ভাষার উৎস

ভাষার উৎস (ইংরেজি: Origin of language), যার ভাষাবৈজ্ঞানিক ইংরেজি নাম গ্লটোগনি বা গ্লসোগনি (Glottogony, Glossogeny), নিয়ে বহু শতাব্দী ধরে লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু ভাষার পরিবর্তনশীলতার জন্য প্রাচীন ভাষাগুলির উৎসের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য প্রায় নেই বললেই চলে। মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে আকার-ইঙ্গিতের নির্বাক অথবা প্রাক-ভাষা থেকে অন্তত একবার মৌখিক ভাষার জন্ম হয়। কিন্তু এর বেশি জানা নেই। বর্তমান মানব সভ্যতার কোথাও এখন সেই আদিম প্রাক ভাষার অস্তিত্ব নেই[1]। বিজ্ঞানীরা তাই বিভিন্ন অপ্রত্যক্ষ পদ্ধতি (indirect method) প্রয়োগ করে ভাষার উৎস খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

ভাষার উৎপত্তি

৮০ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার কিছু জঙ্গলে বাস করত এপ-জাতীয় কিছু প্রাণী। এই এপ-জাতীয় প্রাণীগুলির মধ্যে শিম্পাঞ্জি ও মানুষদের পূর্বপুরুষও ছিল। এরা সম্ভবত ছিল বর্তমান গরিলাদের মত। এরা মূলত বৃক্ষে বসবাস করত, মাটিতে চার পায়ে হাঁটত এবং বিশ-ত্রিশটার মত ভিন্ন ডাকের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করত। আজ থেকে ২০ লক্ষ বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষ প্রাণীটি শিম্পাঞ্জিদের পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে এই প্রাণীগুলির ভাষা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশ উন্নত; কিন্তু মানুষদের এই আদি পূর্বপুরুষদের ভাষার প্রকৃতি সম্পর্কে খুব কমই জানতে পারা গেছে। আধুনিক মানুষ তথা Homo Sapiens-এর ভাষার উৎস নিয়ে বিংশ শতাব্দীর বেশির ভাগ সময় ধরেই তেমন গবেষণা হয়নি। কেবল অতি সম্প্রতি এসেই এ বিষয়ে নৃবিজ্ঞানী, জিনবিজ্ঞানী, প্রাইমেটবিজ্ঞানী এবং স্নায়ুজীববিজ্ঞানীদের আহরিত তথ্য কিছু কিছু ভাষাবিজ্ঞানী খতিয়ে দেখছেন।

বিশ্বের অনেক ধর্মেই ভাষার উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে। ইহুদী-খ্রিস্টান-ইসলাম ধর্মের ধারায় বলা হয়, ঈশ্বর প্রথম মানুষ আদমকে বিশ্বের যাবতীয় পশু-পাখীর উপর কর্তৃত্ব দেন, এবং আদম এই সব পশু-পাখির একটি করে নাম দেন; এটি ছিল আদমের ভাষাজ্ঞানের প্রথম বড় প্রয়োগ। বর্তমানে পৃথিবীতে ভাষার প্রাচুর্যের কারণ হিসেবে বাবেলের মিনারের কাহিনীর উল্লেখ করা হয়; এই কাহিনী অনুসারে বর্তমান পৃথিবীতে ভাষার প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য হল মানুষের ঔদ্ধত্যের শাস্তি। এই ধর্মীয় কাহিনীগুলি অতীতে মেনে নেয়া হলেও বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে ভাষার উৎসের একটি প্রাকৃতিক, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

১৮শ শতকের বেশ কিছু ইউরোপীয় দার্শনিক যেমন জঁ-জাক রুসো, কোঁদিয়াক, হার্ডার, প্রমুখ মনে করতেন ভাষার উৎস নির্ণয় করা খুব কঠিন কোন কাজ নয়। ভাষা যে মানুষের লিখিত ইতিহাসের চেয়ে বহু প্রাচীন, এ ব্যাপারটিকে তারা তেমন আমল দেননি। তারা মনে করেছিলেন, ভাষাহীন মানুষ কীভাবে বসবাস করত, তা মনের পর্দায় গভীরভাবে কল্পনা করে যৌক্তিকভাবে এগোলেই ভাষার কীভাবে উৎপত্তি হল, সে বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এই অনুমানগুলির মধ্যে কোন ঐকমত্য নেই। ১৯শ শতকে ভাষার উৎস নিয়ে এমন সব উদ্ভট, কল্পনাপ্রসূত তত্ত্বের অবতারণা করা হয়েছিল, যে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠালগ্নে প্যারিসের ভাষাতাত্ত্বিক সমিতি একটি নির্ভরযোগ্য সংগঠন হিসেবে নিজেদের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাদের সমিতিতে ভাষার উৎস সংক্রান্ত যেকোন গবেষণাপত্র পাঠে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। আজও বেশির ভাগ ভাষাবিজ্ঞানী ভাষার উৎস সম্পর্কে তেমন আগ্রহী নন, কেননা তাদের মতে ভাষার উৎস নিয়ে যেকোন ধরনের সিদ্ধান্ত এতটাই কল্পনাপ্রসূত যে এগুলিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বের সাথে নেয়া সম্ভব নয়।

১৯৬০-এর দশক থেকে নোম চম্‌স্কির প্রবর্তিত ধারণাগুলি ব্যাকরণের তত্ত্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। চম্‌স্কির মতে ভাষাবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় একটি প্রশ্ন হল মস্তিষ্কে অন্তর্নিহিত যে ক্ষমতাবলে মানুষ তার জীবনের প্রথম বছরগুলিতে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে দক্ষভাবে কোন ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করে, সেই জৈবিক ক্ষমতার প্রকৃতি কী? এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাষার উৎসের গবেষণা বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানের একটি অংশ বলেই মনে হয়। কীভাবে আদি মানুষের মধ্যে এই অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বিকাশ ঘটেছিল? অন্যান্য প্রাইমেটদের মধ্যে কীভাবে এর বিবর্তন ঘটে? চম্‌স্কি নিজে অবশ্য বেশ স্পষ্টভাবেই ভাষার বিবর্তন নিয়ে গবেষণাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। ফলে চমস্কীয় ভাষাবিজ্ঞানীরা এক ধরনের স্ববিরোধিতার মধ্যে কাজ করছেন। তারা সব ভাষাকে একটিমাত্র বিশ্বজনীন ব্যাকরণের আওতায় এনে ব্যাখ্যা করতে চাইছেন, যে ব্যাকরণের উৎস হল মানুষের অন্তর্নিহিত ভাষিক ক্ষমতা। অথচ এই ক্ষমতাটির উদ্ভব ও বিকাশ কীভাবে ঘটল, তা নিয়ে তারা খুব একটা চিন্তিত নন। ইদানীং স্টিভেন পিংকার-সহ আরও কিছু বিজ্ঞানী এই নিরুদ্বেগ কাটিয়ে ভাষার উৎসের ব্যাপারে মনোযোগী হয়েছেন।

নৃবিজ্ঞান ও প্রত্নবিজ্ঞান থেকে প্রাপ্ত প্রমাণাদি

নৃবিজ্ঞানে কেবল মানুষের সংস্কৃতি নয়, জীববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের বিবর্তনের ধারাও আলোচিত হয়। নৃবিজ্ঞানীরা ভাষাকে মানুষের সংস্কৃতির একটি প্রপঞ্চ হিসেবে যেমন গণ্য করেন, তেমনি এটিকে আধুনিক Homo Sapiens-এর সবচেয়ে স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য হিসেবেও মর্যাদা দেন। তাই সাংস্কৃতিক ও জীববৈজ্ঞানিক উভয় ধরনের নৃবিজ্ঞানীরাই ভাষার উৎস সম্পর্কে আগ্রহী।

ভাষার যে প্রত্যক্ষ লিখিত নিদর্শন পাওয়া গেছে, তার বয়স ৫ হাজার বছরের বেশি নয়। মুখের ভাষার উৎপত্তি কী করে ঘটল, তার উপর এই প্রমাণ তাই আলোকপাত করতে পারে না। তাই ভাষার উৎসের জন্য আমাদেরকে অপ্রত্যক্ষ প্রমাণের উপরেই নির্ভর করতে হবে। প্রাচীন মানুষদের বাগযন্ত্র (জিহ্বা, ঠোঁট, স্বরযন্ত্র) সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারলে আমরা অনেক কিছু জানতে পারতাম, কিন্তু এগুলি নরম পেশীকলা দিয়ে তৈরি বলে আজ আর এগুলির অস্তিত্ব নেই। নৃবিজ্ঞানীদেরকে তাই খুলির হাড় থেকেই প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়েছে। এর বাইরে প্রাচীন মনুষ্যবসতির আশেপাশে পাওয়া পাথরের হাতিয়ার, ফেলে দেওয়া জীবজন্তুর হাড় ও অন্যান্য উপকরণ থেকে যতদূর সম্ভব তথ্য আহরণ করতে হয়। এ সব বিচার করে নৃবিজ্ঞানীরা দুইটি তুলনামূলকভাবে স্থির তারিখের উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে একটি তারিখের পর থেকে নিশ্চিতভাবেই মানুষের মুখের ভাষা তার আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করেছিল। অন্যদিকে অপর তারিখটির পূর্বে নিশ্চিতভাবেই মানুষের মুখের ভাষা তার আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করেনি। এই দুই তারিখের মধ্যবর্তী সময়ে ভাষার বিবর্তন কীভাবে ঘটেছিল, দুর্ভাগ্যবশত বর্তমানে প্রাপ্ত প্রমাণাদি থেকে এ সম্পর্কে কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়।

নৃবিজ্ঞানীরা আরও মনে করেন, ভাষার উৎপত্তির ঘটনা ইতিহাসে একবারই ঘটেছিল, একাধিকবার নয়। বিশ্বের সর্বত্র প্রচলিত মনুষ্য ভাষাগুলির মধ্যে গাঠনিক সাদৃশ্য এই অনুমানের ভিত্তি। ধারণা করা হয় আধুনিক ভাষাক্ষমতা বলতে যা বোঝায়, তার সূচনা ঘটেছিল অস্ট্রেলিয়াতে Homo Sapiens-দের বসতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা অনুসারে এই ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে ৪০ থেকে ৬০ হাজার বছর আগে।

অন্যদিকে এ কথাও সত্য যে আধুনিক মুখের ভাষাগুলির বিভিন্ন ধ্বনি উচ্চারণের জন্য মানুষের বিশেষ উল্টো L আকৃতির বাগনালী প্রয়োজন, এবং স্বরযন্ত্র বা ল্যারিংক্সের গলার বেশ ভেতরে থাকা প্রয়োজন। কোন কোন প্রত্নতাত্ত্বিকের মতে নিয়ান্ডার্থাল মানুষদের মধ্যেও ল্যারিংক্সের অবস্থান গলার বেশ উপরের দিকে ছিল এবং তাদের পক্ষে বর্তমান মনুষ্য ভাষার ধ্বনিগুলি উচ্চারণ করা সম্ভব ছিল না। আবার কোন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন মানুষ যখন দুই পায়ে হাঁটা শুরু করেছিল, তখন মানুষের মাথার খুলি মেরুদণ্ডের সাথে একই রেখাতে চলে আসে এবং খুলির ভিত্তির সংকোচন ঘটে, ফলে মানুষের স্বরযন্ত্র গলার গভীরে নেমে আসে। এ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন দ্বিপদী মানুষটি হল australopithecus afarensis প্রজাতির লুসি-র কঙ্কাল, যার বয়স প্রায় ৩০ লক্ষ বছর। সুতরাং অনুমান করা যায়, ঐ সময়ের দিকেই মানুষের ভাষা উৎপাদনকারী বিশেষ বাগযন্ত্রের উৎপত্তি হয়েছিল।

আদি মানুষের মস্তিষ্কের বিবর্তনের সাথে ভাষার উৎপত্তির সম্পর্ক স্থাপন করা আরও কঠিন। আদি মানুষের মস্তিষ্কের কোন অবশেষ আমাদের কাছে নেই। এদের মাথার খুলির ভেতরের খাঁজ থেকে মস্তিষ্কের বহির্গঠন সম্পর্কে ধারণা করা যায়। আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের যে অংশের সাথে ভাষার ক্ষমতা জড়িত, তাকে ব্রোকা-র এলাকা বলা হয়। মানুষের আদি পূর্বপুরুষদের মধ্যে ব্রোকার এলাকার মত কোন এলাকা ছিল কি না তা যদি জানাও যায়, তার পরেও সেটি ভাষার উৎস সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করতে পারবে না। ব্রোকার এলাকা শুধু ভাষা নয়, মানুষের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের সাথেও জড়িত। এছাড়া শিম্পাঞ্জি ও অন্যান্য এপ-জাতীয় প্রাণীর মস্তিষ্কের মধ্যে এরকম কোন আলাদা এলাকা দেখতে পাওয়া যায়নি, যা তাদের মৌখিক ভাষার সাথে সম্পর্কিত।

কোন কোন পণ্ডিত ডান হাতে কাজ করার প্রবণতার সাথে ভাষার সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। বেশির ভাগ মানুষের ডান হাতে কাজ করার প্রবণতা বেশি, আর মানুষের ডান হাত নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের বাম অংশ, যে অংশে ভাষা এলাকাগুলি অবস্থিত। তারা মনে করেন যে যদি দেখানো যায় যে প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা বেশির ভাগ ডান হাতে কাজ করত, তাহলে হয়ত ভাষার উৎসের সাথে এই ডান হাতে কাজ করার একটা সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু ডান বা বাম হাতে কাজ করার প্রবণতার সাথে ভাষিক দক্ষতার কী ধরনের কার্যকারণ সম্পর্ক আছে, তার কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আজও দেয়া সম্ভব হয়নি।

জীববৈজ্ঞানিক নৃবিজ্ঞানের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হতে পারে যে মানুষের ভাষিক দক্ষতার উন্নতির ছাপ তার আশেপাশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, তার হাতিয়ারে, সরঞ্জামে, শিল্পে, ইত্যাদিতে পড়ার কথা। আসলেই প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে মানুষের হাতিয়ার ও সরঞ্জামের বৈচিত্র্য ও মানে এক ধরনের ব্যাপক উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। ফ্রান্সের লাস্কো-র বিখ্যাত গুহাচিত্রগুলিও প্রায় ৩০ হাজার বছর পুরনো। কিন্তু এই তারিখগুলিকে আধুনিক ভাষা উদ্ভবের তারিখ হিসেবে বেশ দেরির তারিখ বলেই গণ্য করা হয়।

তথ্যসূত্র

  1. "Primitive languages"Language Miniatures। ২০০৭-০২-০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৭

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.