পেঁপা
পেঁপা ভারতের অসম রাজ্যে প্রচলিত এক ধরনের সুরাশ্রয়ী বাদ্যযন্ত্র। চোঙ্গা আকৃতির এই বাদ্যযন্ত্রের অনুনাদী মুখ্য অংশটি মোষের শিং দিয়ে তৈরী করা হয়। মুখ্যতঃ বিহুর বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ঢোল, গগনা ইত্যাদির সাথে এই বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়ে থাকে। এটা বাজানোর জন্য ব্যাগপাইপের মতো চোঙ্গায় ফুঁ দিতে হয় এবং ফুটোয় আঙ্গুলি চালাতে হয়।[1]
পেঁপার প্রকাভেদ
গুটীয়া পেঁপা বা গুয়াল পেঁপা এবং যুরীয়া পেঁপা এই দু ধরনের পেঁপা বাদ্যযন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়। মহিষের একটি শিং ব্যবহার করে বানানো পেঁপাকে গুটিয়া পেঁপা বলা হয়। মহিষ পালকেরা এই ধরনের পেঁপা আবিষ্কার করেছিলেন এবং এই ধরনের পেঁপা তাদের প্রিয় বলে এই পেঁপাকে গুয়াল পেঁপা বলা হয়ে থাকে। অসমীয়া ভাষায় গোয়ালাদের "গুয়াল" বলে।[2] অপরদিকে যুরীয়া পেঁপায় দুটি সমান আকারের পেঁপা সমান্তরালে বেঁধে একসাথে বাজানো হয়ে থাকে। এই ধরনের পেঁপায় শিং, নলিচা ও থুরি দুটি করে থাকলেও চুপহি একটাই থাকে।[2] দুটি ভিন্ন ভিন্ন কম্পাঙ্কের শব্দে এই বাদ্যের সুর সুরেলা হয়। শিং দুটির একটিকে খংশিঙা ও আরেকটিকে বংশিঙা বলা হয়ে থাকে।[1]
পেঁপার অংশ
পেঁপা সাধারণতঃ চুপহি, থুরি বা থুরুহী, নলিচা বা গবলনা এবং থুলা বা শিং - এই চারটি অংশে বিভক্ত। পেঁপার যে অংশ মুখ দিয়ে বাজানো হয়, তার প্রথম অংশ হল চুপহি। পেপাঁর নলীচার সাথে চুপহি লাগানো থাকে। পেঁপার যে অংশ মুখ দিয়ে বাজানো হয়, সেই অংশক বেহু বলা হয়। এটি একটি সরু নালী বিশেষ। এই অংশটিকে চুপহীর শেষ প্রান্তে লাগিয়ে রাখা হয়ে থাকে। পরম্পরাগত ভাবে চুপহি নির্মাণের জন্য উপযুক্ত হল নলগাছ। কিন্তু আজকাল বাঁশের তৈরী চুপহিও দেখা যায়। থুরি বা থুরুহী নলীচার সাথে লাগানো একটি নলাকার অংশবিশেষ যা থেকে পেঁপার মূল শব্দ উৎপাদিত হয়। থুরি নির্মাণের জন্য সাধারণতঃ তৃণ জাতীয় উদ্ভিদের ডাল ব্যবহৃত হয়। নলিচা বা গবলনা একটি সরু সোজা নলবিশেষ। এর একমুখে চুপহি ও থুরি এবং অন্যমুখে শিং লাগানো থাকে। নলিচার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪.৫ ইঞ্চি হয় এবং ব্যাস প্রায় আধা ইঞ্চি হয়ে থাকে। এই অংশে আধা ইঞ্চি ব্যবধানে ৪-৫ টি ছোট ছিদ্র করা হয়, যাকে বুলনি বলা হয়ে থাকে। পেঁপার ভেতরে বায়ুস্তম্ভের দৈর্ঘ্য কমবেশি করে বিভিন্ন ধরনের সুর তৈরী করার জন্য এই নলের গায়ে অবস্থিত চারটি বা পাঁচটি ফুটোর ওপর আঙ্গুল চেপে বিভিন্ন ফুটো খুলে বা বন্ধ করা হয়। শিং বা থুলা অংশটি মহিষের শিং থেকে বানানো হয়। চুপহি থেকে সৃষ্টি ধ্বনি নলিচার মধ্যে দিয়ে এসে এর ফাঁপা অংশে ধাক্কা খাওয়ায় বৃহৎ আকারের ধ্বনির সৃষ্টি করে । মৃত মহিষের শিং কেটে নানান ধরনের কারিগরী বিদ্যায় ইহাকে প্রস্তুত করা হয়। সৌন্দর্যের জন্য এখানে বৃত্তকার পিতলের ব্যবহার করা হয়।[1][2]
পেঁপা প্রস্তুত প্রণালী
মৃত মহিষের শিং কেটে গোবরে বা কলাগাছের ভিতরে রেখে প্রায় ছয়মাসের জন্য পচতে দেওয়া হয়। তারপর শিংয়ের ভেতরে ও বহির্ভাগে তীক্ষ্ণ ছুড়ি বা ব্লেড দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। এই কার্যটিতে সুক্ষ্মতা, দক্ষতা ও ধৈর্য্যের প্রয়োজন কারণ সামান্য ভুল পেঁপার সুর নষ্ট করতে পারে। যেহেতু মহিষের শিং সম্পূর্ণ গোলাকার নয় অতএব শিংটিকে গরম জলে ডুবিয়ে রেখে কোমল করা হয় এবং গোলাকার বাঁশ এর শূন্যস্থানে ভরিয়ে রাখা হয়। কয়েকদিন পর শিং গোলাকার রুপ ধারণ করার পর এর চিকন প্রান্ত নলিচার মাপ অনুযায়ী কাটা হয় অবশেষে নলিচা, চুপহি ও বেহু সংযুক্ত করে পেঁপার পূর্ণরূপ দেওয়া হয়। নলিচা বা গবলনা বাঁশের দ্বারা প্রস্তুত করা হয়। নলিচার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪.৫ ইঞ্চি হয় এবং এখানে আধা ইঞ্চি ব্যবধানে ৪-৫ টি ছোট ছিদ্র করা হয়। বাঁশের অংশকে পাতলা করে কেটে চুপহি প্রস্তুত করা হয়। চুপহির দৈর্ঘ্য প্রায় এক-দেড় ইঞ্চি হয়। থুরি বা থুরুহী বাঁশের নল দ্বারা প্রস্তুত করা হয়। থুরির দৈর্ঘ্য ২ ইঞ্চি হয় এবং এর একপ্রান্তে গিট বা গিরা থাকে যা বায়ুরোধী হিসাবে কাজ করে। নলটির মাঝখানে ছুরি দিয়ে ছিদ্র করা হয়। ছিদ্রটি ফাঁকা অবস্থায় রাখার জন্য সুতার ব্যবহার করা হয় যাহা বাহির থেকে দৃশ্যমান হয়। সরিষার তেল লাগিয়ে থুরিকে নলিচার সাথে সংযুক্ত করা হয়।[1][2]
বাজানোর রীতি
পেঁপা বাজানো অত্যন্ত কঠিন কাজ। পেঁপা বাজাতে গেলে অনেক জোরে ফুঁ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কেবল সুদক্ষ বাদকেরা পেঁপা বাজিয়ে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। বুলনির ফু্টোতে আঙুল বোলালে মুখ্যতঃ "টিহিটি টিলৌ" (কথিত ভাষাতে) ছন্দতে শব্দ হয়। একে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বিন্যাস করে ও ফুঁ দেওয়ার শক্তি বাড়িয়ে-কমিয়ে বিভিন্ন সুর বের করা যায়। সাধারনতঃ চুপহির গঠনের উপর পেঁপার সুর নির্ভর করে। পেঁপা বাদকেরা এক জটিল নিশ্বাস প্রক্রিয়ায় বাদনের কাজ সম্পূর্ণ করেন, বাদকেরা নাক দ্বারা নিশ্বাস নিয়ে কিছুটা অংশ ফুসফুসে পাঠান এবং বাকিটা অংশ সরাসরি মুখের সাহায্যে পেঁপায় প্রবেশ করান, এইভাবে বাদকেরা দীর্ঘসময় ধরে বিরামহীন অবস্থায় বাজিয়ে থাকতে পারেন। বিহু উৎসবে সাধারণতঃ পেঁপার সাথে ঢোল বা গগনা নামক বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করা হয়।[2]
তথ্যসূত্র
- দত্ত, আনন্দ চন্দ্র (১৯৯৬)। "ম'হর শিঙর পেঁপা"। প্রান্তিক। ১৫শ বছর (৯ম সংখ্যা): ২৪। অজানা প্যারামিটার
|month=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য) - "পেঁপার প্রকার"। ২০১১। এপ্রিল ৫, ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ October 09, 2012। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য)
আরো পড়ুন
- অসমর বাদ্যযন্ত্র – শ্রীধর্মেশ্বর দুবরা- বাণী মন্দির (অসমীয়া)
- বিহুরে বিরিণা পাত – শ্রী জয়কান্ত গন্ধীয়া এবং ড: নোমল গগৈ – পৃথিবীরাজ মেডিয়া (অসমীয়া)