বাঙালি জাতীয়তাবাদ

বাঙালি জাতীয়তাবাদ হলো একটি রাজনৈতিক অভিব্যক্তি যার মাধ্যমে প্রাচীন কাল থেকে দক্ষিণ এশিয়াতে বসবাসরত বাঙালি জাতি, তথা বাংলা ভাষাগত অঞ্চলের অধিবাসীদের বুঝানো হয়ে থাকে। বাঙালি জাতি উপমহাদেশের একটি অন্যতম জাতীয়তাবাদী চেতনায় প্রভাবিত এক প্রভাবশালী জাতি। বাঙালি জাতিকে উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের রূপকার বলা হয়ে থাকে। অবিভক্ত বাংলা পরবর্তীতে ব্রিটিশ চক্রান্তে বিভক্ত করা হয়। প্রাচীন বঙ্গদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামআন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায়ের একতাবদ্ধ পরিচয়কে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলা হয় যাদের ইতিহাস অন্তত চার হাজার বছর পুরোনো। এদের মাতৃভাষা বাংলা। ১৯ শতকে উদ্ভূত বাংলার নবজাগরণ এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন, বাংলা ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও একটি অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা সৃষ্টির পেছনে প্রধান অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করছে।

বাঙালি অধ্যুষিত সম্মিলিত বাংলা

ইতিহাস

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলার ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে গৌরবোজ্জ্বল ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলার নবজাগরণ বলতে বাঙালি সমাজের রুপান্তর এবং উন্নয়নে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও শিক্ষা প্রচলন শুরু হওয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে। বাংলা হয়ে ওঠে আধুনিক সংস্কৃতি, বুদ্ধিজীবী ও বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের, রাজনীতি এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। প্রথম সামাজিক ও ধর্মীয় পুনর্গঠন যেমন বাংলায় ব্রাহ্ম সমাজ এবং রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদির নেতৃত্বে ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, শ্রী অরবিন্দ, রামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দের মত বিভিন্ন জাতীয় নেতা এবং সংস্কারকগণ। বাংলা সাহিত্য, কবিতা, ধর্ম, বিজ্ঞান এবং দর্শনের বিস্তারের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, জগদীশ চন্দ্র বসু ও কাজী নজরুল ইসলামের কাজ ব্যাপক অবদান রাখে। ইয়ং বেঙ্গল এবং যুগান্তর আন্দোলন এবং অমৃত বাজার পত্রিকার মত ভারতের সংবাদপত্রগুলো বুদ্ধিজীবী উন্নয়ন নেতৃত্বে দিয়েছিলো। কলকাতা-ভিত্তিক ভারতীয় ন্যাশনাল এসোসিয়েশন এবং ব্রিটিশ ভারতীয় এসোসিয়েশন ছিল ভারতে প্রথমদিকের রাজনৈতিক সংস্থা।

বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)

পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশের মানচিত্র

প্রথম বাঙলা জাতীয়তাবাদের যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ নামে অধিক পরিচিত লাভ করে তা মূলত ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ দ্বারাই সংঘটিত হয়।[1][2] বঙ্গভঙ্গকে বাঙালি মুসলমানরা সমর্থন করলেও অধিকাংশ বাঙালি বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন এবং স্বদেশী আন্দোলন এর মত বিভিন্ন ধরনের প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন এবং ব্যাপকভাবে ইউরোপীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা দেয়। ব্রিটিশ আধিপত্যকে প্রত্যাখ্যান করে এবং একটি অখণ্ড বাংলার প্রতিষ্ঠার আশায়, বাঙালিরা একটি বিপ্লবী আন্দোলন ডাক দেন, যা বাঙালির জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিগণিত হয়। বিপিন চন্দ্র পাল, খাজা সলিমুল্লাহ, চিত্তরঞ্জন দাস, মাওলানা আজাদ, সুভাষচন্দ্র বসু, তার ভাই শরৎচন্দ্র বসু, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এর মত রাজনৈতিক নেতাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙলা, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অন্যতম ভিত্তি হিসেবে গড়ে উঠে।

অবিভক্ত বাংলা

হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়া ও একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের চাহিদা ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠায়, ১৯৪৭ সালের মাঝামাঝিতে ভারত বিভাজনের প্রয়োজনীয়তা প্রবল হয়ে উঠে।

ভাষা আন্দোলন

বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দু’টি অংশ: পূর্ব বাংলা (১৯৫৫ সালে "পূর্ব পাকিস্তান"রূপে আবির্ভূত; বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক , পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন

ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদ্‌যাপন করা হয়।

বাংলাদেশ গঠন

১৯৭১ সালে বাংলার বৃহত্তম (৬২%) অংশ নিয়ে নতুন একটি দেশ গঠন করা হয় যার নাম দেওয়া হয় বাংলাদেশ

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. John R. McLane, "The Decision to Partition Bengal in 1905," Indian Economic and Social History Review, July 1965, 2#3, pp 221–237
  2. Encyclopedia Britannica, "Partition of Bengal" http://www.britannica.com/EBchecked/topic/60754/partition-of-Bengal
  • এম আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমানের যুগ (১৯৮৩), ইউনিভার্সিটি প্রেস
  • ক্রেগ বক্সার, বাংলাদেশ: একটি জাতি থেকে একটি রাজ্য (১৯৯৭), ওয়েস্টভিউ প্রেস
  • Cyriac Maprayil, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (২০০১) আইএসবিএন ৮১-৭৫১০-১২১-০
  • Anthony Mascarenhas, Bangladesh: A Legacy of Blood আইএসবিএন ০-৩৪০-৩৯৪২০-X
  • Mahua Sarkar, Visible Histories, Disappearing Women: Producing Muslim Womanhood in Late Colonial Bengal, (2008) Durham, NC: Duke University Press.
  • Nitish Sengupta, History of the Bengali-speaking People আইএসবিএন ৮১-৭৪৭৬-৩৫৫-৪
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.