ভাগবত পুরাণ
ভাগবত পুরাণ (দেবনাগরী: भागवतपुराण; অন্যান্য নাম শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবতম্ বা ভাগবত;) হল একটি হিন্দু মহাপুরাণ। এটি একটি ভক্তিবাদী ধর্মগ্রন্থ। বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার তথা "স্বয়ং ভগবান" কৃষ্ণের প্রতি গভীর ব্যক্তিগত ভক্তিই এই পুরাণের প্রধান আলোচ্য বিষয়।[1] হিন্দু পৌরাণিক সাহিত্যের অনেক কাহিনি তথা বিষ্ণুর চব্বিশ জন অবতারের কাহিনি ভাগবত পুরাণে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ভাগবত পুরাণই প্রথম পুরাণ যেটি কোনো ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়। ১৮৪০ থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে ভাগবত পুরাণের তিনটি ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।[2] পদ্মপুরাণের শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে ভাগবত পুরাণ একটি সাত্ত্বিক পুরাণ (অর্থাৎ, এই পুরাণ কল্যাণ ও পবিত্রতার সঙ্গে যুক্ত)।[3] প্রচলিত হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, ব্যাস এই পুরাণের রচয়িতা।
ভাগবত পুরাণকে পবিত্রতম ও সর্বশ্রেষ্ঠ পুরাণ মনে করা হয়। কারণ, এটি বিষ্ণু ও তার বিভিন্ন অবতারের (প্রধানত কৃষ্ণের) প্রতি ভক্তির কথা প্রচার করে।[4] এই পুরাণে জাগতিক কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি, বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের উপায় ও বিষ্ণুভক্তির মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে।[5]
ভাগবত পুরাণ সর্বাধিক প্রভাবশালী অষ্টাদশ পুরাণও ইতিহাস রামায়ণ, মহাভারতের পাশাপাশি অন্যান্য পুরাণের সাথে এটিকে "পঞ্চম বেদ" বলা হয়ে থাকে।[6][7]
ভাগবত পুরাণে বিষ্ণুকে (নারায়ণ) পরব্রহ্ম বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তিনিই অসংখ্য বিশ্ব সৃষ্টি করে প্রতিটির মধ্যে ঈশ্বর-রূপে প্রবেশ করেন।[8] বিষ্ণু রজোগুণ অবলম্বন করে ব্রহ্মা রূপে প্রত্যেক বিশ্বের মধ্যে চোদ্দোটি করে জগৎ সৃষ্টি করেন; সত্ত্বগুণ গ্রহণ করে বিষ্ণু রূপে সেই জগৎগুলি রক্ষা ও প্রতিপালন করেন এবং মহাকল্পের অন্তকালে তমোগুণ অবলম্বন করে রুদ্র রূপে সেই জগৎগুলি ধ্বংস করেন।[9][10]
এই পুরাণ প্রথমে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। এর বর্তমান রূপটি খ্রিস্টীয় ৪র্থ থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে লিপিবদ্ধ হয়।[2][11]
বিষ্ণুর যে মানবরূপ কৃষ্ণের প্রতি ভক্তি ভাগবত পুরাণের আলোচ্য, সেই কৃষ্ণের কাহিনি এই পুরাণের ১০ম স্কন্ধে এককভাবে বর্ণিত হয়েছে। এই স্কন্ধটি সমগ্র ভাগবত পুরাণের এক-চতুর্থাংশ জুড়ে রয়েছে।[2] কৃষ্ণের জন্ম থেকে অন্তর্ধান পর্যন্ত সকল ঘটনা এই স্কন্ধেই সুসংবদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে ভক্তিযোগের আচরণ-পদ্ধতি, ভক্তির ব্যাখ্যা এবং বিভিন্ন ধরনের ভক্তির বর্ণনা।[12] অনেক বৈষ্ণব এই গ্রন্থটিকে ও কৃষ্ণকে অভিন্ন এবং এই গ্রন্থটিকেই কৃষ্ণের বাণীমূর্তি মনে করেন।
ভাগবত পুরাণের সকল কাহিনি ব্যাসের পুত্র শুকের মুখে বর্ণনাচ্ছলে কথিত হয়েছে। মহাভারতে আছে রাজা পরীক্ষিৎ কৃষ্ণের তৎপরতায় জীবন পেয়েছিলেন। ভাগবত পুরাণে দেখা যায়, মৃত্যুপথযাত্রী পরীক্ষিৎ শুকের মুখে কৃষ্ণের কথা জানতে চান। তার নানা প্রশ্নের উত্তরে সাত দিনে শুক তার কাছে ভাগবত পুরাণের কাহিনি বিবৃত করেন।
হিন্দুধর্ম |
---|
ধারাবাহিকের অংশ |
|
গুরুত্ব
ভাগবত পুরাণ সর্বাধিক পরিচিত । ভারতীয় ধর্মীয় সাহিত্যে ভাগবত পুরাণ একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে। কারণ, ভক্তিবাদের উপর এই পুরাণ বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ভগবদ্গীতার তাত্ত্বিক ভক্তির তুলনায় ভাগবত পুরাণের ভক্তি অনেক বেশি ব্যবহারিক। ধর্মের সংজ্ঞা এই পুরাণে পুনরালোচিত হয়েছে এবং ঈশ্বরকে মানবরূপী বলে তার সেই স্বরূপের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।[12] ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত কৃষ্ণের ছেলেবেলার নানান জনপ্রিয় কাহিনির উৎস এই পুরাণ।[2] ভাগবত পুরাণ নিজেকে বেদান্তের সার বলে ঘোষণা করে থাকে:
"শ্রীমদ্ভাগবতম্ হল বেদান্ত সাহিত্যের যথার্থ সারমর্ম। যিনি এই গ্রন্থের রসামৃত পান করেন, তিনি অন্য কিছু কামনা করেন না।" (12.13.15)[13]
বৈষ্ণবরা বিষ্ণু পুরাণ ও ভগবদ্গীতাকে বিষ্ণুভক্তি-সংক্রান্ত বিষয়ে প্রধান শাস্ত্রীয় উৎস মনে করেন। ভাগবত পুরাণের একটি বহু-উদ্ধৃত শ্লোক উদ্ধৃত করে কৃষ্ণ-উপাসক বৈষ্ণবরা কৃষ্ণকে "স্বয়ং ভগবান" বা সাক্ষাৎ ঈশ্বর হিসেবে দাবি করে থাকেন: "এঁরা [অন্যান্য অবতারগণ] অংশ, বা কলা, অংশাবতার, কিন্তু "কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্", কৃষ্ণ নিজেই ভগবান"।(1.3.28).[14] কিন্তু কোনো কোনো বৈদিক পণ্ডিত বলে থাকেন, কৃষ্ণকে স্বয়ং ভগবান বলার কারণ, তিনি মহাবিষ্ণুর পূর্ণাবতার। বিষ্ণুপুরাণেও কৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়েছে। রাম প্রভৃতি বিষ্ণুর অন্যান্য অবতারগণকেও "ভগবান" বলা হয়ে থাকে।
১৫শ-১৬শ শতকে অসমে একেশ্বরবাদী একশরণ ধর্মের প্রবর্তক শঙ্করদেব ভাগবত পুরাণের একটি অসমীয়া অনুবাদ (শঙ্করদেবের ভাগবত) রচনা করেন। শঙ্করদেবের দশম স্কন্ধের অনুবাদ দশম বিশেষ জনপ্রিয়।
লক্ষ্য
ভাগবত পুরাণে হিন্দুধর্মের সকল ধর্মগ্রন্থ সহ ভাগবত পুরাণের লক্ষ্য বর্ণিত হয়েছে। এই পুরাণে বলা হয়েছে, পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার প্রকৃত সম্পর্কের রহস্য ভাগবত পুরাণেই নিহিত আছে।
″আদিমধ্যাবসানেষু বৈরাগ্যাখ্যানসংযুতম্ ।হরিলীলাকথাব্রাতামৃতানন্দিতসৎসুরম্।।
সর্ববেদান্তসারং যদ ব্ৰহ্মাত্মৈকত্বলক্ষণম্ ৷ বস্ত্বদ্বিতীয়ং তন্নিষ্ঠং কৈবল্যৈকপ্রয়োজনম্।। ″(ভাগবত পুরাণ, দ্বাদশ স্কন্ধ, ত্রয়োদশ অধ্যায়,একাদশ ও দ্বাদশ শ্লোক।)
″শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রীমদ্ভাগবত সেই সমস্ত বর্ণনায় পরিপূর্ণ যা মানুষকে জড় জীবনে বৈরাগ্য লাভে উৎসাহিত করে এবং সেখানে বর্ণিত ভগবান শ্রীহরির অমৃতময় দিব্য লীলাসমূহ সাধু ভক্ত এবং দেবতাদের দিব্য আনন্দ দান করে।এই শ্রীমদ্ভাগবত হচ্ছে বেদান্ত দর্শনের সারাতিসার, কেননা এর আলোচ্য বিষয় হচ্ছে পরম সত্য যা একই সঙ্গে চিন্ময় আত্মা থেকে অভিন্ন, পরম বাস্তব এবং অদ্বিতীয়। এই গ্রন্থের লক্ষ্য হচ্ছে সেই পরম সত্যের প্রতি কেবলা ভক্তিমূলক সেবা লাভ করা″[15]
পাদটীকা
- Bhagavata Purana Canto 12 Chapter 13 Verse 11
- Bryant 2007, পৃ. 111–113
- Wilson, H. H. (১৮৪০)। The Vishnu Purana: A system of Hindu mythology and tradition। Oriental Translation Fund। পৃষ্ঠা 12।
- Bhagavata Purana: Canto 12 Chapter 13 Verse 16
- Bhagavata Purana Canto 12 Chapter 13 Verse 18
- Sheridan 1986, পৃ. 1–16
- Matchett 2001, পৃ. 107
- Bhagavata Purana Canto 2 Chapter 10 Verse 10
- Bhagavata Purana Canto 2 Chapter 5 Verse 16-18
- Bhagavata Purana Canto 11 Chapter 4 Verse 5
- "Anthology of World Scriptures", by Robert Van Voorst, p. 28, year = 2007, isbn = 1111810745
- Kumar Das 2006, পৃ. 172–173
- Haberman ও Rūpagōsvāmī 2003, পৃ. 65
- Bryant 2007, পৃ. 113–114
- Bhagavata Purana Canto 12 Chapter 13 Verse 11-12 by disciple of A.c Bhaktivedanta swami Prabhupada
তথ্যসূত্র
- Beach, Milo Cleveland (১৯৬৫)। "A Bhāgavata Purāṇa from the Punjab Hills and related paintings"। Bulletin of the Museum of Fine Arts। Museum of Fine Arts, Boston। 63 (333): 168–177।
- Beck, Guy (১৯৯৩)। Sonic theology: Hinduism and sacred sound। University of South Carolina Press। পৃষ্ঠা 183–184। আইএসবিএন 9780253353344।
- Brown, Cheever Mackenzie (১৯৯৮)। The Devī Gītā: the song of the Goddess ; a translation, annotation, and commentary। SUNY Press। আইএসবিএন 9780791439401।
- Brown, C. Mackenzie (১৯৮৩)। "The Origin and Transmission of the Two "Bhāgavata Purāṇas": A Canonical and Theological Dilemma"। Journal of the American Academy of Religion। Oxford University Press। 51 (4): 551–567।
- Bryant, Edwin Francis (২০০৭)। Krishna: A Sourcebook। Oxford University Press US। আইএসবিএন 9780195148916।
- Cutler, Norman (১৯৮৭)। Songs of Experience। Indiana University Press। পৃষ্ঠা 1। আইএসবিএন 9780253353344।
- Dasgupta, Surendranath (১৯৪৯)। A history of Indian philosophy। IV: Indian pluralism। Cambridge University Press।
- Datta, Amaresh (২০০৬)। The Encyclopaedia Of Indian Literature। vol. 1। Sahitya Akademi। আইএসবিএন 8126018038।
- Doniger, Wendy (১৯৯৯)। Merriam-Webster's encyclopedia of world religions। Merriam-Webster। আইএসবিএন 0877790442।
- Glasenapp, Helmuth von; Shrotri, Shridhar B. (১৯৯৯)। Jainism: an Indian religion of salvation। Motilal Banarasidass। আইএসবিএন 81-208-1376-6।
- Haberman, David L. (২০০৩)। Indira Gandhi National Centre for the Arts, সম্পাদক। The Bhaktirasāmṛtasindhu of Rūpa Gosvāmīn। Motilal Banarsidass Publ.। আইএসবিএন 9788120818613।
- Jarow, Rick (২০০৩)। Tales for the dying: the death narrative of the Bhāgavata-Purāṇa। SUNY Press। আইএসবিএন 9780791456095।
- Kumar Das, Sisir (২০০৬)। A history of Indian literature, 500-1399। Sahitya Akademi। আইএসবিএন 9788126021710।
- Matchett, Freda (১৯৯৩)। "The Pervasiveness of Bhakti in the Bhāgavata Purāṇa"। Werner, Karel। Love Divine: Studies in Bhakti and Devotional Mysticism। Routledge। পৃষ্ঠা 95–116। আইএসবিএন 9780700702350।
- Matchett, Freda (২০০১)। Kṛṣṇa, Lord or Avatāra?। Routledge। আইএসবিএন 9780700712816।
- Matchett, Freda (২০০৩)। "The Purāṇas"। Flood, Gavin D.। The Blackwell companion to Hinduism। Wiley-Blackwell। পৃষ্ঠা 129–144। আইএসবিএন 9780631215356।
- Rocher, Ludo (১৯৮৬)। The Puranas। Wiesbaden : Harrassowitz। পৃষ্ঠা 138–151। আইএসবিএন 3447025220।
- Rukmani, T. S. (১৯৯৩)। "Siddhis in the Bhāgavata Purāṇa and in the Yogasutras of Patanjali - a Comparison"। Wayman, Alex। Researches in Indian and Buddhist philosophy: essays in honour of Professor Alex Wayman। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 217–226। আইএসবিএন 9788120809949।
- Sheridan, Daniel (১৯৮৬)। The Advaitic Theism of the Bhāgavata Purāṇa। Columbia, Mo: South Asia Books। আইএসবিএন 81-208-0179-2।
- Singh, Nagendra Kr. (২০০১)। Encyclopaedia of Jainism। 1। Anmol Publications PVT. Ltd। আইএসবিএন 81-261-0691-3।
- van Buitenen, J. A. B (১৯৯৬)। "The Archaism of the Bhāgavata Purāṇa"। S.S Shashi। Encyclopedia Indica। New Delhi: Anmol Publications। পৃষ্ঠা 28–45। আইএসবিএন 9788170418597।
- Varadpande, Manohar Laxman (১৯৮৭)। History of Indian theatre। vol. 3। Abhinav Publications। আইএসবিএন 8170172217।
অতিরিক্ত পাঠ
বহিঃসংযোগ
- English
- translated by A.C. Bhaktivedanta Swami Prabhupada and disciples.
- Anand Aadhar version.
- Bhartiya Jain Milan
- Share your ideas and view related with jain religion
- Sanskrit
- GRETIL etext: The transliterated Sanskrit text for the entire work
- Searchable transliterated PDF file of the entire Bhagavata-Purana from sanskritweb.net
- For Children
- Tales From The Bhagavatham Retold For Children by P.S. Krishna Iyer