মিলেতুসীয় দর্শন

মিলেতুসীয় দর্শন বলতে এশিয়া মাইনরের মিলেতুস নগরীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা দর্শনকে বোঝায়। এই নগরীতেই গ্রিক দর্শনের সূত্রপাত ঘটে। এই নগরীর সাথে এশিয়ার বড় বড় শহরগুলোর বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। এ কারণেই নগরীটি বিকশিত হয় এবং উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে। এরিস্টটল বলেছিলেন, দার্শনিক চিন্তার বিকাশের জন্য দুটি জিনিস আবশ্যক: অবকাশ এবং সম্পদ। মিলেতুসের অধিবাসীদের এ দুটিই ছিল। একে কেন্দ্র করেই আদি দর্শনের সূচনা ঘটায়। তাদের সে দর্শন ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ, সত্যানুসন্ধানই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। সেরা মিলেতুসীয় দার্শনিকদের একজন হলেন থেলিস

আনাতোলিয়ার পশ্চিম তীরে মিলেতুসের অবস্থান, মিলেতুস হচ্ছে থেলিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার ও অ্যানাক্সিমেনিসের আবাসস্থল

মৌলিক দার্শনিক চিন্তাধারা

বস্তুজগৎকে কেন্দ্র করেই মিলেতুসীয় দর্শনের শুরু হয়। তাদের সে বস্তুবাদী দর্শন শুরু হয়েছিল দুটি মৌলিক প্রশ্নকে ঘিরে:

  • এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল তত্ত্বের স্বরূপ কি?
  • স্থায়ী মূল জগৎ থেকে দৃশ্যমান ইন্দ্রিয় জগতের উদ্ভব কীভাবে হল?

দেখা যাচ্ছে, তাদের দর্শনের মূল নিহিত বিশ্বজগতের আদি কারণ এবং সত্তার সন্ধানে। আদিম ও চিরন্তন সত্তা থেকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিভিন্ন পদার্থের উৎপত্তি হল কীভাবে, এ নিয়েই তারা চিন্তা শুরু করেছিলেন। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এর মধ্যে মানব মনের মৌলিক সন্দেহের প্রমাণ পাওয়া যায়: ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা যে জগতের অভিজ্ঞতা অর্জন করছি তা প্রকৃত নয়, একটি অবভাস (অ্যাপিয়ারেন্স) মাত্র। অবশ্য তারা কখনও বলেননি, ইন্দ্রিয় জগৎ মিথ্যা বা অলীক। কিন্তু তাদের মতে এটি প্রকৃত নয়। ইন্দ্রিয় জগৎ যে বাস্তব নয়, একটি ভ্রান্ত অধ্যাস মাত্র তা দার্শনিক চিন্তায় ক্রমেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। কিন্তু এই ধারণার জনক মিলেতুসীয়দের বলা যবেনা। এর বিকাশ ঘটে আরও পড়ে। জগতের মৌল নীতি আবিষ্কারেই তাদের চিন্তা সীমাবদ্ধ ছিল এবং কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়েই তা বিকশিত হয়।

তাদের দর্শনের সবচেয়ে বৈপ্লবিক দিকটি হল, বিশ্বজগতের মৌল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তারা সকল ধর্মমত এবং পৌরাণিক কাহিনী পরিত্যাগ করেন। মানব মস্তিষ্কপ্রসূত বিশুদ্ধ প্রজ্ঞার মাধ্যমেই তারা সবকিছুর ব্যাখ্য দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু, তাদের দর্শনেও ঈশ্বর উপস্থিত ছিল। কিন্তু, সে ঈশ্বর কোন একক সত্তা নয়; সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তথা ইন্দ্রিয় ও বাস্তব জগৎকেই তারা ঈশ্বর হিসেবে জ্ঞান করেছেন। পরবর্তীকালে গ্রিস এবং অন্যত্র ঈশ্বরকে ব্যক্তি বা একক পরাক্রমশালী সত্তা হিসেবে মেনে নেয়ার যে প্রচলন দেখা যায় তা মিলেতুসীয়দের মধ্যে ছিলনা।

মিলেতুসীয় দর্শনের আরেকটি মৌল বিষয় হল, তারা সবাই সজীব জড়বাদে (hylozoism) বিশ্বাসী ছিলেন। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করতেন, শুধু জীব নয় সকল জড় বস্তুরও প্রাণ আছে। শুধু তারা নন, প্রাক-সক্রেটিসীয় দার্শনিক যুগের সকল দার্শনিকরাই এ মতে বিশ্বাস করতেন। এই বিশ্বাস পোষণকারীদের বলা হয় সজীব জড়বাদী বা হাইলোজোয়িস্ট।

তথ্যসূত্র

    • প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাশ্চাত্য দর্শন - ডক্টর আমিনুল ইসলাম, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; পুনর্মুদ্রণ ২০০২, শিখা প্রকাশনী; ৩ মাইলেসীয় দর্শন, পৃষ্ঠা - ৪২-৪৩
    This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.