ভাইরাস নিরোধক

ভাইরাস নিরোধক ঔষধ বলতে এমন কিছু সক্রিয় রাসায়নিক পদার্থকে বোঝায় যেগুলি কোনও ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংক্রামক রোগের চিকিৎসাতে ব্যবহৃত হয়। এগুলি হয় ভাইরাসকে বিনষ্ট করে কিংবা ভাইরাসকে প্রতিরোধ করে।[1][2] ভাইরাস-সৃষ্ট রোগব্যাধিগুলির মধ্যে রয়েছে এইচআইভি/এইডস (মানব প্রতিরক্ষা-অভাবসৃষ্টিকারী ভাইরাস / অর্জিত প্রতিরক্ষা অভাবজনিত উপসর্গ), ইনফ্লুয়েঞ্জা, বিসর্প (হার্পিস) সিমপ্লেক্স টাইপ ১ (মুখগহ্বরের বিসর্প) এবং টাইপ ২ (যৌনাঙ্গের বিসর্প), ঘুনশি ঘা (হার্পিস জোস্টার), ভাইরাসঘটিত যকৃৎপ্রদাহ (হেপাটাইটিস), মস্তিষ্কপ্রদাহ (এনসেফালাইটিস), সংক্রামক মনোনিউক্লিওসিস এবং সাধারণ সর্দিকাশি।

এইচআইভি সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ভাইরাস নিরোধক

ভাইরাস নিরোধক নকশাকরণ

ভাইরাস সাধারণত নিউক্লিয়িক অ্যাসিড (ডিএনএ বা আরএনএ) এবং একে ঘিরে থাকা একটি প্রোটিন আবরণ নিয়ে গঠিত। কোষের বিভিন্ন উপাদান উৎপাদন করার জন্য প্রয়োজনীয় উৎসেচক ভাইরাসদের নেই। তাই এগুলি নিরুপায় পরজীবী, অর্থাৎ বেঁচে থাকতে হলে ও প্রজনন করতে হলে তাদেরকে কোনও কোষে প্রবেশ করতে হয়। ভাইরাস একবার কোষে প্রবেশ করলে এটির নিউক্লিয়িক অ্যাসিড পোষক কোষকে ভাইরাসে উপাদান তৈরি করার নির্দেশ দেয়। কিছু ক্ষেত্রে যেমন হার্পিস সংক্রমণের ক্ষেত্রে ভাইরাসের নিউক্লিয়িক অ্যাসিডটি কোনও প্রতিলিপিকরণ ছাড়াই আশ্রয় কোষের ভেতরে থেকে যায়, যাকে ভাইরাসের সুপ্তাবস্থা (ভাইরাল লেটেন্সি) বলে। অন্য কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাস উৎপাদন করতে গিয়ে পোষক কোষটির মৃত্যু হয়। কিছু ভাইরাসঘটিত রোগের চিকিৎসাপ্রণালীর একটি বড় সমস্যা হল সুপ্ত ভাইরাসগুলি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।

ভাইরাস নিরোধক ঔষধ নকশা ও নির্মাণ করা বিভিন্ন কারণে দুরূহ। এখানে উল্লেখ্য যে ব্যাকটেরিয়া নিরোধক বা অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধগুলি ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীরের উপাদানের সংশ্লেষণে বিঘ্নের সৃষ্টি করে, কিন্তু মানুষের কোষের উপর কোনও প্রভাব ফেলে না, কেননা ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীরের ঔপাদানিক গঠন-কাঠামো মানুষের কোষপ্রাচীর থেকে ভিন্ন ও স্বাধীন। কিন্তু এর বিপরীতে ভাইরাসের জীবনচক্র প্রায় সম্পূর্ণরূপে পোষক মানবকোষের জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ার উপরে নির্ভরশীল। ভাইরাস পোষক কোষের ভেতরে অবস্থান করে বলে ভাইরাস নিরোধক পদার্থটিকে এমন হতে হয় যেন সেটি ভাইরাসের উপর ক্রিয়া করে কিন্তু একই সাথে পোষক কোষের উপর গুরুতর কোনও প্রভাব যেন না ফেলে। আবার দ্বিতীয় একটি সমস্যা হল এই যে, একেকটি ভাইরাসের কাঠামো একেক রকম। বহু রকমের ভাইরাসকে একসাথে আক্রমণ করতে পারে (বৃহৎ ব্যাপ্তির নিরাময়মূলক ঔষধ), এরকম ভাইরাস নিরোধক ঔষধ তৈরি করা প্রায় দুঃসাধ্য। সাধারণত কোনও ভাইরাস নিরোধক ঔষধ বিশেষ এক ধরনের ভাইরাসকে লক্ষ্য করে বানানো হয়। তৃতীয়ত, বিশেষ ভাইরাসকে লক্ষ্য করে নির্মিত ঔষধীয় চিকিৎসাও প্রায়শই দীর্ঘমেয়াদে নিষ্ফল হয়, কেননা ভাইরাস সাধারণত এমন কোনও দীর্ঘস্থায়ী বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে না, যা যেকোনও সময়ে অনন্যভাবে ঐ ভাইরাসটিকে শনাক্ত করতে সাহায্য করে। কারণ সময়ের সাথে সাথে ভাইরাসের অ্যান্টিজেনিক বা প্রতিরক্ষা-উদ্দীপক প্রোটিনগুলি (যে প্রোটিনগুলি পোষকদেহে প্রতিরক্ষামূলক উত্তরের সৃষ্টি করে) প্রায়শই পর্যায়ক্রমে পরিবর্তিত হয়।[3]

ভাইরাসবিজ্ঞানীদেরকে ভাইরাস নিরোধক পদার্থ নকশা করার সময় তাই ভাইরাসের প্রজনন চক্রের সম্বন্ধে বিস্তারিত জ্ঞান আহরণ করতে হয়। একটি ভাইরাস নিরোধককে অবশ্যই ভাইরাসের প্রতিলিপিকরণ চক্রের (replication cycle) পাঁচটি মৌলিক ধাপের যেকোনও একটিকে ব্যাহত করতে হয়। এগুলি হল ১) পোষক কোষের গায়ে সংযুক্ত হওয়া ও প্রাচীর ভেদ করে কোষের ভেতরে প্রবেশ করা। ২) ভাইরাসের আবরণমোচন অর্থাৎ প্রোটিন পৃষ্ঠতল খুলে ভাইরাসের অন্তঃস্থ ডিএনএ বা আরএনএ-র নির্গমন, ৩) ভাইরাসের ডিএনএ-র নির্দেশ অনুযায়ী পোষক কোষ কর্তৃক নতুন ভাইরাসীয় উপাদানের সংশ্লেষ। ৪) ভাইরাসীয় উপাদানগুলির সন্নিবেশনের মাধ্যমে নতুন ভাইরাসের সৃষ্টি এবং ৫) পোষক কোষ থেকে ভাইরাসের নির্গমন। কিন্তু ভাইরাসের প্রতিলিপিকরণ চক্র নির্ণয় করা কঠিন। পরীক্ষাগারে মানব কোষ আক্রমণকারী ভাইরাসগুলিকে উৎপাদন করা কঠিন। ফলে পরীক্ষাগারে ভাইরাস নিরোধকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখাও কঠিন। মানুষ ব্যতীত অন্য প্রাণীর উপরে করা পরীক্ষাগুলিও মানবদেহের জন্য সাধারণত প্রযোজ্য নয়।[3]

বিদ্যমান ভাইরাস নিরোধক ঔষধসমূহ

এইচআইভি (মানব প্রতিরক্ষা অভাব সৃষ্টিকারী) ভাইরাস ব্যতীত বেশির ভাগ ভাইরাসঘটিত রোগই মূলত স্ব-নিয়ন্ত্রক রোগ, যেগুলির জন্য বিশেষ কোনও ভাইরাস নিরোধক চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। ভাইরাসগুলি প্রজাতির উদ্‌বর্তনের (অব্যাহতভাবে টিকিয়ে রাখার) জন্যে নিজেরাই প্রজনন বা প্রতিলিপিকরণ বন্ধ করে দেয়।[4] বর্তমানে বিদ্যমান ভাইরাস নিরোধক ঔষধগুলি তিনটি প্রধান ভাইরাস শ্রেণীকে লক্ষ্য করে নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলি হল বিসর্প (হার্পিস), ভাইরাসঘটিত যকৃৎপ্রদাহ (হেপাটাইটিস) এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা।

হার্পিস বা বিসর্প ভাইরাস নিরোধী ঔষধগুলির প্রায় সবগুলিই ভাইরাসীয় ডিএনএ পলিমারেজের প্রতিদ্বন্দ্বী যৌগক (substrate) হিসেবে কাজ করে ভাইরাসের প্রতিলিপিকরণ (প্রজনন) প্রক্রিয়াতে বাধাদান করে। কেবল অ্যান্টিসেন্স অণু ফোমিভার্সেন ভিন্নভাবে কাজ করে।[4]

ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাসের বিরুদ্ধে দুই ধরনের ভাইরাস প্রতিরোধক ঔষধ ব্যবহার করা হয়। প্রথম শ্রেণীটিকে আয়ন চ্যানেল এম ২ (M2) প্রোটিনকে বাধাদানকারী নামে ডাকা হয়। এগুলি হল অ্যামান্টাডিন ও রিমান্টাডিন। এগুলি ভাইরাসকে দেহকোষে ঢুকতে বাধা দেয়। দ্বিতীয় শ্রেণীর ঔষধগুলি হল উৎসেচক নিউর‍্যামিনিডেজ-কে বাধাদানকারী। এগুলি সংক্রামিত কোষ থেকে ভাইরাসের নির্গমনে বাধা দেয়। যেমন জানামিভির এবং ওসেলটামিভির।[4]

সংক্রমণ-পরবর্তী চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণত উপসর্গের প্রাদুর্ভাবের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভাইরাস নিরোধক দেহে প্রয়োগ করতে হয়। ভাইরাস নিরোধকগুলি ভাইরাস সংক্রমণজনিত উপসর্গগুলি উপশম করে, এগুলির স্থায়িত্ব হ্রাস করে এবং অন্য ব্যক্তির দেহে ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ করে। কিন্তু ভাইরাস নিরোধকগুলি সরাসরি ভাইরাসের উপর কাজ করে, মানব প্রতিরক্ষাতন্ত্রের প্রতিরক্ষিকা কণা বা অ্যান্টিবডিগুলিকে উদ্দীপ্ত করে না। তাই ঔষধ প্রয়োগ বন্ধ করে দিলে এগুলির প্রভাবও বন্ধ হয়ে যায়, কোনও দীর্ঘ-মেয়াদী প্রতিরক্ষা অর্জিত হয় না।[5] চিকিৎসককে খুব সাবধানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, রোগীর অবস্থা (বয়স, বিদ্যমান অন্যান্য রোগ, ইত্যাদি) বুঝে, সর্বোচ্চ কার্যকারিতা ও সম্ভাব্য বিরূপ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে কোন্‌ ভাইরাস নিরোধক ঔষধ ব্যবহার করা হবে, সে ব্যাপারে পরামর্শ দিতে হয়।

টিকার মাধ্যমে ভাইরাস প্রতিরোধ

ভাইরাসঘটিত সংক্রমণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সফল সমাধান হচ্ছে টিকাগ্রহণের মাধ্যমে দেহের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বা অনাক্রম্যতা বৃদ্ধি করা। ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিও, হাম, মাম্পস, জলবসন্ত, ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে এটি সফল হয়েছে। এক্ষেত্রে জীবন্ত কিন্তু দুর্বল ভাইরাস কিংবা মৃত ভাইরাস ব্যবহার করা হয়। যেমন টিকাদান কর্মসূচির কারণে জলবসন্ত রোগ নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস প্রতিনিয়ত তাদের প্রতিরক্ষা উদ্দীপক প্রোটিনগুলি পরিবর্তন করছে বলে পুনরায় টিকাগ্রহণ করতে হয়। কিছু কিছু ভাইরাসের দলে ৫০-এরও বেশি ভিন্ন ভিন্ন ভাইরাস থাকে, ফলে কার্যকরী টিকাদান দুঃসাধ্য।

নিষ্ক্রিয় টিকাদান পদ্ধতিতে প্রতিরক্ষাবিশিষ্ট (ইমিউন) ব্যক্তিদের রক্তরস বা প্রতিরক্ষিকা (অ্যান্টিবডি) ব্যবহার করে ভাইরাসঘটিত সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এইসব ইমিউনোগ্লোবিউলিন বা প্রতিরক্ষিকাগুলি (যেমন যেগুলি হেপাটাইটিস বা শ্বসনীয় সিনসাইশিয়াল ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়) কেবলমাত্র রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেই কার্যকর, সংক্রমণ-পরবর্তী চিকিৎসার জন্য নয়।

সারা বিশ্বে প্রায় ২০টি নিরাপদ ও কার্যকর ভাইরাস নিরোধক টিকা রয়েছে যেগুলি সারা বিশ্বে ব্যবহারের জন্য সুলভ্য। এই ভাইরাস নিরোধকগুলি জনস্বাস্থ্য ও প্রতিরোধমূলক চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অর্থসাশ্রয়ী উপকরণ হতে পারে। কিন্তু এগুলি বিশ্বের বহু দেশে পুরোপুরি এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে না, যার কারণ শিশুদের চিকিৎসার জন্য উন্নত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা অবকাঠামোর অনুপস্থিতি। যেমন প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ১ লক্ষ শিশু হামের কারণে মারা যায়, যদিও এটি নিরাপদে ও স্বল্প খরচে সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।[6]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. Dorland's Illustrated Medical Dictionary, Elsevier Health Sciences, ২০১১, পৃষ্ঠা 110
  2. Elizabeth Martin, সম্পাদক (২০১৫), Concise Medical Dictionary (9 সংস্করণ), Oxford University Press, পৃষ্ঠা 44
  3. Lauren Sompayrac (২০০২), How Pathogenic Viruses Work, Jones & Bartlett Learning, পৃষ্ঠা 103
  4. Raymund R. Razonable, MD (অক্টোবর ২০১১), "Antiviral Drugs for Viruses Other Than Human Immunodeficiency Virus", Mayo Clin Proceedings, 86 (10): 1009–1026
  5. Parliament. House of Lords. Science and Technology Committee (২০০৫), Pandemic Influenza: Report with Evidence, The Stationery Office, পৃষ্ঠা 18
  6. Juliet Morrison; Stanley Plotkin (২০১৬), "Viral Vaccines: Fighting Viruses with Vaccines", Viral Pathogenesis (3 সংস্করণ), Academic Press, পৃষ্ঠা 253-269
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.