রক্ষণভাগের খেলোয়াড়
ফুটবল খেলায়, একজন রক্ষণভাগের খেলোয়াড় অথবা ডিফেন্ডার হচ্ছেন একজন মাঠের প্রান্তবর্তী অংশের খেলোয়াড়, যার প্রাথমিক ভূমিকা হচ্ছে খেলার সময় বিপক্ষ দলের আক্রমণ প্রতিহত করা করা এবং প্রতিপক্ষ দলকে গোল করা বিরত রাখা। রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের অবস্থান হচ্ছে গোলরক্ষকের সামনে এবং মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের পেছনে।
সাধারণত কেন্দ্রীয় রক্ষণভাগের খেলোয়াড় জোড়া হয়ে থাকে, তাদের বাম এবং ডানপাশে ২জন পার্শ্বীয় রক্ষণভাগের খেলোয়াড় থাকে। তবে পার্শ্বীয় রক্ষণভাগের খেলোয়াড় থাকলে তিনজন কেন্দ্রীয় রক্ষণভাগের খেলোয়াড় থাকতে পারে।
সাধারণত চার ধরনের রক্ষণভাগের খেলোয়াড় রয়েছে: কেন্দ্রীয় রক্ষণভাগের খেলোয়াড়, সুইপার, পার্শ্বীয় রক্ষণভাগের খেলোয়াড় এবং উইং-ব্যাক। তবে অধিকাংশ আধুনিক বিন্যাসে কেন্দ্রীয় রক্ষণভাগের খেলোয়াড় এবং পার্শ্বীয় রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের ভূমিকাই বিশেষগুরুত্বপূর্ণ। সুইপার এবং উইং-ব্যাকের ভূমিকা ফুটবলে কিছু বিশেষ বিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ।
সেন্টার-ব্যাক
সেন্টার ব্যাক, সেন্টার হাফ, সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার বা স্টপার যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তাদের মূল কাজ হচ্ছে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় বিশেষ করে স্ট্রাইকারকে থামানো, গোল করা থেকে বিরত রাখা এবং পেনাল্টি সীমানা থেকে বলকে বের করে আনা। তাদের নামের মত তারা মাঠের মধ্যভাগে খেলে থাকে। বেশিরভাগ দলেই দুজন সেন্টার ব্যাক থাকে, যারা গোলরক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। সেন্ট্রাল ব্যাকগণ রক্ষণভাগের জন্য দুটি পন্থা অবলম্বন করে: মাঠের কিছু নির্দিষ্ট অংশ পাহারা দেয়া (জোনাল ডিফেন্স) অথবা কোন নির্দিষ্ট খেলোয়াড়কে পাহারা দেয়া (ম্যান-টু-ম্যান মার্কিং)।
সেন্টার ব্যকগণ সাধারণত লম্বা হয়ে থাকেন এবং তাদের হেড ও ট্যাক্ল করার দক্ষতা বেশি থাকে। খেলা বোঝার ক্ষমতা একটি অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে কাজ করে। সাধারনত, নিম্নস্তরের ফুটবলে সেন্টার ব্যাকদের বল নিয়ন্ত্রণ বা পাস দেয়ার উপর দক্ষতার উপর মনোযোগ না দিয়ে বলকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দিতে পারাটাকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে সেন্টার ব্যাকরা নিয়ন্ত্রণমূলক ফুটবলে দারুন ভূমিকা রাখেন।
এই অবস্থানটিকে আগে সেন্টার হাফ বলা হতো। এসময় অধিকাংশ দল ২-৩-৫ এই গঠন অনুসরন করত। রক্ষণভাগের দুজন খেলোয়াড়কে ফুল ব্যাক এবং তাদের সামনের তিনজনকে হাফ ব্যাক বলা হতো। সময়ের সাথে ফুটবলের গঠন পরিবর্তিত হয়েছে এবং সেন্টার হাফদের আরো পেছনে সরে রক্ষণভাগে অবস্থান নিতে হয়েছে, তাই তাদের নাম দাঁড়িয়েছে সেন্টার ব্যাক। ডান ও বাম পাশের খেলোয়াড়কে যথাক্রমে রাইট হাফ ও লেফট হাফ বলা হত।
সেন্টার ব্যাকগণ সাধারণত নিজেদের অর্ধেই থাকেন এবং নিজেদের গোল বাচাতে সচেষ্ট হন। তবে লম্বা খেলোয়াড়েরা কর্নার কিক বা ফ্রি কিকের সময় হেড করার জন্য আক্রমণভাগে চলে আসেন।
ফুটবলের ইতিহাসের কিছু উল্লেখযোগ্য সেন্টার ব্যক হলেনঃ জন টেরি, জেমি ক্যারাঘার, ফাবিও কান্নাভারো, আলেসান্দ্রো নেস্তা, লুসিও, কার্লেস পুইয়োল, রিও ফার্ডিনান্ড, রোবের্তো আয়ালা, দানিয়েল আগার, লিলিয়ান থুরাম, সার্হিও রামোস, ইয়াপ স্টাম, ড্যানিয়েল ফন বুইটেন প্রমুখ।
সুইপার
সুইপার একধরনের বিচিত্র সেন্টার ব্যাক, যারা প্রতিপক্ষ রক্ষণব্যুহ ভেদ করার চেষ্টা করলে বলকে "ঝাড়ু দেয়ার মত" সরিয়ে দেয়। অন্যান্য ডিফেন্ডারদের মত মাঠে এদের অবস্থান নির্দিষ্ট থাকে না। একারণে এই অবস্থানকে লিবেরো (ইতালীয় ভাষায় স্বাধীন) নামেও ডাকা হয়। খেলা বোঝার ক্ষমতা সুইপারের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুইপার সাধারণত প্রতি-আক্রমণ চালাতে পারেন এবং এ কারণে সুইপারদের বল নিয়ন্ত্রণ ও পাস দেয়ার দক্ষতা বেশি থাকতে হয়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে পুরোপুরি রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হিসেবেও সুইপার ব্যবহৃত হয়। যেমন ১৯৬০ দশকের ইতালীয় ঘরানার খেলায় পুরোপুরি রক্ষণাত্মক একজন সুইপার ব্যবহৃত হয়েছিল যিনি কেবল রক্ষণব্যুহের চারপাশে দৌড়ে বেড়িয়েছেন।
ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ার, ববি মুর, লরেন্ত ব্লাঁ, মাথিয়াস সামার, রুদ ক্রল, ফ্রাঙ্কো বারেসি ও দানিয়েল পাসারেয়া কিছু পরিচিত সুইপার। আধুনিক খেলার সুইপারদের মধ্যে রাফায়েল মারকুয়েজ, লুসিও, ক্রিস্তিয়ান শিভু, ও পাওলো মালদিনি উল্লেখযোগ্য। তাদের রক্ষণাত্মক ভূমিকা চিরাচরিত সেন্টার ব্যাকের মত নয় বরং অনেকটা মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের মত। উদাহরণস্বরুপ, মারকুয়েজ আক্রমণকে পাসগুলো চিনতে পারেন বলে খ্যাত এবং তাই তিনি সহজে বিভিন্ন পাস নষ্ট করে দিতে ওস্তাদ, যার জন্য তাকে তেমন কোন ট্যাক্ল করতে হয় না। আধুনিক ফুটবলে সুইপারের ব্যবহার খুবই সীমিত, কেবল কয়েকটি উচু মানের ক্লাব এই অবস্থান ব্যবহার করে থাকে।
কেউ কেউ মনে করেন আক্রমণাত্মক সুইপার থেকেই ডিফেন্সিভ মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের জন্ম হয়েছে।
ফুল-ব্যাক
ফুল ব্যাকরা মাঠের প্রশস্ত অংশের দুইপাশে থেকে দলকে পাহারা দেন। তাদের মূল কাজ বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় যাতে ক্রস বা কাটিং এর মাধ্যমে বলকে পেনাল্টি সীমানার মধ্যে না নিতে পারে সে চেষ্টা করা। কোন কোন রক্ষণ ব্যবস্থায় ফুল ব্যাকগণ ম্যান মার্কিং-এর কাজও করে থাকেন। অধিকাংশ ফুল ব্যাকের কাছেই প্রত্যাশা করা হয় তারা উইং-এর মাধ্যমে বল নিয়ে আক্রমণে যেতে পারেন এবং আক্রমণভাগের খেলোয়াড়কে ক্রস দিতে পারেন।
প্রচলিত ২-৩-৫ দল গঠনে গোলরক্ষকের সামনে থাকা দু'জনকে ফুল ব্যাক বলা হত। তারা হাফ ব্যাকদের (২-৩-৫ এর "৩" জন) থেকে আলাদা। বর্তমানের আধুনিক ফুটবলে এই গঠন ব্যবহার করা হয়না বললেই চলে, এবং আধুনিক গঠনে সবমিলিয়ে ৪ জন খেলোয়াড়ের সমন্বয়ে রক্ষণভাগ গঠন করা হয়। তবে "ফুল ব্যাক" নামটি এখনো রয়ে গেছে। ফুলব্যাক মাঠের রক্ষনরেখার দুই প্রান্তে থাকে এবং মধ্যে থাকে সেন্টার হাফ ব্যাক।
প্রচলিত ইংরেজ ফুটবলে ফুল ব্যাক ছিল একজন শক্তিশালী খেলোয়াড় যারা প্রায়শই "হ্যাকিং" - উদ্দেশ্যপ্রনদিতমূলক ভাবে প্রতিপক্ষকে আঘাত করত। এই ধারাটি ইংল্যান্ডে গ্রহণযোগ্য ও বৈধ ধরা হলেও বাইরের দেশে তা ছিল বেআইনি। ১৯৫০ দশকে এ নিয়ে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে এটি সারাবিশ্বেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কখনো কখনো ফুলব্যাকদের আক্রমণাত্নক মেজাজেও দেখা যায়। তারা মাঝে মাঝে পার্শ্বীয় খেলোয়াড়দের বদলে খেলেন এবং ক্রসের জোগান দিতে সচেষ্ট থাকেন। আধুনিক ফুলব্যাকদের হতে হয় দ্রুতগতি সম্পন্ন, শক্তিশালী এবং অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী। ফুলব্যাকের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছেনঃ : অ্যাশলি কোল, জিয়ানলুকা জামব্রোত্তা, উইলি সানিওল, মিগুয়েল, গ্যারি নেভিল, স্টিভ ফিনান, পাওলো মালদিনি, ফিলিপ লাম ও গাব্রিয়েল হেন্জে।
উইং-ব্যাক
উইংব্যাক আধুনিক জমানায় ফুল ব্যাকের একটি ভিন্ন রুপ। এই অবস্থানে আক্রমণকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। উইংব্যাক নামটি এসেছে "পার্শ্বীয় খেলোয়াড়" ও "ব্যাক" শব্দ থেকে। সাধারণত ৩-৫-২ গঠনের ফুটবল খেলায় উইংব্যাক ব্যবহৃত হয়। একারণে এই অবস্থানকে রক্ষণভাগের চেয়ে মধ্যমাঠের অবস্থান হিসেবেই বেশি মানায়। অধিকতর রক্ষণের কৌশল গ্রহণ করলে ৫-৩-২ গঠনেও উইংব্যাক খেলানো যেতে পারে।
আধুনিক খেলার বিবর্তনে উইংব্যাক হলো পার্শ্বীয় খেলোয়াড় ও ফুলব্যাকের সম্মিলিত রুপ। এ কারণে এই অবস্থানটি আধুনিক ফুটবলের সবচেয়ে চাহিদাপূর্ণ অবস্থানের একটি। যেসব দলে পার্শ্বীয় খেলোয়াড় খেলে না সেসব দলে ফুলব্যাকের তুলনায় উইংব্যাক অধিকতর কার্যকর। তবে উইংব্যাক অবস্থানে খেলার জন্য যথেষ্ট শারীরিক ক্ষমতার প্রয়োজন। উইংব্যাক আক্রমণে গেলে ডিফেন্সিভ মধ্যমাঠের খেলোয়াড় সাধারণত রক্ষণের দায়িত্ব নেন।
উল্লেখযোগ্য উইংব্যাকের মধ্যে রয়েছেন আনড্রেয়াস ব্রেহমা, জিয়ানলুকা জামব্রোত্তা, ম্যাসিমো ওডো, কাফু, রবার্তো কার্লোস, ফিলিপ লাম, হাভিয়ের জানেত্তি, হুয়ান পাবলো সোরিন, অ্যাশলি কোল প্রমুখ।