ভাইফোঁটা
ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া একটি হিন্দু উৎসব। এটি কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে, কালীপূজার দুই দিন পরে অনুষ্ঠিত হয়।[1] বাঙালি হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, এই উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ২য় দিনে উদযাপিত হয়। পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও পরিচিত। সেখানে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পাঁচ-দিনব্যাপী দীপাবলি উৎসবের শেষদিন। মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে ভাইবিজ বলা হয়। নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব পরিচিত ভাইটিকা নামে। সেখানে বিজয়া দশমীর পর এটিই সবচেয়ে বড় উৎসব। এছাড়াও এটি যমদ্বিতীয়া নামেও পরিচিত।
ভ্রাতৃদ্বিতীয়া | |
---|---|
অন্য নাম | ভাইফোঁটা, ভাইটিকা, ভাই দুজ, যম দ্বিতীয়া, ভাইবিজ |
পালনকারী | হিন্দু |
ধরন | ধর্মীয় |
তাৎপর্য | ভাই-বোনের অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধন, শুভকামনা |
তারিখ | কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি |
সংঘটন | বার্ষিক |
সম্পর্কিত | রাখীবন্ধন |
কিংবদন্তী
কিংবদন্তী অনুসারে, মৃত্যুর দেবতা যম কার্তিক শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে বোনের নিমন্ত্রণ স্বীকার করে তাঁর বাড়ি যান। সে দিন যমুনার পুজো গ্রহণ করে, তাঁর গৃহে ভোজন করেন। যমুনা আশীর্বাদ চাইলে যম বলেন যে, এই তিথিতে যে ভাই নিজের বোনের বাড়ি গিয়ে তাঁর পুজো স্বীকার করবে ও তাঁর হাতে তৈরি রান্না গ্রহণ করবে, তাঁর ভাগ্যে অকালমৃত্যুর ভয় থাকবে না। তার পর থেকেই এই তিথিটি যম দ্বিতীয়া, ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া বা ভাই ফোঁটা নামে পরিচিত হয়।[1]
হিন্দুধর্মের ইতিহাসের একটি জনপ্রিয় কিংবদন্তি অনুসারে, নরকাসুর নামে দুষ্ট রাক্ষসকে বধ করার পর, কৃষ্ণ তার বোন সুভদ্রার সাথে দেখা করেছিলেন। যিনি তাকে মিষ্টি এবং ফুল দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা করেছিলেন। তিনিও স্নেহের সাথে কৃষ্ণের কপালে তিলক লাগালেন। কেউ কেউ এটাকে উৎসবের উৎপত্তি বলে মনে করেন।
ভাইফোঁটার দিন বোনেরা তাদের ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে ছড়া কেটে বলে-
“ | ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা। যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥ যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর। আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর॥[2] |
” |
এইভাবে বোনেরা ভাইয়ের দীর্ঘজীবন কামনা করে। তারপর ভাইকে মিষ্টি খাওয়ায়। ভাই বোনকে বিভিন্ন উপহার দেয়।
আঞ্চলিক নাম
উৎসবটি যে যে নামে পরিচিত:
- ভাই দুজ ( হিন্দি : भाई दूज ) ভারতের সমগ্র উত্তরাঞ্চলে, দিওয়ালি উৎসবের সময় পালন করা হয়। উত্তর প্রদেশ এবং বিহারের আওধ এবং পূর্বাঞ্চল অঞ্চলে এটি ভাইয়া দুজ নামেও পরিচিত । এটি নেপাল এবং বিহারের মৈথিলদের দ্বারা ভার্দুতিয়া এবং অন্যান্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা ব্যাপকভাবে উদযাপন করে । এই নববর্ষের প্রথম দিনটি গোবর্ধন পূজা হিসেবে পালন করা হয় ।
- ভাই টিকা ( নেপালি : भाइटीका ) নেপালে এটি দশাইনের (বিজয়া দশমী / দশেরা) পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। তিহার উৎসবের পঞ্চম দিনে পালন করা হয় , এটি নেপালের মৈথিলদের দ্বারা ব্যাপকভাবে পালিত হয় ভার্দুতিয়া ভাই টিকা হিসাবে এবং মাধেসিদের মধ্যে অন্যান্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা অনুসরণ করে । যদিও নেওয়ারিরা এটিকে কিজা পূজা হিসেবে পালন করে । বোনেরা তাদের ভাইয়ের কপালে সপ্তরঙ্গী টিকা নামে পরিচিত সাত রঙের একটি উল্লম্ব টিকা রাখে।
- বাংলায় ভাই ফোঁটা ( বাংলা : ভাই ফোঁটা ) এবং এটি প্রতি বছর কালী পূজার দ্বিতীয় দিনে হয়। প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ , ত্রিপুরা, বাংলাদেশে এই নামে পালিত হয়।
- ভাই জিন্তিয়া ( ওড়িয়া : ଜିଉନ୍ତିଆ ) শুধুমাত্র পশ্চিম ওড়িশায়।
- মহারাষ্ট্র, গোয়া, গুজরাট এবং কর্ণাটক রাজ্যের মারাঠি, গুজরাটি এবং কোঙ্কানি -ভাষী সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাউ বীজ , বা ভাব বিজ ( মারাঠি : भाऊ बीज ) বা ভাই বীজ ।
- দিনটির আরেকটি নাম হল যম দ্বিতীয়া, মৃত্যুর দেবতা যম এবং তার বোন যমুনার মধ্যে দ্বিথেয় (অমাবস্যার পরের দ্বিতীয় দিন) একটি কিংবদন্তি বৈঠকের পরে ।
- অন্যান্য নামের মধ্যে রয়েছে ভাত্রু দ্বিতিয়া বা ভ্রাত্রী দিত্য বা অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার ভাগিনী হস্ত ভোজনামু।
রীতিনীতি
বোন চন্দন কাঠ জল দিয়ে ঘষে ( কেউ কেউ দইও মিশ্রিত করেন চন্দন কাঠের সাথে), নিজের অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে ভাইয়ের কপালে নিচের বাক্যগুলো পড়তে পড়তে তিনবার ফোঁটা দিয়ে দেয়।
“ | ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা। যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥ যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর। আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর॥[3] |
” |
অনেক সময় এই ছড়াটি বিভিন্ন পরিবারের রীতিনীতিভেদে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। অতঃপর, বোন তার ভাইয়ের মাথায় ধান এবং দুর্বা ঘাসের শীষ রাখে। এই সময় শঙ্খ বাজানো হয় এবং হিন্দু নারীরা উলুধ্বনি করেন। এরপর বোন তার ভাইকে আশীর্বাদ করে থাকে (যদি বোন তার ভাইয়ের তুলনায় বড় হয় অন্যথায় বোন ভাইকে প্রণাম করে আর ভাই বোনকে আশীর্বাদ করে থাকে)। তারপর বোন ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি দ্বারা ভাইকে মিষ্টিমুখ করায় এবং উপহার দিয়ে থাকে। ভাইও তার সাধ্যমত উক্ত বোনকে উপহার দিয়ে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গে ভাইফোঁটা একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলেও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পালিত হয়। পশ্চিম ভারতের ভাইবিজ একটি বর্ণময় অনুষ্ঠান। সেখানে এই উপলক্ষে পারিবারিক সম্মেলনেরও আয়োজন করা হয়। মহারাষ্ট্রে মেয়েদের ভাইবিজ পালন অবশ্যকর্তব্য। এমনকি, যেসব মেয়েদের ভাই নেই, তাদেরও চন্দ্র দেবতাকে ভাই মনে করে ভাইবিজ পালন করতে হয়। এই রাজ্যে বাসুন্দি পুরী বা শ্রীখণ্ড পুরী নামে একটি বিশেষ খাবার ভাইবিজ অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি করার রেওয়াজ আছে।
তথ্যসূত্র
- "Bhai Phota 2022: ২৬ না ২৭ অক্টোবর, কবে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া? শুভ তিথিতে ফোঁটা দিন ভাইকে, জেনে নিন"। Eisamay। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৪-১৩।
- Kapoor, Subodh (২০০২)। The Indian encyclopaedia: biographical, historical, religious, administrative, ethnological, commercial and scientific। Genesis Publishing। পৃষ্ঠা 773। আইএসবিএন 81-7755-257-0। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ১৯, ২০১১।
- Kapoor, Subodh (২০০২)। The Indian encyclopaedia: biographical, historical, religious, administrative, ethnological, commercial and scientific। Genesis Publishing। পৃষ্ঠা 773। আইএসবিএন 81-7755-257-0। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ১৯, ২০১১।