মহাসাগর

মহাসাগর (বা মহাসমুদ্র, মহাসিন্ধু) অতি প্রকাণ্ড ও লবণযুক্ত বিপুল জলরাশি যা পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ওসেন শব্দটির উৎস হল প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘ওকিআনোজ’ (Ὠκεανός)।[1] স্বীকৃত ৫ টি মহাসাগর : প্রশান্ত, আটলান্টিক, ভারতীয়, আর্টিক, এবং দক্ষিণ[2][3]। মহাসাগরগুলি একত্রে পৃথিবীর মোট আয়তনের (৩.৬১×১০১৪ বর্গ মিটার) প্রায় ৭০.৯% স্থান দখল করে আছে। এ বিপুল জলরাশি আবার অনেকগুলো মহাসাগর ও ছোট ছোট সমুদ্রে বিভক্ত।

মহাসাগর ভাগের বিভিন্ন পদ্ধতি।

মহাসাগরের অর্ধেকেরও বেশি জায়গার গড় গভীরতা ৩,০০০ মিটারেরও (৯,৮০০ বর্গফুট) বেশি। মহাসাগরের জলের গড় লবণাক্ততা ৩.৫% এবং প্রায় সকল সমুদ্রের গড় লবণাক্ততা ৩% থেকে ৩.৮%৮। বৈজ্ঞানিকেরা হিসেব করে দেখেছেন যে, মহাসাগরে প্রায় ২,৩০,০০০ সামুদ্রিক ও জলজ প্রাণী রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সামুদ্রিক ও জলজ প্রাণীর সংখ্যা নির্ণিত সংখ্যার তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি।

পরিচিতি

প্রচলিতভাবে আমরা বিভিন্ন ধরনের মহাসাগরের নাম দেখতে পাই। একসময় বর্তমানকালের মহাসাগরগুলোর আন্তঃসংযোগকৃত লবণাক্ত জলরাশি ‘বৈশ্বিক মহাসাগর’ হিসেবে নির্দেশ করতো। মহাসাগর মূলতঃ একটি। এ ধারণাটি অবিচ্ছেদ্য ও পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং মুক্ত জলরাশির আন্তঃসংযোগে মহাসাগরীয়বিদ্যার মৌলিক গুরুত্বকেই তুলে ধরে। পাশ্চাত্ত্য ভূগোলবিদরা তাদের নিজেদের সুবিধার্থে মহাসাগরকে ৫টি অংশে বিভক্ত করেছেন। মহাসাগরীয় বিভাজনসমূহ সংজ্ঞায়িত এবং মূল্যায়িত হয়েছে - মহাদেশ, মাটির স্তর এবং অন্যান্য শর্তাবলীর আলোকে। সেগুলো হলোঃ-

  1. প্রশান্ত মহাসাগর: এটি আমেরিকাকে এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে বিভক্ত করেছে।
  2. আটলান্টিক মহাসাগর: এটি আমেরিকাকে ইউরেশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে বিভক্ত করেছে।
  3. ভারত মহাসাগর: এটি দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে রেখেছে এবং আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়াকে বিভক্ত করেছে।
  4. দক্ষিণ মহাসাগর বা এন্টার্কটিকা মহাসাগর: এ মহাসাগর এন্টার্কটিকা মহাদেশকে ঘিরে রেখেছে এবং প্রশান্ত, আটলান্টিক এবং ভারত মহাসাগরের বহিরাংশ হিসেবে নির্দেশিত হচ্ছে।
  5. উত্তর মহাসাগর বা আর্কটিক মহাসাগর: এ মহাসাগরটি আটলান্টিক মহাসাগরের একটি সমুদ্র হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছে যা আর্কটিকের অধিকাংশ এলাকা এবং উত্তর আমেরিকা ও ইউরেশিয়ার একাংশকে ঘিরে রেখেছে।

প্রশান্ত এবং আটলান্টিক মহাসাগর বিষুবরেখা কর্তৃক উত্তরাংশ ও দক্ষিণাংশকে আন্তঃবিভাজন করেছে। ক্ষুদ্রতম এলাকাগুলোয় মহাসাগরকে সাগর, উপসাগর, উপত্যকা, প্রণালী ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণে মহাসাগর বলতে সুবিশাল মহাসাগরীয় জলাধারকে বুঝায়। মহাসাগরীয় জলাধার হচ্ছে আগ্নেয়গিরির বাসাল্টের পাতলা স্তর যা পৃথিবীর অগ্নিকুণ্ডস্বরূপ। মহাসাগরীয় প্লেটের কঠিন আবরণের তুলনায় এর আবরণ পুরু হলেও কম ঘণপূর্ণ। এ দৃষ্টিকোণে পৃথিবীতে তিনটি মহাসাগর আছে যা বিশ্ব মহাসাগর, কাস্পিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণ সাগর বা ব্ল্যাক সি নামে পরিচিত। শেষোক্ত দু’টি লওরেসিয়াসহ কাইমেরিয়া এলাকায় একত্রিত হয়েছে। ভূ-মধ্যসাগর ঐ সময়েই মহাসাগর থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়, টেকটোনিক প্লেট নড়াচড়ার ফলে জিব্রাল্টার প্রণালী থেকে বিশ্ব মহাসাগরের সাথে সম্পর্কচ্যুত হয়। কৃষ্ণ সাগর বসফরাস প্রণালীর মাধ্যমে ভূ-মধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত হয়। কিন্তু বসফরাস প্রণালীর প্রাকৃতিক খালটি মহাদেশীয় শিলাচ্যুতির কারণে প্রায় ৭,০০০ বছর পূর্বে বিচ্ছিন্ন হয় এবং মহাসাগরীয় সাগরতলের একটি টুকরো জিব্রাল্টার প্রণালীর উদ্ভব ঘটে।

মহাসাগর এবং জীবনধারা

ভূ-মণ্ডলে মহাসাগরের বিপুল প্রভাব লক্ষ করা যায়। মহাসাগরীয় বাষ্পীভবন যা পানিচক্রের একটি ধাপ, তা অনেক বৃষ্টিপাতের উৎসস্থল হিসেবে চিহ্নিত তা মহাসাগরীয় তাপমাত্রা জলবায়ু ও বাতাসের গতিপথের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এটি ভূ-স্থিত জীবন ও জীবনধারায় বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। মহাসাগর গঠনের ৩ বিলিয়ন বছরের মধ্যে ভূ-স্থিত জীবন গড়ে উঠে। উপকূলের গভীরতা এবং দূরত্ব উভয়ই বিরাটভাবে প্রভাবান্বিত করেছে বলেই সাগর উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা জন্মেছে এবং সংশ্লিষ্ট প্রাণীকূল বসবাস করছে।

দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়সমূহ

বৈশ্বিক মহাসাগরের আয়তন প্রায় ৩৬১*১০ বর্গকিলোমিটার (১৩৯*১০ বর্গমাইল)। প্রতি ঘণকিলোমিটারে পানির আয়তন হচ্ছে ১,১১১ কিলোমিটার। মহাসাগরের গড় গভীরতা ৩,৭৯০ মিটার এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ১০,৯২৩ মিটার। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জলরাশি ৩০০০ মিটারেরও গভীরে রয়েছে। মোট বাষ্পীভবন হচ্ছে ১.৪*১০২১ কেজি যা পৃথিবীর মাত্র ০.০২৩%। ৩ শতাংশের কম স্বাদুপানি; বাকী লবণাক্ত পানির প্রায় সবই মহাসাগরের।

রং

সাধারণের ধারণা যে, মহাসাগরের পানির রং নীল। এছাড়াও, পানিতে খুবই কম পরিমাণে নীল রং থাকে এবং যখন বিপুল জলরাশিকে একত্রে রাখা হয় তখনই মহাসাগরের পানি নীল দেখায়। এছাড়াও, আকাশে নীল রংয়ের প্রতিফলন এর জন্য দায়ী, যদিও তা মূখ্য বিষয় নয়। মূল কারণ হচ্ছে - পানির পরমাণুগুলোতে লাল রংয়ের নিউক্লিয়ার কণা থাকে যা আলো থেকে আসে এবং প্রকৃতি প্রদত্ত রংয়ের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে ইলেকট্রনিক, ডাইনামিক বিষয়গুলোর তুলনায় প্রাকৃতিক অণুকম্পনকে ফলাফলকে ধরা হয়।

রক্তিম আভা

নাবিক এবং অন্যান্য নৌ-বিদদের প্রতিবেদনে জানা জায়, মহাসাগরে প্রায়শঃই দৃশ্যমান রক্তিম আভা, আলোকছটা মাইলের পর মাইল রাত্রে দেখা যায়। ২০০৫ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো প্রকাশ করেন যে, আলোকচিত্রের মাধ্যমে গ্লো’র উপস্থিতি তারা নিশ্চিত করেছেন। এটি জৈব-আলোকছটার সাহায্যে ঘটতে পারে।

আবিষ্কার

মহাসাগরে ভ্রমণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অতিপ্রাচীনকাল থেকেই নৌকা যোগাযোগের একটি প্রধান পরিবহন হিসেবে সু-খ্যাতি অর্জন করেছে। কিন্তু আধুনিক যুগে জলের নীচ দিয়েও ভ্রমণ করা সম্ভবপর হয়েছে। গভীরতম স্থান হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ হিসেবে নর্দার্ন মারিয়ানা দ্বীপের মারিয়ানা খাতের স্থান নির্ণিত হয়েছে। এর গভীরতা ১০,৯৭১ মিটার। ব্রিটিশ নৌযান চ্যালেঞ্জার-২ ১৮৫১ সালে স্থানটি জরিপ করে এবং সবচেয়ে গভীর স্থানকে নামকরণ করেছে ‘চ্যালেঞ্জার ডিপ’ হিসেবে। ১৯৬০ সালে ট্রিস্ট দু’জন ক্রু-সহ ‘চ্যালেঞ্জার-২’-এর কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছতে সফলকাম হন। অধিকাংশ মহাসাগরের কেন্দ্রস্থল এখনো আবিস্কৃত হয়নি এবং স্থানও নির্ণিত হয়নি। ১৯৯৫ সালে মহাকর্ষীয় সূত্র প্রয়োগ করে ১০ কিলোমিটারেরও অধিক বৃহৎ ভূ-চিত্রাবলীর দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে।

আঞ্চলিকতা

মহাসাগরবিশারদরা ভূ-গঠন এবং জীবনধারার উপযোগী পরিবেশকে উপজীব্য করে মহাসাগরকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করেছেন।

তথ্যসূত্র

  1. "Ὠκεανός"Perseus Digital Library। সংগ্রহের তারিখ মে ১৭, ২০১২
  2. "ocean, n"। Oxford English Dictionary। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১২
  3. "ocean"। Merriam-Webster। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১২

বহিঃসংযোগ

এখানে মহাসাগর সম্পর্কে 50টি অজানা তথ্য রয়েছে:

মহাসাগর পৃথিবীর পৃষ্ঠের প্রায় 71% জুড়ে রয়েছে। সমুদ্রের গড় গভীরতা প্রায় 12,080 ফুট (3,680 মিটার)। সমুদ্রে পৃথিবীর 97% জল রয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগর হল বৃহত্তম মহাসাগর, প্রায় 63 মিলিয়ন বর্গ মাইল (165 মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার) জুড়ে রয়েছে। ক্ষুদ্রতম মহাসাগর হল আর্কটিক মহাসাগর, প্রায় 5.4 মিলিয়ন বর্গ মাইল (14 মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার) জুড়ে রয়েছে। মহাসাগরে আনুমানিক 1 মিলিয়ন বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণী রয়েছে। মহাসাগর তাপ এবং কার্বন ডাই অক্সাইড সঞ্চয় করে পৃথিবীর জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। সমুদ্র সামুদ্রিক উদ্ভিদ দ্বারা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে পৃথিবীর অক্সিজেনের অর্ধেক উৎপাদন করতে সাহায্য করে। মহাসাগর সমুদ্রের স্রোতের মাধ্যমে সারা বিশ্বে তাপ বিতরণে সহায়তা করে। মহাসাগর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে জটিল বাস্তুতন্ত্রের আবাসস্থল। সমুদ্র হল 1 বিলিয়নেরও বেশি মানুষের প্রোটিনের প্রধান উৎস। মানুষের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রায় 25-30% সমুদ্র শোষণ করে। সমুদ্র প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য একটি "ডুব" হিসাবে কাজ করে, প্রতি বছর আনুমানিক 8 মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক সমুদ্রে প্রবেশ করে। মহাসাগর পৃথিবীর গভীরতম বিন্দুর আবাসস্থল, মারিয়ানা ট্রেঞ্চ, যা 36,070 ফুট (10,994 মিটার) গভীরতায় পৌঁছেছে। সাগরে পানির নিচের পাহাড় রয়েছে, যা সিমাউন্ট নামে পরিচিত, যা অনন্য ইকোসিস্টেমকে সমর্থন করতে পারে। সাগর অনেক সক্রিয় এবং সুপ্ত পানির নিচে আগ্নেয়গিরির আবাসস্থল। পৃথিবীর জলে চাঁদ এবং সূর্যের মহাকর্ষীয় টানের কারণে সমুদ্রে জোয়ার হয়। সমুদ্রের তরঙ্গ রয়েছে, যা জলের পৃষ্ঠ জুড়ে বাতাসের কারণে সৃষ্ট হয়। সাগর অনেক প্রজাতির মাছের আবাসস্থল, যার মধ্যে কিছু বড় মাছ রয়েছে, যেমন তিমি হাঙ্গর এবং মান্তা রে। সাগর অনেক প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাসস্থল, যেমন তিমি, ডলফিন এবং সীল। সমুদ্রে বিপন্ন লেদারব্যাক কচ্ছপ সহ অনেক প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের আবাসস্থল। সাগর অনেক প্রজাতির সামুদ্রিক পাখির আবাসস্থল, যেমন পেলিকান, সিগাল এবং অ্যালবাট্রস। সমুদ্র অনেক প্রজাতির জেলিফিশের আবাসস্থল, যার মধ্যে কিছু বায়োলুমিনেসেন্ট এবং রাতে জল আলোকিত করতে পারে। সাগরে অনেক প্রজাতির শেওলা রয়েছে, যার মধ্যে কিছু বিষাক্ত ফুল তৈরি করে যা সামুদ্রিক জীবন এবং মানুষের ক্ষতি করতে পারে। সাগরে কাঁকড়া, লবস্টার এবং চিংড়ির মতো বহু প্রজাতির ক্রাস্টেসিয়ানের বাসস্থান। সমুদ্র অনেক প্রজাতির মোলাস্কের আবাসস্থল, যেমন ক্লাম, ঝিনুক এবং স্কুইড। সমুদ্র অনেক প্রজাতির প্রবালের আবাসস্থল, যা বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্রগুলির মধ্যে একটি প্রবাল প্রাচীরের ভিত্তি তৈরি করে। সাগরে সারগাসো সাগরের মতো খুব কম সামুদ্রিক জীবন সহ পানির নিচে "মরুভূমি" রয়েছে। সাগরে গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের মতো প্রচুর সামুদ্রিক জীবন সহ পানির নিচে "মরুদ্যান" রয়েছে। সাগরে পানির নিচে "গিরিখাত" আছে যা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে গভীর, যেমন মন্টেরি ক্যানিয়ন। সাগরের পানির নিচে "নদী" আছে যা গভীর সমুদ্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, যেমন উপসাগরীয় স্রোত। সাগরে লোনা পানির পানির নিচে "হ্রদ" রয়েছে যা লোহিত সাগরের মতো মূল মহাসাগর থেকে বিচ্ছিন্ন। সাগর আছে

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.