ভারতের রেল পরিবহনের ইতিহাস

ভারতের রেল পরিবহনের ইতিহাস আরম্ভ হয়েছিল উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে। ১৮৪৯ সালে ভারতে এক কিলোমটারও রেলপথ ছিল না। ১৯২৯ সাল পর্যন্ত দেশের বেশিরভাগ জেলা নিয়ে ৪১,০০০ মাইল রেলপথ বাড়ানো হয়েছিল। সেই সময়ের হিসাবে রেলওয়ের মূলধন ছিল ৬৮৭ মিলিয়ন ষ্টার্লিং। [1]

ভারত রেল সংযোগ

ভারতের প্রথম রেলওয়ের প্রস্তাব ১৮৩২ সালে মাদ্রাজ তৈরি করা হয়েছিল।[2] দেশের প্রথম ট্রেন, 'রেড হিল রেলওয়ে' (রাস্তার বিল্ডিংয়ের জন্য গ্রানাইট পরিবহনের জন্য আর্থার তুলা নির্মিত হয়েছিল, রেড হিলস ১৮৩৭ সালে মাদ্রাজে চিনত্রিপেট সেতুতে গোদাওয়ারি বাঁধ নির্মাণ রেল রাজমুমারী ডলেশ্বরম ১৮৫১ সালে, গোদাওয়ারী নদী থেকে বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রস্তর সরবরাহের জন্য রুড়ি রুর্কি থেকে রুবি কটিলি সোলানি অ্যাকুড্টল রেলওয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। সোলানি নদীর উপর অ্যাককডাক্ট[2]

1855 সালে থানে কাছে ছোট থেন রেলওয়ে সেতু
1855 সালে থানে নিকটস্থ থানা রেলওয়ে সেতুতে একটি ট্রেন

এই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ব্রিটিশ সংসদে গৃহীত হওয়া একটি আইনের মাধ্যমে ১৮৪৯ সালের ১ আগস্টে দি গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে (Great Indian Peninsula Railway) গঠন করা হয়েছিল। মুখ্য কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল মুম্বইয়ের বোরি বন্দরে। কোম্পানিটির অংশের মূলধন ছিল ৫০,০০০ পাউণ্ড। ১৮৪৯ সালের ১৭ আগস্ট পেনিনসুলা রেলওয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ৫৬ কিঃ মিঃ দৈর্ঘ্যের একটা রেলপথ স্থাপন এবং পরিচালনা সম্পর্কিত একটি চুক্তিত আবদ্ধ হয়। ১৬ এপ্রিল ১৮৫৩ তারিখটি ভারতীয় রেল পরিবহনের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটিতে ভারতের মুম্বইয়ের বোরি বন্দর স্টেশন থেকে থানে পর্যন্ত প্রথম রেলের যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল। [3] ফকল্যাণ্ড নামের ছোট স্টিম ইঞ্জিনে টানা ১৪টা বগির রেলটিতে সেদিন কোনো সাধারণ যাত্রী ছিল না। ছিলেন ৪০০জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। ২১টি তোপধ্বনির মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক যাত্রার শুভারম্ভ করা হয়েছিল বেলা ৩-৩৫ টায়।[4] বোরি বন্দর স্টেশনকে পরবর্তী কালে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস এবং বর্তমানে ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস বলে নামকরণ করা হয়। গথিক স্থাপত্যের আদলে নির্মাণ করা এই স্টেশনটি বিশ্ব ঐতিহ্যর তালিকায় স্থান পেয়েছে।[5]

১৮৪৫-৪৬ সালে কলকাতা থেকে এবং দিল্লী পর্যন্ত রেলপথ বাড়ানোর জন্য সার্ভে করা হয়। এর তিন বছর পরে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে হাওড়া থেকে পান্ডুয়া পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন লাভ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের মুখ্য কার্যালয় ছিল হাওড়ায়। ১৯৫৭ সালের শেষদিকে এই ৬১ কিঃ মিঃ দৈর্ঘ্যের পথটির কাজ শেষ হয়। ১৮৫৪ সালের ২৮ জুনের দিন পরীক্ষামূলকভাবে রেলের চলাচল করানো হয়। একই বছরের ১৫ আগস্ট থেকে নিয়মিত হাওড়া এবং হুগলির মধ্যে পুরোপুরি যাত্রীবাহী রেলের পরিষেবা আরম্ভ হয়।

১৫ আগস্ট ১৮৫৪ সালে হাওড়া থেকে হুগলি, পূর্ব ভারতের প্রথম রেল চলাচলের স্মৃতিফলক

মাদ্রাজ রেলওয়ে কোম্পানিটি বেয়াসারপান্দি থেকে (Veyasarpandy) ওয়ালাজা রোড বা আরকট পর্যন্ত (Walajah Road) ৬৩ কি.মি. রেলপথ ১৮৫৬ সালের ১ জুলাইয়ের দিন মুক্ত করে। আর. আর. ভাণ্ডারি তার 'সাউদার্ণ রেলওয়ে' নামের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ১৮৩৬ সালে ৩.৫ মাইল (৫.৬ কি.মি.) দৈর্ঘ্যের একটা রেলপথ বাড়ানো হয়েছিল। এটিই ভারতের সর্বপ্রথম রেলপথ। রেড হিল থেকে সেণ্ট থমাস মাউণ্টের শিলারখনি পর্যন্ত মাত্র পাথর তোলার উদ্দেশ্যে এই পথটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তাছাড়া, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি ১৯৩২ সালে সর্বপ্রথম রেলপথ নির্মাণের প্রস্তাব দাখিল করেছিল। এরপরে বেঙ্গল এবং বোম্বে প্রেসিডেন্সি এমন প্রস্তাব দেয়। [1] এলাহাবাদ থেকে কানপুর পর্যন্ত ১১৯ মাইল দৈর্ঘ্যের রেলপথ ১৯৫৯ সালের ৩ মার্চ মুক্ত করা হয়েছিল। এটি ছিল উত্তর ভারতের প্রথম রেলপথ। ১৮৮৯ সালে বাড়ানো হয়েছিল দিল্লী- আম্বালা- কালকা পথ।[3]

১৮৭৪ সাল থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে নর্থ বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে বর্তমান বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে চিলাহাটী হয়ে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি পর্যন্ত একটা ২৫০ কি.মি. দৈর্ঘ্যের রেলপথ নির্মাণ করেছিল। ১৮৮২ সালে "অসম রেলওয়ে এণ্ড ট্রেডিং কোম্পানি" প্রথম অসমে রেলপথ স্থাপন করেছিল। ডিব্রুগড়ের আমোলাপট্টি থেকে দিনজান পর্যন্ত নির্মাণ করা ১৫ কিঃ মিঃ দৈর্ঘ্যের মূলতঃ চাপাতা এবং কয়লা উত্তোলনের জন্য নির্মাণ করা এই রেলপথ ১৯৮৪ সালে মার্ঘেরিটা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। এই কোম্পানিটি ডিব্রু-শদিয়া রেলওয়ে নামে অসমে প্রথম যাত্রীবাহী রেলের প্রচলন করেছিল। অন্যদিকে, ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে হলদিবাড়ি-শিলিগুড়ি, বারসোই-কিসানগঞ্জ, মণিহারি-কাটিহার-কাসবা রেলপথগুলি ১৯০০ সালের কিছু আগে নির্মাণ করে ফেলেছিল। ১৯০০- ১৯১১ সালের মধ্যে হাসিমারা-আলিপুরদুয়ার, গীতালদহ- বামনহাট, গোলোকগঞ্জ-ধুবড়ি-আমিনগাঁও, রঙিয়া-রঙাপারা রেলপথগুলি নির্মাণ করা হয়েছিল। অসমের বরাক উপত্যকার রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ করেছিল আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে

স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় রেলের শুরু

বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত, ভারতের ব্যস্ততম রেল স্টেশন ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস। পূর্বের নাম ছিল ক্রমে বোরি বন্দর এবং ভিক্টোরিয়া টার্মিনস

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজিত রূপে স্বাধীনতা লাভ করে। রেল নেটওয়ার্কের ৪০ শতাংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলস্বরূপ, কিছু স্থানের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। বিশেষত অসমের সঙ্গে ভারতের মূল ভূমিভাগকে সংযোগ করা রেলপথটির একটা অংশ পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় দুই বছরেরও অধিক কাল অসমের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে।

অসম রেল সংযোগ প্রকল্পের অধীনে কিসানগঞ্জ এবং ফকিরাগ্রাম সংযোগী রেলপথ নির্মাণর পর রাজ্যটির সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন হয়। অসমের বরাক উপত্যকা, পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি রাজ্যের বহু রেলপথ বন্ধ হয়ে যায়। নতুন পথ নির্মাণ করে যোগাযোগ সচল করে তোলা হয়। স্বাধীনতার পূর্বে বহুস্থানে বিভিন্ন কোম্পানীর অধীনে রেল পরিষেবা চলত।

স্বাধীনতার পরে ভারতের রেল পরিবহনকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয় এবং পরিচালনার সুবিধার্থে ১৯৫১-৫২ সালে ভারতীয় রেলকে ৬টা জোনে (Zone) বিভাজিত করা হয়।[6]

স্থাপনার তারিখ জোন সদর পূর্বের রেল কোম্পানী
১৪-৪-১৯৫১দক্ষিণ রেলওয়ে
Southern Railway
চেন্নাইদক্ষিণ মারহাট্টা রেলওয়ে
মাদ্রাজ রেলওয়ে
মহীশূর রেলওয়ে
দক্ষিণ ভারতীয় রেলওয়ে
৫-১১-১৯৫১মধ্য রেলওয়ে
Central Railway
মুম্বাইগ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে
নিজাম রেলওয়ে
স্কিণ্ডিয়া রেলওয়ে
ধলপুর রেলওয়ে
৫-১-১৯৫১পশ্চিম রেলওয়ে
Western Railway
মুম্বাইবোম্বে বরোদা এবং মধ্য ভারতীয় রেলওয়ে
সৌরাষ্ট্র রেলওয়ে
রাজস্থান রেলওয়ে
জয়পুর রেলওয়ে
১৪-৪-৯৫২উত্তর রেলওয়ে
Northern Railway
নতুন দিল্লীপূর্ব পাঞ্জাব
বিকানির রেলওয়ে
পূর্ব ভারতীয় রেলওয়ের ৩, আপার ডিভিজন
১৪-৪-১৯৫২উত্তর-পূর্ব রেলওয়ে
North Eastern Railway
গোরখপুরঅবোধ
তিরহুট রেলওয়ে
আসাম রেলওয়ে
১৪-৪-১৯৫২পূর্ব রেলওয়ে
Eastern Railway
কলকাতাবঙ্গ-নাগপুর রেলওয়ে
পূর্ব রেলওয়ের বাকী অংশ

পরবর্তী পর্যায়ে ভারতীয় রেলের এবং কিছু জোন সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে ভারতীয় রেলের মোট জোন ১৬টা।[7] নতুনকরে স্থাপন করা জোনগুলি হল-

স্থাপনার তারিখ জোন সদর
১৯৫৫দক্ষিণ পূর্ব রেলওয়ে
South Eastern
কলকাতা
১৯৫৮উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলওয়ে
Northeast Frontier Railway
গুয়াহাটি
২-১০-১৯৬৬দক্ষিণ মধ্য রেলওয়ে
South Central
চেকেন্দ্রাবাদ
১-১০-২০০২পূর্ব মধ্য রেলওয়ে
East Central Railway
হাজীপুর
১-১০-২০০২উত্তর পশ্চিম রেলওয়ে
North Western Railway
জয়পুর
১-৪-২০০৩দক্ষিণ পূর্ব মধ্য রেলওয়ে
South East Central Railway
বিলাসপুর
১-৪-২০০৩দক্ষিণ পশ্চিম রেলওয়ে
South Western Railway
হুবলি
১-৪-২০০৩পশ্চিম মধ্য রেলওয়ে
West Central Railway
জব্বলপুর
১-৪-২০০৩পূর্ব উপকূলীয় রেলওয়ে
East Coast Railway
ভূবনেশ্বর
১-৪-২০০৩উত্তর মধ্য রেলওয়ে
North Central Railway
এলাহাবাদ

তথ্যসূত্র

  1. "Heritage consciousness"। The Hindu। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১২
  2. "[IRFCA] India's First Railways"www.irfca.org
  3. "Official site of Nothern Railway"। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১২
  4. "ভারতীয় রেলের ইতিহাস"। ২৫ নভেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১২
  5. "ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস"। জানুয়ারি ১৯, ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১২
  6. "ভারতীয় রেলের পুনর্গঠন"। মে ৩, ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৫, ২০১২
  7. "ভারতীয় রেল জোন" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৫, ২০১২

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.