প্রাচীন মিশরে সমকামিতা

প্রাচীন মিশরে সমকামিতা মিশরতত্ত্ব-সংক্রান্ত গবেষণার একটি কৌতুহলোদ্দীপক ও বিতর্কিত বিষয়। প্রাচীন মিশরীয় সমাজ সমকামিতা সম্পর্কে ঠিক কী মনোভাব পোষণ করত, তা নিয়ে ইতিহাসবিদ ও মিশরতত্ত্ববিদগণ একমত হতে পারেননি। মিশরে প্রাচীন কালে ঘটে যাওয়া অল্প কয়েকটি ঘটনার মধ্যেই সমকামিতার প্রত্যক্ষ আভাস পাওয়া যায়। এছাড়াও কয়েকটি ঘটনার ক্ষেত্রে সমকামিতার অনেক সম্ভাব্য আভাস পাওয়া যায়। তবে এ সবই অস্পষ্ট আভাস। এগুলির ভিত্তিতে গবেষকেরা সমকামিতা প্রসঙ্গে প্রাচীন মিশরীয়দের মনোভাব সম্পর্কে কিছু অনুমান করতে পেরেছেন মাত্র।

সম্ভাব্য সমকামিতার বিবরণ

চুম্বনরত অবস্থায় নিয়াঙ্খখ্‌নুম ও খ্‌নুম-হোটেপ

নিয়াঙ্খখ্‌নুম ও খ্‌নুমহোটেপ

প্রাচীন মিশরীয় সমাজে যে ঘটনাগুলিকে সমকামিতার সম্ভাব্য আভাস হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তার মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ঘটনাটি হল খ্‌নুমহোটেপ ও নিয়াঙ্খখ্‌নুম নামে দুই উচ্চপদস্থ আধিকারিকের প্রেমকাহিনী। এঁরা পঞ্চম রাজবংশের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৪৯৪২৩৪৫ অব্দ) ফ্যারাও নিউসের্‌রের সমসাময়িক ছিলেন এবং তারই সেবায় নিযুক্ত ছিলেন।[1] নিয়াঙ্খখ্‌নুম ও খ্‌নুমহোটেপ দুজনেই ছিলেন বিবাহিত এবং তাদের সন্তানসন্ততিও ছিল। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর তাদের পরিবারবর্গ দু’জনকে একত্রে সমাধিস্থ করতে মনস্থ করেন। দুজনকেই একই মাস্তাবা সমাধিস্থলে সমাহিত করা হয়। এই মাস্তাবায় দুজনের একাধিক চিত্র রয়েছে। এই চিত্রগুলিতে দেখা যায়, তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে আলিঙ্গনবদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন এবং নাকে-নাক ঠেকিয়ে পরস্পরের মুখমণ্ডল স্পর্শ করে রয়েছেন। এই চিত্রগুলি দেখে গবেষকেরা নানাপ্রকার অনুমান করে থাকেন। কারণ প্রাচীন মিশরে নাকে-নাক স্পর্শ করাটি আনুষ্ঠানিকভাবে চুম্বন বলে বিবেচিত হত।[1]

মিশরতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদগণ নিয়াঙ্খখ্‌নুম ও খ্‌নুমহোটেপের এই চিত্রগুলির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করতে পারেননি। কোনও কোনও গবেষক বিশ্বাস করেন যে, এই চিত্রগুলি দুই বিবাহিত পুরুষের সমকামী প্রবৃত্তির উদাহরণ এবং এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে প্রাচীন মিশরীয়রা সমলিঙ্গ সম্পর্কগুলিকে অনুমোদন করতেন।[2] অন্যান্য গবেষকেরা এই মত স্বীকার করেন না। তাঁদের ব্যাখ্যা অনুসারে, এই দৃশ্যগুলি থেকে প্রমাণিত হয় যে, নিয়াঙ্খখ্‌নুম ও খ্‌নুমহোটেপ ছিলেন যমজ। হয়ত তাঁরা মিলিত যমজ ছিলেন। এই দুই ব্যাখ্যার মধ্যে কোন ব্যাখ্যাটি সঠিক, তা বিচারের অপেক্ষা না রেখেও বলা চলে যে, এই চিত্রগুলি থেকে বোঝা যায় নিয়াঙ্খখ্‌নুম ও খ্‌নুমহোটেপ জীবদ্দশায় তথা মৃত্যুকালেও পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন।[1]

রাজা দ্বিতীয় পেপি ও তাঁর সেনা আধিকারিক সাসেনেত

মধ্য রাজ্যের সমসাময়িক একটি সুপরিচিত গল্পে এক অজ্ঞাতনামা নাগরিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি রাজা দ্বিতীয় পেপির (এখানে তাঁর জন্মনাম ‘নেফারকারি’ উল্লিখিত হয়েছে) দরবারে উপস্থিত হন। এই নাগরিক রাজার সম্মুখে এক অনামা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বিলাপ করতে চান। কিন্তু সেই বিলাপ শোনার ইচ্ছা রাজার ছিল না। তিনি তার সভা-বাদ্যকারদের নির্দেশ দেন, তারা যেন বাদ্যের ঝংকার দ্বারা সেই আগন্তুকের বাক্য চাপা দিয়ে দেন। আগন্তুক হতাশ হয়ে প্রাসাদ পরিত্যাগ করেন। কয়েকবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে পরে তিনি তার বন্ধু তথা উচ্চপদস্থ আধিকারিক ‘ৎজেতি’কে আদেশ করেন রাজাকে অনুসরণ করার জন্য। রাজা প্রায়শই রাতে প্রাসাদ ত্যাগ করতেন। ৎজেতি জানতে পারলেন যে, রাজা দ্বিতীয় পেপি কয়েক ঘণ্টার জন্য তাঁর অনুগত সেনা আধিকারিক ‘সাসেনেতে’র কাছে গিয়ে সময় কাটান এবং তারপর প্রাসাদে ফিরে আসেন।[3]

যে অধ্যায়ে রাজা দ্বিতীয় পেপির সঙ্গে তাঁর অনুগত সামরিক আধিকারিকের সাক্ষাতের বিবরণ রয়েছে, তা একটি বিতর্কের বিষয়। বিশেষ করে একটি নির্দিষ্ট বাক্যবন্ধ এই বিষয়ে অনুসন্ধানের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু: এই কাহিনীতে বলা হয়েছে যে, “মহারাজ সাসেনেতের বাড়ীতে যান এবং যা মহারাজ কামনা করেন, তা-ই তাঁর সঙ্গে করেন”। “যা কামনা করা হয়, তা করা” বাক্যবন্ধটি যৌনতার বিবরণ-সংক্রান্ত একটি সাধারণ সুভাষিত বাক্যবন্ধ।[4] এই জন্য কোনও কোনও গবেষক নিশ্চিতভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, প্যাপিরাসটি রাজা পেপির সমকামী প্রবৃত্তি এবং তার সামরিক আধিকারিকের সঙ্গে সমলিঙ্গ সম্পর্কের কথা নির্দেশ করছে।[1] কিন্তু অন্যান্য গবেষকদের মতে, এই পরিচ্ছেদটি ধর্মগ্রন্থের বিদ্রুপাত্মক রূপক মাত্র। ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে যে, সূর্যদেবতা রা মধ্যরাতের চার ঘণ্টার জন্য পাতালদেবতা ওসিরিসের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এখানে রাজা দ্বিতীয় পেপি রা-র ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং সাসেনেত গ্রহণ করেন ওসিরিসের ভূমিকা। “যা কামনা করা হয়, তা করা” বাক্যবন্ধটি তাই অতিরঞ্জিত ও ভ্রান্তব্যাখ্যার দোষে দুষ্ট।[3]

রামেসিড যুগের একটি অস্ট্র্যাকন। এই দৃশ্যে যৌনক্রিয়ার রত এক সমকামী যুগলকে দেখা যাচ্ছে।

হোরাস ও সেথ

প্যাপিরাস ইল্লাহুনে সমকামী যৌনসঙ্গম-সংক্রান্ত আরও একটি বিখ্যাত গল্প পাওয়া যায়। এই গল্পটিও মধ্য রাজ্যের সমসাময়িক। এই গল্পে ওসিরিস পুরাণকথার প্রায় সম্পূর্ণ সংরক্ষিত গল্পটি এবং মিশরের সিংহাসনের দখল নিয়ে হোরাসসেতের কিংবদন্তি যুদ্ধটির গল্পটি পাওয়া যায়। আলোচ্য অধ্যায়টিতে দেখা যায়, সে্ত তার তরুণ ভাগিনেয় হোরাসের প্রতি প্রবল ঈর্ষান্বিত ছিলেন। কারণ, হোরাস ছিলেন তরুণ ও জনপ্রিয়। অন্যান্য দেবতারাও তাকে অনেকটা প্রশ্রয় দিতেন। অন্যদিকে সে্তের অনুগামীর সংখ্যা ছিল অল্প। তার খিটখিটে ও নির্দয় ব্যবহারের জন্য তিনি জনপ্রিয় ছিলেন না। তাই সেত যে কোনও মূল্যে হোরাসকে বিতাড়িত করতে বা হত্যা করতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু বারবার সেই কাজে বিফল হয়ে সেথ এমনভাবে হোরাসকে অপদস্থ করার পরিকল্পনা করলেন, যাতে হোরাস চিরতরে মিশর থেকে নির্বাসিত হন। সে্ত হোরাসকে একটি মিলনসভায় আমন্ত্রণ জানান এবং কিশোর হোরাসকে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে বাধ্য করেন। এরপর সেত মদ্যপ হোরাসকে রাতে এক বিছানায় শয়নের জন্য প্রলুব্ধ করেন। শয়নের পর সেত হোরাসকে ধরে তাকে ধর্ষণ করেন। কিন্তু হোরাস কৌশলে সেতকে ছলনা করেছিলেন। তার মত্ততা ছিল অভিনয় মাত্র। তিনি সেতের বীর্যরস হাতে নিয়ে লুকিয়ে ফেলেন। পরদিন সকালে হোরাস তার মা আইসিসের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলেন। আইসিস প্রথমে রাগে ও অবিশ্বাসে হতবাক হয়ে যান। তারপর তিনি স্থির করেন যে, সেতকে অনুরূপভাবে শাস্তি দেবেন: তিনি হোরাসের হাত কেটে ফেলেন এবং সেতের প্রিয় খাদ্যে (মিশরীয় লেটুস) সেথের বীর্যরস মাখিয়ে দেন। সেত কিছুই বুঝতে পারেননি। তিনি সেই বীর্যমিশ্রিত লেটুস ভক্ষণ করেন। তারপর হোরাসের কথা জানাতে তিনি যান দৈব বিচারালয়ে। প্রথমে দৈব বিচারকেরা হোরাসকে অভিশাপ দেন। কিন্তু যখন বিচারালয়ের লিপিকার ঠোথ হোরাসের শরীর থেকে সেতের বীর্যরস নিঃসৃত করার দাবি জানান, তখন সেই বীর্যরস সেতের শরীর থেকে নিঃসৃত হয়। সেত লজ্জায় ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েন এবং পালিয়ে যান। হোরাস মুক্তি পান।[1][3]

ঈর্ষান্বিত মাতুল কর্তৃক হোরাসের বিখ্যাত ধর্ষণ-কাহিনীটি বিতর্কের বিষয়বস্তু। বেশিরভাগ গবেষকই একমত যে, প্যাপিরাসে ধর্ষণের বর্ণনা স্পষ্টভাবে দেওয়া রয়েছে। এটি যদি সমকামিতা-প্রসূত কাজ হয়, তবে এটিকে সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখতে হবে। তবে সেতের উদ্দেশ্যের প্রেক্ষাপটটি বিতর্কিত: তিনি হোরাসকে ভালোবাসতেন না। অপরপক্ষে তিনি তার ভাগিনেয়কে ঘৃণা করতেন। স্পষ্টতই এই ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটানো হয়েছিল হোরাসকে অপদস্থ করার জন্য। এখানে ধর্ষণ ও সমকামিতার একমাত্র সাধারণ ক্ষেত্রটি হল, এটি সমকামী যৌনতার বিষয়।[3] কোনও কোনও গবেষক এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেন না। তারা সেতের যৌন প্রবৃত্তির প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, সেত একবার তার নিজের ভগিনী আইসিসকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। অন্য একটি গল্পে দেখা যায়, সেত স্পষ্ট ভাষায় হোরাসের প্রতি প্রেম নিবেদন করছেন।[1]

প্রাচীন মিশরীয় দৃষ্টিভঙ্গি

প্রাচীন মিশরীয়রা সমকামিতা সম্পর্কে ঠিক কী মনোভাব পোষণ করতেন, তা অস্পষ্টই রয়ে গিয়েছে। সে সকল সাহিত্যে বা নথিপত্রে যৌনপ্রবৃত্তি-কেন্দ্রিক গল্পগুলি রয়েছে, সেগুলিতে কোথাও যৌনক্রিয়ার প্রকৃতিটির নাম করা হয়নি। বরং ব্যবহার করা হয়েছে কৃত্রিম ও সুভাষিত শব্দবন্ধ। সেথ ও তার যৌন আচরণের গল্পগুলি হয়ত নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। কিন্তু নিয়াঙ্খখ্‌নুম ও খ্‌নুমহোটেপের সমাধিলিপি থেকে অনুমিত হয় যে সমকামিতা একইভাবে অনুমোদন-যোগ্য ছিল। প্রাচীন মিশরীয় নথিপত্রে কখনই স্পষ্টভাবে বলা হয়নি যে, সমকামী সম্পর্ক অনৈতিক বা লজ্জাজনক। প্রাচীন মিশরীয় নথিপত্রে এও বলা হয়নি যে, সমকামী সম্পর্ক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই এই ব্যাপারে সরাসরি কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন।[1][3]

তালমুদীয় সাহিত্য

তালমুদীয় সাহিত্যে প্রাচীন মিশরীয়দের উদ্দাম যৌনজীবনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সাহিত্যে প্রায়শই যৌন অপরাধের প্রধান উদাহরণ হিসেবে প্রাচীন মিশরীয়দের কথা উল্লেখ করা হয়। রাশির বর্ণনা অনুসারে, মিশরীয় নারীদের মধ্যে একাধিক স্বামী গ্রহণের প্রথা ছিল। মাইমোনিডেস নারী-সমকামিতাকে “মিশরের ক্রিয়া” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বহুপুরুষগামিতা ও নারী-সমকামিতা প্রাচীন মিশরের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হত এবং পুরুষ-পুরুষ সমকামী সম্পর্ক সাধারণত বিবেচিত হত সদোম, গোমোরাহআমালেকের বৈশিষ্ট্য হিসেবে।[5]

আরও দেখুন

  • এলজিবিটি ইতিহাসের সময়রেখা (স্ত্রী-সমকামিতা, পুরুষ-সমকামিতা, উভকামিতা, রূপান্তরকামিতা বিষয়ক ইতিহাস)

তথ্যসূত্র

  1. Richard Parkinson: Homosexual Desire and Middle Kingdom Literature. In: The Journal of Egyptian Archaeology (JEA), vol. 81, 1995, pp. 57–76.
  2. Dena Connors-Millard: Niankhkhnum and Khnumhotep - Evidence of Gay Relationships Exists as Early as 2400 B.C.? (English).
  3. Emma Brunner-Traut: Altägyptische Märchen. Mythen und andere volkstümliche Erzählungen. 10th Edition. Diederichs, Munich 1991, আইএসবিএন ৩-৪২৪-০১০১১-১, pp. 178–179.
  4. Günter Burkard, Heinz J. Thissen: Einführung in die altägyptische Literaturgeschichte vol. 1 (= Einführungen und Quellentexte zur Ägyptologie,vol. 1). LIT, Berlin 2003, আইএসবিএন ৩-৮২৫৮-৬১৩২-৫, pp. 187–191.
  5. Rebecca T. Alpert: Like Bread on the Seder Plate: Jewish Lesbians and the Transformation of Tradition. Columbia University Press, New York 1997, আইএসবিএন ০২৩১০৯৬৬১৫, page 17 - 36.

আরও পড়ুন

  • Graves-Brown, Carolyn, সম্পাদক (২০০৮)। Sex and Gender in Ancient Egypt: "Don Your Wig for a Joyful Hour"। The Classical Press of Wales। আইএসবিএন 9781905125241।
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.