মহেশ চন্দ্র রায়

মহেশ চন্দ্র রায় (জন্ম : ১ জানুয়ারি, ১৯১৮ - মৃত্যু: ২৯ জানুয়ারি, ১৯৯৩) উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী। কানিছাত গারুনু আকাশি আকালী, টুলটুলিরে টুলটুলি দিনাও বেড়াইস চুলখুলি, কোঁড়ক কোঁড়ত কড়কা বাজে, ও তুই যাগে নানী থুইয়া আয় এলায়, দয়াল তুই আরিনে মোর নিদানে, বিয়াও বিয়াও করিস না ম্‌ন, আবো তুই মরিয়া গেইলে এ নাইওর মোক কায় নিগাইবে, না দেখো তোর টেরিয়া সিতা’, ‘ওরে ফোঁক দিও না প্রাণবন্ধুয়া মাকলা বাঁশের বাঁশিতে ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।[1]

মহেশ চন্দ্র রায়
জন্ম১ জানুয়ারি, ১৯১৮
পুটিমারী, কিশোরীগঞ্জ, নিলফামারী, ব্রিটিশ ভারত
মৃত্যু২৯ জানুয়ারি, ১৯৯৩
রংপুর, বাংলাদেশ
জাতীয়তাবাংলাদেশী
নাগরিকত্ব বাংলাদেশ
পরিচিতির কারণভাওয়াইয়া গানের শিল্পী
দাম্পত্য সঙ্গীবীণাপাণি রায় (মৃত্যু)
কামিনী বালা রায় (মৃত্যু)
সরলা বালা
সন্তান

প্রারম্ভিক জীবন

মহেশচন্দ্র রায়ের জন্ম ১৩২৫ সালের ১৯ মাঘ (১৯১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি) দলিত শ্রেণীভুক্ত রাজবংশী ক্ষত্রিয় বংশে। তার গ্রাম পুটিমারী (তৎকালীন রংপুর), বর্তমানে নীলফামারী জেলার কিশোরীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। বাবা বাবুরাম রায় ও মাতা বিমলা রানী। জন্মের পাঁচ বছর পরেই মহেশ রায়ের মা মারা যান। পিতার আদরে লালিত-পালিত শিশু মহেশকে বাবা গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি করান। তিন বছরের মাথায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে কিশোরীগঞ্জ ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। ১১-১২ বছর বয়সেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।

শিক্ষাজীবন শেষ করে যোগ দেন গ্রাম্য যাত্রা সংকীর্তন প্রভৃতির দলে। জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠেন অল্প দিনেই। এ সময় বাবা ছেলের ভবিষ্যত উন্নতির জন্য নীলফামারীর প্রবীণ উকিল সুরথ কুমার ঘোষের তত্ত্বাবধানে রেখে আসেন শহরে। এই শহরে ঘটনাক্রমে পরিচয় ঘটে ভারতবর্ষ অবতার পত্রিকার লেখক অধ্যাপক তারা প্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ও লেখক বলাই দেব শর্ম্মার সঙ্গে। তাদের নির্দেশেই পরবর্তীকালে তিনি সংগ্রহ করতে শুরু করেন প্রাচীন পুঁথি। কণ্ঠে ধারণ করতে থাকেন এই গানের অনেকগুলোই।

ব্যক্তিগত জীবন

নীলফামারী শহরে তার পালনকর্তা সুরথ কুমার ঘোষের মৃত্যুর পর মহেশচন্দ্র ছেড়ে দেন শহরবাস। এর মধ্যেই গান গাওয়ার সুবাদে তিনি শিক্ষকতার সুযোগ পান শহর থেকে দূরে জয়চণ্ডী পুটীহারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৩৪৪ থেকে ১৩৪৬ সন পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন তিনি এ বিদ্যালয়ে। আর সে সময়ই সংগলসী ইউনিয়নের দীঘলডাঙ্গী গ্রামের গগনচন্দ্র রায়ের কন্যা বীণাপাণি রায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং স্থায়ীভাবে থেকে যান শ্বশুরালয়েই। কিন্তু বেশিদিন টেকেনি তার স্থায়ী দাম্পত্য জীবন। স্ত্রী বীণাপাণি মৃত্যুবরণ করেন ১৩৪৯ সনে দুটি সন্তান রেখে। ১৩৫০ সনে তিনি বিয়ে করেন কামিনী বালা রায়কে। কয়েক বছর পর চারটি সন্তান রেখে দ্বিতীয় স্ত্রীরও বিয়োগ ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে মাতৃহীন সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করার পর শেষ বয়সে সরলা বালা নামক একজন বিধবাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছিলেন।

পাকিস্তান আমলে তিনি রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে কণ্ঠস্বর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিমাসে অনিয়মিত শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। সেখানে কয়েক বছর অতিবাহিত করার পর রংপুর কেন্দ্রে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন।[2]

সাহিত্য সাধনা

মহেশচন্দ্র রায় তার দীর্ঘ জীবনে যে গানগুলো সৃষ্টি করেছেন, ধারণ করেছেন, সেগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের চেষ্টাও চালিয়েছেন নিরন্তর। তার লেখা ও সুর করা গানগুলো গেয়েছেন বাংলাদেশের ভাওয়াইয়া গানের প্রধান শিল্পী মুস্তফা জামান আব্বাসী, শরিফা রানী, নাদিরা বেগম, রথীন্দ্রনাথ রায়সহ আরও অনেকে। বাংলা একাডেমীশিল্পকলা একাডেমী প্রকাশ করেছে গানের সঙ্কলন ও জীবনী এবং ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস বাংলাদেশ বেতার আর্কাইভসে সংরক্ষিত হচ্ছে তার গানের সুর। কথিত আছে যে, মহেশচন্দ্র রায়ের লিখিত গানের সংখ্যা এক হাজারের মতো। কিন্তু গবেষকের তথ্য অনুযায়ী সংগ্রহ করা গেছে মাত্র ২০০ গান।[1]

বই

১৯৯৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর মহেশ চন্দ্র রায় রচিত ‘ধীরে বোলাও গাড়ী’ (প্রথমখন্ড) নামে একটি গানের বই নীলফামারী শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে প্রকাশ করা হয়। ২০০৩ সালে বাংলা একাডেমী থেকে ‘মহেশ চন্দ্র রায়ের গান’ নামে একটি বই বের করা হয়। ২০১০ সালে শিল্পকলা একাডেমী ‘ভাওয়াইয়া শিল্পী মহেশ চন্দ্র রায়ের জীবনী ও গান’ নামে একটি বই প্রকাশ করে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীঁত বিষয়ে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় শিল্পীর গান ও জীবনী। [3]

দেহাবসান

এই শিল্পী ১৯৯৩ সালের ২৯ জানুয়ারি ৭৫ বছর বয়সে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র

  1. দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৮, ২০১০
  2. "সৈয়দপুরের লোকসঙ্গীতের প্রাণপুরুষ মহেশ চন্দ্র রায়ের ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ"। ২৮ অক্টোবর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০১৩
  3. ভাওয়াইয়া সম্রাট মহেশ চন্দ্র রায়
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.