বিজয়গুপ্ত
মনসামঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে বিজয়গুপ্ত-এর খ্যাতি। তার মনসামঙ্গল বাংলার জনপ্রিয় কাব্যগুলির মধ্য অন্যতম। তিনি মনসামঙ্গলের পূর্ণাঙ্গ কাহিনী রচনা করেছিলেন। এই মনসামঙ্গল "পদ্মাপুরাণ নামেও জনপ্রিয়।
বিজয়গুপ্ত (পদ্মাপুরাণ) | |
---|---|
বাসস্থান | বরিশাল জেলার ফুল্লশ্রী গ্রামে |
জাতীয়তা | অবিভক্ত বাংলা |
সময়কাল | মধ্যযুগ (পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ) |
ধরন | মঙ্গলকাব্য |
বিষয় | মনসামঙ্গল |
কবির পরিচয়
"রাজার পালনে প্রজা সুখে ভুঞ্জে নিত।
মুল্লুক ফতেয়াবাদ বাঙ্গরোড়া-তক্সিম।।
পশ্চিমে ঘাঘর নদী পূর্বে ঘণ্ডেশ্বর।
মধ্যে ফুল্লশ্রী গ্রাম পণ্ডিত নগর।।"
--- কাব্যের সূচনায় কবিকৃত এই আত্মকাহিনী থেকে জানা যায়, কবির নিবাস ছিল ফুল্লশ্রী গ্রামে (বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলায়)। পিতা সনাতন ও মাতা রুক্মিণী ("সনাতন তনয় রুক্মিণী গর্ভজাত")। কথিত আছে, বিজয় গুপ্ত নিজের গ্রামে মনসার মন্দির ও মৃতি প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যক্তিগত পরিচয় দিতে গিয়ে কবি জন্মভূৃমি ফুল্লশ্রীকে পপ্তিতনগর বলেছেন। [1]
কবির বৈশিষ্ট্য
কবির বৈশিষ্ট্য গুলি হল-
ক) মানবতা: মধ্যযুগের সাহিত্য পরিমণ্ডল ছিল দেববাদের পরিপূর্ণ তাই সর্বত্র দেববাদের জয় গান সূচিত হয়েছিল এই দেববাদের পরিমণ্ডলে থেকেও সর্বপ্রথম মানবতার পরিচয় দিলেন কবি।
খ) পাণ্ডিত্য: ঘনরাম চক্রবর্তী ছিলেন জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। সংস্কৃত সাহিত্য ও অলংকারের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশীয় ভাষার ক্ষেত্রেও তিনি অসামান্য জ্ঞান ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার এই জ্ঞান এই কাব্যেও প্রতিফলিত হয়।
কবি প্রতিভার স্বতন্ত্র
কবি প্রতিবাদ দিক থেকে বিজয়গুপ্তের কবি প্রতিভা ছিল চোখে পড়ার মতো। সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্রকে তিনি খুব দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। সে যুগের আচার ব্যবহার, রীতিনীতি, পােশাকপরিচ্ছদ, আহার ও রন্ধন প্রণালী প্রভ়ৃতি বিষয়কে তিনি খুবই নিপুণডাবে তুলে ধরেছেন।
মনসার চরিত্র চিত্তনে দক্ষতা
প্রচণ্ড হিংসা ও নির্মম ক্রুরতার এক দাবদাহ চরিত্র মনসা। একটি দেবী চরিত্রকে এরুপ অসদগুণর অধিকারী করে তােলার সিছনে কবি যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণগুলি মনসার চরিত্রের মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট করেছেন। তবে বাস্তব চরিত্র হিসেবে চরিত্রটি পাঠকের সহানুভূতি করে। তার রচিত অন্যান্য চরিত্র গুলি হল: ১. চাঁদ সওদাগর ২. লখীন্দর ৩. বেহুলা
কাব্যের রচনাকাল
কাব্যের রচনাকাল নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতান্তর রয়েছে। কেননা বিভিন্ন পুঁথিতে ভিন্ন ভিন্ন তারিখের শ্লোক পাওয়া যায়।[1] যেমন—এক।
ঋতুু শশী বেদশশী শক পরিমিত।
দুই।
ঋতুশূন্য বেদ শশী পরিমিত শক।
সুলতান হসেন সাহা নৃপতি তিলক।।
---১ম শ্লোক থেকে কাব্যের রচনাকাল পাওয়া যায় ১৪৯৪-৯৫ খ্রিঃ। কিন্তু প্রাচীন পুথিতে উল্লিখিত দ্বিতীয় শ্লোকটি পাওয়া যাওয়ার কারণে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ২য় শ্লোক অনুযায়ী কাব্যের রচনাকাল হয় ১৪৮৪-৮৫ খ্রিঃ। সমালোচকের মতে প্রাচীন পুঁথিতে পাওয়া এই শ্লোকটিই আসল এবং এই সময়ে বাংলার শাসক ছিলেন জলালউদ্দীন ফতেহ শাহ, আলাউদ্দীন হোসেন শাহ নয়।[2]
কাব্য প্রসঙ্গ
বিজয়গুপ্তের কাব্য পূর্ববঙ্গে সর্বাধিক প্রচারিত হয়েছিল। ১৩০৩ বঙ্গাব্দে প্যারীমোহন দাশগুপ্ত সর্বপ্রথম বরিশাল থেকে বিজয়গুপ্তের "পদ্মাপুরাণ" প্রকাশ করেন।[3] প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পুঁথির ভাষা নিয়ে সাহিত্যের গবেষকদের মধ্যে সংশয় দানা বাঁধে। যাইহোক বিজয়গুপ্তের কৃতিত্ব এতে কম হওয়ার নয়। সমকালীন অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক চিত্র এই কাব্যে স্থান পেয়েছে। চরিত্র-চিত্রণের দিক দিয়েও তার কৃতিত্ব যথেষ্ট। শিব, চণ্ডী, মনসা সাধারণ মানব-মানবীর মতো।[3] কিন্তু চাঁদ চরিত্রের পরিকল্পনায় তার ত্রুটি থেকে গেছে। তাই সমালোচক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, "দেবীর মহিমা প্রচারের জন্য বিজয়গুপ্ত চাঁদের চরিত্রটির পরিণতি নষ্ট করিয়া কাব্যের ভরাডুবি করিয়াছেন।"[4] তবে এ ত্রুটি সামান্যই । আশুতোষ ভট্টাচার্য বিজয়গুপ্তের যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন এই বলে, " বিজয়গুপ্ত দেবতার মাহাত্ম্য রচনা করেন নাই, মানবেরই মঙ্গলগান গাহিয়াছেন ।"[4]
তথ্যসূত্র
- আচার্য, ড. দেবেশ কুমার (মে ২০০৭)। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম)। কোলকাতা: ইউনাইটেড বুক এজেন্সি। পৃষ্ঠা ৩৪৩।
- মুখোপাধ্যায়, সুখময় (১৯৬০ (১ম))। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম। পৃষ্ঠা ০২। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - আচার্য, ড দেবেশ কুমার (মে ২০০৭)। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম) (১ম সংস্করণ)। কোলকাতা: ইউনাইটেড বুক এজেন্সি। পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য ৩৪১।
- আচার্য, ডঃ দেবেশ কুমার (মে ২০০৭)। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম)। কলকাতা: ইউনাইটেড বুক এজেন্সি। পৃষ্ঠা ৩৪৬।