মিশরের চতুর্থ রাজবংশ
মিশরের চতুর্থ রাজবংশ-এর শাসনামল (মোটামুটি ২৬২০ - ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)[1] সাধারণভাবে ঐতিহাসিকদের কাছে মিশরের পুরাতন রাজত্বের সময়কালীন স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত।[2] এইসময় সমগ্র সাম্রাজ্যে সাধারণভাবে শান্তি বজায় ছিল এবং কৃষি ও ব্যবসাবাণিজ্যের বিকাশের হাত ধরে সমৃদ্ধির দেখাও মিলেছিল। এইসময় মিশরের সাথে অন্যান্য বহির্দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের সাক্ষ্যবহনকারী বিভিন্ন উপাদানের সন্ধান পাওয়া গেছে।
মিশরের চতুর্থ রাজবংশ | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
২৬১৩ খ্রিস্টপূর্ব–২৪৯৪ খ্রিস্টপূর্ব | |||||||||
চতুর্থ রাজবংশের আমলে তৈরি গিজার তিনটি বৃহৎ পিরামিড | |||||||||
রাজধানী | মেমফিস | ||||||||
প্রচলিত ভাষা | মিশরীয় ভাষা | ||||||||
ধর্ম | প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম | ||||||||
সরকার | সম্পূর্ণ রাজত্ব | ||||||||
ঐতিহাসিক যুগ | ব্রোঞ্জ যুগ | ||||||||
• প্রতিষ্ঠা | ২৬১৩ খ্রিস্টপূর্ব | ||||||||
• বিলুপ্ত | ২৪৯৪ খ্রিস্টপূর্ব | ||||||||
|
সম্রাটগণ
ফারাও স্নোফ্রুর হাত ধরে চতুর্থ রাজবংশের সূচনা ঘটে। তিনি সম্ভবত পূর্ববর্তী ফারাও হুনিরই এক সন্তান ছিলেন। মোটামুটি ১০০ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে এই রাজবংশের সাতজন ফারাও রাজত্ব করেন। এদের মধ্যে চারজন - স্নোফ্রু, খুফু, খাফরে ও মেনকাউরে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় (১৮ - ৩০ বছর) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।[3]
ব্যক্তি নাম | হোরাসনাম | তারিখ | পিরামিড | সম্রাজ্ঞী |
---|---|---|---|---|
স্নোফ্রু | নেবমা-আত | ২৬১৩-২৫৮৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ | লাল পিরামিড বক্র পিরামিড মেইদমের পিরামিড | সম্রাজ্ঞী প্রথম হেতেফেরেস |
খুফু | মেদজেদু | ২৫৮৯–২৫৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ | খুফুর পিরামিড | সম্রাজ্ঞী প্রথম মেরিতিতেস সম্রাজ্ঞী হেনুতসেন |
জেদেফ্রে | খেপের | ২৫৬৬–২৫৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ? | জেদেফ্রের পিরামিড | সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় হেতেফেরেস সম্রাজ্ঞী খেনতেৎকা |
খাফরে | উসেরিব | ২৫৫৮–২৫৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ | খাফরের পিরামিড | সম্রাজ্ঞী তৃতীয় মেরেসানখ সম্রাজ্ঞী প্রথম খামেরেরনেবতি সম্রাজ্ঞী হেকেনুয়েদিয়েত Queen Persenet |
মেনকাউরে | কাখেত | ২৫৩২–২৫০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ? | মেনকাউরের পিরামিড | সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় খামেরেরনেবতি |
শেপসেসকাফ | ?? | ২৫১৮-২৫১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ? | সাক্কারায় ফারাওদের বেঞ্চ | সম্রাজ্ঞী বুনেফের |
বিবরণ
এই রাজবংশের আমলকে প্রাচীন মিশরের অন্যতম স্বর্ণযুগ বলে মনে করা হয়। মিশরের বড় বড় ও বিখ্যাত পিরামিডগুলির অনেকগুলিই এই আমলেই নির্মিত। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফারাও স্নোফ্রু। তাঁকে অনেকেই একজন আদর্শ ফারাও হিসেবে গণ্য করে থাকেন। তিনি সাম্রাজ্যের প্রভূত বিস্তার ঘটিয়েছিলেন, এমনকী লিবিয়া ও নুবিয়ার মতো দূরদেশেও তিনি অভিযান চালান। সাম্রাজ্যের সীমানারক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি সীমান্তদুর্গও তৈরি করান। এছাড়া মেইদম ও দাহ্শুরে তিনি পরপর তিনটি বড় পিরামিড তৈরি করান; নির্মাণরীতি ও কৌশলের দিক থেকে এই তিনটি পিরামিডকে পুরনো স্টেপ পিরামিড ও পরবর্তীকালের তুলনামূলক আধুনিক পিরামিডগুলির মধ্যবর্তী পর্যায়ের বলে মনে করা হয়। তাঁর বংশধর হিসেবে পরবর্তী ফারাও হন খুফু। গিজার মালভূমি অঞ্চলকে তিনি পিরামিডনির্মাণস্থল হিসেবে বেছে নেন ও সেখানে ১৪৬.৫৯ মিটার উঁচু যে পিরামিডটি তৈরি করান, সেটি আজ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পিরামিড হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর আমলের এই বিশাল নির্মাণকার্যের কারণে অনেক ঐতিহাসিকই তাঁকে, তাঁর বাবা স্নোফ্রুর বিপরীতে, একজন অত্যাচারী, নিষ্ঠুর ও যশলোভী সম্রাট হিসেবে চিত্রিত করে থাকেন; কিন্তু বাস্তবে তিনি যে মিশরীয়দের দ্বারা এমনকী প্রাচীন মিশরের শেষ যুগ পর্যন্ত পূজিত হতেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁর দুই পুত্র জেদেফ্রে ও খাফরে, তাঁর পর একে একে ফারাও হন। জেদেফ্রে প্রথম ফারাও হিসেবে নিজেকে রে'র পুত্র বলে চিহ্নিত করেন। অন্যদিকে খাফরে তাঁর বাবার তৈরি পিরামিডের পাশে আরও একটি বিশাল পিরামিড তৈরি করান। পরবর্তী ফারাও বিখেরিস সম্পর্কে খুব একটা কিছু জানতে পারা যায় না। তাঁর পর সিংহাসনে বসেন ফারাও মেনকাউরে। গিজার তৃতীয় ও ক্ষুদ্রতম পিরামিডটি তাঁর তৈরি। এই রাজবংশের ষষ্ঠ তথা শেষ ফারাও ছিলেন শেপসেসকাফ। তুরিনে প্রাপ্ত ফারাওদের তালিকায় এছাড়াও থামফথিস নামে আরেক ফারাও'এর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু সমকালীন অন্যান্য তথ্যপ্রমাণাদিতে এই নামের কোনও ফারাও'এর উল্লেখ পাওয়া যায়নি।[3][4]
প্রশাসন
এই রাজবংশের আমলে যে ব্যাপক নির্মাণকার্য পরিচালিত হয়, তার জন্য এমন এক জটিল ও দক্ষ প্রশাসনের প্রয়োজন, যা এর আগে মিশরে কখনও গড়ে ওঠেনি। এইসময়ে প্রশাসনের ক্রমাগত বিস্তার ঘটে এবং "রাজকীয় কার্য দপ্তর" নামক একটি বিশেষ বিভাগই তৈরি হয় যার কাজই ছিল শুধুমাত্র এইসব নির্মাণকার্যের তদারক করা। এই বিভাগের প্রশাসনিক দায়িত্ব মোটেই কম ছিল না। এইসব দায়িত্বের মধ্যে পড়ত - বড় বড় ও জটিল প্রাকৌশলিক চাহিদা বিশিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পের পরিকল্পনা করা, তার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক নিয়োগ করা, নির্মাণস্থলের কাছাকাছি সেই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের জন্য আবাসস্থল নির্মাণ ও তাদের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা, নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও মালপত্র রাখার ব্যবস্থা করা, নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় বড় বড় পাথর ও অন্যান্য সামগ্রী দূরদূরান্তের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে মেমফিস অঞ্চলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি। এছাড়া কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে দূরবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে (হাতনুব, ফায়ুম, ওয়াদি হামামাত, সিনাই, প্রভৃতি) যেসব পাথর খাদান থেকে এইসব পাথর উত্তোলন করা হত, সেগুলির দেখভাল ও উন্নয়নও তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল ফারাও'এর হাতে। তাঁর দৈব ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে এইসময়ে যেসব বিশাল নির্মাণকার্য পরিচালিত হয়, আগে কখনওই তা এই মাত্রায় দেখা যায়নি। রাষ্ট্রের বিভিন্ন উচ্চপদে সাধারণত রাজপুত্র বা রাজপরিবারের লোকেরাই নিযুক্ত হতেন। তাছাড়া বিভিন্ন প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবেও তাঁদের অনেকসময় নিয়োগ করা হত।[5][6]
তথ্যসূত্র
- Shaw, Ian, ed. (2000). The Oxford History of Ancient Egypt. Oxford University Press. p. 480. ISBN 0-19-815034-2.
- "EGYPT AND THE EGYPTIAN DYNASTIES: IV — Alexander Wilder". www.theosociety.org.
- Miroslav Verner: Contemporaneous Evidence for the Relative Chronology of dyns. 4 and 5. in: Erik Hornung, Rolf Krauss und David A. Warburton (Hrsg.).: Ancient Egyptian Chronology, Leiden 2006, S. 128–136. DOI: 10.1163/9789047404002_011
- Rainer Stadelmann: Fourth Dynasty. in: Donald B. Redford (Hrsg.): The Oxford Encyclopaedia of Ancient Egypt, Oxford University Press, Oxford und New York 2001, ISBN 0195102347, S. 593–597.
- Dominique Valbelle: Histoire de l'État pharaonique. Presses universitaires de France, Paris 1998, ISBN 2130493173, S. 36–56. (ফরাসি)
- Michel Baud: The Old Kingdom. in: Allan S. Lloyd (Hrsg.): A Companion to Ancient Egypt, Blackwell Publishing, Malden und Oxford 2010, ISBN 9781405155984, S. 73–74.