পারস্য

পারস্য ইরানের প্রাচীন নাম। ১৯৩৫ সাল পর্যন্তও বহির্বিশ্বে ইরান "পারস্য" নামে পরিচিত ছিল, যদিও ইরানিরা বহুযুগ ধরে নিজেদের দেশকে ইরান নামেই ডেকে এসেছে।

পারস্য সাম্রাজ্য, খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০

প্রথম পারসিক সাম্রাজ্য

আর্য জাতির বিভিন্ন গোত্র খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে ইরানীয় মালভূমিতে বসতি স্থাপন করে। এদের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মেদেস ও পারসিক গোত্রদ্বয়। মেদেস গোত্রীয় লোকেরা মালভূমির উত্তর-পশ্চিম অংশে বাস করা শুরু করে। পারসিক জাতির লোকেরা ঊর্মিয়া হ্রদের পশ্চিমের পার্সুয়া নামের অঞ্চল থেকে এসেছিল; এরা ইরানীয় মালভূমির দক্ষিণ অংশে বাস করা শুরু করে এবং অঞ্চলটির নাম দেয় পার্সুমাশ। পারসিকদের প্রথম বড় নেতার নাম ছিল হাখ'মানেশ, এক যুদ্ধবাজ সেনাপতি। হাখ'মানেশ ৬৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ জীবিত ছিলেন। মেদেস জাতির লোকেরা পারসিকদের উপর আধিপত্য বিস্তার করত। ৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহান কুরুশ [Cyrus the Great] পারসিকদের রাজা হন এবং এর পর পারসিকদের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়। কুরোশ মেদেসীয় বা মেদীয়দের পরাজিত করেন, ৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ লিদিয়া রাজ্য এবং ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলন জয় করেন। কুরোশের অধীনে পারস্য এশিয়ার অন্যতম মহাশক্তিতে পরিণত হয়। কুরুশের পুত্র ২য় কামবুজিয়েহ ৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশর বিজয় করে পারস্য সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান। ৫২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট ১ম দরিয়ুশ ক্ষমতায় আসার পর সিন্ধু নদ পর্যন্ত পারস্যের পূর্ব সীমানা প্রসারিত করেন। তিনি নীল নদ থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত খাল খনন করান এবং সমস্ত পারস্য সাম্রাজ্যকে ঢেলে সাজান। তার নাম হয় মহান দরিয়ুশ। ৪৯৯ থেকে ৪৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এশিয়া মাইনরে পারসিকদের অধীনে বসবাসরত আয়োনীয় গ্রিকরা বিদ্রোহ করলে তিনি তাদের শক্তহাতে দমন করেন। এরপর বিদ্রোহীদের সহায়তা দানের শাস্তি হিসেবে তিনি ইউরোপীয় গ্রিকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। কিন্তু ৪৯০ খ্রিষ্টাব্দে ঐতিহাসিক ম্যারাথনের যুদ্ধে দরিয়ুশের সৈন্যরা গ্রিকদের কাছে পরাজিত হয়। দরিয়ুশ মারা যাবার আগে গ্রিকদের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন। তার পুত্র ১ম খাশয়র্শ' পিতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন কিন্তু তিনিও ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সালামিসের নৌযুদ্ধে এবং পরের বছরগুলিতে আরও দুইটি স্থলযুদ্ধে গ্রিকদের কাছে পরাজিত হন।

খাশয়র্শ'-এর অভিযানগুলি ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তারের শেষ উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা। খাশয়র্শ'-এর দ্বিতীয় পুত্র সম্রাট ১ম আর্দাশির-এর আমলে মিশরীয়রা গ্রিকদের সহায়তায় পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ৪৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাদের দমন করা হলেও এটি ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রথম বৃহৎ আক্রমণ এবং এভাবেই এর পতন শুরু হয়।

মহাবীর আলেকজান্ডার ও সেলুকাসীয় রাজবংশ

খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে পারস্যে অনেকগুলি বিপ্লব ঘটে। শেষ পর্যন্ত ম্যাসেডোনিয়ার রাজা আলেকজান্ডার ৩৩৪ থেকে ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করেন এবং সম্রাট ৩য় দরিয়ুশের সৈন্যদের পরাজিত করে পারস্য বিজয় করেন। পারস্য আলেকজান্ডারের বিশাল সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। আলেকজান্ডার তার সেনাবাহিনীতে বহু পারসিক সেনাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেন এবং তার নির্দেশে সমস্ত গ্রিক উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারেরা পারসিক মহিলাদের বিয়ে করেন। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হলে তার সেনানেতাদের মধ্যে পারস্যের সিংহাসন দখলের লড়াই শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ১ম সেলেউকুস বা সেলুকাস পারস্যের রাজা হন। তিনি পূর্বে সিন্ধু নদ থেকে পশ্চিমে সিরিয়াএশিয়া মাইনর পর্যন্ত বিশাল এলাকার রাজা ছিলেন। তার বংশধরেরা পারস্যে সেলুকাসীয় রাজবংশ গঠন করে। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে মধ্য এশিয়া থেকে আগত পার্থীয় জাতির লোকেরা সেলুকাসীয় রাজবংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপর আরও প্রায় চারশত বছর পারস্য পার্থীয়দের অধীন সাম্রাজ্যের একটি অংশ ছিল। পারসিকরা এসময় ছিল পার্থীয়দের অধীন একটি প্রজারাজ্যের অধিবাসী।

সসনীয় রাজবংশ

২২৪ খ্রিষ্টাব্দে পারসিক জাতির রাজা ১ম আর্দাশির পার্থীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং হর্মুজের যুদ্ধে তাদেরকে পরাজিত করেন। তিনি এক নতুন পারসিক রাজবংশের পত্তন করেন, যার নাম সসনীয় রাজবংশ। এরপর তিনি পার্শ্ববর্তী অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য দখল করেন এবং শেষে ভারত আক্রমণ করেন। সেখানে পাঞ্জাব তাকে করপ্রদানকারী এক রাজ্যে পরিণত হয়। এরপর তিনি আর্মেনিয়া জয় করেন। আর্দাশির ছিলেন অগ্নি-উপাসক জরথুষ্ট্রবাদী। তার সময় পারস্যতে জরথুষ্ট্রীয় ধর্ম সরকারি ধর্মের মর্যাদা পায়। ২৪১ খ্রিষ্টাব্দে আর্দাশিরের ছেলে ১ম শাপুর ক্ষমতায় আসেন। তিনি বাইজেন্টীয় রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দুইবার যুদ্ধে যান এবং এভাবে মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া এবং এশিয়া মাইনরের এক বড় এলাকা পারস্যের অধীনে আনেন। কিন্তু ২৬০ থেকে ২৬৩ সালের মধ্যে তিনি তার বিজিত এলাকাগুলি রোমের মিত্র, পালমিরা রাজ্যের শাসক ওদেনাথুসের কাছে হারান। এরপর সম্রাট নারসেস আবার বাইজেন্টীয় রোমানদের সাথে যুদ্ধে যান এবং ২৯৭ সালে রোমান সেনাবাহিনী তার বাহিনীকে প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। তিনি শেষ পর্যন্ত রোমানদের সাথে শান্তিচুক্তি করেন এবং পারস্যের সীমানা ইউফ্রেটিস নদী থেকে পূর্বে সরিয়ে টাইগ্রিস নদী পর্যন্ত নিয়ে আসেন। এছাড়া আরও অনেক অঞ্চল হাতছাড়া হয়। রাজা ২য় শাপুর, যিনি ৩০৯ থেকে ৩৭৯ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন, রোমানদের সাথে পরপর তিনটি যুদ্ধে অংশ নেন এবং অনেক হৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন।

পারস্যের এরপরের শাসকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ১ম ইয়াজদেগের্দ। তিনি ৩৯৯ থেকে ৪২০ সাল পর্যন্ত শান্তিতে শাসন করেন। তিনি প্রথমে পারস্যের খ্রিস্টানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছিলেন এবং নিজেও খ্রিস্টান হবার চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি পূর্বপুরুষের ধর্ম জরথুষ্ট্রবাদে ফিরে যান এবং খ্রিস্টানদের উপর অত্যাচার শুরু করেন। তার ছেলে ৫ম বাহরামও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে অত্যাচার অব্যাহত রাখেন। বাহরাম ৪২০ সালে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, কিন্তু রোমানরা ৪২২ সালে তাকে পরাজিত করে। শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে রোমানরা প্রতিশ্রুতি দেয় তাদের রাজ্যে জরথুষ্ট্রীয়দের ধর্মীয় স্বাধীনতা দেবে যদি পারস্যে খ্রিস্টানদের একই মর্যাদা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, এর দুই বছর পরে বাইজেন্টীয় রোমানদের গির্জা পশ্চিম রোমের গির্জা থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল।

৫ম শতকের শেষদিকে মধ্য এশিয়া থেকে শ্বেত হুন জাতির লোকেরা পারস্য আক্রমণ করে এবং ৪৮৩ সালে পারস্যের রাজা ২য় ফিরোজকে পরাজিত করে। এরপর কিছু বছর ধরে তারা আক্রমণ না করার প্রতিদান হিসেবে পারস্য থেকে অনেক সম্পদ নিয়ে যায়। ৪৮৩ সালে পারস্যের খ্রিস্টানরা নেস্তরবাদকে সরকারী ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে। রাজা ১ম কাভাধ মাজদাক নামের এক জরথুষ্ট্রীয় ধর্মীয় নেতার অনুশাসনের প্রতি দুর্বল ছিলেন। কিন্তু ৪৯৮ সালে তার অর্থোডক্স খ্রিস্টান ভাই জামাস্প তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। পরে শ্বেত হুনদের সহায়তায় ৫০১ সালে কাভাধ আবার ক্ষমতায় আসেন। তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে দুইটি অমীমাংসিত যুদ্ধে অংশ নেন। ৫২৩ সালে তিনি মাজদাকের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করেন এবং মাজদাকের অনুসারীদের গণহারে হত্যা করেন। কাভাধের পুত্র ছিলেন ১ম খসরোও। তিনি সম্রাট ১ম জুস্তিনিয়ানের অধীন বাইজেন্টীয় রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দুইটি যুদ্ধ করেন এবং পারস্যের সীমানা ককেশাস ও কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। ১ম খসরোও ছিলেন সবচেয়ে পরাক্রমশালী সসনীয় রাজা। তিনি সাম্রাজ্যের প্রশাসনের সংস্কারসাধন করেন এবং সরকারী ধর্ম হিসেবে জরথুষ্ট্রবাদকে পুনর্বহাল করেন। তার পৌত্র ৩য় খসরোও ৫৯০ থেকে ৬২৮ সাল পর্যন্ত পারস্য শাসন করেন। উল্লেখ্য, তার শাসনামলে আরবে মুহম্মদ ও ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। যদিও বাইজেন্টীয় সম্রাট মরিসের সহায়তায় তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, ৩য় খসরোও ৬০২ সালে বাইজেন্টীয় সাম্রাজ্যের সাথে এক দীর্ঘ যুদ্ধ শুরু করেন। ৬১৯ সাল নাগাদ তিনি এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ এবং মিশর দখল করতে সক্ষম হন। কিন্তু বাইজেন্টীয় সম্রাট হেরাক্লিউস এসে তার গতিরোধ করেন এবং ৬২২ থেকে ৬২৭ সালের মধ্যেই পারসিকেরা তাদের পুরানো সীমান্তে ফেরত যেতে বাধ্য হয়।

৩য় ইয়াজদেগের্দ ছিলেন সসনীয় রাজবংশের শেষ রাজা। তার আমলেই আরবদেশের মুসলমানেরা পারস্য আক্রমণ করে ও শেষ পর্যন্ত পারস্য বিজয় করে।

  1. এই প্রশ্নের উত্তরটি ভুল
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.