বাঁকখালী নদী

বাঁকখালী নদী বাংলাদেশের পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের বান্দরবানকক্সবাজার জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৬৯ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৯৫ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা "পাউবো" কর্তৃক বাঁকখালী নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের নদী নং ৯।[1] কক্সবাজার এই নদীর তীরে অবস্থিত।

বাঁকখালী নদী
দেশ বাংলাদেশ
অঞ্চল চট্টগ্রাম বিভাগ
জেলাসমূহ বান্দরবান জেলা, কক্সবাজার জেলা
উৎস দোছারি ইউনিয়নের পাহাড়
মোহনা মহেশখালী নদী
দৈর্ঘ্য ৬৯ কিলোমিটার (৪৩ মাইল)

বর্ণনা

ভারতের মিজোরাম রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড় থেকে উৎসারিত কিছু স্রোতধারা বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়িতে মিলিত হয়ে সম্মিলিত ধারায় বাঁকখালী নদীর সৃষ্টি করেছে। নদীটি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ও কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মহেশখালী চ্যানেলে পতিত হয়েছে। এই নদী খরস্রোতা ও প্রায় ৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। বাঁকখালী নদীর মোহনা থেকে ৬০ কিমি উত্তরে মাতামুহুরী মোহনা এবং মাতামুহুরী মোহনা থেকে আরো ৬০ কিমি উত্তরে শঙ্খ নদীর মোহনা। এখান থেকে আবার ২০ কিমি উত্তরে কর্ণফুলী নদীর মোহনা। আরাকান মহাসড়কের উপর কর্ণফুলী সেতু, শঙ্খ সেতু, মাতামুহুরী সেতু ও বাঁশখলী সেতু রয়েছে।[2]

ইতিহাস

অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) আরাকান দখল করে উৎপীড়ন-নির্যাতন শুরু করলে হাজার হাজার শরনার্থী বাঁকখালী নদী তীরবর্তী রামু ও কাক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স এদের পুনর্বাসন করেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের সমাধী বাঁকখালী নদীর ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এই নদী অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। নদীপথে এখানে এসেছে বহু আরব বণিক, পর্তুগিজ ও হার্মাদ-আরাকান জলদস্যু। পরে এসেছে ব্রিটিশ বণিক শাসকরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে কক্সবাজারে ব্রিটিশ-মার্কিন সৈন্যসহ মিত্র সৈন্যরা এসে বাঁকখালী নদীতে কাঠের তৈরী জেটি নির্মাণ করে। এখানে অস্ত্র-গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য জেটিতে জাহাজ ভিড়ত।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানবাহী জাহাজ 'বিক্রান্ত'সহ অন্যান্য জাহাজ থেকে মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা জলযানযোগে বাঁকখালী নদী হয়ে কক্সবাজারে অবতরণ করেন। নদীপাড়ে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীসহ স্থানীয় মানুষ তাদের স্বাগত জানায়।[2]

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাকঁখালী

নদীটি মূলত কক্সবাজার সদর ও রামুর নিম্নাংশ পর্যন্তই জোয়ারভাটা প্রভাবিত। শুষ্ক মৌসুমে এর ঊর্ধ অববাহিকার জলধারা ক্ষীণ হয়ে আসে। মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ নদীর নিম্ন অববাহিকা পাহাড়ি ঢলে বন্যা কবলিত হয়, বিশেষত রামু ও কক্সবাজার এলাকার নিম্ন ভূমি। মিঠা পানির প্রবাহ আটকে রেখে শীতকালীন সেচের মাধ্যমে কৃষি আবাদের সুযোগ বৃদ্ধিতে মোহনার কাছাকাছি এ নদীতে বাংলাদেশের প্রথম রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়। শীতকালে বাঁকখালীর জলধারা কমে গেলে দুই তীরে জেগে ওঠা চরে ব্যাপক সবজির চাষ করা হয়। এতে হাজার হাজার কৃষকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়। কক্সবাজার জেলায় সবজি উৎপাদনে বিশাল অবদান রয়েছে বাঁকখালী নদী তীরের। আবার এ নদীর মিষ্টি পানিতে শুষ্ক মৌসুমে চাষ হচ্ছে হাজার হাজার একর জমি। নদীটির জোয়ারভাটা প্রভাবিত উপকূলীয় সমভূমি ব্যাপকভাবে লবণ ও মৎস্য চাষে ব্যবহৃত হয়। বাঁকখালীর নৌকা বাইচ স্থানীয়দের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এ নদীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাদের জাহাজ ভাসা উৎসব পালন করে। বাঁকখালী ৩৫ প্রকার মাছ এবং ১০ প্রজাতির চিংড়ির আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়া বঙ্গোপসাগরের ৪ শতাধিক সামুদ্রিক প্রাণির অধিকাংশই এ নদীর মোহনায় এসে ডিম ছাড়ে বলে জানান কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র প্রধান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান।

তিনি বলেন, বাঁকখালী কক্সবাজারের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। অবদান রাখছে কক্সবাজারের জীববৈচিত্র্য রক্ষায়। বর্তমানে কক্সবাজার শহর ও খুরুশকুলের বাঁকখালী নদী তীরে বাইনসহ নানাজাতের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ রয়েছে। তবে একসময় বাঁকখালী নদী তীর গোলপাতা ও কেওড়ার জন্য বিখ্যাত ছিল।[3]

পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, বাকঁখালী নদীর প্যারাবনে ১২ হাজারের বেশি প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে উদ্ভিদ রয়েছে ৫৬৭ প্রজাতির। শামুক-ঝিনুক রয়েছে ১৬২ প্রজাতির, কাঁকড়া ২১, চিংড়ি ১৯, লবস্টার দুই, মাছ ২০৭, উভচর ১২ ও ১৯ প্রজাতির সরীসৃপ। এ প্যারাবনে ২০৬ প্রজাতির পাখির বিচরণ রয়েছে। এর মধ্যে দেশি ১৪৯ ও ৫৭ প্রজাতির অতিথি পাখি রয়েছে। বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় অনেক পাখিও প্যারাবনে দেখা যায়।[4]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক (ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। "পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের নদী"। বাংলাদেশের নদনদী: বর্তমান গতিপ্রকৃতি (প্রথম সংস্করণ)। ঢাকা: কথাপ্রকাশ। পৃষ্ঠা ২৮৭। আইএসবিএন 984-70120-0436-4।
  2. বাংলাদেশের নদীঃ মোকাররম হোসেন; পৃষ্ঠা ১২৬ ও ১২৭ কথাপ্রকাশ; দ্বিতীয় সংস্করণঃ আগস্ট ২০১৪
  3. Azadi, Dainik (২০২১-০৬-১৭)। "জীবন জীবিকার জলধারা বাঁকখালী"দৈনিক আজাদী (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-১৮
  4. "বাঁকখালীর বাঁকে বাঁকে"সমকাল (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-১৮
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.