বাংলাদেশ গণপরিষদ
বাংলাদেশ গণপরিষদ হল বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হয় গণপরিষদ। এটি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ অস্থায়ী সংসদ হিসেবে ছিল। ১৯৭২ সালে এটি বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন ও গ্রহণ করে।
বাংলাদেশ গণপরিষদ | |
---|---|
ধরন | |
ধরন | |
ইতিহাস | |
শুরু | ১৯৭১ |
বিলুপ্তি | ১৯৭৩ |
পূর্বসূরী | পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ পূর্ব বাংলা আইনসভা |
উত্তরসূরী | জাতীয় সংসদ |
আসন | ৪০৪[1] |
সভাস্থল | |
সংসদ ভবন (বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ঢাকা, বাংলাদেশ) |
গণপরিষদ গঠন
১৯৭২-এর জানুয়ারির ১১ তারিখ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষরিত “বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২” জারি করা হয়। এই আদেশ বলে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায় অনুসারে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবলম্বিত হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী ১৯৭২ সালের ২৩শে মার্চ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন। এবং তা ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকরী বলে ঘোষিত হয়।
এই আদেশ বলে, ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৬৯-এর (জাতীয় পরিষদে ১৬৯ জন আর প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ জন) মধ্যে ৪০৩ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। ৪০৩ জনের মধ্যে ৪০০ জন সদস্য ছিল আওয়ামী লীগের আর ১ ছিল ন্যাপের আর ২ জন ছিল নির্দলীয়। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১০ এপ্রিল ১৯৭২ সালে। অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। প্রথম অধিবেশনের শুরুতে শাহ আব্দুল হামিদ স্পীকার ও মোহাম্মদ উল্ল্যাহ ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন।[2]
সংবিধান প্রণয়ন
সংবিধান কমিটি গঠন ও কমিটি কর্তৃক খসড়া প্রণয়ন
১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট “খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটি” গঠিত হয়।[3][4] তাঁরা হলেন:
- ড. কামাল হোসেন (ঢাকা-৯, জাতীয় পরিষদ)
- মো. লুৎফর রহমান (রংপুর-৪, জাতীয় পরিষদ)
- অধ্যাপক আবু সাইয়িদ (পাবনা-৫, জাতীয় পরিষদ)
- এম আবদুর রহিম (দিনাজপুর-৭, প্রাদেশিক পরিষদ)
- এম আমীর-উল ইসলাম (কুষ্টিয়া-১, জাতীয় পরিষদ)
- মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মনজুর (বাকেরগঞ্জ-৩, জাতীয় পরিষদ)
- আবদুল মুনতাকীম চৌধুরী (সিলেট-৫, জাতীয় পরিষদ)
- ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল (বাকেরগঞ্জ-১৫, প্রাদেশিক পরিষদ)
- সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (সিলেট-২, প্রাদেশিক পরিষদ)
- সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ময়মনসিংহ-১৭, জাতীয় পরিষদ)
- তাজউদ্দীন আহমদ (ঢাকা-৫, জাতীয় পরিষদ)
- খন্দকার মোশতাক আহমেদ (কুমিল্লা-৮, জাতীয় পরিষদ)
- এ এইচ এম কামরুজ্জামান (রাজশাহী-৬, জাতীয় পরিষদ)
- আবদুল মমিন তালুকদার (পাবনা-৩, জাতীয় পরিষদ)
- আবদুর রউফ (রংপুর-১১, ডোমার, জাতীয় পরিষদ)
- মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ (রাজশাহী-৩, জাতীয় পরিষদ
- বাদল রশীদ, বার অ্যাট ল,
- খন্দকার আবদুল হাফিজ (যশোর-৭, জাতীয় পরিষদ)
- শওকত আলী খান (টাঙ্গাইল-২, জাতীয় পরিষদ)
- মো. হুমায়ুন খালিদ
- আছাদুজ্জামান খান (যশোর-১০, প্রাদেশিক পরিষদ)
- এ কে মোশাররফ হোসেন আখন্দ (ময়মনসিংহ-৬, জাতীয় পরিষদ)
- আবদুল মমিন
- শামসুদ্দিন মোল্লা (ফরিদপুর-৪, জাতীয় পরিষদ)
- শেখ আবদুর রহমান (খুলনা-২, প্রাদেশিক পরিষদ)
- ফকির সাহাব উদ্দিন আহমদ
- অধ্যাপক খোরশেদ আলম (কুমিল্ল্না-৫, জাতীয় পরিষদ)
- অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক (কুমিল্লা-৪, জাতীয় পরিষদ)
- দেওয়ান আবু আব্বাছ (কুমিল্লা-৫, জাতীয় পরিষদ)
- হাফেজ হাবিবুর রহমান (কুমিল্লা-১২, জাতীয় পরিষদ)
- আবদুর রশিদ
- নুরুল ইসলাম চৌধুরী (চট্টগ্রাম-৬, জাতীয় পরিষদ)
- মোহাম্মদ খালেদ (চট্টগ্রাম-৫, জাতীয় পরিষদ)
- রাজিয়া বানু (নারী আসন, জাতীয় পরিষদ)
১৭ এপ্রিলের এই কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কমিটি জনগণের সকল অংশের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়নকালে কমিটি কর্তৃক বিবেচনার জন্য যেকোন প্রতিষ্ঠান এবং এই ব্যাপারে আগ্রহী যে কোন ব্যক্তির নিকট হতে লিখিত প্রস্তাব আহ্বান করে।[5] এইরূপ সকল প্রস্তাব ১৯৭২ সালের ৮ই মের মধ্যে বাংলাদেশ গণপরিষদের খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির সচিবের নিকট রেজিস্ট্রিকৃত ডাকযোগে পাঠানের অনুরোধ জানায়।
এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যম, সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশন ইত্যাদির মাধ্যমেও প্রস্তাব পাঠানোর আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর ফলে কমিটি ৯৮টি স্মারকলিপি লাভ করে যা কমিটির সদস্যদের কাছে পেশ করা হয়।[5] এপ্রিলের ১৭ থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত কমিটির ১৩টি ও মে মাসের ১০ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত ১৬টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৯টি বৈঠকে প্রতিটি খসড়া বিধান নিয়ে আলোচনা হয় এবং বিভিন্ন দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করা হয়।[5]
বেশীর ভাগ অনুচ্ছেদ ও দফা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত হয়। কিছু ক্ষেত্রে উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতানুযায়ী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৭২-এর মে মাসের ২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, খসড়া বিধানাবলী নিয়ে সদস্যগণ যে সব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তার ভিত্তিতে সংবিধানের একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া প্রস্তুত করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া প্রস্তুত করা হয় এবং জুনের ৩ তারিখে কমিটি বৈঠকে তা উপস্থাপন করা হয়। কমিটি এই খসড়াটি দফাওয়ারী পর্যালোচনা করে জুনের ১০ তারিখে কমিটি কর্তৃক খসড়া সংবিধান অনুমোদিত হয়।
এরপর খসড়া সংবিধানের পাঠ আইনগত খসড়া রচনাকারীদের এবং বাংলা ভাষার পণ্ডিতদের দিয়ে পরীক্ষা করানো হয় ও তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিমার্জিত খসড়া সংবিধানের একটি পাঠ আগস্টের ১০ তারিখ কমিটি বৈঠকে উপস্থিত করা হয়। আগস্টের ১০ থেকে সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ এবং সেপ্টেম্বরের ৯ থেকে অক্টোবরের ১১ তারিখ পর্যন্ত কমিটি পুনরায় এই পাঠের পর্যালোচনা করে। কোন কোন বিষয়ে কমিটির ৬ জন সদস্য সংখ্যগরিষ্ঠ মত সমর্থন করেননি এবং মতানৈক্যমূলক মন্তব্য সংযোজন করার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করেন। চূড়ান্তরূপে গ্রহণ করার জন্য কমিটি এ বিষয়ে মতানৈক্যমূলক মন্তব্য সংযোজনসহ একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করে ও খসড়াটি বাংলাদেশ গণপরিষদে পেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
খসড়া সংবিধান পেশ
১৯৭২-এর অক্টোবরের ১২ তারিখ গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে স্পীকার মোহাম্মদউল্লাহ দিনের ৪ নং কর্মসূচী অনুযায়ী খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি কামাল হোসেনকে রিপোর্টসহ খসড়া সংবিধান বিল পেশ করার অনুরোধ করেন। কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি বলেন:
স্পীকার সাহেব, আপনার অনুমতিক্রমে বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রস্তাব অনুযায়ী গঠিত সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে আমি এই কমিটির রিপোর্ট এবং সেই সঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য সংবিধান বিল পেশ করছি।
সংবিধানে যেন জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়, সেজন্য খসড়া সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়:
…যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।
খসড়া সংবিধানে আরো বলা হয় যে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ কতর্ক ঘোষিত “মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র”-এ লিপিবদ্ধ মৌলিক মানবাধিকারসমূহ হুবহু সংরক্ষিত করে এই খসড়ার তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার বিধানাবলী সংযোজন করা হয়। আর আইন সভা গঠনের ব্যবস্থা করা হয়েছে অন্যূন আঠারোো বছর বয়স্ক নাগরিকদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের ভার অর্পিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভার উপর; আর এই মন্ত্রিসভাকে যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ রাখা হয়। আরো ব্যবস্থা করা হয় যে, রাষ্ট্রপতি হবেন সাংবিধানিক প্রধান; তার ক্ষমতা ও পরিধি কি হবে, তা খসড়ায় বিধিবদ্ধ করা হয়। এই খসড়ায় নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার ব্যবস্থা করা হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য যে সব পদ ও দপ্তর অপরিহার্য বলে মনে করা হয়, সে সব পদ ও দপ্তর সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এটর্নি-জেনারেল, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও পরীক্ষকের পদ এবং নির্বাচন কমিশন ও সরকারী কর্ম কমিশন দপ্তর।
হাতেলেখা খসড়া সংবিধান বিল পেশ করার পর গণপরিষদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কমিটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর ভাষণে বলেন:
…প্রায় ৭২ দিন আমাদের এই কমিটির সদস্যরা কাজ করেছেন, চিন্তা করেছেন, আলোচনা করেছেন এবং পৃথিবীর সমস্ত সংবিধান যতদূর সম্ভব দেখাশুনা করে একটি খসড়া আজ এই গণপরিষদে পেশ করতে পেরেছেন। …আজ বাংলাদেশের গণপরিষদের সদস্যরা সেই রক্ত লেখা দিয়ে শাসনতন্ত্র দিতে চান। শাসনতন্ত্র ছাড়া কোন দেশ চলতে পারে না। …শাসনতন্ত্র ছাড়া কোন দেশ- তার অর্থ হলো মাঝিবিহীন নৌকা, হালবিহীন নৌকা। শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকার থাকবে, শাসনতন্ত্রে মানুষের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যও থাকবে। এখানে ফ্রি স্টাইল ডেমোক্রেসি চলতে পারে না। …আমাদের আদর্শ পরিষ্কার হয়ে রয়েছে। এই পরিষ্কার আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং সে আদর্শের ভিত্তিতে দেশ চলবে। …চারটি আদর্শের ভিত্তিতে বাংলার শাসনতন্ত্র তৈরি হবে।” “…দুনিয়ার কোন দেশে দেখা যায় না, দশ মাসের মধ্যে কোন দেশ শাসনতন্ত্র দিতে পেরেছে। মোবারকবাদ জানাবো বাংলার জনসাধারণকে। যাদের রক্তে লেখা এই শাসনতন্ত্র…।
সংবিধান বিল উত্থাপন প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী ও কমিটির সভাপতি কামাল হোসেন তাঁর বক্তৃতায় বলেন:
…আজ আমি সর্বপ্রথমে শ্রদ্ধার সঙ্গে সেই বীর শহীদদের স্মরণ করি যাঁরা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়েছেন। যাঁদের প্রাণের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সুযোগ পেয়েছি। …বাংলা ভাষায় খসড়া সংবিধান পেশ করতে পেরেছি, একারণেও আজকের দিন আমাদের জন্য অত্যন্ত সুখের দিন। বাংলা ভাষার ইতিহাসেও এটা স্মরণীয় ঘটনা। রাষ্ট্র-ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের যে মহান পর্ব রচনা করেছিল, তার যোগ্য পরিণতি আজ ঘটলো। …সংবিধানকে বলা হয় একটা দেশের মৌলিক আইন বা সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান জনগণকে প্রেরণা দেবে এবং জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী সমাজ গঠনের ভিত্তি সংস্থাপন করবে, এটা আশা করা যায়। আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায় যে, জনগণ যে ক্ষমতার মালিক, সেই ক্ষমতা আইনসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করার জন্য কতকগুলা প্রধান অঙ্গ সংবিধানে প্রতিষ্ঠা করা হয়। যে দেশের এরকম মৌলিক আইন আছে, সে দেশে কোন ব্যক্তি বা কোন রাষ্ট্রীয় অঙ্গ সেই আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না। এই জন্যই বলা হয় যে, সাংবিধানিক সরকারে ব্যক্তির শাসন নয়, আইনের শাসন প্রবর্তিত হয়। …সংবিধান প্রণয়নের যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব আমাদের উপর অর্পিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে শুধু আমাদের বর্তমান জনগণ নন, পৃথিবীর মানুষ এবং আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা আমাদের প্রচেষ্টাকে বিচার করবেন। এই কথা ক’টি বলে আমি গণপরিষদে সংবিধান-বিল উত্থাপন করছি।
সংবিধান-বিলের ওপর সাধারণ আলোচনা
১৯৭২-এর অক্টোবরের ১২ তারিখ বাংলাদেশ গণপরিষদে সংবিধান বিল পেশ করার পর সাত দিন ধরে জাতীয় দৈনিকগুলোতে ধারাবাহিকভাবে খসড়া সংবিধানের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়। অক্টোবরের ১৯ তারিখ গণপরিষদে সংবিধান বিষয়ে সাধারণ আলোচনা আরম্ভ হয়। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি কামাল হোসেন এদিন সংবিধান-বিলটি অবিলম্বে বিবেচনার জন্য পরিষদের স্পীকারকে অনুরোধ করেন এবং স্পীকার সংবিধান-বিলটি অবিলম্বে বিবেচনার জন্য পরিষদ সদস্যদের সাধারণ আলোচনার আহ্বান জানান।
সাধারণ আলোচনার শুরুতেই পরিষদের ন্যাপ দলীয় একমাত্র বিরোধী সদস্য সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত বলেন:
…বাংলার মানুষ মাত্র ১০ মাস সময়ের মধ্যে অফুরন্ত আশার প্রতীক এই সংবিধান পেতে যাচ্ছে এবং এই সংবিধানের মাধ্যমে তারা কতটুকু গণতান্ত্রিক অধিকার লাভ করছে, সেটা এখানে আলোচনা হওয়া দরকার। তাছাড়া কিছু লোক এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে যাতে সংবিধান পাস হতে না পারে, সংবিধান যাতে বানচাল হয়ে যায়, মানুষের আইন যাতে এদেশে টিকতে না পারে, সত্যিকার আইনের শাসন যাতে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে। …কোন ষড়যন্ত্রে যাতে এই সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া পিছিয়ে না যায়, আমি সে জন্য সজাগ আছি। …সংবিধান মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকরূপে পাস হওয়ার আগে যাতে এদেশের মানুষ আলোচনা করতে পারে, তার জন্য পরিষদের নেতার কাছে আবেদন করছি।
সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্তের প্রস্তাবকে সমর্থন করে অতঃপর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত নির্দলীয় সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেন:
আজ যে সংবিধান আমরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য রেখে যাচ্ছি, সেই সংবিধানে যদি এমন একটা নীতি না থাকে, যে নীতির দ্বারা আমাদের দেশে যারা ঘুষখোর, যারা দুর্নীতিপরায়ণ, তাদের যদি আমরা উচ্ছেদ করতে না পারি, তাহলে এই সংবিধানের কোন অর্থ হয় না। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে একথা ছিল না, ১৯৬২ সালের সংবিধানেও একথা ছিল না। …যারা ভবিষ্যতের নাগরিক, যারা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর, তারা আমাদেরকে বলবে যে, যাঁরা এই সংবিধান প্রণয়ন করে গিয়েছেন, তাঁরা ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং দুর্নীতির পথ উন্মুক্ত করে গিয়েছেন। …আমরা এ সংবিধানকে সুন্দর করে গড়ে তুলি, যেন আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে এই দাবি রেখে যেতে পারি যে, আমরা সুন্দর একটি সংবিধান রচনা করেছি।
১৯৭২-এর অক্টোবরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সংবিধান-বিলের ওপর সাধারণ আলোচনা অব্যাহত থাকে। সংযোজন-বিয়োজনের পর অতঃপর অক্টোবরের ৩১ তারিখ থেকে সংবিধান-বিল বিবেচনার দফাওয়ারী পাঠ শুরু হয়। গণপরিষদে পেশকৃত খসড়া সংবিধানের প্রতিটি দফা স্পীকার পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে পাঠ করেন এবং দফাটি সম্পর্কে সদস্যগণের কোনরূপ ভিন্নমত বা সংশোধনী থাকলে সেটা নিয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনার পরই কেবল ভোটাভুটির মাধ্যমে তার নিষ্পত্তি বিধান করে দফাটি গৃহীত হয়। এরপর নভেম্বরের ৩ থেকে শুরু হয় দফাওয়ারীভাবে সংবিধান-বিল আলোচনা। একটানা চলে মাঝ রাতের বিরতি দিয়ে পরদিন ৪ তারিখ সকাল ১১-৩০ মিনিটে অধিবেশন পুনরায় আরম্ভ হয়। আলোচনা-পর্যালোচনার সমাপ্তিতে প্রস্তাবনা থেকে শুরু করে চতুর্থ তফসিল পর্যন্ত পৃথক পৃথকভাবে সকল দফা ধ্বনি-ভোটে গৃহীত হয়। কমিটির সভাপতি কামাল হোসেন স্পীকারের অনুমতিক্রমে প্রস্তাব করেন যে,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি সংবিধান প্রদানের উদ্দেশ্যে পরিষদে স্থিরীকৃত-আকারে সংবিধান-বিলটি গ্রহণ করা হোক।
স্পীকার গণপরিষদ সদস্যদের উদ্দেশে কমিটির সভাপতির প্রস্তাবের প্রতিধ্বনি করেন।
নেতা, বিরোধী দলীয় ও নির্দলীয়র বক্তব্য
চূড়ান্তরূপে সংবিধান গৃহীত হওয়ার পূর্বে সংবিধান-বিলের উপর বক্তব্য প্রদান করার অনুমতি চান যথাক্রমে সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত এবং মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। ন্যাপ দলীয় গণপরিষদ সদস্য সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত তাঁর বক্তৃতায় বলেন:
…এই সংবিধানে বাঙালী জাতীয়তাবাদ- ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বেড়াজাল ভেঙ্গে যে নূতন ধর্মনিরপেক্ষ, বাংলা-ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, পৃথিবীর সামনে স্থান পেয়েছে, তার মূলমন্ত্র যেটা, সেটা হলো, একটা জাতির অন্য দিকে উত্তরণ এবং সেই উত্তরণের যিনি কাণ্ডারী থাকেন, তাঁকে নেতা বলে গ্রহণ করা হয়। …আজকে এই সংবিধানের মাধ্যমে দেখা যাবে যে, কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের যে ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল, সেই জাতীয়তাবাদের বেড়াজাল ভেঙ্গে আজ সত্যি ধর্ম-নিরপেক্ষতার আগড়ে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছে।
নির্দলীয় সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁর বক্তৃতায় বলেন:
…এই গণপরিষদের একজন নির্দলীয় সদস্য হিসেবে আমি যে আলোচনা করেছি এই সংবিধানের উপর, সেখানে আমার মনের যে অভিব্যক্তি, মনের যে আবেগ, মনের যে ধারণা, সেটাই আমি সরল মনে ব্যক্ত করেছি আমার বক্তব্যে- একজন সম্পূর্ণ সরল মানুষের মতো। …এই মহান গণপরিষদে সেই সব কথা বলার যে অধিকার আমি পেয়েছি, আমি মনে করি, এই মহান গণপরিষদে সেটা গণতান্ত্রিক অধিকারের একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। …আমার দেশে সমাজতন্ত্র হবে, দেশে অভাব থাকবে না, হিংসা, দ্বেষ-বিদ্বেষ- কিছুই থাকবে না। শুধু থাকবে মানুষে মানুষে প্রেম, প্রীতি, মায়া-মমতা এবং তার দ্বারা এক নূতন সমাজ গড়ে উঠবে। মানবতার একটা ইতিহাস থাকবে এবং তাতে লেখা থাকবে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ …সর্বশেষে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি জাতির শ্রদ্ধেয় পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যাঁর নেতৃত্বে আজ এই মহান গণপরিষদে কোটি কোটি মানুষের জন্য এই পবিত্র দলিল রচিত হয়েছে।
সংবিধান-বিলটি গৃহীত হওয়ার পূর্বে পরিষদ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বক্তৃতায় বলেন:
…আজ প্রথম সাড়ে সাত কোটি বাঙালী তাদের শাসনতন্ত্র পেতে যাচ্ছে। বাংলার ইতিহাসে বোধ হয় এই প্রথম নজির যে, বাঙালীরা তাদের নিজেদের শাসনতন্ত্র প্রদান করছে। …বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের ভোটের মারফতে গণপরিষদে এসে তাদের দেশের শাসনতন্ত্র প্রদান করছেন। …বাংলার মানুষ আমরা বুঝতে পারি না, হুজুগে মেতে পরের ছেলেকে বড় করে দেখি, এই ছিল আমাদের দুর্ভাগ্য। দুনিয়ার কোনো দেশে “পরশ্রীকাতরতা” বলে কোন অর্থ পাই না এক বাংলাদেশ ছাড়া। বাঙালী জাতি আমরা পরশ্রীকাতর খুব বেশি। ইংরেজি ভাষায়, রাশিয়ান ভাষায়, ফ্রেঞ্চ ভাষায়, চায়নিজ ভাষায় “পরশ্রীকাতরতা” বলে কোন শব্দ নাই, একমাত্র বাংলাভাষা ছাড়া। এই কারণে বাঙালীদের মধ্যে যেমন ত্যাগ ও সাধনা করার শক্তি ছিল, তেমনি পরশ্রীকাতরতার মনোভাবও দেখা গেছে। …১৯৪৭ সাল থেকে এক বিরাট ষড়যন্ত্র চলেছিল বাংলাদেশের মানুষকে একটা কলোনি করে রাখার জন্য। …১৯৪৮ সালে আঘাত হেনেছে ১৯৫২ সালে, আঘাত হেনেছে ১৯৫৪ সালে। এমনকি ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্র রচনার সময় যখন বাঙালীরা পরিষদ থেকে ‘ওয়াক আউট’ করে, তখনও বাঙালীদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক বেইমানি করে পশ্চিমাদের সঙ্গে হাত মিলায় মন্ত্রিত্বের লোভে। …আমি প্রথমেই বলেছি, এই শাসনতন্ত্র শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে। কোন দেশে কোন যুগে আজ পর্যন্ত এত বড় রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে এতো তাড়াতাড়ি শাসনতন্ত্র দিতে পারে নাই। …বিপ্লবের পর নয় মাসের মধ্যে শাসনতন্ত্র দেওয়া, মানুষের মৌলিক অধিকার দেওয়ার কারণ হলো আমরা জনগণের উপর বিশ্বাসী; …চারটা মূল স্তম্ভের উপর এই শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছে। এই সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা এই হাউসে হয়েছে। আমার সহকর্মীরা অনেকেই এর উপর বক্তৃতা করেছেন। …এই যে চারটা স্তম্ভের উপর শাসনতন্ত্র রচনা করা হলো এর মধ্যে জনগণের মৌলিক অধিকারই হচ্ছে মূল বিধি। …আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র, সেই গণতন্ত্র যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। …আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র। …আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি; এবং বিশ্বাস করি বলেই আমরা ঐগুলি জাতীয়করণ করেছি। যারা বলে থাকেন, সমাজতন্ত্র হলো না, সমাজতন্ত্র হলো না, তাদের আগে বুঝা উচিত, সমাজতন্ত্র কি? …সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। …ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবো না। …আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। …কেবল শাসনতন্ত্র পাস করলেই দেশের মুক্তি হয় না, আইন পাস করলেই দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয় না। ভবিষ্যৎ বংশধর, ভবিষ্যত জনসাধারণ কি করে, কীভাবে শাসনতন্ত্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবে তারই উপর নির্ভর করে শাসনতন্ত্রের সাফল্য, তার কার্যকারিতা। আমরা চারটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র দিয়েছি। …গণতন্ত্রে মৌলিক অধিকার ব্যবহার করতে হবে। তার জন্যে এথিকস্ মানতে হয়। …গণতন্ত্রে যেমন অধিকার আছে তেমনি সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যও রয়েছে। সেইজন্য শাসনতন্ত্র রচনা করার সময় আমরা চারটি স্তম্ভ ঠিক রেখেছি। …আমরা শাসনতন্ত্র প্রদান করেছি- এর উপর আইন পাস হবে যার দ্বারা দেশ পরিচালিত হবে। …শাসনতন্ত্রের অর্থ আইন নয়। শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে আইন হয়। আইন যে কোন সময় পরিবর্তন করা যায়। শাসনতন্ত্র- …যার একটা আদর্শ, নীতি থাকে। সেই শাসনতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে আইন পাস করতে হয়। …শাসনতন্ত্রের মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে আইন হয়।[5]
গণপরিষদ নেতার নীতি-নির্ধারণী বক্তৃতার পর খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি কামাল হোসেন তাঁর বক্তৃতায় বলেন:
…নেতার বলার পর আমার আর কিছু বলার নেই। গণপরিষদের সামনে এই যে প্রস্তাবটা আছে, সেটা গৃহীত হলে আমার দায়িত্বও আপাতত শেষ হবে। আপনার মাধ্যমে ধন্যবাদ জানাতে চাই সকলকে। বিশেষত, নেতার কাছ থেকে যে প্রেরণা পেয়েছি তা ভুলবার নয়, যার ফলে অনেক অসম্ভব সম্ভব হয়েছে এবং অল্প দিনের মধ্যে সংবিধান রচনা করা সম্ভব হয়েছে।
সংবিধান-বিল অনুমোদন
কমিটির সভাপতি কামাল হোসেন তাঁর বক্তৃতার সমাপ্তি টেনে বলেন,
…পরিশেষে আপনাকে আবার ধন্যবাদ জানিয়ে আমি বলতে চাই যে, আমার নামে যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, তা এখন গণপরিষদের ভোটে দেওয়া হোক।
সংবিধান বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে গণপরিষদের স্পীকার গণপ্রতিনিধিবৃন্দের উদ্দেশে বলেন,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে পরিষদে স্থিরীকৃত-আকারে সংবিধান-বিলটি গ্রহণ করা হোক।
প্রস্তাবটি পরিষদে স্থিরীকৃত-আকারে সংবিধান-বিল হিসেবে পাস হয়। এরপর “বিলের প্রস্তাবনা, সংক্ষিপ্ত শিরনামা, সূচীপত্র, তফসিল, সকল অনুচ্ছেদ, দফা, উপ-দফা, বিষয়বস্তু” সংবিধান-বিলের অংশ বলে নবেম্বর ৪, ১৯৭২-এ ধ্বনি-ভোটে গৃহীত হয়।[6] মোট ২১টি অধিবেশনে ২০৮ দিনে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়।
হাতেলেখা সংবিধান
১৯৭২-এর ডিসেম্বরের ১২ তারিখ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর গণভবনে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে সাক্ষাৎ করেন ৬ সদস্যের শিল্পীবৃন্দের এক প্রতিনিধি দল। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ও আইনমন্ত্রী কামাল হোসেন। প্রতিনিধি দলের নেতা জয়নুল আবেদিন হাতেলেখা সংবিধানের অনুলিপিটির প্রতিটি পাতায় অঙ্কিত চিত্রগুলো বঙ্গবন্ধুর কাছে উপস্থাপন করেন।
লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের দ্বিতীয় সচিব, পেশাদার লিপিকর একেএম আবদুর রউফকে সংবিধান হাতে লেখার জন্য লন্ডন থেকে আনা হয়। নকশার কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিল্পীগণ বাংলা-মায়ের নয়ন-মনোহর মনোরম দৃশ্যগুলি চিত্রায়িত করেন। নদী-মেঘলা আকাশ, নৌকাবাইচ, মাঝি-মাল্লা, পাটচাষী, নবান্ন ও কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের জীবনসহ মাতৃভূমির শোভা দলিলে প্রস্ফূটিত করেন শিল্পাচার্য।[5]
হাতেলেখা সংবিধানে স্বাক্ষর-দান অনুষ্ঠান
বাংলাদেশ গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনের অষ্টাদশ বৈঠক ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর, সকাল ৯টা ১০ মিনিটে স্পীকার মহম্মদুল্লাহর সভাপতিত্বে ঢাকাস্থ পরিষদ ভবনে আরম্ভ হয়। অধিবেশনের শুরুতে সংবিধান কমিটির সভাপতি এবং আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কামাল হোসেন বলেন,
গত ৪ঠা নভেম্বর তারিখে এই গণপরিষদে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যে সংবিধান গৃহীত হয়েছে, সদস্যরা আজ তাতে স্বাক্ষর-দান করতে পারবেন বলে আমরা খুবই আনন্দবোধ করছি। …জনাব স্পীকার, আপনার অনুমতি নিয়ে আমি এখন প্রস্তাব করছি যে, সকল সংশোধনী ও লেখনীগত ত্রুটির শুদ্ধি অন্তর্ভুক্ত করার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মূল পাঠ বাংলা এবং ইংরেজিতে অনূদিত একটি অনুমোদিত পাঠ এখন স্পীকার কর্তৃক নির্ভরযোগ্য বলে সার্টিফিকেট প্রদান করা হোক এবং গণপরিষদ সদস্যগণ কর্তৃক সংবিধান ও তার ইংরেজি অনুবাদের স্বাক্ষরিত একটি করে পাঠ জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত করা হোক।[7]
এরপর ধ্বনি-ভোটে প্রস্তাবটি গৃহীত হলে স্পীকার দিনের কার্যসূচির দ্বিতীয় দফা অর্থাৎ স্বাক্ষর-দান অনুষ্ঠান শুরু করেন।
এ-পর্যায়ে স্পীকার বলেন,
সদস্যগণ …আমাদের স্বাক্ষর উৎসব শুরু হবে। আপনারা যার যার আসনে আছেন, সেই ক্রমানুসারে এক এক করে এসে আমাদের রিপোর্টারগণ যে টেবিলে বসে লেখেন, সেই টেবিলে রক্ষিত সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি পাঠে স্বাক্ষর-দান করুন। এক নম্বর আসনে রয়েছেন পরিষদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে আমি প্রথমে স্বাক্ষর করার জন্য আহ্বান করছি।
তখন শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে সংবিধানের বাংলা এবং পরে ইংরেজি পাঠে স্বাক্ষর-দান করেন। এর পর পর যথাক্রমে পরিষদ উপনেতা ও শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাক্ষর-দান করার পর অন্য সদস্যবৃন্দ স্বাক্ষর-দান অব্যাহত রাখেন এবং পরদিন ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা প্রলম্বিত হয়। ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭২ সকাল ১০টায় পুনরায় অধিবেশন আরম্ভ হয় এবং যেসব সদস্য স্বাক্ষর-দান করেননি তাঁদের স্বাক্ষর-দানের পর স্পীকার স্বাক্ষর-দান অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেন।
গণপরিষদ বিলুপ্তি
হাতেলেখা সংবিধানে স্বাক্ষর-দান শেষ হবার পর পরিষদ নেতা বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার পর স্পীকার বাংলাদেশ গণপরিষদের সিদ্ধান্ত ও অভিপ্রায় অনুযায়ী জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে রাত বারোটায় (১৬ ডিসেম্বর) পরিষদের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন।[8]
তথ্যসূত্র
- Syed Giasuddin Ahmed (১৯৯০)। Bangladesh Public Service Commission। University of Dhaka। পৃষ্ঠা 95।
- Momen, Nurul (১৯৮০)। Bangladesh, the First Four Years: From 16 December 1971 to 15 December 1975 (ইংরেজি ভাষায়)। Bangladesh Institute of Law & International Affairs।
- Omar, Imtiaz (১৯৯৬-০৪-২৪)। Rights, Emergencies, and Judicial Review (ইংরেজি ভাষায়)। Martinus Nijhoff Publishers। আইএসবিএন 978-90-411-0229-4।
- "WE, THE PEOPLE"। The Daily Star (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৩-১২-১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-২৪।
- "সংবিধান প্রণয়ন বার্ষিকী ও প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য"। banglanews24.com। ৩ নভেম্বর ২০১২।
- হারুন আল রশীদ (৫ নভেম্বর ২০১০)। "বাহাত্তরের নথিপত্র লাপাত্তা"। www.prothom-alo.com। ২০১৭-০৩-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-২২।
- আবুল খায়ের (১০ নভেম্বর ২০১০)। "বাংলাদেশ গণপরিষদ ॥ সংবিধানের আঁতুড়ঘর"। oldsite.dailyjanakantha.com। দৈনিক জনকণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ১৫ মার্চ ২০১৯।
- "গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ"। archive1.ittefaq.com.bd। ২৯ জানুয়ারী ২০১৮। ২ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ মার্চ ২০১৯।