বাংলাদেশের সংস্কৃতি

বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশের গণমানুষের সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, ভোজনরীতি, পোশাক, উৎসব ইত্যাদির মিথস্ক্রিয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বাঙালিদের রয়েছে শত শত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বাংলাদেশের বাঙালি সংস্কৃতি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বাংলাদেশ পৃথিবীর সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারণকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।

বাংলা নববর্ষে ঢাকায় পালিত মঙ্গল শোভাযাত্রা

বাংলাদেশের সংস্কৃতি বাংলা অঞ্চলের সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। মূলত বাঙালী সংস্কৃতি বলতে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকেই বোঝানো হয়। এটি কয়েক শতাব্দী ধরে বিবর্তিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকের বঙ্গীয় রেনেসাঁ, প্রখ্যাত বাঙালি লেখক, সাধু, লেখক, বিজ্ঞানী, গবেষক, চিন্তাবিদ, সংগীত রচয়িতা, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতারা বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বেঙ্গল রেনেসাঁর মধ্যে একটি নবজাতক রাজনৈতিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বীজ রয়েছে যা আধুনিক ভারতীয় শৈল্পিক সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির অনেক উপায়ে অগ্রদূত ছিল।

এম. নজরুল ইসলাম তমিজ, একজন মানবাধিকার কর্মী এবং জাতীয় মানবাধিকার সোসাইটির (এনএইচআরএস) চেয়ারম্যানের মতে, মানবাধিকার বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং এটি বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের সংমিশ্রিত সংস্কৃতিতে ইসলাম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম এবং খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব রয়েছে। এটি সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক সহ বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়; শিল্প নৈপুণ্য; লোককাহিনী লোককথা; ভাষা সাহিত্য; দর্শন ধর্ম; উৎসব উদযাপন; সেইসাথে একটি স্বতন্ত্র রন্ধনশৈলীতে রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য।

সাহিত্য ও সঙ্গীত

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য হাজার বছরের বেশি পুরনো। ৭ম শতাব্দীতে লেখা বৌদ্ধ দোহার সঙ্কলন চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় কাব্য, লোকগীতি, ও পালাগানের প্রচলন ঘটে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বাংলা কাব্য ও গদ্যসাহিত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটে।১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ বাংলা ভাষায় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলার লোক সাহিত্যও সমৃদ্ধ; মৈমনসিংহ গীতিকায় এর পরিচয় পাওয়া যায়। আধুনিক সাহিত্যিকদের মধ্যে আল মাহমুদ, হুমায়ূন আহমেদ খুব বেশি জনপ্রিয়। তাছাড়াও ছোটদের কাছে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, রকিব হাসান, খুব জনপ্রিয়। অন্যান্য প্রধান ধারার সাহিত্যিকদের মধ্যে কাজী আনোয়ার হোসেন, কবি শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছেন।

বাংলাদেশের সঙ্গীত বাণীপ্রধান; এখানে যন্ত্রসঙ্গীতের ভূমিকা সামান্য। গ্রাম বাংলার লোক সঙ্গীতের মধ্যে বাউল গান, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, গম্ভীরা, কবিগান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গ্রামাঞ্চলের এই লোকসঙ্গীতের সাথে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে মূলত একতারা, দোতারা, ঢোল, বাঁশি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। আধুনিক সংগীতকাররা অবশ্য বিদেশী বাদ্যযন্ত্র যেমন কীবোর্ড, ড্রামস, গীটার ইত্যাদিরও ব্যবহার করে থাকেন। কেউ কেউ আবার লোকজ ও আধুনিকতার মিশ্রণে ফিউশন ধারারও প্রচলন করেন।

নৃত্য

নৃত্যশিল্পের নানা ধরন বাংলাদেশে প্রচলিত। এর মধ্যে রয়েছে উশের গ্রামাঞ্চলে যাত্রা পালার প্রচলন রয়েছে। ঢাকা-কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র শিল্প হতে প্রতি বছর প্রায় ৮০ হতে ১০০টি বাংলা চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়।[1]

গণমাধ্যম

বাংলাদেশে মোট প্রায় ২০০টি দৈনিক সংবাদ পত্র ও ১৮০০রও বেশি সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তবে নিয়মিতভাবে পত্রিকা পড়েন এরকম লোকের সংখ্যা কম, মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৫%। [2] গণমাধ্যমের মধ্যে রেডিও অঙ্গনে বাংলাদেশ বেতারবিবিসি বাংলা জনপ্রিয়। অবশ্য একবিংশ শতাব্দিতে বেশ ক'টি বেসরকারি এফএম বেতার অনুমোদন পাওয়ার পর সাধারণ মানুষের মাঝে এফএমও বেশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তাছাড়া কিছু অনলাইন রেডিওও ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা নিয়ে গণমাধ্যমে স্থান করে নেয়ার প্রয়াস নিয়েছে। সরকারি টেলিভিশন সংস্থা বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে ২৫টিরও বেশি উপগ্রহভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারিত হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন তার টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচার দ্বারা দেশের সর্বত্র বিরাজমান থাকার পাশাপাশি বিটিভি ওয়ার্ল্ড-এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাঙালির মাঝে নিজের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে।

রন্ধন

বাংলাদেশের রান্না-বান্নার ঐতিহ্যের সাথে ভারতীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের রান্নার প্রভাব রয়েছে। ভাত, ডাল ও মাছ বাংলাদেশীদের প্রধান খাবার, যার কারণে বলা হয়ে থাকে মাছে ভাতে বাঙালি। দেশে ছানা ও অন্যান্য প্রকারের মিষ্টান্ন , যেমন রসগোল্লা, চমচম বেশ জনপ্রিয়। ভাতজাতীয় খাবারের মধ্যে বিরিয়ানি, পোলাওজাতীয় উচ্চ ক্যালরির খাবার বেশ সমাদৃত। তাছাড়া তেল-চর্বিজাতীয় মসলাযুক্ত রন্ধনপ্রণালী এতদ অঞ্চলের মানুষের খাদ্যতালিকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মানুষ শাক-সবজিকে তুলনামূলক গরীবদের খাদ্য মনে করেন আর মাছ-মাংসকে আভিজাত্য ধরে নেন।

পোশাক

বাংলাদেশের নারীদের প্রধান পোশাক শাড়ি। অল্পবয়স্ক মেয়েদের মধ্যে, শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সালোয়ার কামিজেরও চল রয়েছে। একবিংশ শতাব্দিতে শহরাঞ্চলের কিশোরী-যুবতীরা শার্ট-প্যান্ট কিংবা জিন্স-কামিজ বা জিন্স-ফতুয়াও পরে থাকেন। পুরুষদের প্রধান পোশাক লুঙ্গি, তবে শহরাঞ্চলে পাশ্চাত্যের পোশাক শার্ট-প্যান্ট প্রচলিত। গ্রামাঞ্চলেও দাপ্তরিক পোশাক হিসেবে শার্ট-প্যান্টকে আভিজাত্যের অংশ মনে করা হয়। বিশেষ অনুষ্ঠানে পুরুষরা পাঞ্জাবী-পায়জামা পরিধান করে থাকেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবি বাংলাদেশী পুরুষদের অন্যতম অনুষঙ্গ।

সামাজিক অনুষ্ঠান

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎসব ঈদুল ফিত্‌র , ঈদুল আজহা। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা পূজা, বৌদ্ধদের প্রধান উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা, আর খ্রিস্টানদের বড়দিনও ঘটা করে পালিত হয়ে থাকে স্ব স্ব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে। এই দিবসগুলোতে রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে। সার্বজনীন উৎসবের মধ্যে পহেলা বৈশাখ প্রধান। গ্রামাঞ্চলে নবান্ন, পৌষ পার্বণ ইত্যাদি লোকজ উৎসবের প্রচলন রয়েছে। এছাড়া স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং ভাষা আন্দোলনের স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারি সাড়ম্বরে পালিত হয়।

ক্রীড়া

ক্রিকেটফুটবল বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম খেলা। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ফুটবল জনপ্রিয় হলেও ২০০০ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টেস্ট ক্রিকেট খেলার মর্যাদা লাভ করার পর থেকে ক্রিকেট বাংলাদেশীদের কাছে খুবই প্রিয় খেলা হয়ে উঠে। কাবাডি বাংলাদেশের জাতীয় খেলা, যা গ্রামাঞ্চলে খুব বেশি প্রচলিত। অন্যান্য খেলার মধ্যে হকি, হ্যান্ডবল, সাঁতার এবং দাবা উল্লেখযোগ্য। এযাবৎ ৫ জন বাংলাদেশী - নিয়াজ মোরশেদ, জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, আবদুল্লাহ আল রাকিবএনামুল হোসেন রাজীব - দাবার আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ড মাস্টার খেতাব লাভ করেছেন।[3]

লোক ও কারুশিল্প[4]

শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের একটি উম্মুক্ত প্রদর্শনী কক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন কারুশিল্পের পণ্য

বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্প এ দেশের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারুশিল্পের বিশাল ভান্ডারে রয়েছে জামদানি, সতরঞ্জি, ধাতব শিল্প, শঙ্খ শিল্প, মৃৎশিল্প, দারুশিল্প, ঝিনুক শিল্প, পুতুল শিল্প, পিতল-কাঁসা শিল্প, বাঁশ-বেত শিল্প, শোলা শিল্প ইত্যাদি।  এছাড়া নকশি কাঁথা, নকশি শিকা, শীতল পাটি, মাটির ফলকচিত্র, পাতা ও খড়ের জিনিস, লোকচিত্র প্রভৃতি এদেশের লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শন।

তাঁত ও বয়ন শিল্প

বাংলাদেশের তাঁত ও বয়ন শিল্পের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। এ দেশের মসলিন ও জামদানি বিশ্ববিখ্যাত। ঢাকাই শাড়িও জনপ্রিয়।

নকশি কাঁথা

নকশি কাঁথা বাংলাদেশের লোক ও কারু শিল্পের ঐতিহ্যমন্ডিত ও নান্দনিক নিদর্শন। পুরনো কাপড়ের কাঁথা সেলাই করে তার ওপর গ্রামবাংলার মহিলারা বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তোলেন।

শিকাশিল্প

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শন শিকাশিল্প। পাট শিকা তৈরির প্রধান উপকরণ। নকশি শিকা তৈরিতে কঞ্চি সুতলি, ঝিনুক, কড়ি, শঙ্খ, কাপড়, পোড়ামাটির বল ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয়।

নকশি পাখা

বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্পের ঐতিহ্যের আরেক প্রতীক নকশি পাখা। তালপাতা, সুপারীর পাতা ও খোল, সুতা, পুরনো কাপড়, বাঁশের বেতি, নারিকেল পাতা, চুলের ফিতা, পাখির পালক ইত্যাদি অতি সাধারণ ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে পাখা তৈরি করা হয়।

শীতলপাটি

বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এক শিল্পের নিদর্শন শীতলপাটি। মুর্তা নামক এক ধরনের বেতি বা পাতি দিয়ে শীতলপাটি বোনা হয়।

লোকচিত্র

হাঁড়ির ওপর বিভিন্ন চিত্র আঁকা এ দেশের একটি প্রাচীন সংস্কৃতি। আবহমান বাংলার লোক সমাজের দৈনন্দিন জীবন, ধর্ম বিশ্বাস, লৌকিক আচার-আচরণ ধারণ করে আসছে এই চিত্রিত হাঁড়ি। এসব হাঁড়িতে ঘোড়া, পাখি, শাপলা ফুল, পানপাতা, মাছ প্রভৃতি মটিফ ব্যবহৃত হয়।

মৃৎশিল্প

বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্পে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে মৃৎশিল্প। এ শিল্পের হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী মৃত শিল্পসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে হাঁড়িপাতিল, কলসি, সানকি, চুলা, শাক-সবজি, ফলমূল, খেলনা, পুতুল, ঘরের টালি, ধর্মীয় প্রতিকৃতি, প্রাণীজ প্রতিকৃতি, অলঙ্কার প্রভৃতি।

মেলা

বাংলাদেশের জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী একটি সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ ‘মেলা’। [5] মেলার উৎপত্তি মূলত গ্রাম-সংস্কৃতি হতে।[6] বিভিন্ন ধর্মীয় উপলক্ষ, কৃষি মেলা, ঋতুভিত্তিক মেলা, সাধু-সন্তের ওরশ উপলক্ষে মেলা, বরেণ্য ব্যক্তিত্বের স্মরণোৎসব উপলক্ষে মেলা, জাতীয় দিবসসমূহ উদ্‌যাপন উপলক্ষে মেলা ইত্যাদি এদেশের লোক সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৈশাখী মেলা বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক।[7]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.