বহাগ বিহু
ব’হাগ বিহু বা রঙালী বিহু বসন্তের আগমনে উদ্যাপন করা আসাম-এর মূল বিহু উৎসব। বসন্তের আগমনে যখন প্রকৃতি নতুন রূপে জেগে ওঠে, তখন চহা জনতা জীবন উপভোগ করতে এগিয়ে আসে। রঙালী বিহু যৌবনের উৎসব। ডেকা গাভরু রাতি বিহু শুরু করে, বিহুর মধ্যে নিজের জীবন সঙ্গী বেছে নেয়। কৃষি সংস্কৃতির আরম্ভ থেকে এমনধরনের উৎসব চলে আসছে। যৌবনের সঙ্গে চাষ মাটির উর্বরতার সম্বন্ধ আছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে। সেজন্য চাষ আরম্ভ করার আগে আগে পালন করা রঙালী বিহুর কৃষির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্বন্ধ আছে।[1]
বিহু | |
---|---|
আনুষ্ঠানিক নাম | অসমীয়া: বিহু |
পালনকারী | অসমীয়া |
ধরন | কৃষিভিত্তিক উৎসব ভারতীয় উৎসব |
| ||
---|---|---|
তিনি বিহু নৃত্য গীত
খাদ্য অন্যান্য
|
||
সাত বিহু
ব'হাগ বা রঙালী বিহু, একসাথে সাতদিন ধরে উদ্যাপন করা হয়। চৈত্রের সংক্রান্তির দিনের থেকে আরম্ভ করে বৈশাখের ৬ তারিখ পর্যন্ত সাত দিন ধরে থাকে। প্রত্যেক দিনের বিহুর একধরনের নাম আছে। এটি "সাত বিহু" বলে পরিচিত। চৈত্রের দুমাসের দিন গরু বিহুর আরম্ভ হয়ে ক্রমে মানুষ বিহু, হাত বিহু, চেনেহী বিহু, মাইকী বিহু, রঙালী বিহু এবং শেষের দিন চেরা বিহুর বহাগ বিহু সমাপ্ত হয়। ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পারে তার একটি দিন গোঁসাই বিহু বলেও পালন করা যায়।[2] অবশ্য এই সাত বিহুর পরম্পরা বর্তমান বিলুপ্তপ্রায়।
কিছু ব্যক্তি আবার বৈশাখের বিহুর এই অনুষ্ঠানসমূহকে নিম্নলিখিত মতো ভাগ করেছেন:-
- চ’ত বিহু: চৈত্রের নিশা ডেকা-গাভরু বিহুর আখরা করে এবং আখরা করা প্রথম নিশাটি হল চ’ত বিহু।
- রাতি বিহু: চ’ত বিহুর আখরার পরবর্তী বিহু মরা নিশাগুলিকে রাতি বিহু বলা হয়।
- গরু বিহু: চৈত্রের সংক্রান্তির দিন গরুকৈ গা ধুইয়ে নতুন পঘারে বাঁধা হয়। গোধূলিতে ধূপ-ধূনা ইত্যাদি দেয়া হয়।
- মানুষ বিহু বা চেনেহী বিহু: এক বৈশাখের দিন এই বিহু শুরু হয়। এই বিহুটিকে আপনজন আপনব্যক্তিকে বিহুবান দেন। বিহুগীত, হুঁচরি গান গেয়ে অতি আনন্দ করেন।
- কুটুম বিহু: বৈশাখের দ্বিতীয় দিনটি কুটুম বিহু। এই দিন মেয়েরা মাকহঁতের ঘরে যায়। ইষ্ট-কুটুম্ব পরস্পর পরস্পরকে আদর এবং সেবা-সত্কার করে।
- মেলা বিহু বা হাট বিহু: এই বিহুর দিন পথের মধ্যে একটি গাছকে প্রতীক হিসাবে নিয়ে তার নিচে গাভরুরা বিহু নাচে। গাছ জোপা থেকে বিহুবান, তামোল-পাণ ইত্যাদি শুরু করে। শিমলুগুড়ি, নাহরকটীয়া, টেঙাখাট ইত্যাদি অঞ্চলে এই বিহু দেখা যায়।
- চেরা বিহু বা এরা বিহু: বহাগ বিহুতে ডেকা-গাভরু নেচে-বেগে ভাগরে পড়ে এবং সপ্তম দিন অতি আদরের বিহুটির সমাপ্তি ঘটায়। সেই দিন বিহুবানগুলি আবার ধুইফে বিহুকে বিদায় দেন।
গরু বিহু
প্রথম বিহুটির নাম গরু বিহু।[3] এই দিন গরুর শিঙে তেল দিয়ে ধুইয়ে লাউ-বেগুন খাওয়ায় এবং তাকে মালাও পরায়। গ্রামের সব গরু কাছের নদী, বিল বা অন্য কোনো স্থানে নিফে সকলে গরু ধুইয়ে এবং নিচের গীতটি গেয়ে গেয়ে দীঘলতী, মাখিয়তী ইত্যাদি গাছের ডালের বলাই
দীঘলতির দীঘল পাত, গরু বলাওঁ জাত জাত।
মার ছোট বাপের ছোট, তই হবি বর গরু।
লাও খা বেঙেনা খা, বছরে বছরে বাঢ়ি যা।
সেদিনই মানুষ মাস, হলদি, আমর মল এবং দৈবজ্ঞের আগে দিয়ে যাওয়া সর্বৌষধিতে গা ধোয়। এইমতো গা ধুলে অপায়-অমঙ্গল দূর হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। দুপুরের নামঘরে নাম-কীর্তন করা হয়। গোধূলিতে গরুকে নতুন পঘা দেয় এবং নাড়ু পিঠা খাওয়ায়।[3]
মানুষ বিহু
দ্বিতীয় দিন বর বিহু বা মানুষের বিহু।[3] সেদিনও নামঘরে সামূহিকভাবে নাম-কীর্তন করা হয়। সাধারণত বর বিহুর দিন বিহুবান নেওয়া হয়। এই বিহুবান নিজের সঙ্গে পরিবারের অন্যান্য ইষ্ট-কুটুম্ব এবং কাছের ব্যক্তিকেও দেয়া হয়। এও এক ধরনের পরম্পরা। ব'হাগ বিহুতে খাওয়া-বোবাত রং-ধামালির ওপর বেশি গুরত্ব দেয়া হয়। ডেকা-ডেকারীরা বিহু-উৎসব তৈরি করে বিহুগীতি, বিহু নাচ, হুঁচরি, নানা রকমের খেলাধুলার ব্যবস্থা করে। সঙ্গে মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে হুঁচরি গেয়ে গৃহস্থকে আর্শীবাদ দেয়। অন্যদিকে কোনো কোনো স্থানে শেন-কনুবার যুদ্ধ, মোহ যুদ্ধ, কণী যুদ্ধ ইত্যাদি খেলাধুলারও ব্যবস্থা আছে।
রাতি বিহু
আগের কালে চৈত্র মাসের আরম্ভ থেকে ডেকা গাভরু মিলে 'রাতি বিহু' শুরুর পরম্পরা ছিল। বর্তমান এই প্রথা প্রায় উঠে যাচ্ছে। রাতি বিহু কেবল ডেকা গভরুর বিহু। ডেকা গাভরু মিলে রাতারাতি আছুতীয়া স্থানে বিহু নাচ, বিহু গীতিতে একজন সেইব্যক্তিকে প্রেম নিবেদন করত এবং বিহু তলা থেকে বহুলোক সাংসারিক জীবন আরম্ভ করত। অবশ্য বর্তমান আধুনিক সভ্যতার পরশে এই বিলাক প্রথা একেবারে লোপ পেয়ে গিয়েছে, কেবল কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে 'গাছ তলার বিহু' নামে এই রাতি বিহুর অল্প পরিবর্তিত রূপ প্রচলিত হয়ে আছে। এই রাতি বিহুর শেষ হত গরু বিহুর উরুকার দিন।
জেং বিহু
এই বিহু নৃত্য এবং গীতি কেবল মহিলাদের দ্বারা পরিবেশন করা হয়। আগে গ্রামে মহিলারা এমন বিহু নৃত্য পরিবেশন করাতে তার চারদিকে বাঁশের কিছু "জেং" গুজে নিতেন। সেজন্য পরে একে "জেং বিহু" বলে নামকরণ করা হয়। একে গাছ তলার বিহু বলেও পরিচিত।
তথ্যসূত্র
- অসমীয়া সংস্কৃতির কণিকা- সম্পাদনা-ডঃ নারায়ণ দাস, ডঃ পরমানন্দ রাজবংশী- পৃষ্ঠা- ২৪০,২৪১,২৪২
- ড: লীলা গগিয়ে (১৯৯৪)। আসামের সংস্কৃতি। ডিব্রুগড়: বনলতা প্রকাশন। পৃষ্ঠা ১৬৯।
- "Rongali Bihu Celebration"। festivalsofindia.in। Pan India Internet Private Limited (PIIPL)। ২০১৩-০৪-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৪-১৩।