প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
প্রভাবতী দেবী সরস্বতী (৫ মার্চ, ১৯০৫ - ১৪ মে, ১৯৭২) ছিলেন একজন বাঙালি সাহিত্যিক, গীতিকার ও শিক্ষাব্রতী। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। তিনি নারী গোয়েন্দা চরিত্র কৃষ্ণা-র নির্মাতা।[1]
প্রারম্ভিক জীবন
প্রভাবতী দেবী বাংলার অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার গোবরডাঙার নিকট খাঁটুরা গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল গোপাল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। মাতা সুশীলাবালা দেবী। পিতা ছিলেন আইনজীবী। প্রভাবতী প্রথাগত শিক্ষা না পেলেও পিতার উৎসাহে দেশী বিদেশি কাব্য পড়তেন। কীটস, শেলী বায়রন প্রভৃতি কবির কাব্য পড়ে ফেলেন অল্প বয়েসে। মাত্র ৯ বছর বয়েসে তার বিবাহ হয় বিভূতিভূষণ চৌধুরীর সাথে। ব্রাহ্ম গার্লস ট্রেনিং কলেজ থেকে টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেট লাভ করে প্রথমে উত্তর কলকাতার সাবিত্রী বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ নেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুরোধে কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছিলেন।[2] তার বোন বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী হাসিরাশি দেবী।
সমাজকর্ম
প্রভাবতী দেবী একজন শিক্ষাব্রতী ছিলেন। নিজের বাল্যবিবাহের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি কিন্তু স্ত্রী শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন তিনি। খাঁটুরার বঙ্গ বালিকা বিদ্যালয়কে নিজের প্রতিভা ও কর্মদক্ষতায় তাকে খাঁটুরা বালিকা বিদ্যালয় নামে পুনরুজ্জীবিত করে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্বভার নেন। সমাজসেবা, দেশপ্রেম ও নারী প্রগতিতে উৎসাহী ছিলেন। ঐ অঞ্চলে সরোজ নলিনী নারী মঙ্গল সমিতির শাখা কেন্দ্রের সভানেত্রী ছিলেন।
সাহিত্য
১১ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা ‘গুরুবন্দনা’ প্রকাশ পায় তত্ত্বমঞ্জরী পত্রিকায়। প্রথম গল্প ‘টমি’ প্রকাশ পায় অর্চনা পত্রিকায় ১৯২২ সালে।[3] জলধর সেন সম্পাদিত 'ভারতবর্ষ' মাসিক পত্রিকায় ১৩৩০ বঙ্গাব্দে তার প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস 'বিজিতা' প্রকাশিত হয়। এটি বাংলা, হিন্দি ও মালায়লম ভাষায় যথাক্রমে ভাঙাগড়া, ভাবী ও কূলদেবম নামে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। তার উপন্যাস পথের শেষে 'বাংলার মেয়ে' নামে নাট্য রূপায়িত ও সাফল্যের সাথে অভিনীত হয়েছে। বাঁশরী, সারথি, উপাসনা, উদ্বোধন, সম্মিলনী, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় লেখালিখি করতেন। ব্রতচারিণী, মহীয়সী নারী, ধুলার ধরনী, রাঙা বৌ, ব্যাথিতা ধরিত্রী, বিধবার কথা ইত্যাদি তার রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। সাবিত্রী বিদ্যালয়ে কাজ করার সময়ে তার সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আলাপ হয়। কবি তাকে সাহিত্য রচনায় উৎসাহ প্রদান করেন। তার লেখায় সামাজিক মূল্যবোধ, সনাতন আদর্শের কথা ফুটে উঠতো। শিশুদের জন্যে রচিত ইন্টারন্যাশনাল সার্কাস, কৃষ্ণা সিরিজ ছিল জনপ্রিয়। বাংলা গোয়েন্দা কাহিনী সাহিত্যে তিনিই প্রথম মেয়ে গোয়েন্দা কৃষ্ণা'র সৃষ্টি করেন। তিনি কিছু গানও রচনা করেছেন।[2] তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে জামসেদপুরে নিখিল ভারত বঙ্গ-সাহিত্য সম্মেলনের পরিচালিকা ছিলেন।[4]'... প্রভাবতী দেবী সরস্বতী পুরনো যুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য লেখিকা ছিলেন। তবে আজ সেই ভাবে তেমন কোনও গল্পের নাম মনে পড়ে না যেটি মনে দাগ কেটেছিল। এখন আমার বয়স ৮৯। এই বয়সে মনে রাখাও খুব কঠিন কাজ। এক সময় হিন্দি ‘ভাবী’ সিনেমা দেখেছিলাম। কী আশ্চর্য ঘটনা! আজ জানলাম সেটি তাঁরই উপন্যাস ‘বিজিতা’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল। এ রকম কত গুণীজন যে ছড়িয়ে আছেন, আড়ালে রয়ে গেলেন... '
উপন্যাস
ব্রতচারিণী, মহিয়সী নারী, ব্যথিতা ধরিত্রী, ধূলার ধরণী, রাঙা বৌ, জাগৃহি, বিধবার কথা, তরুণের অভিযান, প্রতিষ্ঠা, ঘূর্ণিহাওয়া, সোনার সংসার, সন্ধ্যা, স্নেহের মূল্য, সংসার, পথের সাথী, বোধন, দানের মর্যাদা, দূরের আকাশ, বির্সজন, মাটির দেবতা, আয়ুষ্মতী, সহধর্মিনী, পান্থপাদপ, আসামের জঙ্গল, আটলান্টিকের তীরে, মুখর অতীত ইত্যাদি।
গল্পগ্রন্থ
শুভা, সাগর পারের চিঠি, হারানো স্মৃতি, পাঁকের ফুল, লক্ষ্মী প্রতিষ্ঠা, শেষের দিকে, আশ্রয়, সমাজদ্রোহী, অপরাধিনী ইত্যাদি।
ছোটোদের গল্প ও অন্যান্য
কৃষ্ণা রোমাঞ্চ সিরিজ’ অন্তর্গত কারাগারে কৃষ্ণা, কৃষ্ণার অভিজ্ঞান, কৃষ্ণার পরিচয়, মায়াবী ও কৃষ্ণা, কষ্ণার জয়যাত্রা
ইন্টারন্যাশনাল সার্কাস
রহস্যময়ী শিখা, শিখার স্বপ্ন, শিখা ও রাজকন্যা ইত্যাদি[3]
পুরস্কার
নবদ্বীপ বিদ্বজ্জন সভা তার সাহিত্যসাধনার জন্যে তাকে সরস্বতী উপাধি প্রদান করেন। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে লীলা পুরস্কারে সম্মানিত হন।[2]
মৃত্যু
১৪ মে, ১৯৭২ সালে গলব্লাডারের অসুখে তার জীবনাবসান হয় নিজ বাসগৃহ কলকাতায়।[3]
তথ্যসূত্র
- "বিস্মৃত এক সরস্বতী"। www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-২৭।
- প্রথম খন্ড, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু (২০০২)। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ৩০৫, ৩০৬।
- "সরস্বতীর আবাহনে"। আনন্দবাজার পত্রিকা। ২১ মার্চ ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০১৭।
- "সরস্বতী, প্রভাবতী দেবী"। বাংলাপিডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০১৭।