মুখান্নাস

মুখান্নাসুন (مخنثون "মেয়েলী পুরুষ", "মহিলার বেশধারী পুরুষ", একবচন মুখান্নাস) হল ধ্রুপদী আরবিতে ব্যবহৃত একটি প্রাচীন প্রতিশব্দ, যা বর্তমানকালের রূপান্তরিত লিঙ্গের মহিলাদের আধুনিক ধারণার প্রাচীন পূর্বপুরুষরুপী সমার্থক প্রতিশব্দ, যাদেরকে সময়ের পরিক্রমায় একসময় জোর করে খোজা বা নপুংসক বানানো হত। হাদিস ও ইসলামী পণ্ডিতদের দ্বারা মুখান্নাস শব্দটি লক্ষনীয়ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বাইরে, তারা সঙ্গীত ও বিনোদনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল।[1]

খানিস হল ওমান ও জাজিরাতুল আরবে ব্যবহৃত মুখান্নাসের সমার্থক ও স্থানীয়ভাবে আরবি পরিভাষা যা সেসব পুরুষদের লিঙ্গিয় ভূমিকাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যারা যৌনতার দিক থেকে এবং কিছু পন্থায় সামাজিকভাবে মহিলাদের মত কাজ করে। শব্দটি মুখান্নাস শব্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।

হাদিস ও সুন্নতে মুখান্নাসের উল্লেখ

হাদিস ও সুন্নতে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয়পন্থায় মুখান্নাস বিষয়ক তথ্যসূত্র রয়েছে।

একটি হাদিস হল সুনান আবু দাউদ ৪১, ৪৯১০:

হাতে পায়ে মেহেদি রাঙানো একজন মুখান্নাসকে নবীর কাছে নিয়ে আসা হল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: এই লোকের কি হয়েছে? তাঁকে বলা হল: আল্লাহর রাসূল! সে নারীদের চলন বলনের অনুকরণ করে। তাই তিনি তার ব্যাপারে আদেশ জারি করলেন এবং তাকে আন-নাক্বি' নামক স্থানে নির্বাসন দেওয়া হল। লোকে বলল: আল্লাহর রাসূল! আমাদের কি তাকে হত্যা করা উচিত নয়? তিনি বললেন: যারা নামাজ পড়ে তাদেরকে হত্যা করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। আবু উসামা বলেন: নাক্বি মদিনার নিকটবর্তী একটি এলাকা এবং তা বাক্বি নামক স্থান নয়।[2]

আরেকটি তথ্যসূত্র রয়েছে সুনান আবু দাউদে ৩২, ৪০৯৫, যেখানে নবীর স্ত্রী আয়িশা বলেন:

এক মুখান্নাস নবীর স্ত্রীদের ঘরে যাতায়াত করত। তারা (লোকজন) তাকে শারীরিক চাহিদামুক্ত লোকদের একজন হিসেবে গণ্য করত। এক দিন নবী সে লোকটি তার এক স্ত্রীর ঘরে থাকা অবস্থায় সেই ঘরে গেলেন, সে সময় লোকটি মহিলাদের গুণের বর্ণনা দিচ্ছিল, এই বলে: যখন সে সামনে আসে, সে চারটি (পেটের ভাঁজ) নিয়ে সামনে আসে, আর যখন সে চলে যায়, সে আটটি (পেটের ভাঁজ) নিয়ে চলে যায়। নবী বললেন: আমি কি দেখতে পাচ্ছি না যে সে এখানে যা আছে তা সম্পর্কে জানে। তথন থেকে তাঁরা (স্ত্রীগণ) লোকটির কাছ থেকে পর্দা করতো।[3]

বিজ্ঞ পর্যালোচনা

পণ্ডিত ও হাদিস সংগ্রাহক আন-নববীর মতানুযায়ী:

একজন মুখান্নাস হল সেই ব্যক্তি ("পুরুষ") যে তার চলনে বলনে এবং বেশভূষায় নারীর বৈশিষ্ট্য বহন করে। এঁরা দুই ধরনের; প্রথমটি হল যাদের মধ্যে এই স্বভাব অন্তর্নিহিত, সে নিজে নিজেই এগুলো নিজের মাঝে ধারণ করে নি, এতে কোন দোষ, কোন দোষারোপ বা কোন লজ্জা নেই, যতক্ষণ না সে কোন অনৈতিক কাজ করে বা টাকা উপার্জনের নিমিত্তে এই বৈশিষ্ট্যের সুবিধা নেয় (পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি)। দ্বিতীয় ধরনের লোকটি অনৈতিক কারণে মহিলাদের মত আচরণ করে এবং সে পাপী ও দোষারোপের যোগ্য।[1]

ইবনে 'আব্দুল-বা'র, যে ছিলেন ইবনে হাজমের একজন সমসাময়িক পণ্ডিত, তিনি মন্তব্য করেন:

মুখান্নাস শুধু সেই ব্যক্তি নয় যে মিশ্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিত। মুখান্নাস বলতে তাঁদেরকেও বুঝায় যারা শারীরিকভাবে দেখতে এতোটাই নারীর ন্যায় যে, সে তার নমনীয়তা, বচন, উচ্চারণ ও চিন্তায় নারীর প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। সে যদি এমন হয়, তবে নারীর প্রতি তার কোন অভিলাষ থাকবে না এবং তাঁদের দিকে নজর দেবে না। এরাই তাঁদের মধ্যে একটি দল যাদের নারীদের প্রতি কোনআগ্রহ নেই, যাদেরকে নারীদের ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।[4]

১৯৮০র শেষের দিকে, ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ও মিশরে মুহাম্মাদ সায়িদ তানতাবি মুখান্নাসদের সমবৈশিষ্ট্যের পুরুষদের জন্য লিঙ্গ পরিবর্তন অস্ত্রপাচারের অধিকারের সমর্থনে ফতওয়া জারি করেন।[5] পাকিস্তানে, হিজড়া হিসেবে বসবাসকারী রূপান্তরিত লিঙ্গের সম্প্রদায়ের সদস্যগণ পুরুষ বা নারী কোনটাই না হওয়ার কারণে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃত।[6]

লিঙ্গ ও যৌনতা

কোন দল হিসেবে মুখান্নাস আধুনিক এলজিবিটি সম্প্রদায় কর্তৃক ব্যবহৃত লিঙ্গ বা যৌনতার বর্তমান বিষয়শ্রেণীর কোনটির সাথেই কাছাকাছি মেলে না।[1] যদিও তারা সম্ভবত নিজ যৌনতার উপর প্রযুক্ত লিঙ্গের অনুসারী ব্যক্তি বা বিষমকামী নয়, তাই বলে এটা বলা যাবে না যে, তাহলে তারা স্বভাবতই হয় সমকামী পুরুষ নাহয় রূপান্তরিত লিঙ্গের নারী।[1] যদিও তারা লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের একটি ভিন্নতা প্রদর্শন করে, প্রতীয়মান হয় যে মুখান্নাস ও নিজেদের জন্য লিঙ্গ বা যৌন পরিচয়ের নির্দিষ্ট তকমা নির্ধারণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে অনেক বেশি পার্থক্য রয়েছে।[1]

যৌনতা

The Effeminates of Early Medina গ্রন্থে, এভারেট কে. রওসন সে সকল মুখান্নাসের বর্ণনা করেছেন যাদের বর্ণনা হাদিসে এসেছে এবং যারা মুহাম্মাদ -এর সঙ্গী ছিলেন।[1] রওসন আরও অন্যান্য মুখান্নাসদের কথা বর্ণনা করেছেন যারা মুহাম্মাদ -এর সমসাময়িক ছিলেন, নির্দিষ্টভাবে বললে তুয়াইস ও আল-দালালের কথা।[7] তুয়াইস ছিল একজন মেধাবী বাদ্যযন্ত্রশিল্পী ও সঙ্গীতশিল্পী যে ৮২ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিল।[1] বলা হয়ে থাকে, তুয়াইস বিবাহিত ও সন্তানের পিতা হিসেবে পরিচিত ছিল।[1] লিখিত তথ্যসূত্র হতে স্পষ্ট জানা যায় যে আল-দালাল পুরুষদের পছন্দ করত।[1] এটা বিশেষভাবে লেখা যে, আল-দালাল নারীদের সামাজিক সঙ্গ পছন্দ করত এবং তার প্রতি প্রয়োগকৃত যে কোন যৌন চাহিদা বিফলে যেতো। আল-দালাল এক নারীর বিয়ের রাত্রিতে তার সঙ্গে দুর্ঘটনাবসত যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং এরপর একই রাতে নারীর বরের সঙ্গেও যৌন সম্পর্ক করে।[1] মদিনার অন্যান্য মুখান্নাসদের ব্যপারেও একইরকম কাহিনী প্রচলিত আছে।[1]

মুহসিন হেন্ড্রিক্সের বর্ণনা অনুযায়ী:

মুহাম্মাদ মুখান্নাস নামক মদিনার একদল মেয়েলী পুরুষের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। তবে, যদিও এই মুখান্নাসের দলটি আধুনিক সমকামী পুরুষদের গুণাগুণ ধারণ করত, এটা বলা যাবে না যে মুখান্নাসগণ আধুনিক সমকামী পুরুষদের পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করে, কারণ তারা যেসব চর্চায় জড়িত ছিল সেগুলো সমসাময়িক সমকামী পুরুষদের সমতুল্য নয়।[8]

কিছু পণ্ডিত বলেন, একজন মুখান্নাস বা আন্তঃলিঙ্গ ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যদি সে পুরুষ নাকি মহিলা তা জানা না যায়, তবে তার জন্য বিয়ে করার অনুমতি নেই; যদি এটা পরিষ্কার হয় যে সে পুরুষ, তখন তার জন্য বিয়ে বৈধ, যতক্ষণ না সে এমন ক্ষেত্রে তার লিঙ্গ ও বিয়ে করার সম্ভাবনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বংশগতি ও সম্পর্কিত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কোন বিশ্বাসযোগ্য ডাক্তারের পরামর্শের শরণাপন্ন হয়।[9]

খোজাকরণ

কথিত আছে, উমাইয়া খিলাফতের সময়ে এককালে, সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক নামক এক খলিফা সকল মুখান্নাসকে খোজা করা উচিত বলে নির্দেশ দেন। তিনি তাদের উপর একাধিক কারণে রাগান্বিত ছিলেন - বিভিন্ন বর্ণনাসূত্রের মাঝে এর কারণের পার্থক্য রয়েছে।[1] রওসনের বক্তব্য অনুযায়ী:

বহু উৎস কিছু অথবা সকল ভুক্তভোগীর নাম উল্লেখ করেছে (আল-দালাল সহ, যে প্রায় সবসময়ই অন্তর্ভুক্ত ছিল)। এদের মধ্যে অনেকগুলো উৎস আরও উল্লেখ করেছে যে, একটি উৎসবে তারা বেশ বিচু বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছিল বলে কথিত আছে। হামজা এই বক্তব্যের পূর্ণ সংস্করণ পেশ করেন, যার তালিকা নিম্নরূপ:

  • তুয়াইস: "এটি একটি সাধারণ খৎনা যা আমাদের অবশ্যই আবার করা উচিত।"
  • আল-দালাল: "বা এরচেয়েও বড় খৎনা!"
  • নাসিম আল-সাহার: "নপুংসক করার মাধ্যমে আমি সত্যিই মুখন্নাস হয়ে গিয়েছি!"
  • নাওমাত আল-দুহা: "অথবা আমরা মহিলাই হয়ে গিয়েছি!"
  • বার্য আল-ফুয়াদ: "আমরা মূত্রত্যাগের জন্য একটি নল বহন করার ঝামেলায় ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি।"
  • জিল আল-শাজার: "একটি অব্যবহৃত অস্ত্র দিয়ে আমরা কিইবা করব?"

শেষ দুটি স্বীকারোক্তি ইঙ্গিত করে যে, মুখান্নাসদেরকে জিবাব করা হয়েছিল, যা হল নপুংসককরণের চরমতর রূপ যাতে গুপ্তাঙ্গ সম্পূর্ণরূপে কেটে ফেলা হয়। এটি মুখান্নাসদের নারীদের প্রতি যৌন আগ্রহের অভাবের সমস্যা লাঘবে সাহায্য করত, যেখানে পূর্ববর্তী দুটি স্বীকারোক্তি মুখান্নাসদের নারী হিসেবে যৌন পরিচয়ের পেছনের প্রয়োজনীয় মানসিক কারণ সনাক্ত করে। এই বিদ্রূপগুলোতে অনীহা-প্রকাশক বাচনভঙ্গি নিশ্চিতভাবে মুখান্নাসদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, এবং পাশাপাশি এর নৃশংসতা সত্ত্বেও সুনির্দিষ্টভাবে ভুল শাস্তি হওয়ার দিকে নির্দেশ করে; এখানে যৌন পরিচয়ের বিরোধী হিসেবে যৌন অভিমুখিতা সম্পর্কিত কোন ইতিবাচক তথ্যসূত্র নেই।[1]

রওসন এই গল্প সম্পর্কে এভাবে লিখেছেন:

একটি তৃতীয় বর্ণনা, যা নপুংসককরণের কাহিনীর তাহিফ সংস্করণের উপর নির্ভরশীল, উল্লেখ করে যে, খলিফা সুলায়মান সুদর্শন আল-দালালের দুর্ঘটনাবশত নপুংসককরণে ব্যথিত হন, এবং গোপনে তাকে তার দরবারে হাজির করেন। যখন খলিফা তাকে প্রশ্ন করেন সে কেমন আছে, আল-দালাল উত্তরে বলে, "এখন যে আপনি আমাকে সম্মুখে কেটে দিলেন, আপনি আমাকে পশ্চাতেও কেটে দিতে চান?" সুলায়মান হাসলেন, এবং তাকে গান গাইতে নির্দেশ দিলেন। জ্ঞান নাকি গান, কোন প্রতিভার দ্বারা সে অধিক আনন্দদায়ক তা সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে খলিফা তাকে এক মাস নিজের সঙ্গে রাখলেন, তাকে ধনসম্পদে পুরস্কৃত করলেন, এবং হেজাজে ফেরত পাঠালেন।[1]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. Rowson, Everett K. (অক্টোবর ১৯৯১)। "The Effeminates of Early Medina" (পিডিএফ)Journal of the American Oriental Society। American Oriental Society। 111 (4): 671–693। জেস্টোর 603399ডিওআই:10.2307/603399। ১ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা।
  2. "General Behavior (Kitab al-Adab)"www.usc.edu। Center for Muslim-Jewish Engagement। ৪ মে ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ মার্চ ২০১৮
  3. "Partial Translation of Sunan Abu-Dawud, Book 32: Clothing (Kitab al-Libas)"www.usc.edu। Center for Muslim-Jewish Engagement। ১২ মে ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ মার্চ ২০১৮
  4. Al Muqni, Matan। al Sharh al Kabeer। পৃষ্ঠা 347–348।
  5. Alipour, M (২০১৬)। "Islamic shari'a law, neotraditionalist Muslim scholars and transgender sex-reassignment surgery: A case study of Ayatollah Khomeini's and Sheikh al-Tantawi's fatwas"International Journal of Transgenderism17:1: 91–103 Taylor & Francis Online-এর মাধ্যমে।
  6. Pasquesoone, Valentine"7 Countries Giving Transgender People Fundamental Rights the U.S. Still Won't"Mic
  7. Comstock, Gary David; Henking, Susan E. (১৯৯৭)। Que(e)rying Religion: A Critical Anthology। A&C Black। আইএসবিএন 978-0-8264-0924-9।, page 69
  8. Hendricks, Muhsin (জুলাই ২০০৬)। Islam and Homosexuality (পিডিএফ)। ILGA's preconference on religions: ILGA। ২০০৭-০৯-২৭ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৬-২২
  9. "Ruling on marrying a man who is intersex or impotent, and the difference between them"Muhammad Saalih al-Munajjid। islamqa.info। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুলাই ২০১৫

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.