বরুণ সেনগুপ্ত
বরুণ সেনগুপ্ত (২৩শে জানুয়ারি, ১৯৩৪ - ১৯শে জুন, ২০০৮) একজন ভারতীয় সাংবাদিক। তিনি বর্তমান পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। তিনি বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। বরুণ সেনগুপ্ত বরিশালের বি এম স্কুলে পড়াশোনা করেন।
বরুণ সেনগুপ্ত | |
---|---|
জন্ম | বরিশাল, ব্রিটিশ ভারত | ২৩ জানুয়ারি ১৯৩৪
মৃত্যু | ১৯ জুন ২০০৮ ৭৪) কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত | (বয়স
পেশা | সাংবাদিকতা |
জাতীয়তা | ভারত |
শিক্ষা ও পড়াশুনা
বাবা নির্মলানন্দ সেনগুপ্ত ও মা রানীবালা দেবী। দেশভাগের আগেই সপরিবারে তারা চলে আসেন কলকাতায়। থাকতেন বৈঠকখানা বাজারের কাছে একটি ভাড়া বাড়িতে। তার প্রাথমিক স্কুলশিক্ষা ওপার বাংলাতেই। পড়তেন বরিশালের বি এম স্কুলে। কলকাতায় এসে ভর্তি হন উত্তর কলকাতার টাউন স্কুলে। বাবা নির্মলানন্দ সেনগুপ্ত ছিলেন ওড়িশার ঢেঙ্কানল রাজপরিবারের শিল্পী। তার দাদাও থাকতেন ওখানে। সেই সূত্রেই বরুণ সেনগুপ্ত, তার বড় ভাই অরুণ সেনগুপ্ত ও ছোট ভাই তরুণ সেনগুপ্ত বেশ কিছুকাল কাটিয়েছিলেন ঢেঙ্কানলে। টাউন স্কুলের পর্ব কাটিয়ে আমহার্ষ্ট স্টিটের সিটি কলেজ থেকে বি কম পাস করেন বরুণ।[1]
ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতি আকর্ষণ করেছিল তাকে। ‘ভাবীকাল’ নামে একটি পত্রিকাও বের করেন তিনি। তবে তা চলেছিল অল্পদিন। ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠন করার সময়ে ছাত্রদের একটি পাক্ষিক কাগজে লেখালিখি করেছেন। এর পর ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসুর কাছ থেকে ৫০০ টাকা[1] ধার নিয়ে ১৯৫৭ সাল নাগাদ নিজেই বের করেছেন ‘বর্তমান’ নাম দিয়ে একটি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রিকা ।[1][2] সেই কাগজ টিকে ছিল বছর তিনেক। ১৯৫৯-এর শেষ দিকে বরুণবাবু আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেন। সেই তার পেশাদার সাংবাদিক জীবনের সূচনা।
সাংবাদিকতা
১৯৬৫ সালে হন আনন্দবাজার পত্রিকার রাজনৈতিক সংবাদদাতা। তার আগে কলকাতার কোনও সংবাদপত্রে রাজনৈতিক সংবাদদাতার পদ ছিল না। রাজনৈতিক সংবাদদাতা হিসেবে তার অসামান্য সব লেখা বাংলার মানুষের মধ্যে যথার্থ আলোড়ন ফেলেছিল। জরুরি অবস্থার সোচ্চার প্রতিবাদ করায় মিসায় আটক হয়ে জ়েলে যেতে হয়েছিল বরুণ সেনগুপ্ত কে। দীর্ঘ দশ মাস তিনি প্রায় চার জেলে তাকে রাখা হয়। তাকে কলকাতা থেকে পুরুলিয়া জেলে পাঠানো হয়েছিল।[3]
বাংলা সাংবাদিকতাকে নানা অবদানে সমৃদ্ধ করেছেন বরুণ সেনগুপ্ত। শুধু রাজনৈতিক সংবাদদাতা এবং ভাষ্যকার হিসাবেই নয়, একটি বাংলা দৈনিকের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবেও উত্তরকাল তাকে মনে রাখবে।বাংলা সাংবাদিকতায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক রিপোর্টিংয়ে, গোড়া থেকেই তিনি যোগ করেছিলেন একটি বাড়তি মাত্রা। যার ফলে রাজনীতির নীরস কচকচানিকে অতিক্রম করে তার লেখা হয়ে উঠতে পেরেছিল সর্বজনগ্রাহী। ভাষা বা শব্দের মারপ্যাচ বিশেষ থাকত না সেখানে। বরং একেবারেই সাদামাটা কথ্য ভঙ্গি, সঙ্গে কোনও নেতা বা ব্যক্তি সম্পর্কে লেখকের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ (তা সে প্রমোদ দাশগুপ্তর চুরুটের ছাই ঝাড়া-ই হোক, বা প্রফুল্লচন্দ্র সেনের টেবিল বাজান) তার লেখাকে দিয়েছিল এক সাবলীল ভিন্নতা। তার লেখা ছিল নির্মোহ, সাহসী। সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্তর জনপ্রিয়তার এটি একটি বড় কারণ। এক কথায় বলা চলে, রাজনৈতিক রিপোর্টিংকে তিনি অনেকটাই অন্দরমহলে টেনে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। নিজেকে রিপোর্টার ভাবতেই ভালবাসতেন তিনি। যখন পুরোদস্তুর সংবাদপত্র সম্পাদনায় রত, তখনও লেখায় বা বলায় নিজেকে উল্লেখ করতেন রিপোর্টার বলে। আসলে তার সাংবাদিক জীবনে উত্থান, প্রতিষ্ঠা সব কিছুর মূলেই ছিল রিপোর্টারি। তিনি যখন সাংবাদিকতায় আসেন তখন কংগ্রেস আমল কয়েক বছর পরেই ভোটে জিতে রাজ্যে প্রথম অ-কংগ্রেসি যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এল। এর পটভূমি রাতারাতি তৈরি হয়নি। কংগ্রেসের পতন ও অন্য শক্তির উত্থানের যে রাজনীতি, তা একেবারে ভিতর থেকে নিবিড় ভাবে দেখেছিলেন বরুণ সেনগুপ্ত। যেমন দেখেছিলেন দু-বছরেরমধ্যেই প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ও দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন। রাজ্যের সেই চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার দিনগুলি এক জন রাজনৈতিক রিপোর্টারের কাছে অবশ্যই পঞ্চব্যঞ্জনে ভোজ খাওয়ার মতো লোভনীয়। বরুণবাবু সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন। অনেকের মতে, সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্তর লেখনী ওই সময়েই বিশেষ করে পাঠকদের নজর কাড়ে। সেই সময়ের জানা-অজানা নানা তথ্য সাজিয়ে এর পরেই বরুণবাবু লেখেন তার জনপ্রিয় বই ‘পালাবদলের পালা’। সাংবাদিকতার যে আদর্শে বরুণ সেনগুপ্ত বেড়ে উঠেছিলেন, সেখানে নির্ভীক স্পষ্টবাদিতাই প্রথম ও শেষ কথা। সত্তরের দশকে জরুরি অবস্থার সময় তারই ফলস্বরূপ বরুণবাবুকে জেলে যেতে হয়। তার সাংবাদিক জীবনে সেই জেলযাত্রার ভূমিকাও বড় কম নয়। পরবর্তী কালে রাজনৈতিক বই ‘ইন্দিরা একাদশী’ এবং তার জেলে থাকার কঠোর অভিজ্ঞতার কাহিনি ‘অন্ধকারের অন্তরালে’ আরও এক বার তার জনপ্রিয়তার লেখচিত্র ঊর্ধে তুলে দেয়। এসবের পাশাপাশিই অবশ্য তার সাপ্তাহিক রাজনৈতিক কলাম ‘রাজ্য রাজনীতি’ লেখনীর প্রসাদগুণে তত দিনে পাঠকদের মন জিতে নিয়েছে। পছন্দ অপছন্দ বিতর্ক সমর্থন সব মিলেমিশে সুপুরুষ বরুণ সেনগুপ্ত ছিলেন রীতিমতো ‘হিরো’। মজা করে কেউ কেউ বলতেন, সাংবাদিককুলে উত্তমকুমার।[2]
বর্তমান প্রকাশ
১৯৮৪ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার চাকরি ছেড়ে বরুণ সেনগুপ্ত প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের কাগজ বর্তমান। প্রথমে দৈনিক সংবাদপত্র ও পরে সাপ্তাহিক বর্তমান নামে একটি একটি ঘরোয়া সাপ্তাহিক। প্রথম থেকেই নিজের কাগজকে একটি প্রতিষ্ঠান-বিরোধী চরিত্র দেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন তিনি।[2] তার প্রায় পাঁচ দশকের সাংবাদিক জীবনে সাফল্য যেমন এসেছে বহু ক্ষেত্রে, তেমনই কোনও কোনও ক্ষেত্রে এসেছে ব্যর্থতাও। টেলিভিশন-ইন্টারনেটের যুগেও তবু সাংবাদিকতার ঘরানা পরিবর্তন করেননি তিনি। মানুষের সহজবোধ্য ভাষায় সাবলীল সংবাদ পরিবেশনা ও তত্ত্বব্যাখ্যার এই প্রবণতাই আজ তার সংবাদপত্র ও অন্যান্য পত্রিকার প্রভূত জনপ্রিয়তার কারণ। এমনকি নিজেকে পর্যন্ত সচেতনভাবে টেলিভিশন ক্যামেরা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন আমৃত্যু। ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন, "কাগজের সাংবাদিকের লোকচক্ষুর আড়ালে থাকাই উচিত, না হলে তার সম্পর্কে পাঠকের ধারণা ধাক্কা খেতে পারে।" তার লেখা এবং ভাবনা সাংবাদিকতার এক ফেলে আসা ঘরানাকে মনে করিয়ে দেয়। আর সেই কারণেই বাংলা সাংবাদিকতার জগতে তিনি এক মাইলফলক।
রচনা ও সম্পাদনা
গ্রন্থ
- পালাবদলের পালা
- ইন্দিরা একাদশী
- অন্ধকারের অন্তরালে
- সিদ্ধার্থ শঙ্কর: সিদ্ধি ও নির্বাণ
- সব চরিত্র কাল্পনিক
- রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ
- বিপাক-ই-স্তান
- নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য
- দিল্লির পালাবদল
- বরুণ সেনগুপ্ত রচনাসমগ্র
সম্পাদনা
- বর্তমান
- সাপ্তাহিক বর্তমান
- সুখী গৃহকোণ
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
- আজকাল পত্রিকা,২০শে জুন ২০০৮
- আনন্দবাজার পত্রিকা,২০শে জুন ২০০৮
- বর্তমান পত্রিকা,২০শে জুন ২০০৮
গ্রন্থপঞ্জি
- বরুণ সেনগুপ্ত রচনা সমগ্র, বরুণ সেনগুপ্ত, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা