে রক্ষা করার অপর এক পদ্ধতি হিসেবে লিখিত হয়েছিল। এগুলি ব্যবহৃত হয়েছিল পরলোকে ফ্যারাওয়ের যাত্রাপথ অঙ্কনের উদ্দেশ্যে। চিত্রলিপিতেও মেহেত-ওয়েরেতকে দেখা গিয়েছে অনেকগুলি প্রথাগত সামগ্রী-পরিহিত অবস্থায়। এটি করা হয়েছিল তাঁর দেবীসুলভ ভূমিকাটিকে দর্শানোর জন্য। ছবিতে দেখা যায় একজন মানুষ তাঁর সামনে নত হয়ে তাঁর স্তব করছে। এর মাধ্যমেই দৈব সত্ত্বা হিসেবে তাঁর গুরুত্বটি বোঝানো হয়েছে। এই ছবিতেই মেহেত-ওয়েরেত বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, মৃত্যুর পর ফ্যারাও পরলোকে পুনর্জন্ম লাভ করবেন।[6]

সম্পর্ক

হাথোর

নাদিনে গিলহোর "স্বর্গীয় গোরুর পুরাণকথা" মেহেত-ওয়েরেতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এক স্বতন্ত্র দেবীর কাহিনি, যাঁর নাম হাথোর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাথোরকে মেহেত-ওয়েরেতের চাইতে অনেক বেশি পীড়াদায়িনী দেবী মনে করা হত, কারণ তিনি মানবজগতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারতেন। এই কাহিনির শিরোনামটি "মানবজাতির বিনাশ" নামেও পরিচিত। কারণ, হাথোরকে প্রেরণ করা হয়েছিল সূর্যদেবতা রা ও তাঁর ব্রহ্মাণ্ড পুনর্বিন্যাস পরিকল্পনার বিরোধী বিদ্রোহীদের হত্যা করার জন্য। এই কাহিনিতে হাথোর এক রক্তপিপাসু যোদ্ধা গোরু, তাঁর উদ্দেশ্য মানবজাতির ধ্বংসসাধন। অন্যদিকে মেহেত-ওয়েরেত মানবজাতির কয়েকটি মৌলিক প্রয়োজনীয় বস্তুর সৃষ্টিকর্ত্রী: সূর্য ও জল।[7]

মৃত্যু ও পুনর্জন্ম

মৃতের বইতে অনেকগুলি মন্ত্রে মেহেত-ওয়েরেতের উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনই একটি মন্ত্র হল ১৭ নং মন্ত্র। এই মন্ত্রেই তাঁকে সূর্যদেবতা রা-এর মা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করত যে, প্রতিদিন সূর্যের মৃত্যু ঘটে এবং মেহেত-ওয়েরেত তাঁকে পুনর্জীবন দান করেন। সেই জন্য তাঁকে সূর্যের রক্ষাকর্ত্রীও মনে করা হত। মিশরীয় ধারণা অনুযায়ী, মেহেত-ওয়েরেত সূর্যকে পাতাললোকে অর্থাৎ রাত্রিতে নিয়ে যান এবং পরদিন সকালে অনেকটা পরলোক থেকে পুনরাগমনের মতো করেই পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। মিশরীয়রা মেহেত-ওয়েরেতকে সৃষ্টি ও পুনর্জন্মের দেবী হিসেবে দেখত। তাই এমন একটি মন্ত্রে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায় যেটির মাধ্যমে মানুষ পরলোকে যাত্রা করতে পারে বলে মিশরীয়রা বিশ্বাস করত। মিশরীয় সংস্কৃতিতে মৃতের বই ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। কারণ এই গ্রন্থে মৃতের আত্মা কী করে পরলোকে উপনীত হতে পারে তার বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছিল।[8]

তথ্যসূত্র

  1. Wörterbuch, II, p.122
  2. Wilkinson, Richard H. (2003). The Complete Gods and Goddesses of Ancient Egypt. Thames & Hudson. p. 174
  3. Seawright, Caroline. "Mehet-Weret, Ancient Egyptian Goddess of Creation." Egyptology & Archaeology Essays, November 16, 2003. http://www.thekeep.org/~kunoichi/kunoichi/themestream/mehetweret.html#.VAuIjfldWSo ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২২ মার্চ ২০১৫ তারিখে.
  4. Monaghan, Patricia. Encyclopedia of Goddesses and Heroines [2 Volumes]. ABC-CLIO, 2009.
  5. Pinch, Geraldine. Handbook of Egyptian Mythology. ABC-CLIO, 2002.
  6. “Meht-Urt GreatFlood.” Accessed September 6, 2014. http://www.bibleorigins.net/Meht-urtGreatFlood.html.
  7. Guilhou, Nadine. “Myth of the Heavenly Cow.” UCLA Encyclopedia of Egyptology 1, no. 1 (August 12, 2010). http://escholarship.org/uc/item/2vh551hn.
  8. Budge, E. A. Wallis. The Egyptian Book of the Dead Index Accessed September 15, 2014. http://www.sacred-texts.com/egy/ebod/.
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.