পাঠশালা
পাঠশালা বলতে বোঝায় প্রাক-আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র যেখানে আগেকার দিনে জমিদারি হিসাব, মহাজনী হিসাব, দলিল, ওজন ও পরিমাপ, এবং পত্রলিখন শেখানো হতো।[1] সাধারণত গুরু বলে পরিচিত একজন শিক্ষক কর্তৃক পাঠশালা পরিচালিত হতো, যার ব্যক্তিগত বিবেচনায় পাঠশালা পরিচালিত হত। যদিও সামাজিক উদ্যোগে পাঠশালা কমই প্রতিষ্ঠা করা হতো, তারপরেও পাঠাশালার ব্যবস্থাপনায় গুরুর দায়িত্ব ছিল প্রতিদ্বন্দ্বীহীন। বাংলায় আদি কাল থেকে গুরুভিত্তিক পাঠশালার অস্তিত্ব ছিল[2] এবং ঔপনিবেশিক সরকার কর্তৃক উনিশ শতকে নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তনের ফলে পাঠশালা শিক্ষা ব্যবস্থা বিলুপ্তি শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তা চালু ছিল।
পাঠশালার প্রকৃতি
পাঠশালা হলো খোলা স্থানে তৈরি হওয়া এক ধরনের প্রতিষ্ঠান, যেখানে পেশাগত জিনিসপত্র যেমন- আসবাবপত্র, স্থায়ী কাঠামো, কর্মচারীবৃন্দ ইত্যাদি থাকত না। আজকের দিনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের মত এ ধরনের পাঠশালাগুলোর কোনো নির্দিষ্ট নামও থাকত না। সাধারণত যে গুরু দ্বারা পাঠশালাটি পরিচালিত হত তার নামেই সমাজের সকলের কাছে পরিচিত হতো। ছাত্রদের মাটিতেই বসতে হত। তবে, কেউ কেউ বসার জন্য ছোট বাঁশের চাটাই, পাতা, গাছের ছাল, বেতের মাদুর, ইত্যাদি ইচ্ছামত নিয়ে আসত।
গুরু তার নিজস্ব চৌকিতে বসে তার সম্মান এবং ছাত্রদের ও তার পার্থক্য বজায় রাখতেন। গুরু নিজ উদ্যোগে একাই পাঠশালা পরিচালনা করতেন; তাই, তিনি নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন সে হিসেবে ছাত্র ভর্তি হতে দিতেন। গুরুরা সাধারণত হিন্দুদের কায়স্থ বর্ণ থেকে আসতেন, যারা শিক্ষাদান, দেশের বিভিন্ন কাজ ও ব্যবসার ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন। পাঠশালা সব ধরনের ছাত্ররা পড়াশোনা করতে পারত, তবে এখানে প্রধানত হিন্দু এবং মুসলিম ছাত্ররা পড়াশোনা করতে আসত।[1]
ছাত্রদের অভিভাবকদের দ্বারা প্রদত্ত চাঁদা এবং জনদরদী পাড়াপড়শীদের দান করা অর্থ দ্বারা পাঠশালার আনুসাঙ্গিক খরচ নির্বাহ করা হতো। গুরুর আয় বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন হত। উনিশ শতকের প্রথমে এ আয়ের পরিমাণ ছিল গড়ে পাঁচ হতে বারো টাকা। সেই সময় বিবেচনায় এটি অনেক সম্মানজনক আয় ছিল। কারণ এ অর্থ দ্বারা সেসময়ে গ্রামে দুই হতে তিন মণ চাল কেনা যেত। এর চেয়ে বেশি বেতন খুব কম মানুষ পেত।
পাঠক্রম
পাঠশালা পাঠ্যক্রমে পড়া, লেখা, মহাজনি পাটিগণিত, ব্যবসা-সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ, পত্রলিখন, ধর্মীয় কাহিনী, প্রাথমিক সংস্কৃত ব্যাকরণ, জমিদারি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ছাত্ররা শুধু গুরুর কাছ থেকেই শিক্ষা অর্জন করত না, মনোনীত বড় ছাত্রদের কাছ থেকেও শিক্ষা অর্জন করত। পাঠশালার শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এদেরকে বেশ ভালো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হত। এদেরকে সরদার পোদো নামে ডাকা হত। সব ছাত্র নিয়মমত পাঠশালায় উপস্থিত থাকত কিনা গুরু সেদিকে নজর রাখতেন। শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য শাস্তি দেয়ার অংশ হিসেবে অনেকদিন অনুপস্থিত থাকা শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসার জন্য সরদার পোদোদেরকে বাড়িতে পাঠানো হত। এ ছাত্রদেরকে অনুপস্থিত থাকার কারণে নিয়ম অনুসারে কঠিব শাস্তি দেয়া হত। যখন স্বাভাবিকভাবে বলা কথা ও সতর্কীকরণ উপদেশ ব্যর্থ হত, তখন গুরু পাঠশালার নিয়ম ও শৃঙ্খলা রক্ষার্থে কঠোর শাস্তি প্রদান করতেন। ছাত্ররা পাঁচ বছর বয়সে পাঠশালায় আসা শুরু করত এবং পাঠশালার যে বিষয়ে পাঠদান করা হত সে বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য সেখানে ছয় বছর হতে নয় বছর পর্যন্ত অধ্যয়ন করত। দুটি আলাদা পর্বে পাঠ দেয়া হত। প্রথমটি সকালে, দ্বিতীয়টি বিকালে। নির্ধারিত কোনো বই ছাত্রদের পড়ার জন্য ব্যবহার করা হত না। ফলে মৌখিকভাবেই শিক্ষাদান হত। গুরু কোনো পাঠ উচ্চস্বরে বলতেন এবং ছাত্ররা তা একসাথে পুনরাবৃত্তি করত। কখনো কখনো সরদার পোদোরা এ কাজ করে দিত ও গুরু বেত হাতে নিয়ে পড়াশোনা তদারকি করতেন। ছাত্ররা শুরুর দিকে বালুতে লেখা শিখত। আস্তে আস্তে কলাপাতায়, তারপর তালপাতায় এবং সর্বশেষে কাগজে লিখত ছাত্ররা। পাঠশালার লেখাপড়া সম্পন্ন করার পর কোনো শংসাপত্র দেয়া হত না। ছাত্র যে গুরুর পাঠশালা থেকে শিক্ষা গ্রহণ সমাপ্ত করত, সেটাই হত ছাত্রত্ব অর্জনের অস্থায়ী স্বীকৃতি। পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থা ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রচলিত পদ্ধতিতে চলেছে, যখন চিরায়ত পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করায় ক্রমবর্ধমান চাপের সম্মুখীন হতে থাকে।[1]
তথ্যসূত্র
- "পাঠশালা - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০১-২৮।
- "প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা এবং শূদ্র সম্প্রদায়"। প্রথম আলো। ২০১৭-০৪-০৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০১-২৮।