মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ বাংলাদেশের তৃতীয় ক্যাডেট কলেজ। অন্যান্য ক্যাডেট কলেজের মতই এতেও জাতীয় পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের পাশাপাশি ক্যাডেটদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, চারিত্রিক, সাংস্কৃতিক ও নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা সম্পূরক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এর পাশাপাশি এ ক্যাডেট কলেজটি শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য লাভ করেছে।
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ | |
---|---|
অবস্থান | |
, ১৯৪২ বাংলাদেশ | |
তথ্য | |
নীতিবাক্য | বিদ্যাই বল |
প্রতিষ্ঠাকাল | ২৯ নভেম্বর ১৯৬৩ |
ইআইআইএন | ১৩৩৮৬১ |
প্রথম প্রধান শিক্ষক | মাইকেল উইলিয়াম পিট |
আয়তন | ৯৫ একর (৩,৮০,০০০ বর্গমিটার) |
রং | মেরুন |
বিশেষণ | মির্জাপুরিয়ান |
ওয়েবসাইট | www.mcc.army.mil |
অবস্থান ও প্রতিবেশ
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ ৯০o৯' পূর্ব দ্রাঘিমারেখা এবং ২৪o৫.৩' উত্তর অক্ষরেখা বরাবর অবস্থিত। এর উত্তরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক এবং তিনদিকে রাজাবাড়ি গ্রাম অবস্থিত। এর পূর্ব দিয়ে বংশী নদীর একটি ছোট শাখা চলে গেছে । আর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিয়ে চলে গেছে বারিন্দা নদী। পশ্চিম পাশ দিয়ে আবার ফুটজানি নদী এসে বারিন্দা নদীর সাথে মিশেছে। কলেজ হতে মির্জাপুর সদর থানার দূরত্ব প্রায় ৮ কি. মি.।
ইতিহাস
চট্টগ্রাম জেলায় ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ ও খুলনা বিভাগে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার পরপরই মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজ (মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের পূর্বতন নাম) প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। অন্য ক্যাডেট কলেজগুলোর মত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য যোগ্য কর্মকর্তা তৈরি করাই ছিল এ কলেজ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য।
পাকিস্তান আমল
তদানিন্তন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এ ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তার হাতে ১৯৬৩ সালের ২৯ নভেম্বর তদানিন্তন ময়মনসিংহ জেলার মির্জাপুরের গড়াই নামক স্থানে কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তারপর থেকে কলেজ পুরোদমে চালু করার সবরকম আয়োজন চলতে থাকে। কিন্তু তা মোটেই সহজ ছিলনা। কারণ পুরো কলেজ এলাকাটি ছিল অরণ্যবেষ্টিত এবং বন্ধুর। কলেজের পাশে অবস্থিত রাজাবাড়ি গ্রামটি তখনও পুরো বিকশিত হয়নি। মোটামুটি একটি বন্ধুর বিরানভূমিকে কেটেছেটে সমান করা হয় এবং কলেজের পাশে বড় ধরনের একটি খাল তৈরি হয়ে যায়। ৯৫ একর এলাকা নিয়ে গড়ে উঠে মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজ। মেজর জেনারেল ফজলে মুকিম খান কলেজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালের ৯ জানুয়ারি তারিখে। এ দিনটিকে কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে পালন করা হয়। কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে জনাব এম ডব্লিউ পিট কে নিয়োগ দেয়া হয়।
১৯৬৫ সালেই কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে একসাথে ৪ টি ইনটেক (ব্যাচ) ভর্তি করা হয়। তখন ক্যাডেটদের থাকার জন্য ২ টি হাউস ছিল। হাউসগুলোর নামও বর্তমানের মত ছিলনা। বর্তমান ফজলুল হক হাউসের নাম ছিল জিন্নাহ হাউস আর সোহরাওয়ার্দি হাউসের নাম ছিল আইয়ুব হাউস। বর্তমান নজরুল হাউস তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তী বছর যখন নতুন ইনটেক নেয়া হয় তখন তাদের থাকার ব্যবস্থা করার জন্য ~ হাউস তৈরি করা হয় যার বর্তমান নাম নজরুল হাউস। কলেজটি প্রথম বছরই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়
কলেজ যখন পুরোদমে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তখনই শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে কলেজের অধ্যক্ষ এবং এডজুটেন্ট দুজনই ছিলেন পাকিস্তানি। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে যেখানে এডজুটেন্টই যুদ্ধে যেতে ক্যাডেটদের উৎসাহিত করেছেন সেখানে মোমেনশাহীর অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। মেজর কাইউম ছিলেন এডজুটেন্ট। এই প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বেশ কিছু ক্যাডেট যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। শহীদ খোরশেদ তারই উদাহরণ। এছাড়াও আরও কয়েকজন যুদ্ধে অংশ নেন এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার যুদ্ধ শেষে কলেজে ফিরে আসেন।
শিক্ষা ব্যবস্থা
ক্যাডেটগণ সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ছয় বছরের জন্য তাদের পড়াশুনা চালান। উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষা হল চূড়ান্ত পরীক্ষা।
প্রতিটি ক্লাস সাধারণত পঞ্চাশজন ছাত্র থাকে। এখানে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) এবং উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষা ঢাকা বিভাগের শিক্ষা বোর্ডের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।
বিভাগ
|
|
|
|
জাতীয় শিক্ষা নীতি অনুসারে, মির্জাপুর ৯ম শ্রেণী থেকে ক্যাডেটদের জন্য শুধুমাত্র বিজ্ঞান এবং মানবিক শিক্ষা বিভাগে পড়ায়। তবে, ক্যাডেটদের বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য উত্সাহিত করা হয়।
অবকাঠামো
কলেজের ক্যাম্পাসের নকশা করেছেন থারিয়ানি।
যাদুঘর
যাদুঘরটি চারু ও কারুশিল্প এবং ভূগোল বিভাগের পাশে অবস্থিত। এখানে কিছু আইটেম হল:
- বাংলাদেশের এমসিসি এবং ক্যাডেট কলেজ সম্পর্কিত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলির ছবি।
- কলেজের একটি মানচিত্র।
- নাসার নভোচারীগণ দের খাবারের প্যাকেট ।
- বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমীর সোর্ড অব অর্নার ।
যাদুঘর পরিচালক হলেন কলা ও কারুশিল্প বিভাগের প্রধান নাঈনা আক্তার।
ভোজনশালা
সব ক্যাডেট ডাইনিং হল বা ভোজনশালায় একসঙ্গে তাদের খাবার খান। অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের জন্য পৃথক আসনযুক্ত খাবার সুবিধা আছে যা "হাই টেবিল" হিসাবে পরিচিত। প্রতিদিন পাঁচ বার খাবার পরিবেশন করা হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মনোনীত দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্ররা ডাইনিং হলের নেতৃত্ব দেয়।
হাউজ
ফজলুল হক হাউস(বর্তমান চ্যাম্পিয়ন হাউস) | এ কে ফজলুল হক-এর নামানুসারে সন্ধান সংগ্রাম বিজয় বাঘ নীল |
---|---|
সোহরাওয়ার্দী হাউস | হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী-এর নামানুসারে এলাম দেখলাম জয় করলাম ঈগল লাল |
নজরুল হাউস | কাজী নজরুল ইসলাম-এর নামানুসারে চির উন্নত মম শির সিংহ সবুজ |
১৯৬৫ সালের ৯ জানুয়ারি কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হলে ছাত্রছাত্রীদের আবাসনের জন্য জিন্নাহ (বর্তমানে ফজলুল হক হাউস) এবং লিয়াকত (এখন সোহরাওয়ার্দী হাউস) নামে দুটি ঘর ছিল। পরে আরো ছাত্রদের জন্য আইয়ুব হাউস (এখন নজরুল হাউস) নির্মিত হয়েছিল। ঘরগুলির মধ্যে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ঘরগুলিতে পয়েন্ট দেয়া হয়। বছর শেষে মোট পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে ঘরের চ্যাম্পিয়নশিপ নির্ধারিত হয়।
মসজিদ
একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় মসজিদ আছে যেখানে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে পারেন। সকল মুসলমান ক্যাডেটদের বাধ্যতামূলক মাগরিব এর নামাজ এখানে আদায় করতে হয়।ক্যাডেটরা তাদের জুম্মার নামাজ এখানে আদায় করে।
হাসপাতাল
মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ক্যাডেটদের জন্য এবং কর্মীদের জন্য একটি হাসপাতাল রয়েছে। সহকারীসহ আর্মি মেডিকেল কর্পসের একজন পূর্ণ-সময়ের ডাক্তারকে এই জন্য নিয়োগ করা হয়। সমস্ত ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হয়। যে কোন বিশেষ প্রয়োজন মেটাতে হাসপাতাল ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে।
জটিল ক্ষেত্রে সরাসরি ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল কাছে পাঠানো হয়।
গ্রন্থাগার
গ্রন্থাগারটির নাম শহীদ খুরশীদ স্মৃতি গ্রন্থাগার যা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া কলেজের এজকন ক্যাডেটের নামে নামকরণ করা হয়। গ্রন্থাগারের দেয়ালে খুরশীদ আলীর প্রতিকৃতি রয়েছে।
গ্রন্থাগারে ১৮০০০ টি বই আছে। এছাড়া দৈনিক পত্রিকা এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা পাওয়া যায়।
সংঘ ও সমিতি
- রোবটিক্স এবং প্রোগ্রামিং ক্লাব: সদস্যরা আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে রোবট বানানো শিখে এবং প্রোগ্রামিং চর্চা করে থাকে।২০১৯ সালে ক্যাডেটদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত এ ক্লাবটি আন্ত: হাউস ফুটবল প্রতিযোগতায় ডিজিটাল স্কোর বোর্ড তৈরির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে।ইতিমধ্যে এ ক্লাবের সদস্যরা ২০২০-আন্তর্জাতিক রোবটিক্স অলিম্পিয়াড এ পদক অর্জন করে ।
- কুরআনী সোসাইটি: সদস্যরা কুরআনের পাঠ্যক্রম অনুশীলন করে এবং আয়াতগুলির মূলনীতি ও তাত্পর্য শেখে। তারা মুহাম্মদ(সাঃ) এর জীবনধারা অধ্যয়ন করে।
- বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সোসাইটি সদস্যরা বাংলা সাহিত্য অন্বেষণ করে। তারা বাঙালি নাট্যকারদের দ্বারা তৈরি চরিত্রগুলি অভিনয় করে অনুশীলন করে। এছাড়াও কবিতা পাঠ, বিতর্ক এবং বহির্মুখী বক্তৃতা অনুশীলন করা হয়।
- ইংরেজি সোসাইটি: এটি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের জন্য উত্সাহ সৃষ্টি করে এবং ক্যাডেটের ইংরেজি ব্যবহার করার ক্ষমতা আরও বাড়ায়। সদস্যরা বক্তৃতা, পাবলিক ভাষাভাষী এবং বিতর্ক অনুশীলন করে।
- ভূগোল সোসাইটি
- হাইকিং ক্লাব
- আলোকচিত্র ক্লাব
- জীববিজ্ঞান ক্লাব
- প্রকৃতি অধ্যয়ন ক্লাব
- পদার্থবিজ্ঞান ক্লাব
- রসায়ন ক্লাব
- কম্পিউটার ক্লাব
- ফার্স্ট এইড ক্লাব
- ওয়াইড ওয়ার্ক ক্লাব
- সঙ্গীত ক্লাব: এই ক্লাবের সদস্য একজন সঙ্গীত শিক্ষকের নির্দেশনা অনুসারে অনুশীলন করে এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজায়। এখানে রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুল গান, গ্রামীণ (বাংলা-পল্লী) গান, আধুনিক গান, শাস্ত্রীয় গান এবং ব্যান্ডের গানের অনুশীলন করা হয়।
- সাধারণ জ্ঞান এবং বর্তমান বিষয়ক ক্লাব
- চারু ও কারুশিল্প ক্লাব
কৃতি সাবেক ক্যাডেট
- আতিউর রহমান, গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক
- জেনারেল আব্দুল মুবীন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান
- লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিনা ইবনে জামালী
- শাহাদুজ্জামান, মননশীল কথাসাহিত্যিক
- আলমগীর (পপ গায়ক) পাকিস্তান
চিত্রশালা
- মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ক্যাডেটদের হাউসের প্রবেশ পথ
- প্রশাসন ও একাডেমিক ভবনের সামনের বাগান.
- সোহরাওয়ার্দি হাউজ
- ক্যাডেটদের খেলার মাঠ
উৎস
- প্রসপেক্টাস - মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ
- বার্ষিকী ২০০২ - মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ
- বার্ষিকী ২০০৪ - মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ
- প্রসপেক্টাস - ক্যাডেট কলেজ
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলীলপত্র - তথ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকার
আরও দেখুন
- ক্যাডেট কলেজ
- কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ
- বাংলাদেশ সেনা বাহিনী
- মির্জাপুর এক্স ক্যাডেট্স এসোসিয়েশন