মঙ্গলকাব্য

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বিশেষ এক শ্রেণির ধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্য মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, যে কাব্যে দেবতার আরাধনা, মাহাত্ম্য-কীর্তন করা হয়, যে কাব্য শ্রবণেও মঙ্গল হয় এবং বিপরীতে হয় অমঙ্গল; যে কাব্য মঙ্গলাধার, এমন কি, যে কাব্য ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয় তাকে বলা হয় মঙ্গলকাব্য।

সর্পদেবী মনসার প্রতিকৃতি

সার সংক্ষেপ

মঙ্গলকাব্য সাধারণত বিশেষ কোনও হিন্দু দেবতা বা দেবীকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। এইসব দেবতা বা দেবীরা ছিল মূলত বাংলার স্থানীয় (যেমনঃ মনসা); সেই কারণেই তারা বেদ, পুরাণ, প্রভৃতি ধ্রুপদী শাস্ত্রে ছিল অনুল্লেখিত। এইসব “নিম্নকোটি”, স্থানীয় দেবতাদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে তাদের পূজা-অর্চনা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করাই মঙ্গলকাব্যগুলির মূল লক্ষ্য ছিল বলে ইতিহাসবিদেরা মনে করে থাকেন। এইসব দেবতারা বেশিরভাগই পরবর্তীকালে বাংলার আঞ্চলিক হিন্দুত্ববাদের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই দেবদেবীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এই যে এদের প্রায়শই অসাধারণ দৃঢ় মানবিক গুণাবলির অধিকারী হতে দেখা যায় ও এরা সরাসরি মানুষের সাথে আচরণে লিপ্ত হয়ে থাকেন। তাদের চরিত্রের মধ্যেও নানা মানবিক দোষ ও গুণাবলিও (যেমনঃ ঘৃণা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, লোভ, স্নেহ, প্রভৃতি) পরিলক্ষিত হয়।

মঙ্গলকাব্যে স্থানীয় ও বহিরাগত দেবতাদের স্বার্থের মধ্যে প্রায়শই সংঘাত ঘটে থাকে এবং পরিসমাপ্তিতে স্থানীয় দেবতারা জয়লাভ করেন। মঙ্গল শব্দটির অপর অর্থ বিজয়।[1] অর্থাৎ, এই কাব্যগুলি লেখা হয়েছিল বিদেশী ঈশ্বরপূজারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় দেবতাদের জয়কে উদ্‌যাপন উপলক্ষে। এই কারণে এ ধরনের অনেক কবিতাতেই 'বিজয়' শব্দটির বিশেষ উল্লেখ রয়েছে, যেমন বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসাবিজয়

মঙ্গলকাব্য ছিল সকল মধ্যযুগীয় সাহিত্যের ধারক। মঙ্গলকাব্য ছিল বাংলা ভাষার ক্রান্তীয় মধ্যযুগীয় বহিঃপ্রকাশ।

রচনাপদ্ধতি

মঙ্গলকাব্য ৪টি অংশে রচিত হয়।

বন্দনা

প্রথম অংশ হল বন্দনা, এতে রয়েছে দেবীর বা সম্মানিতের অর্চনা। বন্দনা শূদ্র ও সংখ্যালঘু সীমান্ত পেরিয়ে এক মহিমান্বিত উপায়ে দেবীকে উত্সর্গ করা হয়।

কারণ

দ্বিতীয় অংশে কবি ব্যাখ্যা করেন কেন তিনি কিংবদন্তীটি রচনা করেছেন। কবি নিজের পরিচয় তুলে ধরেন এবং সেই দেবদর্শনের বর্ণনা দেন যা তাকে কবিতাটি লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। দেবদর্শন প্রধানত স্বপ্ন বা কোন স্বর্গীয় আদেশ হিসেবে আসে।

দেবখণ্ড

তৃতীয় অংশ দেবখণ্ড এক বৈদিক দেবতার সাথে স্থানীয় দেবীর সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ বর্ণনা করে। এই অংশের একটি পরিচিত অংশ হিসেবে প্রভু শিব সর্বদা একবার দর্শন দেন এই অংশে।

নরখণ্ড

চতুর্থ অংশে প্রধান বর্ণনা থাকে, সাধারণত এখানে দেবী অভিশপ্ত হয়ে স্বর্গ থেকে পতিত হন এবং স্বর্গীয় ধর্ম বিচ্যুত হন। তিনি তখন পুনর্জাগরণে নিমজ্জিত হন এবং মরণশীল হিসেবে পৃথিবীতে জীবনযাপন করেন। চূড়ান্তভাবে তিনি নিজেকে অর্চনীয় এক দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই গল্পের আর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল তার কষ্ট ও কষ্টমোচন, এবং তার চরিত্র ও ব্যবহারের বর্ণনা দেওয়া ।

গঠন: মঙ্গলসমূহ গঠনে একই রকম হলেও দৈর্ঘ্যে তারতম্য ঘটাতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো সাধারণ পয়ার মিটারে রচিত, যা ছন্দ “এএ বিবি” এর একটি দ্বৈত রূপ এবং একে লোক সাহিত্যের উপযোগী গঠন বিবেচনা করা হয়।

প্রয়োগ

দেব দেবীদের জন্য আয়োজিত উৎসবে কাব্যগুলো পাঠ করা হত বলে কাব্যগুলোতেই উল্লেখ রয়েছে। জনপ্রিয় কাব্যগুলোকে ভজন হিসেবে গ্রামের মানুষের বিনোদনের জন্য উপস্থাপন করা হত। গায়কদের পঙ্‌ক্তি বদলে ফেলার বদলে গানগুলোর বেশ কিছু প্রকরণ আছে। বেশির ভাগ কাব্যসমূহ সাধারণ দ্বৈত ছন্দে রচিত হত, এবং রূপক হিসেবে সাধারণ পার্থিব বস্তু যেমন: গ্রাম, মাঠ ও নদী ইত্যাদি ব্যবহার করা হত।

প্রভাব

১৭০০ সালের শেষের পর্যায়ে মঙ্গলকাব্য সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। মাজিলপুর শহরে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে এই অঞ্চলে মঙ্গলকাব্য রচিত ও প্রচারিত হবার পর থেকে শিব মন্দিরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল।

মঙ্গল কাব্যের কয়েকজন বিখ্যাত কবি

তথ্যসূত্র

  1. ভৌমিক, দুলাল। "মঙ্গলকাব্য"। banglapedia। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৯-০২
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.